সমগ্র বেদ কি ব্রহ্মকেই প্রতিষ্ঠা করে—বহুত্ব ও বৈচিত্র্যের জগতকে অস্বীকার করে? না কি এর একটি অংশই কেবল তা করে? প্রকৃতপক্ষে, বেদ সর্বত্রই কোনো-না-কোনো স্থানে কোনো এক বিশেষ ভেদের নাকচ করাকেই উদ্দেশ্য হিসেবে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, "স্বর্গকামো যজেত": যে স্বর্গ কামনা করে, সে যজ্ঞ করুক— এই injunction-এ (বিধি বা বিধান বা বিধি-বাক্য বা আজ্ঞাবচন বাক্যে) যা বোঝানো হয়েছে, তা হলো: যিনি শরীর নন, বরং শরীর থেকে ভিন্ন—সেই যোগ্য ব্যক্তি স্বর্গভোগের অধিকারী। এর দ্বারা, শরীরকে আত্মা বলে যে-ধারণা প্রচলিত ছিল, তা নাকচ করা হয়েছে।
ঠিক তেমনি, “যে ব্যক্তি গবাদিপশু চায়, সে যেন দধিভাণ্ড (দুধভরা পাত্র) দ্বারা আঘ্রায়ণ (sprinkling ritual) সম্পন্ন করে।” (আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র, ১।১৬।৩; আপস্তম্ব ছিলেন ঋগ্বেদ–যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার অনুসারী এক বৈদিক ঋষি/আচার্য, যিনি আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ও আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র সহ একাধিক সূত্র রচনা করেন।) Apastamba Śrauta Sūtra হলো বৈদিক শ্রৌতসূত্র সাহিত্যভাগের অন্তর্গত এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগ্রন্থ, যা মূলত তৈত্তিরীয় যজুর্বেদ শাখা অনুসারীদের জন্য যজ্ঞাদি আচারবিধি নির্ধারণ করেছে। এই বিধি-বাক্য দ্বারা বোঝানো হলো—যিনি আঘ্রায়ণ (দধি দিয়ে ছিটানো) করবেন, তিনিই যোগ্য। যিনি নির্দিষ্ট ফল (গবাদিপশু/সম্পদ) চান, তিনি যেন শাস্ত্রবিধানমতে একটি আচার পালন করেন। এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে: যোগ্য কর্তৃকই আচার সম্পন্ন হবে— ফলে ‘কর্তা ও শরীর ভিন্ন’, এই ভ্রমের নাকচ করা হচ্ছে। এভাবে, বেদের বিধি-বাক্যসমূহ সর্বত্রই ভুল ধারণা, বিভ্রম ও মিথ্যা ভেদকে নাকচ করার কাজটি করে।
অনুরূপভাবে, বেদের injunction (বিধি-বাক্য) ও prohibition (নিষেধ-বাক্য) উভয়ই কামনা, আসক্তি ইত্যাদি দ্বারা চালিত স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে নাকচ করবার জন্যই রচিত। নিষেধ তা করে সরাসরি, আর বিধি তা করে পরোক্ষভাবে—অর্থাৎ কোনো বিকল্প ও শাস্ত্রসম্মত কাজ নির্দেশ করে। যেমন লোকজীবনেও দেখা যায়: মানুষকে অনাকাঙ্ক্ষিত পথে চলা থেকে ফিরিয়ে আনা হয় কখনো সরাসরি নিষেধ করে, কখনো আবার অন্য এক বিকল্প সৎপথের পরামর্শ দিয়ে।
যজ্ঞাদি কর্মকে যেসব বিধি-বাক্য নির্দেশ করে, তারা প্রকৃতপক্ষে আত্মজ্ঞান-লাভের জন্যই সহায়ক, কারণ সেগুলি কামনা-আসক্তি-প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত নানা স্বাভাবিক ক্রিয়া-বৃত্তিকে দূর করে। এর ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া যায়: যে-ব্যক্তি মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করেছেন, যিনি শান্ত-সৌম্য, তিনিই আত্মজ্ঞান-লাভের যোগ্য; তিনি আত্মজ্ঞান-প্রাপ্ত হতে পারেন। বিপরীতে, যে-ব্যক্তি ইন্দ্রিয়বিষয়ে আসক্ত, ভোগলোলুপতা ও কামনা-প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত নানা ক্রিয়ায় নিমগ্ন—তিনি আত্মার প্রতি মন একাগ্র করতে অক্ষম। বরং, যে-ব্যক্তি এসব বাহ্যিক ক্রিয়া থেকে মুক্ত এবং নিজের মনকে সংযত করেছেন—সেই যোগ্যতার কারণে তিনি আত্মজ্ঞান-প্রাপ্তির অধিকারী।
অল্পকথায়—বেদের বিধি-বাক্যসমূহ কেবল বহুত্বের ভ্রম অস্বীকারই করে না, সেগুলি অনুক্রমে সেই আসক্তিমূলক ক্রিয়াকেও নাকচ করে, যেগুলি আত্মজ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে। বেদ সামগ্রিকভাবে তাই পরম ব্রহ্মকেই প্রতিষ্ঠা করে।
কিছু আচার্যের মত এমন: যে-ব্যক্তি তার কামনা-বাসনা পূর্ণ করতে পারেনি এবং যার মন এখনও কামনায় কলুষিত, সে পরম অদ্বৈত বাস্তবতার জ্ঞানলাভের যোগ্য নয়। কিন্তু যে-ব্যক্তি দীর্ঘ এক সহস্রাব্দব্যাপী (‘হাজার বছরের পুরোনো’ অর্থে) যজ্ঞ ও আচারকর্মের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে তার কামনাগুলিকে পূর্ণ করে অবশেষে নিঃশেষ করেছে, সে অদ্বৈত আত্মাকে লাভ করে—যা প্রজাপতি-পদ (Status of Prajāpati) থেকেও ঊর্ধ্বতন। অর্থাৎ, যিনি যজ্ঞকর্মের মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে কামনা-বাসনা পূর্ণ করে অবশেষে সেগুলো নিঃশেষ করেন, তিনি প্রজাপতি-পদ থেকেও ঊর্ধ্বতন অদ্বৈত আত্মাকে লাভ করেন—প্রজাপতি-পদও সীমিত পরিসরের; তার ওপরে আছে অপরিমিত অদ্বৈত আত্মা। এ এক অত্যন্ত উচ্চ দেবত্বের অবস্থা, যা সাধারণ দেবতাদের (ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি ইত্যাদি) থেকেও ঊর্ধ্বতন।
বৈদিক সাহিত্যে প্রজাপতি মানে “প্রাণীদের অধিপতি,” “সৃষ্টিকর্তা।” এটি একপ্রকার শ্রেষ্ঠ স্বর্গীয় পদ— যেখানে সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব, ভোগসুখ এবং মহিমা বিদ্যমান। কখনো তাঁকে ব্রহ্মার সমার্থক বলা হয়, কখনো আবার এক স্বতন্ত্র দেবতা— যিনি সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক, প্রাণী ও প্রজার রক্ষক। ঋগ্বেদ–এ প্রজাপতি এক সর্বোচ্চ সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, যিনি সমস্ত জগতকে সৃষ্টি করেছেন। ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ–এ প্রজাপতি সাধারণত এক উচ্চ দেবত্ব-পদ, যেখান থেকে জীবজগৎ পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, বেদ চার ভাগে বিভক্ত: সংহিতা (Saṃhitā) → মন্ত্র, স্তোত্র, ঋচা (ঋক্ বা স্তোত্র বা স্তবধর্মী মন্ত্রের এক-একটি মন্ত্রপদ); ব্রাহ্মণ (Brāhmaṇa) → যজ্ঞবিধি ও আচারবিধি সম্পর্কিত গদ্য অংশ, যা যজ্ঞকর্ম কীভাবে করতে হবে, কেন করতে হবে, তার ব্যাখ্যা দেয়; আরণ্যক (Āraṇyaka) → অরণ্যে অধ্যয়নযোগ্য ধ্যানমুখী অংশ; উপনিষদ (Upaniṣad) → দার্শনিক তত্ত্ব, আত্মা-ব্রহ্ম বিচার।
সহজ কথায়—কামনা নিঃশেষ না হলে অদ্বৈত জ্ঞান আসে না। তবে সেই নিঃশেষতা আসে ভোগ-পরিপূরণের মাধ্যমে, অর্থাৎ বার বার কাম্যফল ভোগ করার মধ্য দিয়ে; তবে অদ্বৈত দর্শনের দৃষ্টিতে এটিকে অযৌক্তিক বলে মনে করা হবে, কারণ ভোগের দ্বারা কামনা নিঃশেষ হয় না, বরং আরও জন্ম নেয়, আরও বেড়ে যায়।
অন্য একদল আচার্য মত দিচ্ছেন: পুরো বেদের লক্ষ্য একটাই—আত্মজ্ঞান। যজ্ঞ ও আচারসমূহ, যেগুলো পৃথক ফলের (যেমন স্বর্গ, পশুধন ইত্যাদি) জন্য নির্দিষ্ট, সেগুলো আসলে মানুষকে আত্মজ্ঞান অর্জনের যোগ্য করে তোলে; কারণ, যে-ব্যক্তি তিনটি ঋণ (ঋষিঋণ, দেবঋণ, পিতৃঋণ) পরিশোধ করেনি, সে মুক্তির জন্য যোগ্য নয়।
ঋষিঋণ (Ṛṣi-ṛṇa)–ঋষিদের প্রতি ঋণ: ঋষিরা আমাদের জন্য বেদ, মন্ত্র, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক পথ প্রদান করেছেন। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য—বেদ অধ্যয়ন, স্বাধ্যায় (নিজে পাঠ), এবং অন্যকে বেদশিক্ষা দান করা। গৃহস্থ জীবনে ঋষিঋণ শোধ হয় স্বাধ্যায় এবং ব্রহ্মযজ্ঞ (বেদপাঠ/অধ্যয়ন)-এর মাধ্যমে। অর্থাৎ—ঋষিদের দেওয়া জ্ঞানের ঋণ আমরা শোধ করি সেই জ্ঞান ধারণ ও প্রচারের মাধ্যমে।
দেবঋণ (Deva-ṛṇa)–দেবতাদের প্রতি ঋণ: দেবতারা (অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, সূর্য ইত্যাদি) প্রকৃতির শক্তির প্রতীক—তাঁরা বায়ু, জল, অগ্নি, আলো ইত্যাদি দান করেছেন, যা আমাদের জীবনের ধারক। এই ঋণ শোধ হয় যজ্ঞ, হোম, পূজা, প্রার্থনা ইত্যাদি আচার দ্বারা। গৃহস্থের কর্তব্য হলো—দেবতাদের উদ্দেশ্যে অগ্নিহোত্র বা বিবিধ নিত্যযজ্ঞ করা। অর্থাৎ—যাঁদের কারণে আমাদের জীবনধারণ সম্ভব, সেই শক্তিগুলিকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই যজ্ঞ ও পূজার মাধ্যমে।
পিতৃঋণ (Pitṛ-ṛṇa)–পূর্বপুরুষদের প্রতি ঋণ: আমাদের শরীর, জন্ম ও সংস্কার এসেছে পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য হলো—সন্তান জন্ম দেওয়া, পরিবার ও বংশরক্ষা করা, এবং শ্রাদ্ধ-তর্পণ ইত্যাদি আচার পালন করা। সন্তান না হলে দত্তকগ্রহণ বা অন্য উপায়ে বংশ রক্ষা করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। অর্থাৎ—পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতা ও তাঁদের স্মরণ করার মধ্যে দিয়েই পিতৃঋণ শোধ হয়।
মনুস্মৃতি (৬.৩৫) বলছেন: “তিন ঋণ শোধ না করলে মুক্তির জন্য মন স্থির করা যায় না।” গৃহস্থ জীবনে এই তিন ঋণ শোধ করার পরে মানুষ বৈরাগ্য নিয়ে সন্ন্যাস ও মুক্তি-পথে যেতে পারে। অদ্বৈত দর্শনের দৃষ্টিতে, এই ঋণগুলো সংসারধর্মের অন্তর্গত। যখন আত্মজ্ঞান জাগে, তখন বোঝা যায়—আত্মা আসলে অদ্বিতীয়, তাই কোনো ঋণই সত্যিকার অর্থে আত্মার ওপর নেই—ঋষিঋণ: জ্ঞান/বেদ অধ্যয়ন ও প্রচার; দেবঋণ: যজ্ঞ ও পূজা দ্বারা কৃতজ্ঞতা; পিতৃঋণ: সন্তান, বংশরক্ষা ও শ্রাদ্ধ—এদের সবার উপরে আত্মজ্ঞান-অর্জন।
অন্য একটি মত: সকল যজ্ঞকর্মই আত্মজ্ঞানে সহায়ক। দর্ভি-হোম (Darvi-homa)-এর উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি নিয়ে বলা যাক। এটি বৈদিক যজ্ঞবিধির একটি অংশ। Darvi শব্দের অর্থ: কাঠ বা ধাতুর তৈরি হবন-পাত্র/চামচ/কড়াই। বিশেষত, যজ্ঞে অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার জন্য যে চামচ বা পাত্র ব্যবহার করা হয়, তাকে দর্ভি বলা হয়। এটি যজ্ঞ-যন্ত্রপাতির (śrauta implements) একটি প্রধান উপকরণ। দর্ভি-হোম হচ্ছে, দর্ভি-পাত্র ব্যবহার করে অগ্নিতে আহুতি প্রদান। সাধারণত ঘি, দুধ, শস্য বা নির্দিষ্ট দ্রব্য দর্ভি-পাত্রে রাখা হয়, তারপর মন্ত্রোচ্চারণসহ অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। এটি খুবই ছোটো ও সহজ যজ্ঞকর্ম, তুলনায় বৃহৎ সোমযজ্ঞ বা অগ্নিহোত্রের মতো জটিল কিছু নয়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.২২) উদ্ধৃত করে বলছি—“ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞের মাধ্যমে ব্রহ্মকে জানতে চায়।” এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—এমনকি “Darvi-homa”-এর মতো ক্ষুদ্র যজ্ঞও মানুষের মনকে একাগ্র ও শুদ্ধ করে, ফলে সে ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য উপযুক্ত হয়। অর্থাৎ: Darvi-homa অত বড়ো কিছু না হলেও, নিয়মিত শাস্ত্রসম্মতভাবে করলে এটি মনকে পরিষ্কার ও একাগ্র করে, যা আত্মজ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক প্রস্তুতি। Darvi-homa-সহ সকল যজ্ঞই মুক্তির পথে নিয়ে গেলেও, এদের কোনোটিই সরাসরি মুক্তিদায়ক নয়। এগুলো হলো চিত্তশুদ্ধির উপায়—যাতে মন আসক্তি ও দোষ থেকে মুক্ত হয় এবং ব্রহ্মজ্ঞান গ্রহণে সক্ষম হয়। তাই অদ্বৈত দর্শনে এদের ভূমিকা কেবল পরিশোধন (purificatory) হিসেবে, চূড়ান্ত মুক্তি-দানকারী এরা নয়।
যজ্ঞ (Yajña) ও মহাযজ্ঞ (Mahāyajña) মানুষের মানসিক ও নৈতিক শুদ্ধি ঘটায়। এই শুদ্ধিই আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পূর্বশর্ত। মনুস্মৃতি’তে (২.২৮) পাচ্ছি: “মহাযজ্ঞ ও যজ্ঞের মাধ্যমে মানুষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের যোগ্য হয়।” এখানে দুটি দিক বোঝানো হচ্ছে—
যজ্ঞ (Yajña): যজ্ঞ মানে শুধু বড়ো বড়ো হোমযজ্ঞ নয়, বরং ছোটো ছোটো দৈনন্দিন আচারও। যেমন—অগ্নিহোত্র, দর্ভি-হোম, বৈশ্বদেব, অতিথি-সেবা ইত্যাদি। এগুলো মানুষকে দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শেখায় এবং সংসারজীবনের দায়িত্বপালনে সাহায্য করে। ফলত, মন আসক্তি থেকে দূরে হয় এবং ধীরে ধীরে একাগ্রতা জন্মায়। সাধারণ মানুষকে আত্মজ্ঞান-লাভের জন্য তৈরি করতে পূজার্চনা, যজ্ঞাদির ভূমিকা আছে।
মহাযজ্ঞ (Mahāyajña): মনুস্মৃতিতে পাঁচটি মহাযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে— ব্রহ্মযজ্ঞ: বেদ অধ্যয়ন ও শিক্ষা। দেবযজ্ঞ: দেবতাদের উদ্দেশে হোম-আহুতি। পিতৃযজ্ঞ: শ্রাদ্ধ ও তর্পণ, পূর্বপুরুষ স্মরণ। ভূতযজ্ঞ: অন্নদান ও জীবজন্তুর প্রতি দয়া। অতিথিযজ্ঞ: অতিথি-অভ্যর্থনা ও সেবা। এই পাঁচটি মহাযজ্ঞ মানুষকে তিন ঋণ শোধের পথ দেখায়—ঋষি, দেব ও পিতৃঋণ। ফলে জীবনের নৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য তৈরি হয়। মনুস্মৃতির মতে, এইসব যজ্ঞের দ্বারা মানুষ পরিশুদ্ধ হয়, আর শুদ্ধ হলেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপযুক্ত হয়।
গৌতম ধর্মসূত্র (৮.২২) ঠেকে উদ্ধৃত করছি—“যার চল্লিশটি শুদ্ধিকরণ-সংস্কার এবং আটটি গুণ আছে, সে-ই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের যোগ্য।” এখানে দুটি স্তম্ভ সম্পর্কে বলা হয়েছে—
চল্লিশটি সংস্কার (Saṁskāra): মানুষের জীবনে চল্লিশটি শুদ্ধিকরণ-সংস্কার আছে। এর মধ্যে আছে জন্মসংক্রান্ত আচার (যেমন গর্ভাধান, জাতকর্ম), শিক্ষা ও সামাজিক আচার (উপনয়ন, বিবাহ), এবং জীবনের শেষ পর্যায়ের আচার (শ্রাদ্ধ ইত্যাদি)। প্রতিটি সংস্কার মানুষকে আরও শুদ্ধ ও দায়িত্বশীল করে তোলে। জীবনের প্রতিটি ধাপই যেন আধ্যাত্মিক যাত্রার অংশ।
আটটি গুণ (Virtues): সংস্কারের পাশাপাশি দরকার অন্তঃশুদ্ধি। এজন্য শাস্ত্রে আটটি গুণকে অপরিহার্য বলা হয়েছে—দমন (ইন্দ্রিয়সংযম), শান্তি (মনোসংযম), তিতিক্ষা (সহিষ্ণুতা), শ্রদ্ধা (শাস্ত্র ও গুরুর প্রতি আস্থা), শৌচ (অন্তঃ ও বহিঃশুদ্ধি), দান (উদারতা), অহিংসা (অসহিংসতা), সত্য (সত্যবাদিতা)। এগুলো ছাড়া মানুষ যতই আচার পালন করুক না কেন, ব্রহ্মজ্ঞান-লাভ সম্ভব নয়। অর্থাৎ, শুধু আচার নয়, আচার-সংস্কারের সঙ্গে নৈতিক গুণাবলি থাকলেই মানুষ ব্রহ্মজ্ঞান-লাভের যোগ্য হয়।
যজ্ঞ ও মহাযজ্ঞ মন ও সমাজকে মানসিক ও নৈতিকভাবে শুদ্ধ করে, সংস্কার জীবনের প্রতিটি ধাপকে পবিত্র করে, আর আটটি গুণ চরিত্রকে দৃঢ় করে। এই তিন স্তরের প্রস্তুতি মানুষকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের যোগ্য করে তোলে।