অবিদ্যার প্রসঙ্গ: অদ্বৈত বেদান্ত বলে—ব্রহ্ম এক, অদ্বিতীয়, চিরন্তন। কিন্তু আমরা যে বহুবিধ কার্য-কারণের জগৎ দেখি, তা ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত নয়। তাহলে এই বহুবিধ কার্য-কারণের ধারা কোথা থেকে এল? উত্তর: অবিদ্যা (অজ্ঞতা) থেকে।
কার্য-কারণ সম্পর্ককে আমরা যেভাবে বুঝি, সেটাই আসলে অবিদ্যা-সৃষ্ট প্রতীতি। চূড়ান্ত সত্যে (পারমার্থিক স্তরে) কার্য-কারণ নেই, আছে কেবল ব্রহ্ম। কার্য-কারণ সম্পর্ক বোঝাতে গেলে শেষপর্যন্ত সেটিকে অবিদ্যার উপর ঠেকাতে হয়।
স্বপ্নে যদি দেখেন: এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনা ঘটছে (যেমন আগুনে ঘর জ্বলছে, মানুষ পালাচ্ছে)। স্বপ্নের ভেতরে কার্য-কারণ সম্পর্ক আছে। কিন্তু ঘুম ভাঙলে বোঝা যায়—আসলে এগুলো কোনো বাস্তব কারণ-কার্য নয়, অবিদ্যা/অজ্ঞতা থেকেই দেখা হয়েছিল।
“কার্য-কারণ সম্পর্কের স্বরূপ ব্যাখ্যাতীত—এটি শেষপর্যন্ত অবিদ্যায় পৌঁছে যায়”, মানে হলো: কার্য-কারণ সম্পর্ক আমরা জগতে অনুভব করি, কিন্তু যুক্তি দিয়ে তার চূড়ান্ত ভিত্তি খুঁজতে গেলে তা ধরা দেয় না। এই অমীমাংসিত অবস্থাকে অদ্বৈত বেদান্তে ‘অবিদ্যা’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থাৎ, কার্য-কারণের যে ধারাবাহিক জগৎ আমরা দেখি, সেটি আসলে ব্রহ্মের স্বরূপ নয়, অবিদ্যা-জাত প্রতীতি। সুতরাং, এই ব্যাখ্যাতীত জগতের কারণ হলো মায়া—যা নিজেও ব্যাখ্যাতীত। কার্য উৎপাদনের যে-“নির্মল সত্য” আমরা দেখি, সেটাই প্রমাণ করে, এটি মায়ারই কাজ।
এ থেকে প্রশ্ন ওঠে—কার্য কি বাস্তব, না অবাস্তব?
অদ্বৈতবাদ অনুযায়ী, কার্য বাস্তব নয়, কারণ এটি উপনিষদের কঠোর অদ্বৈত শিক্ষার বিরোধী। উপনিষদে বলা হয়েছে: “সবই এক, দ্বিতীয় কিছু নেই।” কার্যকে বাস্তব প্রমাণ করা যায় না। কারণ, উৎপাদনের পূর্বে কার্য হয়তো অস্তিত্বশীল (existent), অথবা অস্তিত্বশূন্য (non-existent)। যদি কার্য অস্তিত্বশূন্য হয়, তবে “খরগোশের শিং”-এর মতো অর্থহীন জিনিসও কার্য-কারণ দ্বারা উৎপন্ন হতে পারত। অবাস্তব জিনিস সর্বদা অভিন্ন (একই রকম); আর যদি অবাস্তব কারণ হতে পারে, তবে খরগোশকে শিং দেওয়া কেন সম্ভব হবে না, গরুর মতো?
অন্যদিকে, যদি কার্য অস্তিত্বশীল হয়, তবে কার্য-কারণের কোনো দরকারই থাকত না। কারণ কার্য তো আগেই ছিল। সেক্ষেত্রে কার্য আর ফল (consequent) হিসেবে থাকে না, তার প্রকৃতিই নষ্ট হয়ে যায়।
কেউ হয়তো বলতে পারেন—“কার্য আসলে নতুন কিছু নয়, কেবল পূর্বে-থাকা জিনিসের প্রকাশ (manifestation) মাত্র।” এক্ষেত্রে অদ্বৈতপক্ষের উত্তর হলো—এমনটা বললেও বিপদ থেকে মুক্তি নেই। কারণ প্রকাশ হওয়ার পূর্বে সেটি হয় অস্তিত্বশীল ছিল, নয় অস্তিত্বশূন্য। উভয় অবস্থাতেই একই সমস্যা এসে দাঁড়ায়।
অতএব, অদ্বৈতবাদীরা মেনে নেন—কার্য ব্যাখ্যাতীত (anirvacanīya)। এবং, সেক্ষেত্রে একমাত্র কারণ হলো—অবিদ্যা (Nescience, মায়া)। এটি ব্যাখ্যাতীত, চিরন্তন, আদি থেকে বিরাজমান এবং তার কার্যগুলোর মতোই একই স্বভাবসম্পন্ন; কারণ কোনো বাস্তব সত্তা কখনো অবাস্তবের কারণ হতে পারে না। সাধারণ অভিজ্ঞতাও এটিকে সমর্থন করে।
এখানে মূল শিক্ষা: এই জগৎ, যাকে আমরা কার্য বা সৃষ্টি হিসেবে দেখি, তা 'সত্যিকারের বাস্তব'ও নয় এবং 'সম্পূর্ণ অবাস্তব'ও নয়। বরং এটি 'অব্যাখ্যেয়'—এমন এক অবস্থা যা আমাদের বুদ্ধির দ্বারা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না, সংজ্ঞায়িত করা যায় না, বা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীতে ফেলা যায় না। এই অব্যাখ্যেয় কার্য-বিশ্বের একমাত্র কারণ হলো মায়া বা অবিদ্যা।
মায়া বা অবিদ্যাকে এক রহস্যময় শক্তি হিসেবে দেখা হয়, যা পরম সত্যকে আড়াল করে এবং বহুত্বের এই জগতকে প্রতিভাত করে। এটি এমন এক ভ্রম, যা আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু তা পরমার্থিকভাবে সত্য নয়। অবিদ্যার প্রভাবেই আমরা একত্বকে ভুলে দ্বৈত বা বহুত্ব দেখি, এবং নিজেকে জগতের অংশ হিসেবে বিবেচনা করি, যখন কিনা প্রকৃত সত্য ভিন্ন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, কার্য-কারণ সম্পর্ক এবং সৃষ্টিপ্রক্রিয়া মায়ারই এক খেলা, যা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দূরীভূত হয় এবং পরম সত্যের উপলব্ধি ঘটায়।
আপনি হয়তো আপত্তি তুলবেন—যদি অবিদ্যা একক হয়, তবে কীভাবে নানারকম কার্য (বস্তু-বিশ্ব) সৃষ্টি সম্ভব? এই আপত্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক, কারণ আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি যে, বহুবিধ কার্য-কারণের পেছনে বহুবিধ কারণ ক্রিয়াশীল থাকে। একটি একক সত্তা থেকে কীভাবে এমন বৈচিত্র্যময় জগতের উৎপত্তি হতে পারে, এই প্রশ্নটি গভীর দার্শনিক জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। যদি অবিদ্যাকে কেবল একটি শক্তি হিসেবে দেখা হয়, তবে তার কার্যক্ষেত্র কীভাবে এত ব্যাপক ও বহুধা বিস্তৃত হয়, তা নিয়ে সংশয় জাগা অত্যন্ত সংগত।
আমরা উত্তর দিই—আমরা আগেই দেখিয়েছি যে, অবিদ্যা এক হলেও তার বহুবিধ শক্তি (manifold powers) রয়েছে। এই বহুশক্তির বৈচিত্র্যের ফলেই বহুবিধ কার্য উৎপন্ন হয়। এই ব্যাখ্যাটি অদ্বৈত বেদান্তের একটি মৌলিক ভিত্তি। অবিদ্যাকে নিছক একটি নেতিবাচক ধারণা হিসেবে না দেখে এটিকে একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়, যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করে। ঠিক যেমন একটি রশিকে অন্ধকারে সাপ মনে হলেও, সাপের ধারণাটি রশির উপর আরোপিত একটি ভ্রম। কিন্তু এই ভ্রমের পেছনেও মন নামক একটি শক্তি কাজ করে। একইভাবে, অবিদ্যার একক সত্তা হলেও এর অন্তর্নিহিত নানা শক্তি বা সামর্থ্য রয়েছে, যা বহুবিধ নামরূপের প্রকাশ ঘটায়। এই শক্তিগুলো একে অপরের থেকে ভিন্ন হওয়ায় তাদের কার্যও ভিন্ন হয়, ফলস্বরূপ আমরা যে বৈচিত্র্যময় জগৎ দেখি, তার সৃষ্টি সম্ভব হয়। এই শক্তিগুলোকে বিভিন্ন উপাধি বা বিশেষণ হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে, যা অবিদ্যার মৌলিক একক সত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই বিভিন্ন প্রকাশের সুযোগ করে দেয়।
আপনি হয়তো আরও আপত্তি তুলবেন—তাহলে তো বেদের প্রারম্ভিক (কর্মকাণ্ড-সংক্রান্ত) অংশের কর্তৃত্ব অস্বীকার হয়ে যায়। বেদের কর্মকাণ্ড অংশে যজ্ঞ, যাগ, তপস্যা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মের বিধান দেওয়া হয়েছে, যা নির্দিষ্ট ফল প্রাপ্তির জন্য অপরিহার্য। যদি অবিদ্যাকে একমাত্র সত্য এবং জগৎকে মিথ্যা বলা হয়, তবে এই কর্মের প্রয়োজনীয়তা ও ফলপ্রাপ্তির ধারণাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই আপত্তি হিন্দুধর্মের মূলধারার সঙ্গে অদ্বৈত বেদান্তের সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। কর্মফল যদি অনিত্য হয় এবং জগৎ যদি মিথ্যা হয়, তবে কেন মানুষ কর্ম করবে? বেদের প্রারম্ভিক অংশের নির্দেশাবলী পালন করা কি তাহলে অর্থহীন? এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গভীর এবং এর উত্তর অদ্বৈত দর্শনের সামগ্রিক কাঠামো বোঝার জন্য জরুরি।
আমরা উত্তর দিই—না, আসলে এই অংশও ব্রহ্মবিদ্যার দিকেই পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করে। কারণ এতে শেখানো হয়েছে—যজ্ঞাদি নির্দিষ্ট ফল আনে, আর ওই ফলভোগ বা অনুশীলনের মাধ্যমে যজমানের বুদ্ধি শুদ্ধ হয়। এই বুদ্ধি-শুদ্ধিই তাকে ব্রহ্মবিদ্যা অধ্যয়নের উপযোগী করে তোলে। অতএব, বেদের কর্মকাণ্ডের কর্তৃত্বও আমাদের অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অদ্বৈত বেদান্তীরা এই আপত্তির জবাবে বলেন যে, বেদের কর্মকাণ্ড অংশ ব্রহ্মবিদ্যা লাভের সোপান বা পূর্বপ্রস্তুতি। তাৎক্ষণিকভাবে কর্মফল সত্য মনে হলেও, এই ফল ভোগ করার মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে জাগতিক সুখের অনিত্যতা উপলব্ধি করে।
যজ্ঞ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের চিত্ত শুদ্ধ হয়, বাসনা হ্রাস পায় এবং মন একাগ্র হয়। এই শুদ্ধ ও একাগ্র চিত্তই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য অপরিহার্য। কর্মফল মানুষকে জাগতিক ভোগ থেকে মুক্তি দিয়ে আত্মানুসন্ধানের পথে চালিত করে। সুতরাং, বেদের কর্মকাণ্ড অংশ সরাসরি ব্রহ্মবিদ্যা না শেখালেও, এটি ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য অনুকূল ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এটি কোনোভাবেই তার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে না, বরং তার গুরুত্বকে একটি বৃহত্তর আধ্যাত্মিক পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপিত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, কর্মকাণ্ড হলো সাধনচতুষ্টয় (বিবেক (viveka)—সত্য-অসত্যের বিচার, বৈরাগ্য (vairāgya)—অনিত্য বস্তুতে আসক্তিহীনতা, শমাদি ষট্সম্পত্তি (ṣaṭ-sampatti)—ছয়টি মানসিক শৃঙ্খলা, মুমুক্ষুতা (mumukṣutva)—মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা)-এর একটি অংশ, যা মোক্ষ লাভের জন্য আবশ্যক।
অতএব, অবিদ্যা-কারণতত্ত্ব মেনে নিয়েও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে; যেমন দড়িতে সাপ কল্পিত হয়, মুক্তার খোলসে রুপা কল্পিত হয়, মরীচিকায় জল কল্পিত হয়, স্বপ্নে জগৎ কল্পিত হয়, তেমনি অবিদ্যা-প্রদত্ত এই বিশ্ব শুধু জ্ঞান-উপস্থিতির সময়েই থাকে। অর্থাৎ—জগতের অস্তিত্ব জ্ঞানের সঙ্গে সমকালীন (cotemporaneous)। এখানে অদ্বৈত বেদান্ত তার মৌলিক অবস্থান পরিষ্কার করছে। জগৎকে ‘সদসৎ অনির্বচনীয়’ বলা হয়—অর্থাৎ একে পুরোপুরি সৎ বা সত্যও বলা যায় না, আবার পুরোপুরি অসৎ বা মিথ্যাও বলা যায় না। এটি এমন এক সত্তা, যা আমাদের অজ্ঞতার ফল। যেমন, অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হয়, কিন্তু আলো জ্বালালে সেই ভ্রম দূর হয়। সাপ তখন আর থাকে না, কিন্তু দড়ি তার নিজস্ব রূপে বর্তমান থাকে। সাপের অস্তিত্ব দড়ি থেকে ভিন্ন নয়, এটি কেবল দড়ির উপর আরোপিত একটি ভ্রম। একইভাবে, মুক্তার খোলসকে রূপা, মরীচিকাকে জল এবং স্বপ্নকে জগৎ হিসেবে উপলব্ধি করা কেবল জ্ঞানের অভাবে হয়। যখন জ্ঞান হয়, তখন এই আরোপিত বস্তুর অস্তিত্ব বিলীন হয়।
এই দৃষ্টান্তগুলো দেখায় যে, যা-কিছু কল্পিত, তা কেবল সেই কল্পনার সময় পর্যন্তই সত্য। যখন জ্ঞান বা উপলব্ধি আসে, তখন সেই কল্পনা বিলীন হয়। জগৎও অবিদ্যার কারণে কল্পিত, তাই এটি কেবল ততক্ষণই বিদ্যমান থাকে, যতক্ষণ আমাদের অজ্ঞতা থাকে। যখন ব্রহ্মজ্ঞান উদয় হয়, তখন জগতের এই পৃথক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং শুধুমাত্র ব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন। এটা “জ্ঞান-উপস্থিতির সময়েই থাকে”, কথাটির অর্থ হলো, জগতের অস্তিত্ব আমাদের উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল। এটি জ্ঞান থেকে স্বাধীন কোনো বাস্তব সত্তা নয়।
এখানে একটি মৌলিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন: প্রচলিত কোনো প্রমাণ (pramāṇa)—যেমন প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ ইত্যাদি—দ্বৈত জগতকে প্রমাণ করতে পারে না। যদি আপনার বক্তব্য হয়—“অস্তিত্ব মানে কেবলই প্রতীতি; sattvam prātītikam, অর্থাৎ esse = percipi।” তাহলে আমি আপনার অবস্থান মেনে নিই—কারণ এটি আমার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী নয়। কিন্তু যদি বলেন—“বিশ্বের অস্তিত্ব ও তার জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য আছে।” তাহলে অনুগ্রহ করে সেই পার্থক্যের প্রমাণ দেখান। এখানে স্পষ্ট হলো—অদ্বৈত বেদান্তের মতে, বিশ্ব-অস্তিত্ব আর তার জ্ঞান আলাদা নয়। বিশ্ব আছে, কারণ তাকে উপলব্ধি করা হচ্ছে। উপলব্ধির বাইরে কোনো আলাদা “সত্যিকারের বিশ্ব” নেই। যদি কেউ বলেও যে, জগতের অস্তিত্ব জ্ঞানের বাইরে স্বাধীন, তবে তাকে প্রমাণ দিতে হবে—যা কোনো প্রমাণপদ্ধতি দিতে সক্ষম নয়।
এই অনুচ্ছেদ অদ্বৈত বেদান্ত জ্ঞানতত্ত্বের একটি গভীর আলোচনা উত্থাপন করেছে। সাধারণত, আমরা প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ (শাস্ত্রবাক্য) ইত্যাদির মাধ্যমে সত্যকে জানি। কিন্তু অদ্বৈত মতে, এই প্রমাণগুলো দ্বৈত জগৎকে তার সত্যরূপে প্রমাণ করতে পারে না। যদি কেউ স্বীকার করে যে, “অস্তিত্ব মানে কেবলই প্রতীতি’ (esse = percipi), অর্থাৎ যা উপলব্ধ হয়, তাই অস্তিত্ব-শীল”, তবে অদ্বৈত বেদান্ত সেই অবস্থানকে মেনে নেয়। কারণ এটি অদ্বৈতের এই মূল ধারণাটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, জগতের অস্তিত্ব জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু যদি কেউ দাবি করে, বিশ্ব ও তার জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য আছে এবং বিশ্বের একটি স্বাধীন অস্তিত্ব আছে, তবে অদ্বৈতী সেই দাবির সপক্ষে প্রমাণ চান। এই প্রমাণ কিন্তু কোনো প্রচলিত প্রমাণ (প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি) দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ, যখন আমরা একটি বস্তুকে প্রত্যক্ষ করি, তখন বস্তুটি এবং বস্তুর জ্ঞান একই সময়ে উৎপন্ন হয়। আমরা কি কখনও জ্ঞানের বাইরে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি?
অদ্বৈত বেদান্তের মূল বক্তব্য হলো, বস্তুর অস্তিত্ব তার জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। আমরা জগৎকে জানি, তাই জগৎ আছে। যদি কেউ জগৎকে না জানত, তবে তার কাছে জগতের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। “উপলব্ধির বাইরে কোনো আলাদা ‘সত্যিকারের বিশ্ব’ নেই”, এই বাক্যটি অদ্বৈতের মূলকথা। এই কারণে, অদ্বৈতীরা বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ এর পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই।