বিশ্বাসে মেলায় বস্তু . . .

শাস্ত্র বলছেন, ভগবান আলোর মতন। তাঁকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। ভগবানের গায়ে কোনো হাড়-মাংস নেই, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। তাঁকে জানাও যায় না, কেবলই অনুভব করা যায়—তা-ও অনেক চেষ্টা করার পর। নিরক্ষর গরিব মানুষ কি আর এসব জানেন বা বোঝেন! তাঁর কাছে তো ভগবান বন্ধুর মতন, রক্তমাংসের মানুষের মতন।

এমনই এক কৃষক খুব অস্থির হয়ে আছেন কয়েক দিন ধরে। বার বারই বলছেন, হে ভগবান! তুমি কোথায়? সামনে আসো, আমাকে তোমার সেবা করতে দাও। আমি তোমার চুলে একটু সুগন্ধি তেল লাগিয়ে দিই, আমি তোমার গা-কোমর-পা টিপে দিই। তুমি দেখা না দিলে, তোমাকে ধরতে-ছুঁতে না পারলে আমি তোমার সেবা করব কীভাবে?

একজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ওই পথে যাবার সময় কৃষককে ওসব বলতে শুনলেন। তিনি কৃষকের কাছে গিয়ে বললেন, এসব কী বলছ? পাগল হয়ে গেছ? এসব বললে পাপ হয়! তুমি তো নরকে যাবে! ভগবানের কোনো চুল নেই, তাঁর তেলের দরকার হয় না। তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি তাঁকে ছুঁতে চাও! ভগবানের গা টিপে দিতে চাইছ কোন আক্কেলে, বলো তো? এমন ইচ্ছে মনে আসাও যে পাপ! তোমার কি পাপের ভয় নেই? তাঁর জ্যোতি দূর থেকে হয়তো একটুখানি টের পাওয়া যায়, সেটাও খুব পুণ্যাত্মা না হলে পাওয়া যায় না। এর চেয়ে বেশি কাছে কেউ কখনও যেতেই পারে না। তোমার এই পাগলের প্রলাপ বন্ধ করো!

গরিব নিরক্ষর কৃষক এত কথা বুঝলেন‌ই না! তিনি আগের মতোই ভগবানকে কাছে পাবার জন্য পাগলামি করেই চলেছেন। অত জ্ঞানের কথা তাঁর কানে ঢোকেইনি।

কৃষকের উপর খুবই বিরক্ত হয়ে পণ্ডিতজি আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, কে যেন তাঁর ঘরে এসে তাঁকে বলছেন, তুমি আজ আমার ভক্তকে এত বকলে কেন? তোমাদের অত জ্ঞানে আমার একটুও তৃপ্তি হয় না। তোমরা আমাকে জানো, কিন্তু চেনো না। আমার ওই ভক্ত আমার সেবা করার জন্য এত অধীর হয়ে আছে, আর তুমি কিনা তার সমালোচনা করতে বসে গেলে! হাজারো শাস্ত্র পড়েও তোমাদের ভেতরে এসেছে কখনো আমার প্রতি অমন প্রেম, সরল ব্যাকুলতা? তুমি আমার সত্যিকারের ভক্তকে মায়াজ্ঞানে বিভ্রান্ত করতে চাইছ কেন?

যাঁরা উপাসনার সাকারত্ব (সবিকল্পত্ব) আর নিরাকারত্ব (নির্বিকল্পত্ব) নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেন, তাঁদের জন্য‌ই উপরের গল্পটা। আপনিই বলুন, ঈশ্বরকে একান্ত নিবিড়ভাবে অনুভব করছেন কে? শাস্ত্রবেত্তা পণ্ডিত, না কি নিরক্ষর কৃষক? আমরা কেবলই বিচার করি আর আচার মানি, আমাদের এমন সরবতা দেখে ভগবান নীরবতায় লুকিয়ে থাকেন। পণ্ডিত ঈশ্বরকে জেনেছেন, কৃষক ঈশ্বরকে পেয়েছেন।

কৃষক যেখানে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছেন, পণ্ডিত সেখানে পৌঁছনোর রাস্তা জানছেন সবেমাত্র। রাস্তা কি কেবল একটাই? গুগলম্যাপে কেবলই রাস্তার ম্যাপ আছে, রাস্তা নেই।