বোকা বাবাটা!

২ নভেম্বর ১৯৮৪। শীর্ষেন্দুর জন্মের ঠিক ৪৯ বছর পর। শাহরুখ খানের জন্মের ঠিক ১৯ বছর পর। এই দিনে আমি জন্মেছিলাম। ঠিক আগের দিনে জন্মনেয়া ঐশ্বরিয়া কেন ‘১ দিনের ছোট’ আমাকে ফেলে ৩ বছরের ছোট অভিষেককে বিয়ে করল, সেই দুঃখ নিয়ে কথা বলতে আমি এই পোস্টটা লিখতে বসিনি। ক্লাস নাইনে যখন আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন হচ্ছিল, তখন আমাদের ক্লাসটিচার আমার বাবাকে এই সুবুদ্ধি দিয়েছিলেন যে আমার জন্মের সাল যেন দুএক বছর পিছিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কিছু সুবিধা পেতে সবাই সাধারণত তা-ই করে। বাবা কোনও কালেই ঘোরানোপ্যাঁচানো চিন্তাভাবনা করতে পারতেন না। কেন বয়স কমাতে হবে, এটা বুঝতে না পেরে বাবা স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? বয়স না কমালে কি পরীক্ষা দিতে কোন সমস্যা হবে?” স্যার হেসে বললেন, “না না দাদা, তা কেন হবে? ও তো ক্লাসের ফার্স্ট। আমরা আশা করি, ও ভবিষ্যতে ভাল কিছু করবে। যদি কখনো সরকারি চাকরিটাকরি করে, তাহলে সার্টিফিকেটে বয়সটয়স একটু কম থাকলে কিছু সুবিধা পাবে। সবাই তো কমিয়ে দিচ্ছে। এই আরকি!” বাবার উত্তরটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। “ও যদি ওর নিজের যোগ্যতায় চাকরি না পায়, তবে যেটা ওর যোগ্যতায় কুলায়, সেটাই করে খাবে। ওর জন্য আমি কেন একটা মিথ্যা তথ্য দেবো? আমি চাই না আমার ছেলের জীবনটা একটা মিথ্যা দিয়ে শুরু হোক। আমি অরিজিন্যালটাই দেবো।” স্যার একথা শুনে হেসে বলেছিলেন, “আপনার কথা শুনে ভাল লাগল। আশীর্বাদ করি, সুশান্তকে কোনদিনও কোন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে না হোক।” অনেক দিন পরে যখন বয়স কমানোর আপাত সুখগুলো বুঝতে শিখেছিলাম, তখন বোকা বাবার উপর খুব রাগ হতো। এটা কোন ব্যাপার! কত দেখি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিয়ে দিব্যি চাকরি করছে, উপজাতি সার্টিফিকেট দেখিয়ে বুয়েটে পড়ছে, যে জীবনেও কোনও দিন ফুটবলে একটাও লাথি মারেনি সেও খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়ে যায়। আরও কত কী! সামান্য একটা বয়স কমালে এমন কী ক্ষতি! বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় কখনো-কখনো মনে হতো, আমি তো মাত্র(!) ৪বার বিসিএস দিতে পারবো! বাবাটা এমন কেন?

এ ব্যাপারে বাবা বরাবরই অন্যগ্রহের মানুষ। ‘৭১য়ে বাবার বয়স ছিল ২২-২৩। বাবা সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু লুকিয়ে-লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন, শাকসবজির ঝুড়িতে লুকিয়ে অস্ত্রগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে দিয়ে আসতেন। আমাদের গ্রামে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছিল, তখন বাবাকে অনেকেই বলেছিল, একটা সার্টিফিকেট নিয়ে রাখতে, ভবিষ্যতে আমাদের দুই ভাইয়ের কাজে লাগবে। বাবা কিছুতেই রাজি হননি। তাঁর একটাই কথা, আমি তো যুদ্ধ করিনি! রেজিস্ট্রশনের কাজটা যাঁরা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমাদের অনেক নিকটাত্মীয় ছিলেন। তাই কাজটা করা বাবার জন্য সহজ ছিল। ওইসময়ে আমাদের গ্রামে অনেক নব্য মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছিল। আমার বোকা বাবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আর জন্মালেন না। (আগ্রহীরা এ নিয়ে আমার ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা নই’ নোটটা পড়ে দেখতে পারেন।)

সালটা ‘৯৪ কী ‘৯৫ মনে নেই। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ভর্তি হবো। ভাল স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়াটা বড় কঠিন। এর জন্য প্রচুর প্রিপারেশন নিতে হয়। আমি কেজি থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি সানি টিউটোরিয়্যাল স্কুলে। ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে আমার ঠাকুরদাদা মারা যান। সেই শোকে এর কয়েকদিনের মধ্যেই আমার ঠাকুরমাও মারা যান। সে সময় আমাদের পুরো পরিবারকে অনেক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল। আমার আর ভর্তি কোচিং করা হয়নি। বাবা পরিবারে সবার বড়। মা আমাদের পরিবারের বড়বৌ। মাকে অনেক কাজ সামলাতে হত বিধায় মা আমাকে নিয়ে পড়াতে বসার সময় পেতেন না। এতে অবশ্য আমি অত্যন্ত খুশিই ছিলাম। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম। সে সময় ছিল বড় সুখের সময়। কী মজা! কী শান্তি! পরে ভর্তি পরীক্ষার আগে ১ সপ্তাহের মতো বাসায় মায়ের কাছে পড়াশোনা করি এবং চট্টগ্রামের সেরা স্কুলগুলোর অন্যতম কলেজিয়েট স্কুলে ‘চান্স পেতে’ ব্যর্থ হই। পরে বাবা খবর নিয়ে জানলেন, যে মার্কস পেলে আমি চান্স পেতাম, আমি সেটির চেয়ে হাফ মার্কস কম পেয়েছি। বাবাকে কোনও এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছিলেন, ১০ হাজার টাকা ‘ডোনেশন’ দিলে আমি কলেজিয়েটে পড়তে পারব। আমার চাইতে অনেক কম মার্কস পেয়েও অনেকেই নাকি ওভাবে করে ‘ব্যাকডোর’ দিয়ে ভর্তি হচ্ছে। সেদিন লজ্জায় বাবা উনাকে কিছুই বলেননি। বাবা উপকার করেছেন, এমন অনেক বড় অবস্থানের লোক বাবাকে খুবই পছন্দ করতেন। কিন্তু বাবা কারও মাধ্যমেই কাউকে রিকোয়েস্ট করেননি। বাবাকে কোনও দিনও আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য কারও কাছে অন্যায়ভাবে অনুরোধ কিংবা মাথা নত করতে দেখিনি। একটা সময়ে বাবার উপর অনেক বেশি রাগ হত। বারবারই মনে হতো, বাবা একটা অথর্ব মানুষ। সততার ফালতু পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জীবনে নিজেও কিছু করতে পারলেন না, আমাদের জন্যও কিছু করলেন না। বাবার সমসাময়িক আইনজীবীরা কত গাড়িবাড়ি করেছেন, কত জায়গাজমি, কত ব্যাংক ব্যালেন্স। আর বাবা কী করেছেন? এখন বুঝি, জীবনে অথর্ব হওয়ার গুরুত্ব কত বেশি! ছেলেমেয়েদের সাময়িক সুখের মোহে ওদের পাপের ভাগীদার হওয়াটা নিতান্তই মূর্খের কাজ। আমাদের পঙ্গু করে দেননি বলেই আজকে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আরেক জনের কাঁধে ভর দিয়ে চলার অভ্যাস যার, সে কখনো মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে পারে না। ভর দেয়ার কাউকে না পেলে সে চলতেই পারে না।

আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করার সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটা মাস্টার্স করতাম—এমডিএস। একই সেশনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক মাস্টার্স করা যায় না। আমার সেশন ভিন্ন ছিল। এমবিএ-এর ২০১০-‘১১; এমডিএস-এর ২০১১-‘১২। তাই অফিসিয়ালি কোনও সমস্যা থাকার কথা না। কিন্তু এমডিএস কর্তৃপক্ষ এটা কিছুতেই মানছিলেন না। ওদের একটাই কথা, না, একইসাথে দুটো মাস্টার্স করা যাবে না। আমি চাইলে আইবিএ’র মাস্টার্সটা ছেড়ে শুধু এমডিএস কোর্সটা কন্টিনিউ করতে পারি। কয়েকজন স্যার বুদ্ধি দিলেন, আমি যদি অফিসিয়ালি এমবিএ করার ব্যাপারটা ‘ট্যাক্টফুলি হাইড’ করি, তাহলে আর কেউ কিছু বলবে না। উনারা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেকই আমি দুটো মাস্টার্স করতে পারি। আমি কেন মাথা নিচু করে চোরের মতো লুকিয়ে মাস্টার্স করবো? আমি কারও কাছেই লুকাতাম না যে আমি একই সাথে এমবিএ’ও করছি। ৩ মাস ফার্স্ট সেমিস্টারে ক্লাস করার পর আমাকে এমডিএস ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হল। সে সময় মিথ্যে বললে, কিংবা অন্তত কৌশলে সত্যটা গোপন করলে এতদিনে আমার নামের পাশে দুটো নামকরা মাস্টার্স থাকার কথা। এখন আছে একটা। সত্যি বলছি, এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও কোন আফসোস নেই। আমার তো অনার্সই করার কথা ছিল না। সেই আমি মাস্টার্সও করে বসে আছি। জীবন এই আমাকে কম কিছু দেয়নি তো! বেঁচে থাকলে আরও কত বোনাস যে পেয়ে যাব! যতদিন বাঁচব, সত্যের জোরে মাথা উঁচু করেই বাঁচব।

আমার বোকা বাবাকে ধন্যবাদ।

Content Protection by DMCA.com