বেদের আলোয় অদ্বৈত: বাইশ




ইন্দ্রিয় কি জ্ঞানলাভের যন্ত্র? অদ্বৈত দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গভীর বিশ্লেষণ:

অদ্বৈত দর্শন, যা ব্রহ্ম এবং আত্মাকে অভিন্ন সত্তা হিসেবে দেখে, প্রচলিত জ্ঞানতত্ত্বের একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে: ইন্দ্রিয় কি সত্যিই জ্ঞানলাভের নির্ভরযোগ্য যন্ত্র? এই প্রশ্নটি মানব অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর দার্শনিক বিতর্কের জন্ম দেয়। অদ্বৈত দার্শনিকরা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং ভ্রান্তির সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং এই সমস্যার সমাধানের জন্য তিনটি বিকল্প প্রস্তাব করেছেন:

১. ইন্দ্রিয় কি কেবল সত্য জ্ঞানের যন্ত্র? এই বিকল্পটি প্রস্তাব করে যে, ইন্দ্রিয়গুলি কেবল সেই জ্ঞানই উৎপাদন করে, যা সত্য এবং নির্ভুল।
২. ইন্দ্রিয় কি সত্য ও মিথ্যা উভয় জ্ঞানের যন্ত্র? এই বিকল্পটি স্বীকার করে যে, ইন্দ্রিয়গুলি সত্য এবং মিথ্যা উভয় প্রকার জ্ঞানই দিতে পারে।
৩. ইন্দ্রিয় কি কেবল মিথ্যা জ্ঞানের যন্ত্র? এই বিকল্পটি সবচেয়ে চরম, যা দাবি করে যে, ইন্দ্রিয়লব্ধ সকল জ্ঞানই মূলত ভ্রান্ত বা মিথ্যা।

এই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে অদ্বৈতবাদের মূল ধারণা—জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের চূড়ান্ত সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

প্রথম বিকল্পের খণ্ডন: ইন্দ্রিয় কেবল সত্য জ্ঞানের যন্ত্র নয়

অদ্বৈত মতবাদ অনুসারে, ইন্দ্রিয়কে কেবল সত্য জ্ঞানের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা গ্রহণযোগ্য নয়। এর স্বপক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি উপস্থাপন করা হয়:

১. যুক্তিচক্রের সমস্যা (Circular Reasoning): যদি আমরা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে সত্য প্রমাণ করতে চাই, তবে আমাদের প্রথমে ধরে নিতে হবে যে, এই জ্ঞানের অবলম্বন (বিষয়) মিথ্যা জ্ঞানের অবলম্বন থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ, যে-বস্তুকে আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানি, সেটি সত্য জ্ঞানের বিষয় এবং মিথ্যা জ্ঞানের বিষয় থেকে স্বতন্ত্র। কিন্তু এই পার্থক্য প্রমাণ করতে হলে আবার বলতে হবে যে, এটি সত্য জ্ঞানের অবলম্বন। এভাবে আমরা একটি চক্রাকার যুক্তির মধ্যে পড়ে যাই, যেখানে একটি বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য সেই বিষয়টিরই পূর্বানুমান করা হয়। এটি একটি "দোলনার মতো" একই স্থানে বারবার ফিরে আসার মতো, যা কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। এই যুক্তিচক্রটি প্রমাণ করে যে, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে শুধুমাত্র তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে চূড়ান্ত সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

২. অবলম্বনের বাস্তব অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা: এমনকি যদি কোনো জ্ঞানকে আপাতত সত্য বলে মনে হয়, তার মানে এই নয় যে, সেই জ্ঞানের অবলম্বনের (বিষয়ের) বাস্তব এবং চিরন্তন অস্তিত্ব রয়েছে। অদ্বৈত দর্শন এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেয়: "এই রুপো অবাস্তব"—এটি একটি সত্য জ্ঞান। এই বাক্যটি সত্য, কারণ এটি একটি ভ্রান্ত ধারণাকে (ঝিনুককে রুপো বলে ভুল করা) সংশোধন করে। কিন্তু এই সত্য জ্ঞানের অবলম্বন কী? এটি হলো সেই ঝিনুককে রুপো বলে ভুল করার অভিজ্ঞতা, যা নিজেই অবাস্তব বা মিথ্যা। অর্থাৎ, যে-বস্তুটিকে আমরা রুপো মনে করেছিলাম, তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এই উদাহরণটি প্রমাণ করে যে, সত্য জ্ঞানও অবাস্তব বা মায়িক বস্তুর উপর ভিত্তি করে হতে পারে। সুতরাং, কেবল জ্ঞানের সত্যতা প্রমাণ করলেই তার অবলম্বনের বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।

৩. সত্য ও মিথ্যা অবলম্বনের পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যর্থতা: সাধারণত, ব্যাবহারিক স্তরে বলা হয় যে, সত্য জ্ঞানের অবলম্বন পরবর্তীতে খণ্ডিত হয় না, অর্থাৎ তার অস্তিত্ব বিলীন হয় না বা অন্য কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় না। অন্যদিকে, মিথ্যা জ্ঞানের অবলম্বন খণ্ডিত হয়, যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে আলো এলে সর্পের ধারণা খণ্ডিত হয়। কিন্তু অদ্বৈত মতে, শ্রুতি (বেদ) এবং যুক্তি উভয়ই প্রমাণ করেছে যে, ব্রহ্ম ছাড়া এই জগতের সব কিছুই মিথ্যা (মিথ্যাত্ব) এবং নশ্বর (অনিত্য)। ব্রহ্মই একমাত্র চূড়ান্ত সত্য এবং চিরন্তন সত্তা। সুতরাং, ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুরই চূড়ান্ত সত্যতা নেই, যা চিরকাল অক্ষত থাকে। অতএব, ইন্দ্রিয়লব্ধ কোনো জ্ঞানই অখণ্ডনীয় হতে পারে না, কারণ জগতের সমস্ত বস্তুই মায়ার অধীন এবং পরিবর্তনশীল। এই কারণে, ইন্দ্রিয়গুলি সত্য এবং মিথ্যা অবলম্বনের মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যর্থ।

এই যুক্তিগুলির মাধ্যমে অদ্বৈত দর্শন প্রতিষ্ঠা করে যে, ইন্দ্রিয়গুলি চূড়ান্ত বা পরম জ্ঞানের উৎস হতে পারে না। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান ব্যাবহারিক জীবনে প্রয়োজনীয় হলেও, তা ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের দিকে পরিচালিত করে না, যা অদ্বৈত দর্শনের মূল লক্ষ্য। এটি কেবল মায়ার জগতে আমাদের কর্ম পরিচালনা করতে সাহায্য করে, কিন্তু বাস্তবতার চূড়ান্ত সত্য উদ্‌ঘাটন করতে পারে না।

ইন্দ্রিয় ও আত্মার সম্পর্ক: অদ্বৈতবোধের গভীর বিশ্লেষণ

ইন্দ্রিয় এবং আত্মার সম্পর্ক এক জটিল দার্শনিক প্রশ্ন, যা অদ্বৈত বেদান্তের মূল ভিত্তি। যদি আমরা মেনে নিই যে, ইন্দ্রিয় জ্ঞানার্জনের একটি যন্ত্র, তবে স্বভাবতই এই প্রশ্ন জাগে, এই ইন্দ্রিয়ের অবলম্বন বস্তু তার অনুপস্থিতিতেও বিদ্যমান থাকা উচিত। কিন্তু এই যুক্তির গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, ইন্দ্রিয়ের প্রকৃত অবলম্বন একমাত্র আত্মা (ব্রহ্ম)। এই ধারণার বিশদ ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

জগতের জড়তা ও অবিদ্যা: অদ্বৈত মতে, এই জগতের সমস্ত বস্তু জড় এবং অচেতন। আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এগুলো নিছক অবিদ্যা বা মায়ার ফল। এগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে না, কারণ এদের নিজস্ব কোনো চেতনা নেই। ইন্দ্রিয়গুলিও এই জড় জগতেরই অংশ, তাই তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্ঞান উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। তারা কেবল আত্মার দ্বারা আলোকিত হয়েই কাজ করে।

চেতনার উপর অবিদ্যার আরোপ: অবিদ্যা নিজেকে নিজে ঢাকতে পারে না, বরং সর্বদা চেতনার (আত্মার) উপর আরোপিত হয়। যখন আমরা বলি 'অজানা', তখন আসলে চেতনার উপর অবিদ্যার একটি আবরণকেই বোঝাই। এই আবরণই আত্মাকে তার স্বরূপ উপলব্ধি থেকে বিরত রাখে এবং জাগতিক বস্তুকে বাস্তব বলে প্রতীয়মান করায়। অবিদ্যার এই আরোপের ফলেই ইন্দ্রিয়গুলি মনে করে যে, তারা স্বাধীনভাবে জ্ঞান লাভ করছে, অথচ প্রকৃত জ্ঞান আত্মারই।

আত্মা জগতের একমাত্র আধার: যেহেতু অবিদ্যা চেতনার উপর নির্ভরশীল এবং চেতনা স্বয়ং আত্মাই, তাই জগতের একমাত্র আধার হলেন আত্মা। অর্থাৎ, সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়—সব কিছুর মূলে রয়েছেন আত্মা। জাগতিক সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব আত্মার উপর নির্ভরশীল। ইন্দ্রিয়-লব্ধ জ্ঞানও এই আত্মারই উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়, কারণ আত্মা না থাকলে কোনো ধরনের জ্ঞানই সম্ভব নয়।

আত্মা নির্গুণ, ইন্দ্রিয়াতীত: যদি ইন্দ্রিয়ের অবলম্বন আত্মাই হন, তবে আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি অসম্ভব পরিস্থিতি। কারণ আত্মা নির্গুণ এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে ধরা যায় না। ইন্দ্রিয়ের কার্যকারিতা কেবল সগুণ জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ—এগুলি সবই সগুণ জগতের বৈশিষ্ট্য। আত্মা এইসব গুণের ঊর্ধ্বে, তিনি গুণাতীত এবং সীমাহীন। তাই ইন্দ্রিয় দিয়ে আত্মাকে উপলব্ধি করা যায় না, যেমন চোখ দিয়ে বাতাস দেখা যায় না। আত্মাকে উপলব্ধি করতে হলে ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করে আত্মানুসন্ধান করতে হয়।

শ্রুতি এবং স্বপ্নের যুক্তি: শ্রুতি বা উপনিষদও এই ধারণাকে সমর্থন করে যে, আত্মা ইন্দ্রিয়াতীত। কঠ উপনিষদের দুটি শ্লোক এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ:

"এই রূপ চোখে দেখা যায় না, কেউ তাঁকে চোখে দেখে না।" (কঠ উপনিষদ, ১.৩.১৫) এই শ্লোকটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, আত্মাকে চাক্ষুষ দর্শন দ্বারা লাভ করা সম্ভব নয়। আত্মা অপ্রাকৃত এবং ইন্দ্রিয়ের বিষয়বস্তু নন।

"স্বয়ম্ভূ (আত্মা) ইন্দ্রিয়ের দ্বারগুলো বাহিরমুখী করে দিলেন; তাই মানুষ বাহিরে দেখে, নিজের অন্তরস্থ আত্মাকে দেখে না।" (কঠ উপনিষদ, ২.১.১) এই শ্লোকটি ব্যাখ্যা করে যে, পরমেশ্বর বা আত্মা যখন সৃষ্টি করলেন, তখন ইন্দ্রিয়গুলিকে বহির্মুখী করলেন, যাতে মানুষ বাইরের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং নিজের অন্তরের আত্মাকে ভুলে যায়। এটি মানবজাতির এক বড়ো ত্রুটি, কারণ বাইরের জগতের প্রতি আসক্তি আত্মানুসন্ধান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

এই শ্রুতিবাক্যগুলি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আত্মা কখনোই ইন্দ্রিয়ের অবলম্বন হতে পারে না।

প্রতিপক্ষ হয়তো বলতে পারে যে, এই শ্রুতি কেবলমাত্র জগতের জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের ভূমিকা অস্বীকার করে না, কিন্তু তা অদ্বৈতমতে দুর্বল যুক্তি। কারণ, ইন্দ্রিয়ের জগৎজ্ঞানের যন্ত্রত্ব যে যুগপৎ উপস্থিতি-অনুপস্থিতি (anvaya-vyatireka) দ্বারা প্রমাণিত, তা ভ্রান্ত প্রমাণ। অদ্বৈত বেদান্ত এই যুক্তিকে মায়ার খেলা হিসেবে দেখে। স্বপ্নের ইন্দ্রিয় তো পুরোপুরি কল্পিত। স্বপ্নে আমরা বিভিন্ন বস্তু দেখি, শব্দ শুনি, কিন্তু এগুলির কোনো বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না। স্বপ্নাবস্থায় চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকলেও, তাদের দ্বারা লব্ধ জ্ঞান কেবল মানসিক কল্পনা মাত্র। ঠিক তেমনি, জাগ্রত অবস্থার ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানও মায়ারই ফল। যদিও জাগতিক বস্তুগুলিকে বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলি ক্ষণস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল, অর্থাৎ মায়ার প্রপঞ্চ। আসলে, এই শাস্ত্রবাক্যের মূল অর্থ হলো—আত্মা কখনোই ইন্দ্রিয়ের অবলম্বন নয়। আত্মা স্বপ্রকাশ এবং স্বতঃসিদ্ধ।

মূল যুক্তি দাঁড়াল এই: যদি ইন্দ্রিয় জ্ঞানযন্ত্র হয়, তবে তাদের অবলম্বন একমাত্র আত্মা হতে হবে। কিন্তু আত্মা নির্গুণ, ইন্দ্রিয় দ্বারা তাঁকে ধরা যায় না। সুতরাং, ইন্দ্রিয় আসলে জ্ঞানের কারণ নয়, তাদের দ্বারা লব্ধ জ্ঞানও ভ্রান্ত, আর ব্রহ্ম ব্যতীত সবই মায়াজাত। এই সিদ্ধান্তটি অদ্বৈত বেদান্তের মূল শিক্ষা, যা বলে—কেবলমাত্র ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিকল্পের খণ্ডন: ইন্দ্রিয় সত্য ও মিথ্যা বা কেবল মিথ্যা জ্ঞানের যন্ত্র

ইন্দ্রিয় এবং জ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তিনটি সম্ভাব্য বিকল্প আলোচনা করা হয়েছিল:

১. ইন্দ্রিয় কেবল সত্য জ্ঞানের যন্ত্র।
২. ইন্দ্রিয় সত্য ও মিথ্যা উভয় জ্ঞানের যন্ত্র।
৩. ইন্দ্রিয় কেবল মিথ্যা জ্ঞানের যন্ত্র।

আমরা প্রথম বিকল্পের খণ্ডন আগেই দেখেছি যে, ইন্দ্রিয় কেবলমাত্র সত্য জ্ঞানের যন্ত্র হতে পারে না, কারণ তাদের অবলম্বন আত্মাই ইন্দ্রিয়াতীত।

দ্বিতীয় বিকল্পের খণ্ডন: যেহেতু ইন্দ্রিয়কে সত্য জ্ঞানের যন্ত্র হিসেবে প্রমাণ করা যায়নি, তাই "ইন্দ্রিয় সত্য ও মিথ্যা উভয় জ্ঞানের যন্ত্র"—এই দ্বিতীয় বিকল্পটিও খণ্ডিত হয়। যদি ইন্দ্রিয় সত্য জ্ঞান উৎপাদন করতে না পারে, তবে সত্য ও মিথ্যা উভয় জ্ঞানই উৎপাদন করার প্রশ্নই আসে না।

তৃতীয় বিকল্পের খণ্ডন: তৃতীয় বিকল্প—"ইন্দ্রিয় কেবল মিথ্যা জ্ঞানের যন্ত্র।"—এটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, প্রতিপক্ষ নিজেই আগেই স্বীকার করেছেন যে, অবিদ্যাই মিথ্যা জ্ঞানের একমাত্র কারণ। এবং, আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, জাগ্রত অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি দ্বারা জগৎজ্ঞানের যে-প্রমাণ দেওয়া হয়, তা স্বপ্নের ইন্দ্রিয়ের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির মতোই নিছক কল্পনা। ইন্দ্রিয় নিজে মিথ্যা জ্ঞানের কারণ নয়, বরং অবিদ্যাই মিথ্যা জ্ঞানের মূল উৎস। ইন্দ্রিয়গুলি অবিদ্যার অধীনে কাজ করে এবং অবিদ্যাই মিথ্যা জ্ঞানের জন্ম দেয়। সুতরাং, ইন্দ্রিয়গুলিকে সরাসরি মিথ্যা জ্ঞানের কারণ বলা যায় না, তারা কেবল অবিদ্যার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে।

এই আলোচনা থেকে অদ্বৈত বেদান্তের একটি মৌলিক সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়: ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের আত্মাকে উপলব্ধি করতে অক্ষম। সত্যিকারের জ্ঞান আত্মানুসন্ধান এবং ব্রহ্মের সঙ্গে একত্বের মাধ্যমে লাভ করা যায়, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অনুভূতির বিষয়।