বাসি আঁজলাভরা জল

জানো, আজকাল আমি ভীষণ চুপ হয়ে গেছি।
রোজ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে আরেকটা রোদেলা দিন দেখে
আমি আর আগের মতো চনমনে হই না;
কুয়াশার মতো টুপ করে পড়ে,
ভোর হতে না হতেই রোদের ভাঁজে মিলিয়ে যাই। 




আমার আকাঙ্ক্ষাগুলো
আমাকে আর বেঁচে থাকার তাগিদে, স্বপ্নগুলো ছুঁয়ে দেখার আকুলতায়
ছোটায় না…
যেন আমার কোথাও যাবার নেই, 
আমি গন্তব্যহীন শান্ত এক নদী।




হুটহাট সাজগোজ, অকারণে বাইরে বেরিয়ে পড়া, পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা, একটা-কিছু শখের কেনাকাটা, রোজ নতুন নতুন পোশাক, শাড়ি-চুড়ি-জিনস-টপস কিছুই আর ভালো লাগে না—
ক্লান্তির মোড়কে হারিয়ে গেছে আমার সব!




এত জলদি আমি এমন হব জানা ছিল না, 
আটপৌরে একঘেয়ে জীবন আমার কোনোদিন ভালো লাগত না…কোনোদিনই না।
আমি চাইতাম ঝুমবৃষ্টিতে রিকশার হুড ফেলে শহরজুড়ে ভিজে বেড়াতে,
বিশেষ দিনগুলো এলেই ইচ্ছে হতো, আজ যে করেই হোক, শাড়ি পরে বেরোতে হবে,
শপিংমলে ঢুকলেই নতুন নতুন টিশার্টের দিকে চোখ যেত,
আমার প্রিয় ড্রেসকোড ছিল জিনস-টিশার্ট,
বাইরে বেরোলে আইসক্রিম ছাড়া কিছুতেই চলত না…
আর এখন আমার এসব ছাড়াই দিব্যি কেটে যায়!




আজকাল ভীষণ গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে, 
নিজের একান্ত গণ্ডিতে খোলসের মধ্যেই ভালো লাগে, 
অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কথা…একদমই নয়,
তার থেকে বেশি বিরক্ত লাগে ধান্দাবাজ মানুষ।




একটা সময় ভাবতাম, আমার অনেক অনেক কাছের মানুষ আছে। অথচ দিনশেষে একে একে সবাইকে চেনা হয়ে গেল—
স্বার্থ ছাড়া বাবা-মা'ও পর হয়ে যায়!
এজন্যই সবার অলক্ষে নিজের চারপাশে উঁচু দেয়াল তুলে নিয়েছি আমি।
অবশ্য, এখন নিজেকে নিয়ে শান্তিতেই থাকি।




স্বার্থপর মানুষগুলোর সাথে যত কম ওঠ-বস করা যায়, ততই ভালো।
আমার আসলে কারও কাছে তেমন কোনো স্বার্থ নেই,
স্বার্থ নিয়ে কারও সাথে মিশিও না।
একজন মানুষ হিসেবে অন্যের দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করে যদি মনে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার সামর্থ্য কিংবা সাধ্য আমার থাকে,
তখন বিনা স্বার্থে সেটুকুই করি, যেটুকু করলে নিজের কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু তার বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করি না—
এমনকি ধন্যবাদটুকুও না।




আমি এখন জানি, মানুষ স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে কত দ্রুত অচেনা হয়ে যায়!
স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে কত দ্রুত মানুষ অকৃতজ্ঞ এবং ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে,
আমি সেসব জানি এখন।




আমার আসলে আজকাল আর কাছের বলে কেউ নেই,
আমার কোনো আত্নীয় নেই, কিন্তু আমি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করিনি কখনও।
আমি শুধু ওদের সবাইকে ভয় পাই,
ওদের কাছে গেলেই আমার শান্তিটুকু শেষ হয়ে যাবে,
আমি ওদের কারও কাছেই কিচ্ছু চাই না;
শুধু চাই, ওরা আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দিক।




জীবনের পথে চলতে চলতে একটা সময় এর মানে বদলে যায়।
একসময়ের খুব আকাঙ্ক্ষার কিছু হঠাৎ করেই ম্লান হতে থাকে, 
চাহিদার অঙ্কটা ছোটো হয়ে আসে,
ভরসার জায়গাগুলো নড়বড়ে হয়ে যায়।




তখন মানুষ দু-চোখ এক করে শুধু কিছু  মানুষের মতো মানুষ খোঁজে,
নিজের চারপাশটায় এমন মানুষ খোঁজে, যারা বিপদ এলে অচেনা হবে না কিংবা অন্যের সুখে হিংসে করে ক্ষতি করবে না;
জীবনের হিসেবগুলো তখন ঠিক এমনভাবে বদলে যায়,
যেন একটা যুগ ধরে নিজেকে আজকের জন্যেই গুছিয়েছি।




এখন আর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয় না, 
ভুলে-যাওয়া স্মৃতিগুলো বেশি খুব মনে পড়ে না,
কোনো প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তির আক্ষেপ নেই, 
হৃদয়ে এমন কোনো ব্যথা কিংবা অভিমান নেই, যার ভার বয়ে বেড়াতে কষ্ট হয়;
নিজের ক্ষুদ্রতায় আক্ষেপ নেই, 
কোনো এক মায়াজড়ানো চাহনি আজ অস্পষ্ট, 
জীবনের হিসেব মেলাতে বসি না কখনও, 
নিজেকে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখতে ভালো লাগে ভীষণ!




মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে, আমি এভাবে এত দ্রুত কেন এগুচ্ছি?
আমার সময়গুলো কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে?
আমি কি খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি?




অবশ্য, সেসব নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই।
যার কোনো পিছুটান নেই, সে সবসময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে;
আর যা-ই হোক, অন্তত মৃত্যুর ভয় সে করে না।
জীবনে যখন নিজের জন্য না হলেও অন্য কারও জন্য বেঁচে থাকাটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তখনই তো মানুষ মৃত্যুভয় পায়!




জীবন জানে, জীবনশেষেও জীবনের কোনো মৃত্যু নেই।
জীবন একেবারে শান্ত, স্থির, বহমান।
জীবনের মানে এক জীবন বাদে আর কিছু নয়।




আজ ছাই হয়ে গেল জোনাকপোকার দল,
জমা হলো বাসি আঁজলাভরা জল।