অবিদ্যার আশ্রয় ও বিষয় (The Locus and Object of Avidyā): শাস্ত্রীয় ভাষায়, অদ্বৈতে আত্মাকে স্বপ্রকাশ বলা হলেও, ভিন্ন ভিন্ন আচার্য অবিদ্যার আশ্রয় (যেখানে অবিদ্যা অবস্থান করে) ও অবিদ্যার বিষয় (যার ওপর অবিদ্যা আবরণ ফেলে) নিয়ে মতবিরোধ করেছেন। এখানে মূল প্রশ্ন দুটি: অবিদ্যার আশ্রয় কি জীবাত্মা (জীব), না কি ব্রহ্ম? অবিদ্যা আসলে কোন সত্তাকে আচ্ছাদিত করে—জীবকে, না ব্রহ্মকে?
অদ্বৈত দর্শনে জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতা একটি মৌলিক তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে, আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র জীবাত্মা এবং পরম ব্রহ্মের মধ্যে কোনো প্রকৃত ভেদ নেই; উভয়ই এক ও অভেদযুক্ত। তবে এই অভিন্নতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, তা নিয়ে পরবর্তীকালে উত্তর-শঙ্করীয় অদ্বৈত বেদান্তে দুটি প্রধান দার্শনিক ধারা গড়ে ওঠে: ভামতী (Bhāmatī) প্রথা এবং বিবরণ (Vivaraṇa) প্রথা। এই দুটি প্রথা মূলত অবিদ্যা বা অজ্ঞানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয় এবং এর আশ্রয় ও বিষয় কী, তা নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে।
ভামতী প্রথা: বাচস্পতি মিশ্র তাঁর 'ভামতী' নামক টীকায় এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রথা অনুসারে, অবিদ্যা বা অজ্ঞান জীবের উপর আশ্রয় করে থাকে। অর্থাৎ, প্রতিটি জীবাত্মার মধ্যেই স্বতন্ত্রভাবে অবিদ্যা বিদ্যমান, যা তাদের ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন মনে করিয়ে দেয়। অবিদ্যা এখানে একটি ব্যক্তিগত সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা প্রতিটি জীবের স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতার মূল কারণ। এই মতে, অবিদ্যা ব্রহ্মকে বিষয় করে না, বরং জীবকে বিষয় করে।
যখন কোনো জীব ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তখন তার নিজস্ব অবিদ্যা দূরীভূত হয় এবং সে মুক্তিলাভ করে। এই ব্রহ্মজ্ঞান হলো পরম সত্যের উপলব্ধি, যেখানে জীব নিজের আত্মাকে ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন রূপে জ্ঞান করে। এই উপলব্ধির ফলে তার জাগতিক বন্ধন, দুঃখ, মোহ এবং সকল প্রকার অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়। তার কাছে জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ—এই দ্বৈততা অর্থহীন হয়ে ওঠে, কারণ সে সকল কিছুর মূলে এক অখণ্ড ব্রহ্মকেই দেখতে পায়। এই অবস্থাপ্রাপ্তির পর সেই জীব আর সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ থাকে না; সে জীবন্মুক্ত পুরুষ হয়ে বিচরণ করে।
তবে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, এক জীবের অবিদ্যা দূরীভূত হলেও অন্য জীবের অবিদ্যা অক্ষুণ্ণ থাকে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করে মুক্তি পেলেও, এর দ্বারা সমগ্র জগতের অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায় না। প্রত্যেক জীবকে তার নিজস্ব সাধনা, জ্ঞানার্জন এবং উপলব্ধির মাধ্যমে নিজের অবিদ্যা দূর করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, যেমন একটি প্রদীপ আলো দিলে তার চারপাশের অন্ধকার দূর হয়, কিন্তু অন্য ঘরে থাকা অন্ধকার প্রদীপটি জ্বালানো না হলে সেই অন্ধকার দূর হয় না। ঠিক তেমনই, একজন জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞান তার নিজের পথ আলোকিত করে, কিন্তু অন্য অজ্ঞানী ব্যক্তিদের পথ তাদের নিজেদের চেষ্টাতেই আলোকিত করতে হবে।
এই বিষয়টি অদ্বৈত দর্শনের একটি মূল ভিত্তি। অদ্বৈতবাদ অনুসারে, যদিও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন, তবুও মায়ার প্রভাবে জীব বহু রূপে প্রতিভাত হয় এবং নিজের স্বরূপ ভুলে গিয়ে নিজেকে সীমিত মনে করে। যখন কোনো জীব এই মায়াজাল ছিন্ন করে ব্রহ্মের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা উপলব্ধি করে, তখন সে নিজ সত্তায় বিলীন হয়। কিন্তু অন্যান্য জীব, যারা এখনও মায়ার অধীনে রয়েছে, তাদের কাছে জগৎ যেমন ছিল, তেমনই থাকে এবং তারা তাদের নিজস্ব অবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। তাই, ব্রহ্মজ্ঞান ব্যক্তিগত মুক্তির পথ, কিন্তু এর প্রভাব সামগ্রিকভাবে সকল জীবের উপর সরাসরি বর্তায় না, যতক্ষণ না তারাও স্বয়ং সেই জ্ঞান লাভ করে। এই কারণেই সমাজে জ্ঞানী পুরুষদের উপস্থিতি থাকলেও সকল মানুষ অজ্ঞ থাকে, কারণ জ্ঞানের উপলব্ধি একটি ব্যক্তিগত যাত্রা।
বিবরণ প্রথা: প্রকাশাত্ম যতি তাঁর 'বিবরণ' গ্রন্থে এই মতবাদকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। এই প্রথা অনুসারে, অবিদ্যা কেবলমাত্র জীবকে আশ্রয় করে না, বরং ব্রহ্মকেই আশ্রয় করে থাকে। অবিদ্যা এখানে একটি একক ও সমষ্টিগত সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা সমগ্র বিশ্বকে আবৃত করে আছে। এই মতে, ব্রহ্মই অবিদ্যা বা অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে জীবরূপে প্রতিভাত হন। অর্থাৎ, অবিদ্যা ব্রহ্মকে বিষয় করে এবং ব্রহ্মই অবিদ্যার কারণে জগৎ ও জীবের বৈচিত্র্য রূপে প্রকাশিত হন।
যখন কোনো জীব ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তখন তা কেবল একটি ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং সামগ্রিক অবিদ্যার বিনাশের দিকে এক বিশাল পদক্ষেপ। এই অবিদ্যা কোনো পৃথক সত্তা নয়, বরং ব্রহ্মেরই উপর আরোপিত একটি ভ্রম। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে করা হয়, তেমনই ব্রহ্মের উপর জগৎ ও জীবের ভেদ আরোপিত হয় অবিদ্যার কারণে। ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে এই আরোপিত ভ্রম দূর হয় এবং জীব তার প্রকৃত স্বরূপ, অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্নতা উপলব্ধি করতে পারে। এই উপলব্ধি শুধু ব্যক্তিগত মুক্তি আনে না, বরং সমগ্র সৃষ্টিতে যে-অবিদ্যার প্রভাব রয়েছে, তারও নিরসনে সাহায্য করে। কারণ প্রতিটি জীব ব্রহ্মের অংশ এবং তাদের জ্ঞান লাভ সামগ্রিক চেতনার উন্মোচনেই অবদান রাখে। এইভাবেই প্রতিটি ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞানলাভ বিশ্বজনীন অবিদ্যার অন্ধকার দূর করে এক উজ্জ্বল সত্যের দিকে পথ প্রশস্ত করে।
এই দুটি প্রথার মধ্যে মূল পার্থক্যটি নির্ভর করে 'আশ্রয়-বিষয় তত্ত্বের' সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের উপর। অবিদ্যা কার উপর আশ্রয় করে (আশ্রয়) এবং কাকে বিষয় করে (বিষয়) এই প্রশ্নের ভিন্ন উত্তরেই ভামতী ও বিবরণ প্রথার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় প্রথাই শেষপর্যন্ত জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতাকে স্বীকার করে, কিন্তু এই অভিন্নতার উপলব্ধি এবং অবিদ্যার স্বরূপ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এই পার্থক্যগুলি অদ্বৈত বেদান্তের দার্শনিক আলোচনাকে আরও গভীর ও সমৃদ্ধ করেছে, এবং মোক্ষ লাভের পথে জ্ঞানের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছে।
আত্মার স্বরূপ এবং অবিদ্যার ভূমিকা (Nature of the Self and the Role of Avidyā): আত্মা, তার অন্তর্নিহিত স্বভাব দ্বারা, স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ। একে কোনো কিছুর দ্বারা সত্যিকার অর্থে আচ্ছাদিত করা যায় না বা বিলুপ্ত করা যায় না। অবিদ্যা, বা অজ্ঞতা, কেবল একধরনের ভ্রম বা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে, যার ফলে আত্মার পূর্ণ, অনন্ত এবং উজ্জ্বল স্বরূপকে অগ্রাহ্য বা অনাবৃত বলে মনে হয়। এই প্রপঞ্চটি এমন নয় যে, আত্মা বস্তুতপক্ষে অপ্রকাশিত, বরং অবিদ্যা একটি আবরণ তৈরি করে, যা আত্মার প্রকৃত মহিমাকে বুঝতে বাধা দেয়।
বেদান্ত শাস্ত্রের ভূমিকা অনেকটা বাতাসের মতো, যা মেঘপুঞ্জকে সরিয়ে দেয়। এটি কোনো অপ্রকাশমান আত্মাকে নতুন করে আলোকিত করে না, কারণ আত্মা তো চিরকালই স্বয়ং-উজ্জ্বল। বরং, বেদান্তের কাজ হলো অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট আবরণকে দূর করে দেওয়া, যার ফলে সদা-উজ্জ্বল আত্মা তার স্বাভাবিক, অপরিবর্তনীয় স্বরূপে প্রকাশিত হয়। আচার্য সুরেশ্বর, একজন প্রখ্যাত অদ্বৈতবাদী দার্শনিক, এই মতকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বলেছেন যে, শাস্ত্রের একমাত্র এবং প্রধান কাজ হলো, আত্মার ওপর চাপানো সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে নস্যাৎ করা এবং মিথ্যা আবরণগুলিকে অপসারিত করা।
যখন এই অবিদ্যার আবরণ দূরীভূত হয়, তখন আত্মা তার নিজস্ব মহিমাতেই উদ্ভাসিত হয়—ঠিক যেমন মেঘ সরে গেলে সূর্য তার পূর্ণ রূপে দৃশ্যমান হয়। এখানে সূর্যকে নতুন করে জ্বালাতে হয় না, কেবল তার ওপরের আবরণটি সরে যায়।
অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে ব্রহ্ম এবং জীবাত্মার সম্পর্ক একটি জটিল ও গভীর বিষয়। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, আর জগৎ মিথ্যা—এই মূল তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আচার্যগণ বিভিন্ন মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে "সংকীর্ণ" বেদান্তীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মত হলো – জীব আশ্রয়, ব্রহ্ম বিষয়। এই মতবাদটি বিশেষত ভামতী প্রথা বা আচার্য বাচস্পতি মিশ্রের অনুসারীদের দ্বারা সমর্থিত।
এই মতবাদের মূল কথা হলো, অবিদ্যার (অজ্ঞান) আশ্রয় (āśraya) হলো জীব, কিন্তু অবিদ্যার বিষয় (viṣaya) হলো ব্রহ্ম। এর অর্থ হলো:
অবিদ্যার আশ্রয় জীব: অবিদ্যা জীবের অন্তঃকরণে (মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার) অবস্থান করে। জীবই এই অবিদ্যার ধারক। জীব তার নিজস্ব অজ্ঞতার কারণে ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না। অবিদ্যা জীবের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে, যার ফলে জীব নিজেকে ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন মনে করে।
অবিদ্যার বিষয় ব্রহ্ম: যদিও অবিদ্যা জীবের মধ্যে থাকে, এর প্রভাব ব্রহ্মকে প্রভাবিত করে না। ব্রহ্ম স্বয়ং কখনও অবিদ্যার দ্বারা প্রকৃত বিচারে আক্রান্ত হয় না। বরং, অবিদ্যা ব্রহ্মকে আবৃত করে বলে মনে হয়, কিন্তু এটি ব্রহ্মের স্বরূপে কোনো পরিবর্তন আনে না। ব্রহ্ম চিরকাল বিশুদ্ধ, জ্ঞানস্বরূপ এবং নির্গুণ। অবিদ্যা ব্রহ্মকে "অজ্ঞাত" করে রাখে কেবল জীবের দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্রহ্মের নিজস্ব সত্তায় নয়। যেমন, মেঘ সূর্যকে আবৃত করে বলে মনে হয়, কিন্তু মেঘের দ্বারা সূর্যের আলো বা সত্তা প্রভাবিত হয় না। একইভাকে, অবিদ্যার দ্বারা ব্রহ্মের জ্ঞানস্বরূপতা বা স্বতঃসিদ্ধতা কখনো মলিন হয় না। এটি কেবল জীবের উপলব্ধির ক্ষেত্রে একটি বাধা সৃষ্টি করে।
এই মতবাদটি ব্রহ্মকে অবিদ্যার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রেখে জীবের উপর অবিদ্যার দায়ভার চাপিয়ে দেয়। এর ফলে ব্রহ্মের নির্গুণ, নিরাকার এবং অপাপবিদ্ধ সত্তা অক্ষুণ্ণ থাকে। বহু জীব, বহু অবিদ্যা—এটিই ভামতী প্রথার গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই ধারার আচার্যগণ, বিশেষ করে ভামতী প্রথার অনুসারীরা, জীববহুলতা ও অবিদ্যাবহুলতা স্বীকার করেন। এটি তাঁদের মতবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক।
প্রত্যেক জীবই নিজস্ব অনাদি অবিদ্যার আসন: তাঁরা মনে করেন যে, প্রতিটি জীবের জন্য একটি পৃথক, অনাদি অবিদ্যা বিদ্যমান। এই অবিদ্যা জীবের জন্মগত এবং এর কোনো শুরু নেই। এটি জীবের নিজস্ব কর্মফল এবং সংস্কারের সাথে যুক্ত। তাই এক জীবের অবিদ্যা অন্য জীবের অবিদ্যার থেকে স্বতন্ত্র।
জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়া: এই তত্ত্ব অনুসারে, কারও অবিদ্যা তখনই দূর হয়, যখন সেই বিশেষ জীব শ্রবণ (গুরুবাক্য শ্রবণ), মনন (শ্রুত বাক্য নিয়ে গভীর চিন্তা) এবং নিদিধ্যাসন (একনিষ্ঠ ধ্যান ও আত্মতত্ত্বের উপলব্ধি) দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করে। অর্থাৎ, মোক্ষ বা মুক্তি একটি ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া।
মুক্তি ও অজ্ঞতার সহাবস্থান: এই মতবাদ একটি বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করে—কিছু মানুষ মুক্তি লাভ করে বা আত্মজ্ঞানী হয়, আর অন্যরা অজ্ঞ রয়ে যায়। যদি অবিদ্যা একক হতো, তাহলে একজন মুক্ত হলে সবার মুক্তি হতো, যা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে মেলে না। জ্ঞানীরা (মুক্ত পুরুষ) এবং অজ্ঞরা একই জগতে সহাবস্থান করে, যা প্রমাণ করে যে, অবিদ্যা বহুবিধ।
ভামতী-আচার্যরা একক অবিদ্যার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর সপক্ষে জোরালো যুক্তি দেন:
সর্বজনীন মুক্তির অনুপস্থিতি: যদি কেবল একটাই সর্বজনীন অবিদ্যা থাকত এবং তা সকল জীবের জন্য প্রযোজ্য হতো, তবে কোনো একজন জীব যখন আত্মজ্ঞান লাভ করত এবং তার অবিদ্যা নষ্ট হতো, তখন সেই অবিদ্যা একবারেই নষ্ট হয়ে যেত। এর ফলস্বরূপ, জগতের সকল জীব একসাথে মুক্তি লাভ করত। কিন্তু বাস্তবে এমনটি ঘটে না।
বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা: আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা (যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন এবং মুক্ত) এবং অজ্ঞ ব্যক্তিরা (যারা এখনো মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ) একই সমাজে এবং একই সময়ে বসবাস করে। এই সহাবস্থান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, অবিদ্যা সর্বজনীন এবং একক নয়।
সিদ্ধান্ত: উপরোক্ত কারণগুলির পরিপ্রেক্ষিতে, ভামতী-আচার্যরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, অবিদ্যা বহুপ্রকার এবং প্রতিটি জীবের জন্য একটি করে অবিদ্যা বিদ্যমান। এটি জীবাত্মার স্বতন্ত্র মুক্তি এবং জাগতিক বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে। এই মতবাদ অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, যা ব্রহ্মের নির্গুণতা এবং জীবের ব্যক্তিগত মোক্ষ লাভের প্রক্রিয়াকে সুচারুরূপে ব্যাখ্যা করে।