শঙ্করাচার্য তাঁর ‘ব্রহ্মসূত্র’ ভাষ্যর শুরুতেই “অধ্যাস” প্রসঙ্গ আনেন, কারণ মানুষের সব দুঃখ-ক্লেশের মূল হলো ভুল ধারণা (অধ্যাস)। আমরা দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কে আত্মা ভেবে ফেলি। এই ভ্রান্তি থেকেই জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, বন্ধন-মোক্ষের কল্পনা তৈরি হয়।
একের ধর্ম আরেকের ওপর চাপানোই অধ্যাস। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ ভেবে নেওয়া। কাচের স্ফটিকে লাল ফুলের প্রতিফলন দেখে মনে হওয়া, স্ফটিকই লাল। একইভাবে আত্মার ওপর দেহ-ইন্দ্রিয়-মন-অহং-এর গুণ চাপানোই হলো অধ্যাস।
“যুষ্মদ-অস্মত” যুক্তি সম্পর্কে জানা যাক। শঙ্করাচার্য বলেন—“তুমি” (yusmad) = বাইরের জগত, দেহ, ইন্দ্রিয়, অনাত্মা। “আমি” (asmat) = অন্তরের আত্মা, চৈতন্য, চিরন্তন সাক্ষী। এরা সম্পূর্ণ বিরোধী। অনাত্মা অচেতন, পরিবর্তনশীল। আত্মা চৈতন্যময়, অপরিবর্তনীয়। অথচ মানুষ এই দুইকে মিশিয়ে ফেলে—“আমি দেহ”, “আমার সন্তান”, “আমার সম্পদ”—এটাই অধ্যাস।
কেন এটিকে মিথ্যা (mithyā) বলা হয়? অধ্যাস না পুরো সত্য, না পুরো মিথ্যা। যেমন: স্বপ্ন—জেগে উঠে বোঝা যায় মিথ্যা, কিন্তু স্বপ্নে থাকাকালীন সত্যি মনে হয়। ঠিক তেমনি—আত্মার ওপর দেহ-মন চাপানো—জেগে থাকলেও সত্যি মনে হয়, কিন্তু জ্ঞান হলে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
অজ্ঞতা (অবিদ্যা) ও অধ্যাসের সম্পর্ক: অবিদ্যা = আত্মার প্রকৃত স্বরূপ না জানা। অধ্যাস = সেই অবিদ্যার প্রকাশ, যা ভুলভাবে দেহ-মনকে আত্মার সঙ্গে জুড়ে দেয়। যেমন: দড়ি চিনতে না পেরে সাপ বলে ভুল ধরা। অবিদ্যা হলো কারণ, অধ্যাস হলো তার ফল।
অধ্যাস কেন অনাদি? কারণ, মানুষ জন্ম থেকেই ভাবে—“আমি দেহ”, “আমি ভোগী”, “আমার সন্তান”। এই ভুলের কোনো শুরুর মুহূর্ত পাওয়া যায় না। তাই একে অনাদি (beginningless) বলা হয়। তবে এটি অসত্য (mithyā), কারণ জ্ঞান উদিত হলে এটি ভেঙে যায়।
অধ্যাসের ধরন: ধর্মাধ্যাস (Attributes-এর অধ্যাস)—যেমন “আমি স্থূল”, “আমি মোটা”, “আমি অসুস্থ”—শরীরের গুণকে আত্মার ওপর চাপানো। অর্থাধ্যাস (Substance-এর অধ্যাস)—যেমন “আমি দেহ”, “আমি মন”—সরাসরি দেহ বা মনকে আত্মা ভেবে নেওয়া।
কেন মুক্তির উপায় কেবলই জ্ঞান? কর্ম (যজ্ঞ, আচার) নতুন কিছু সৃষ্টি করে, কিন্তু মুক্তি কোনো নতুন জিনিস নয়। মুক্তি মানে—অধ্যাস সরে যাওয়া। যেমন মেঘ সরে গেলে সূর্য দেখা যায়, সূর্য নতুন করে জন্ম নেয় না। তেমনি জ্ঞান উদিত হলে আত্মা প্রকাশ পায়, মুক্তি ঘটে।
অধ্যাস ভাষ্যের মূল শিক্ষা: মানুষের বন্ধন = ভুল ধারণা (অধ্যাস)। এর মূল = অবিদ্যা (অজ্ঞতা)। এর প্রকাশ = “আমি দেহ”, “আমার সম্পদ” ইত্যাদি ভাবনা। শাস্ত্রের উদ্দেশ্য = এই অধ্যাস ভাঙা। উপায় = ব্রহ্ম-আত্মার অভেদজ্ঞান। ফল = মুক্তি, যেখানে জন্ম-মৃত্যু, দুঃখ-সুখ, বন্ধন-মোক্ষ কল্পনাই থাকে না। এইভাবেই অধ্যাস ভাষ্য অদ্বৈত বেদান্তের ভিত্তি গড়ে তোলে।
বেদান্ত অধ্যয়ন শুরুর উদ্দেশ্য হলো: ভ্রান্ত ধারণা দূর করা। কারণ, সব দুঃখের মূল হলো ভুল ধারণা (অজ্ঞতা)। সেই ভুল ধারণা দূর হলে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অদ্বৈত ঐক্যের জ্ঞান পাওয়া যায়। তাই বলা হচ্ছে: “এই দুঃখকারণ দূর করার জন্য”—এখানে ফল/প্রয়োজন (prayojana) বোঝানো হয়েছে। “আত্মা ও পরমের ঐক্যের জ্ঞান লাভের জন্য”—এখানে বিষয় (viṣaya) বোঝানো হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠে—তাহলে “যুষ্মদ-অস্মত” দিয়ে শুরু হয়ে “সর্বলোক-প্রত্যক্ষঃ” দিয়ে শেষ হওয়া যে-ভাষ্য আছে, তার উদ্দেশ্য কী? এর উত্তর—ওই ভাষ্যের কাজ হলো এটা দেখানো যে—মানুষের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ও আচরণ আসলে ভুল ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া। এগুলোর ভেতরে থাকে অহংকারের চিহ্ন।
উদাহরণ—“অহং মনুষ্যঃ” → “আমি মানুষ।” এখানে আত্মাকে শরীর বা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অভিন্ন করা হচ্ছে। “অহমিদম্” → “আমি এই (শরীর ইত্যাদি)।” “মমেদম্” → “এ আমার (সন্তান, ধন-সম্পদ ইত্যাদি)।” মানুষ যখন “আমি শরীর” বা “আমি ইন্দ্রিয়” বা “এগুলো আমার” বলে ভাবে, তখন সে অহংকারের ভ্রান্তিতে পড়ে। বেদান্ত শুরু হয় ভুল ধারণা (অহংকার) ভাঙতে, আর এই সত্য দেখাতে যে, আত্মা আসলে শরীর-মন নয়, বরং ব্রহ্মের সঙ্গেই অভিন্ন।
“যুষ্মদ-অস্মত” দিয়ে শুরু হয়ে “সর্বলোক-প্রত্যক্ষঃ” দিয়ে শেষ হওয়া ভাষ্য হলো—আদি শংকরাচার্য রচিত ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের (Brahma-sutra-bhāṣya) উপক্রমণিকা (প্রস্তাবনা বা ভূমিকা অংশ)। ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য হচ্ছে বেদান্ত দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যা (শংকরাচার্যের Advaita Vedanta-র মূল গ্রন্থ)। এর শুরুতে শংকরাচার্য “অধ্যাস-ভাষ্য” (Adhyāsa Bhāṣya) নামে একটি ভূমিকা দিয়েছেন। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, অধ্যাস (superimposition)—অর্থাৎ যা আত্মা নয়, তাকে আত্মার ওপর চাপিয়ে দেখা, আর যা আত্মা, তাকে শরীর-মন-ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে দেখা—এই অংশটাই শুরু হয় “যুষ্মদ-অস্মত-প্রত্যয়…” দিয়ে এবং শেষ হয় “সর্বলোক-প্রত্যক্ষঃ” কথায়।
অধ্যাস-ভাষ্য-এ শংকরাচার্য প্রথমেই বলেছেন: মানুষের সমস্ত দুঃখ-ভোগের মূল হলো অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া অধ্যাস। আমরা ভুল করে বলি—“আমি মানুষ”, “আমি শরীর”, “এ আমার সন্তান/সম্পদ” ইত্যাদি। কিন্তু আসলে আত্মা এসবের সঙ্গে অভিন্ন নয়, আত্মা চিরমুক্ত ব্রহ্মস্বরূপ।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বাঁচি। এই ভ্রান্তির নাম অধ্যাস (superimposition)। অধ্যাস মানে হলো—আত্মা (যা চেতনা, অমর, শুদ্ধ, নির্বিকার) আর অনাত্মা (শরীর, ইন্দ্রিয়, মন, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি)-কে গুলিয়ে ফেলা। আমি বলি: “আমি মানুষ” → এখানে “আমি” (আত্মা)-কে শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে। আমি বলি: “আমি সুখী/দুঃখী” → সুখ-দুঃখ শরীর-মন-এর গুণ, আত্মার নয়। আমি বলি: “এটা আমার ছেলে / আমার টাকা” → এখানে বাইরের জিনিসকে “আমার” বলে আত্মার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এ সবই অধ্যাস।
এই অধ্যাস বা ভ্রান্তি থেকেই আসে—অহংকার (“আমি দেহ”, “আমি মন”), মমকার (“এটা আমার”)। আর এগুলো থেকেই জন্ম নেয় দুঃখ, ভয়, আসক্তি, কামনা। অতএব, দুঃখের মূল কারণ অধ্যাস। ‘ব্রহ্মসূত্র’ শুরু হওয়ার আগে শংকরাচার্য বলেন—বেদান্তশাস্ত্র পড়ার উদ্দেশ্য হলো এই ভ্রান্তি (অধ্যাস) দূর করা। কারণ একমাত্র আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ-জ্ঞান (তত্ত্বমসি, অহং ব্রহ্মাস্মি ইত্যাদি মহাবাক্য) এই ভ্রান্তি ভাঙতে পারে। আমরা সবাই আত্মাকে দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, সুখ-দুঃখ, ধন-সম্পত্তির সঙ্গে ভুল করে মিশিয়ে ফেলি। এই ভুলই হলো দুঃখের আসল কারণ। বেদান্তের কাজ হলো এই ভুল ভেঙে দেওয়া এবং আত্মা-ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান দেওয়া।
ভ্রান্তি বা অধ্যাস (superimposition) থেকেই জন্ম নেয় অহংকার (অহং) ও মমকার (আমিত্ব)। এই ভ্রান্তি দূর করার জন্যই বেদান্ত অধ্যয়ন করা হয়। আর ভ্রান্তি দূর হলে আত্মা-ব্রহ্মের অভেদ-জ্ঞান প্রকাশ পায়। তাই “দুঃখ দূরীকরণ” = ফল (prayojana), আর “আত্মা-ব্রহ্ম অভেদ জ্ঞান” = বিষয় (viṣaya)। সকল ভ্রান্ত ধারণা, যা দুঃখের কারণ, তাদের দূর করার জন্য, এবং সেইসঙ্গে আত্মার সঙ্গে পরমের ঐক্যের জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে বেদান্তের অধ্যয়ন আরম্ভ করা হয়। এখানে—”এই দুঃখ-কারণকে দূর করার জন্য” কথাটিতে ফল (প্রয়োজন– prayojana) নির্দেশ করা হয়েছে। আর “আত্মা ও পরমের ঐক্যের জ্ঞান লাভের জন্য” কথায় বিষয় (viṣaya) স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
তাহলে “যুষ্মদ-অস্মত” দিয়ে শুরু এবং “সর্বলোক-প্রত্যক্ষঃ” দিয়ে শেষ-হওয়া ভাষ্যটির উদ্দেশ্য কী? এখানে তো দেখানো হয়েছে যে, মানুষের সমস্ত কার্যকলাপ—তাদের ভাবনা ও আচরণ—আসলে ভ্রান্তি-জাত, এবং এগুলো “অহংকার”-চিহ্নিত। যেমন: “অহং মনুষ্যঃ”—আমি মানুষ, যেখানে আত্মাকে শরীর বা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অভিন্ন করে ধরা হচ্ছে। “অহমিদম্”—আমি এই (শরীর ইত্যাদি)। “মমেদম্”—এ আমার (সন্তান, ধন-সম্পদ, প্রভৃতি)।
এর জবাব হচ্ছে: ব্রহ্ম-জ্ঞানের দ্বারা জীবনের অনর্থের (অসার দুঃখ-দৈন্যের) মূল কারণের সমাধান হয়—এটি সূত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখন, অনর্থ গঠিত হয়—নিজেকে কর্তা (কর্মকারী) ও ভোক্তা (উপভোক্তা) ভাবা থেকে। আর এই ধারণার ভিত্তি হলো নিজেকে জ্ঞাতা ভাবা।
যদি এই (অনর্থ) সত্যিই বাস্তব হতো, তবে তা কখনোই জ্ঞান দ্বারা নাশ করা যেত না। কারণ জ্ঞান নাশ করে শুধু অজ্ঞতাকে (অবিদ্যাকে)। কিন্তু যদি কর্তা-ভাব ও ভোক্তা-ভাব অজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে থাকে, তাহলে শাস্ত্রকার যা বলতে চাইছেন—ব্রহ্ম-জ্ঞান অনর্থের কারণকে ধ্বংস করে—তা যথার্থ হয়।
অতএব, যেহেতু জ্ঞান কর্তৃত্ব ইত্যাদি ধ্বংস করতে পারে, তাই এটা দাঁড়াল যে—কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব আসলে অজ্ঞানের ফল, এবং সূত্রকার নিজেই তা স্পষ্ট করেছেন, যখন তিনি বলেছেন ব্রহ্ম-জ্ঞান অনর্থ নাশ করে। ফলে, সূত্রে প্রকাশিত অর্থ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভ্রান্তি-জাত বন্ধনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। আর তাই এই প্রারম্ভিক ভাষ্য (ভূমিকা) সমগ্র শাস্ত্রের (অর্থাৎ বেদান্তের) এক ভূমিকা/উপোদ্ঘাত হিসেবে কাজ করছে।
বেদান্ত অধ্যয়ন শুরু হয় দুঃখের মূল কারণ দূর করে ব্রহ্ম-আত্মার ঐক্যের জ্ঞান পাবার উদ্দেশ্যে। দুঃখের মূল কারণ হলো অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া “আমি-ভাব”—যাতে মানুষ শরীর, ইন্দ্রিয়, ধনসম্পদকে “আমি” বা “আমার” বলে ধরে। যদি এই ভ্রান্তি সত্যিই বাস্তব হতো, তবে জ্ঞান তা মুছে দিতে পারত না। কিন্তু যেহেতু এটি অজ্ঞানের ফল, তাই ব্রহ্ম-জ্ঞান দ্বারা তা দূর করা সম্ভব। এজন্য ভাষ্যের শুরুতেই ভ্রান্তি-জাত অহংকার-ভিত্তিক বন্ধনের চরিত্র ব্যাখ্যা করা হলো—যাতে সমগ্র বেদান্ত-শাস্ত্রের আলোচনা বোঝার মাটি (ভিত্তি) তৈরি হয়।
শঙ্করাচার্যের “যুষ্মদ–অস্মত” উপক্রমণিকা (ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের শুরু) ভেঙে ভেঙে বাংলায় ব্যাখ্যা করছি।
সূত্র: “যুষ্মদ-অস্মত-প্রত্যয়গোচরৌ বিষয়বিষয়িনৌ তমঃপ্রকাশবৎ বিরুদ্ধস্বরূপৌ।”
বাংলা অর্থ: “‘যুষ্মদ’ (তুমি/তোমার) আর ‘অস্মত’ (আমি/আমার)—এই দুটি প্রত্যয়ের অর্থ (object) একেবারেই বিপরীত স্বরূপ। যেমন অন্ধকার আর আলো একসঙ্গে থাকতে পারে না, তেমনি এদের প্রকৃতিও একে অপরের বিপরীত।” “যুষ্মত” = তুমি, তোমার, অর্থাৎ বাহির। “অস্মত” = আমি, আমার, অর্থাৎ অন্তঃস্থিত আত্মা। যেমন অন্ধকার-আলো একসঙ্গে থাকে না, তেমনি এরাও কখনও মিশতে পারে না।
সূত্র: “অস্মত্প্রত্যয়গোচরঃ আত্মা সর্বলোকপ্রত্যক্ষঃ।”
বাংলা: “‘অস্মত’ প্রত্যয়ের দ্বারা ধরা যায় যে, সেই আত্মা সর্বলোকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়।” এর অর্থ: আমরা প্রত্যেকে বলি: “আমি আছি”, “আমি দেখি”, “আমি জানি”—এখানে ‘আমি’ মানেই আত্মা। এই আত্মাই সরাসরি অভিজ্ঞতায় আসে।
সূত্র: “যুষ্মত্প্রত্যয়গোচরাঃ শরীরেন্দ্রিয়প্রাণাদয়ঃ, আত্মনো ব্যাপারঃ।”
বাংলা: “‘যুষ্মত’ প্রত্যয়ের দ্বারা ধরা পড়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, প্রাণ প্রভৃতি—যা আত্মার বহিঃপ্রপঞ্চ বা বাহ্য অবয়ব।” এর অর্থ: যেমন আমি বলি: “তুমি শরীর”, “তুমি চোখ”, “তুমি হাত”—এসব বাহ্য জিনিস। এগুলো আত্মা নয়, বরং আত্মার বাইরের অবয়ব।
যুক্তি ও উদ্দেশ্য: শঙ্করাচার্য এখানে শুরুতেই বোঝাচ্ছেন—মানুষ ভুল করে “আমি শরীর”, “আমি মন”, “আমার সন্তান”, “আমার ধন” ইত্যাদি ভাবে। আসল সত্য হলো: আত্মা (অস্মত) আর শরীর-মন-বস্তু (যুষ্মত) কখনও অভিন্ন নয়। যেমন আলো ও অন্ধকার মিলতে পারে না, তেমনি আত্মা ও অনাত্মা এক হতে পারে না।
এই উপক্রমণিকার উদ্দেশ্য হলো—প্রথমেই অহংকারজাত ভ্রান্তি (আমি = শরীর, ইন্দ্রিয়, মন) খণ্ডন করা, আর দেখানো যে, আত্মা = অদ্বিতীয় চেতনা। শরীর-মন-ইন্দ্রিয় = যুষ্মত, অর্থাৎ বাইরের জগৎ, যা পরিবর্তনশীল। আত্মা = অস্মত, যা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়।
শঙ্করাচার্য শুরুতেই একটা দারুণ স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেন—আমি (অস্মত) = আত্মা, চিরন্তন সচেতন সত্তা। তুমি/এটা (যুষ্মত) = শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, সন্তান, ধন, সকল বহির্জগৎ। এ দুটো কখনও এক নয়।