অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে উপাধি তত্ত্ব জীবের স্বরূপ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি ব্রহ্ম এবং জীবের আপাত পার্থক্যের মূল কারণ হিসেবে অবিদ্যার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে। শঙ্কর-পরবর্তী অদ্বৈত স্কুলগুলির মধ্যে দুটি প্রধান মতবাদ এই উপাধি তত্ত্বকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে:
১. অবচ্ছেদ বাদ (Avaccheda Vāda): এটি ভামতী স্কুলের মতবাদ, যা বাচস্পতি মিশ্রের অনুসারীরা সমর্থন করেন। এই মত অনুযায়ী, জীব হলো অবিদ্যার দ্বারা "সীমিত" বা "বেষ্টিত" ব্রহ্ম। এখানে উপাধি বলতে জীবের ব্যক্তিগত অন্তঃকরণ বা বুদ্ধি বোঝানো হয়, যা অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট একটি সীমাবদ্ধতা। এই উপাধি ব্রহ্মের অসীম সত্তাকে সীমিত করে একটি স্বতন্ত্র জীবসত্তারূপে প্রতিভাত করে।
উপাধির প্রকৃতি: অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট সীমাবদ্ধতা বা বেষ্টন।
জীবের স্বরূপ: উপাধি দ্বারা সীমিত ব্রহ্ম।
প্রধান দৃষ্টান্ত: ঘটাকাশ ন্যায়। যেমন, মহাকাশ (ব্রহ্ম) অসীম হলেও ঘট (উপাধি) দ্বারা সীমিত হয়ে ঘটাকাশ (জীব) রূপে প্রতীয়মান হয়। ঘট ভেঙে গেলে ঘটাকাশ আবার মহাকাশের সঙ্গে এক হয়ে যায়, তেমনই উপাধির বিনাশ ঘটলে জীব ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়।
জ্ঞানলাভের পদ্ধতি: এই মতের সমর্থকরা মনে করেন, জ্ঞানলাভের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ধ্যান বা প্রসংখ্যাণ (continued meditation) আবশ্যক। কারণ, উপাধির দৃঢ় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে গভীর মনন ও অভ্যাসের প্রয়োজন হয়।
২. প্রতিবিম্ব বাদ (Pratibimba Vāda): এটি বিবরণ স্কুলের মতবাদ, যা প্রকাশাত্মা যতির অনুসারীরা সমর্থন করেন। এই ধারণা অনুযায়ী, জীব হলো অবিদ্যারূপ দর্পণে ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব (reflection)। এখানে ব্রহ্ম হলেন মূল প্রতিরূপ বা বিম্ব (prototype), অর্থাৎ ঈশ্বর, আর জীব হলো তাঁর প্রতিবিম্ব।
উপাধির প্রকৃতি: অবিদ্যাকে দর্পণ বা আয়নার মতো ধরা হয়, যেখানে ব্রহ্ম প্রতিফলিত হন।
জীবের স্বরূপ: অবিদ্যার দর্পণে ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব।
আভাসবাদ: এই মতবাদের একটি সংশোধিত রূপ হলো 'আভাসবাদ', যা বলে যে এই প্রতিফলনটি কেবলই একটি ভ্রম বা আপাত প্রতিভাস (illusory manifestation), যা বাস্তব নয়।
জ্ঞানলাভের পদ্ধতি: প্রতিবিম্ব বাদীরা মনে করেন, শ্রুতি বাক্য (মহাবাক্য যেমন "তত্ত্বমসি") থেকে সরাসরি (immediate) জ্ঞান লাভ হতে পারে। তাঁদের মতে, প্রতিবিম্ব যেহেতু মূল বিম্ব থেকে ভিন্ন নয়, তাই সরাসরি উপদেশ বা শ্রবণের মাধ্যমেই আত্মজ্ঞান সম্ভব।
রামানুজ অদ্বৈতবাদীদের উপাধি তত্ত্বের সঙ্গে একমত নন। তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈত (Viśiṣṭādvaita) মতবাদ অনুযায়ী, উপাধির প্রকৃতি হলো ব্রহ্মের নিত্য বিশেষণ (Attribute)। জীব ব্রহ্মের স্বতন্ত্র, চিরন্তন অংশ। এখানে আত্মা শরীরের বিশেষণ। রামানুজ ব্রহ্মকে সগুণ এবং জীবকে তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখেন, যা উপাধি দ্বারা সৃষ্ট কোনো ভ্রম নয়।
উপাধি তত্ত্বের কার্যকারিতা: উপাধি তত্ত্ব অবিদ্যার আশ্রয় (locus) এবং বিষয় (object) নিয়ে অদ্বৈত বেদান্তে বিদ্যমান জটিলতার একটি কার্যকরী সমাধান দেয়। প্রশ্ন ওঠে, জড় (Jada) অবিদ্যা কীভাবে চৈতন্যে থাকতে পারে বা চৈতন্যকে প্রভাবিত করতে পারে? উপাধি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে, চৈতন্য (ব্রহ্ম) উপাধি দ্বারা যুক্ত হচ্ছে, কিন্তু এর ফলে ব্রহ্মের প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। ব্রহ্ম নির্বিকার, উপাধির প্রভাব কেবল জীবের উপরই পড়ে। জীবচৈতন্য, ফলস্বরূপ, বাস্তবতা (reality) এবং প্রতিভাসের (appearance) দ্বৈত প্রকৃতির অধিকারী হয়—পারমার্থিকভাবে ব্রহ্ম হলেও ব্যবহারিক স্তরে সে জীব।
মায়া/অবিদ্যা এবং জীবের সম্পর্ক ব্যাখ্যায় অদ্বৈত বেদান্তের অভেদ তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় প্রমাণ হলো শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৪.৫ মন্ত্রটি। এটি সনাতন দর্শনের, বিশেষত সাংখ্য ও অদ্বৈত বেদান্তের কিছু মূল ধারণা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল-আলোচিত শ্লোক।
মন্ত্র:
অজামেকাম্ লোহিত-শুক্ল-কৃষ্ণাম্ বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ।
অজো হ্যেকো জুষমাণোঽনুশেতে জহাত্যেনাং ভুক্ত-ভোগাম্ অজোঽন্যঃ।।
এই মন্ত্রে তিনটি "অজঃ" (যা জন্মহীন বা অনাদি) সত্তার কথা বলা হয়েছে:
১. অজা (স্ত্রীলিঙ্গ, প্রকৃতি/মায়া/অবিদ্যা)—এক জন্মহীন নারী (Ekam Ajaam):
স্বরূপ: ইনি হলেন প্রকৃতি, মায়া বা অবিদ্যা—যিনি সৃষ্টির উপাদান কারণ এবং তিন গুণ (লোহিত, শুক্ল, কৃষ্ণা—রজঃ, সত্ত্ব, তমঃ) রূপে বহুরূপী প্রজা সৃষ্টি করেন।
বর্ণনা: ইনি একটি জন্মহীন সত্তা, যাঁর বর্ণ লোহিত (লাল), শুক্ল (সাদা) ও কৃষ্ণ (কালো)। এই তিনটি বর্ণ প্রকৃতির ত্রিগুণ—সত্ত্ব (শুক্ল), রজঃ (লোহিত), এবং তমঃ (কৃষ্ণ) এর প্রতীক। সত্ত্বগুণ প্রকাশ, শান্তি ও জ্ঞানের ধর্ম; রজোগুণ কর্ম, গতি ও আসক্তির ধর্ম; তমোগুণ জড়তা, আলস্য ও অজ্ঞানতার ধর্ম। এই প্রকৃতিই তার ত্রি-গুণের মাধ্যমে এই দৃশ্যমান বহুবিচিত্র জগৎ সৃষ্টি করে।
কার্য: তিনি নিজের মতো দেখতে বহু প্রজা (সৃষ্টি/বস্তু) সৃষ্টি করেন।
২. অজঃ (পুংলিঙ্গ, বদ্ধ জীবাত্মা)—এক জন্মহীন পুরুষ (প্রথম অজঃ):
স্বরূপ: ইনি হলেন বদ্ধ জীবাত্মা বা পুরুষ। অজ্ঞানের কারণে, সে প্রকৃতির (অজা-সত্তার) সৃষ্ট জগৎকে সত্য বলে মনে করে এবং তাতে আসক্ত হয়ে ভোগ করতে থাকে।
অবস্থা: একজন জন্মহীন পুরুষ সেই অজা-সত্তার সঙ্গে আসক্ত হয়ে থাকেন এবং তাঁর (প্রকৃতির) সৃষ্ট ভোগ (সুখ-দুঃখ) উপভোগ করতে করতে তাঁর অনুশয়ন (আশ্রয় গ্রহণ/শয়ন) করেন। উপনিষদের ভাষায়, সে "অনুশয়ন" করে, অর্থাৎ সে মায়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে (যা স্বপ্নদৃষ্টান্তের সঙ্গে তুলনীয়)। এই অবস্থায় জীব বদ্ধ থাকে। সে "জুষমাণোঽনুশেতে"— অর্থাৎ প্রকৃতিতে আসক্ত হয়ে তার ফল ভোগ করে।
৩. অজঃ অন্যঃ (পুংলিঙ্গ, মুক্ত জীবাত্মা)—অন্য জন্মহীন পুরুষ (অন্য অজঃ):
স্বরূপ: এটিও সেই একই জীবাত্মা, কিন্তু যার মধ্যে জ্ঞান বা আত্ম-উপলব্ধি জেগেছে।
অবস্থা: অপর একজন জন্মহীন পুরুষ সেই অজা-সত্তাকে ত্যাগ করেন, যখন তাঁর দ্বারা সৃষ্ট ভোগসমূহ উপভোগ করা শেষ হয়ে যায়। ইনি হলেন মুক্ত জীবাত্মা, যিনি ভোগ শেষে প্রকৃতি বা মায়াকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন। যখন জীবাত্মা প্রকৃতির সৃষ্ট সমস্ত সুখ-দুঃখের ভোগ (কর্মফল) শেষ করে এবং নিজের স্বরূপকে জানতে পারে, তখন সে প্রকৃতির এই বন্ধন ত্যাগ করে। এই ত্যাগই হলো মোক্ষ বা মুক্তি। এই অবস্থায় পুরুষ আর প্রকৃতির অধীন থাকে না। সে "জহাত্যেনাম্"— অর্থাৎ ভোগ শেষে মায়াকে ত্যাগ করে।
রূপকের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা:
'অজাত স্ত্রী' (প্রকৃতি/অবিদ্যা): এটি অবিদ্যা বা প্রকৃতিকে বোঝায়, যা ত্রিগুণের (সত্ত্ব, রজ, তম) শক্তি বহন করে এবং নানা রূপ সৃষ্টি করে। এই অবিদ্যাই জগতের বৈচিত্র্যের উৎস এবং জন্মহীন, অর্থাৎ এর কোনো আদি নেই।
'শয়নকারী অজাত' (আবদ্ধ জীব): এটি আবদ্ধ জীবকে বোঝায়। জীব অবিদ্যার মায়ায় আসক্ত হয়ে তার সঙ্গে শয়ন করে, অর্থাৎ ভোগ ও আসক্তির দ্বারা আবদ্ধ থাকে। সে অবিদ্যার সৃষ্টি করা জাগতিক বিষয়বস্তুগুলোতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এবং দুঃখ-সুখ অনুভব করে।
'ত্যাগকারী অজাত' (মুক্তাত্মা/ঈশ্বর): এটি মুক্তাত্মা বা ঈশ্বরকে বোঝায়। ঈশ্বর অবিদ্যা থেকে মুক্ত হওয়ায় তার কাছে অবিদ্যা খাওয়া-পরা সাঙ্গ হলে তিনি সেটিকে ছেড়ে দেন। অর্থাৎ, ঈশ্বর অবিদ্যার অধীন নন, বরং তিনি অবিদ্যার নিয়ন্ত্রক এবং এর প্রভাব থেকে মুক্ত। জীব যখন নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করে, তখন সে-ও এই মুক্ত পুরুষের মতো মায়াকে ত্যাগ করতে সক্ষম হয়।
অদ্বৈত ব্যাখ্যার আলোকে মন্ত্রের তাৎপর্য: এই মন্ত্রটি দেখায় যে, অবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া জীবের প্রকৃত সত্তা নয়। জীব অবিদ্যায় আসক্ত হয় ও ভোগের জন্য তাকে গ্রহণ করে, কিন্তু জ্ঞানলাভের মাধ্যমে তাকে ত্যাগ করা সম্ভব। এই ত্যাগই মোক্ষ বা মুক্তি। সংক্ষেপে বললে, এই মন্ত্রটি বদ্ধ জীবাত্মা ও মুক্ত জীবাত্মা-র মধ্যেকার পার্থক্যকে তুলে ধরে এবং এই পার্থক্যের কারণ হিসাবে প্রকৃতি বা মায়ার ভূমিকা ব্যাখ্যা করে।
অদ্বৈত এভাবে বলে—প্রথম পুরুষ (জীব) মায়াকে ভোগ করেন, কারণ তিনি উপাধিযুক্ত থাকার কারণে কর্ম ও ভোগের ফল ভোগ করেন, যা Jīvatva-এর অবস্থা। দ্বিতীয় পুরুষ (মুক্ত অজঃ) মায়াকে ত্যাগ করেন, কারণ তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন এবং জীবত্বের ভ্রমকে দূর করেছেন। "তিনি তাকে ত্যাগ করেন" (Jahātyenām), এই বাক্যটি নিশ্চিত করে যে, মায়া/অবিদ্যার সঙ্গে জীবাত্মার সম্পর্ক চিরন্তন বা নিত্য নয়, বরং আগন্তুক এবং ভঙ্গুর। ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা এই ত্যাগ সম্ভব হয়।
এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় অদ্বৈত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে যে, ব্রহ্ম বা আত্মা (paramaṁ brahma) জগৎ সৃষ্টি দ্বারা অস্পৃশ্য থাকে, যেমন রজ্জুর উপর সাপের ভ্রান্তির দ্বারা দড়ি অস্পৃশ্য থাকে। যদি জীবাত্মা নিত্যভাবে ভিন্ন হতো (যেমন দ্বৈত বা বিশিষ্টাদ্বৈতে), তবে মুক্তির পর মায়াকে ত্যাগ করার প্রশ্ন উঠত না, কারণ সেক্ষেত্রে জীব চিরকালই ব্রহ্মের নিত্য অংশ হিসেবে মায়ার সঙ্গে সম্পর্কে থাকত। কিন্তু যেহেতু জীবত্ব হলো উপাধিজনিত আরোপিত অবস্থা, তাই জ্ঞান দ্বারা উপাধির বিনাশ হলে জীব তার স্বাতন্ত্র্য হারায় এবং ব্রহ্মে লীন হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে 'অবিদ্যা' বা অজ্ঞানতাকে একটি অচেতন বা জড় শক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর অর্থ হলো, অবিদ্যার নিজস্ব কোনো চেতনা নেই এবং সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো কিছু সৃষ্টি বা প্রকাশ করতে পারে না। অবিদ্যাকে বরং এক ধরণের গৃহকলা-সদৃশ আবরণ হিসেবে দেখা হয়, যা ব্রহ্মস্বরূপ আত্মাকে সাময়িকভাবে ঢেকে রাখে, ঠিক যেমন মেঘ সূর্যকে ঢেকে রাখলেও সূর্যের অস্তিত্বকে বিনাশ করে না। এই আবরণ আত্মাকে সীমিত করে না, বরং কেবল তার স্বরূপকে উপলব্ধিতে বাধা দেয়।
অনেকে মনে করেন যে, জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে যে আপাত পার্থক্য দেখা যায়, তা অবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, অবিদ্যাই এই ভেদের কারণ। কিন্তু অদ্বৈতবাদীগণ এই যুক্তিকে তিনটি প্রধান মান্য সম্পর্কের (কার্য-কারণ, গুণ-আধার এবং জ্ঞেয়-জ্ঞাপক) কোনোটির মাধ্যমেই প্রমাণ করতে পারেন না, যা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে ব্যবহৃত হয়।
অবিদ্যা ও ভেদের সম্পর্ক প্রমাণে অদ্বৈতবাদীদের আপত্তি:
১. কার্য-কারণ সম্পর্ক: যদি অবিদ্যা ভেদের কারণ হতো, তাহলে ভেদের উৎপত্তি অবিদ্যার ক্রিয়ার ফলস্বরূপ হতো। কিন্তু ভেদকে অবিদ্যার কার্য বলা যায় না, কারণ অবিদ্যা জড় হওয়ায় কোনো কার্য সৃষ্টি করতে পারে না। জড় বস্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম।
২. গুণ-আধার সম্পর্ক: ভেদকে অবিদ্যার গুণ হিসেবেও দেখা যায় না, কারণ অবিদ্যা নিজেই একটি নিরাকার সত্তা, যা গুণ ধারণ করতে পারে না। গুণ সব সময় একটি আধারকে আশ্রয় করে থাকে।
৩. জ্ঞেয়-জ্ঞাপক সম্পর্ক: ভেদকে অবিদ্যার দ্বারা প্রকাশিত কোনো বিষয়বস্তু হিসেবেও দেখা যায় না, কারণ অবিদ্যা প্রকাশক্ষম নয়। অবিদ্যার নিজস্ব প্রকাশশক্তি নেই।
প্রকৃতপক্ষে, ভেদ যদি অবিদ্যার উপর নির্ভরশীল হতো, তাহলে আমরা অবিদ্যার আশ্রয়েই ভেদকে দেখতাম। কিন্তু বাস্তবে, ভেদের আশ্রয় হয় জীব অথবা ব্রহ্ম—অবিদ্যা নয়। অবিদ্যা কেবল ভেদের একটি আপাত কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়, কিন্তু সে নিজেই ভেদের আধার হতে পারে না। এই সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করে যে, অবিদ্যা জীব ও ব্রহ্মের মৌলিক ভেদের উৎস নয়, বরং একটি আরোপিত অবস্থা। ভেদটি অবিদ্যার কারণে প্রতীয়মান হলেও, এর বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
ভেদ ও নিষেধের দর্শন:
ন্যায়-শাস্ত্রে 'ভেদ' (difference)-কে মূলত একধরনের নিষেধ বা নেগেশন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। "নিষেধের" বা "অভাবের" (Absence) আলোচনা প্রধানত নৈয়ায়িকদের (Nyaya School) মধ্যে দেখা যায়। নিষেধকে বুঝতে গেলে এই দুটি ধারণা অপরিহার্য:
১. অনুযোগী (Anuyāyī) বা আনুযায়ী (Negatum/Counter-Correlate): যা নেই বা যার অভাব বোঝানো হচ্ছে, তাকেই 'অনুযোগী' বা 'আনুযায়ী' বলা হয়। এটি হলো নেগেশনের আশ্রয়। তাৎপর্য—এটি সেই বস্তু বা ধারণা, যা অনুপস্থিত। উদাহরণ: "টেবিলের উপর কলসি নেই।" এই ক্ষেত্রে, কলসিটি হলো আনুযায়ী (অনুযোগী), কারণ কলসিকেই নেগেট করা হচ্ছে বা এর অভাব ঘোষণা করা হচ্ছে।