আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। পরবর্তীতে নানান সময়ে আলাপের সূত্রে তিনি একসময় আমার বন্ধুস্থানীয় (বন্ধু নয়) হয়ে ওঠেন। সেই পরিচয়ের অধিকারে তিনি মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের দাপ্তরিক সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। কোথাও ফোন করে বলে দেওয়া, কাস্টমস-ভ্যাট সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক পথটি বাতলে দেওয়া; এ ছাড়াও সরকারি বিবিধ সেবাগ্রহণ বিষয়ে তাঁকে এবং তাঁর পরিচিত লোকজনকেও যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি সময়ে সময়ে... বিনা স্বার্থে, কেবলই সম্পর্কের খাতিরে।
গতকাল খেলা চলাকালীন আমি অভ্যাসবশত নিছকই মজা করে করে বিভিন্ন সার্কাস্টিক পোস্ট দিচ্ছিলাম; সেগুলি দেখে সেই ভদ্রলোক আমাকে ইনবক্সে নক করে যারপরনাই খারাপ আচরণ করেন এবং আমার বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। আমার কোনও পোস্টেই আমি তাঁকে নিয়ে কিছুই বলিনি, অথচ তিনি ওগুলিকে পার্সোনালি নিয়ে নিলেন এবং আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে বসলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি আমার বন্ধু নন, বন্ধুস্থানীয় মাত্র। ওইটুক জায়গায় থেকে তিনি কোন মাত্রাজ্ঞানে আমার সাথে অমন আচরণ করলেন, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমার পোস্টের কনটেক্সট ও কনটেন্ট নিয়ে যা ইচ্ছে বলুন, নিজেকে প্রাসঙ্গিক অবস্থানে রেখে পারলে আমার লেখাকে একদম ধুয়ে দিন; মননশীলতার ওরকম সুস্থ চর্চা আমার বরং ভালো লাগে। কিন্তু যখন কেউ আমার পোস্ট দেখে আমাকে জড়িয়ে বা আমাকে আক্রমণ করে কিছু বলে, তখন তা খুবই অগ্রহণযোগ্য ও দৃষ্টিকটু ঠেকে। এর কারণ, যাকে আমি চিনিই না, যাকে উদ্দেশ্য করে আমি কিছুই লিখিনি, সে-ও কোন যুক্তিতে আমাকে আক্রমণ করে কথা বলে, তা আমার মাথায় আসে না। অবশ্য তা না করে কথা বলতে গেলে মাথায় কিছু হলেও ঘিলু থাকা লাগে।
ভাবছি, আর্জেন্টিনার সেই পাঁড় সমর্থক ভদ্রলোক যদি আর কখনও কোনও হেল্প চেয়ে ফোন করেন, তবে তাঁকে বলব, ফোনটা আমাকে না করে মেসিকে করলেই বরং ভালো হয়।
এ কী নচ্ছার আবেগ, যার জন্য মানুষ ব্যক্তিগত সম্পর্কও নষ্ট করে দেয়! তা-ও যদি সেই ভদ্রলোকের আত্মীয়-পরিজন কিংবা তাঁকে নিয়ে কিছু বলতাম, তাহলেও একটা কথা ছিল! এ জীবনে কখনোই এমন কাউকে নিয়ে একটাও বাজে শব্দ উচ্চারণ করিনি বা লিখিনি, আমি পরবর্তীতে যার আক্রমণের শিকার হয়েছি। আমাকে যারাই আক্রমণ করেছে, তাদের সবাই-ই বিনা ব্যক্তিগত উস্কানিতে কাজটা করেছে। বড়ো অদ্ভুত জিনিস এই বাঙালি জাতি! পুরো দুনিয়া ঘুরেও এমন খাঁটি আবেগের ডিব্বা মাত্র এক পিসই পাবেন! আমাদের ঘিয়ে-মধুতে ভেজাল থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের আবেগ পুরোটাই... পিউর পিউর হানড্রেড পার্সেন্ট পিউর!
একটা দুঃখের খবর জানাই। ওয়েস্টার্ন মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড-এ কর্মরত সাগরিকা ইয়ার্ড-এর ক্লিনার জনাব স্বপন দাশ, মেসি প্রথম গোলটি দেওয়ার পর অতিরিক্ত খুশিতে চিৎকার করতে করতে হঠাৎ, হার্টঅ্যাটাক করে মারা যান। (সংগত কারণেই, অফিশিয়াল তথ্যবিজ্ঞপ্তিতে খেলার বিষয়টি আসেনি। ওই প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার স্কুলফ্রেন্ড, ওর কাছ থেকেই পুরো ঘটনা জেনে লিখছি।) ৫৫ বছর বয়সি এ দরিদ্র আবেগি ভদ্রলোক মৃত্যুর সময় স্ত্রী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে গেছেন... মেসির কাঁধে নয়, ক্ষুধার মুখে। তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব মেসি নেবেন না... নেবার প্রশ্নই আসে না কোনও যুক্তিতেই; কে নেবেন, তা আমরা জানি না, যেমনটা তিনি নিজেও জানতেন না। পরিবারের কর্তার এমন আকস্মিক মৃত্যু---স্ত্রী-পুত্র-কন্যা'র সারাজীবনের কান্না, আমাদের কাছে স্রেফ একটা তথ্যবিজ্ঞপ্তি, বিশ্বকাপ জয়ীদের কাছে... ঘটনার সাথে যোগসূত্রহীন শ্যাম্পেনের আরেকটা অপাপবিদ্ধ নতুন বোতল! Some celebrate life, some embrace death... on the same occasion!
বেঁচে থাকার চাইতেও জরুরি ও প্রাসঙ্গিক এ পৃথিবীতে আর কী হতে পারে!!!
কারও হুঁশ ঠিক, মাথা খারাপ; কারওবা হুঁশ ও মাথা দুই-ই খারাপ! সেই আবেগের সাথে নিরাবেগ বোঝাপড়া করতে জানাটা খুবই জরুরি, যে আবেগ এক আনন্দ বাদে আর কিছুই দেয় না। নির্বোধের ব্যর্থতায় কিংবা মৃত্যুতে এ পৃথিবীর কখনোই কণামাত্রও আন্তরিক অনুশোচনা হয় না।