বাংলায় লেখা: চার

৪১। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির একটি বিধি: "নিত্যবর্তমানকালে নিয়মিত অভ্যস্ত ঘটনা বোঝাতে ক্রিয়ায় অ-কারান্ত: তুমি কোন কাগজ পড়? এইরকম শোন, ভাব, কাট।" তবে এই রীতিতে 'বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো'-তে 'বিহার' লিখতে গিয়ে বেশ ধাক্কা খাচ্ছি।
কথা সেটা নয়। প্রশ্ন হলো, ওই নিয়মের বিবৃতি কি একটা সামগ্রিক বিবৃতি বলে ধরতে পারি? যদি নিত্যবর্তমানকালে তুমি-পক্ষে ও-বিভক্তি বর্জন করে অ-বিভক্তি করতে চাই, তাহলে সব ক্ষেত্রে তা খাটবে তো? কারণ দেখতে পাই, সিদ্ধ ধাতু স্বরান্ত হলেই ও-বিভক্তির প্রয়োজন হচ্ছে, যেমন আমি জানি, তুমি ভিক্ষা দাও। আবার, ধাতুটি সাধিত ধাতু হলেও তাতে ও-বিভক্তি লাগছে, যেমন, তুমি যে ছাত্রদের পড়াও, ইত্যাদি। তাহলে তুমি-পক্ষের একমাত্র ব্যঞ্জনান্ত ধাতুর ক্ষেত্রে ও-বিভক্তি বর্জন করব কেন? বিভক্তির একরূপণে (neutralization) এখানে অসুবিধে কোথায়?
যেখানে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা, সেখানে ও-কার দেওয়া যেতেই পারে। বাংলা আকাদেমির বানানরীতিতে লেখার দিক থেকে অ-বিভক্তি ধরা হয়েছিল, কারণ অন্যরা ওটাকে উচ্চারণ অনুযায়ী ও-বিভক্তি বলতে চাননি। যা-ই হোক, বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকলে উচ্চারণ অনুযায়ী লেখা নিশ্চয়ই উচিত।
তাই আমরা তুই-অর্থে না হলে অ-কারান্ত রেখে না দিয়ে 'ও-কার' দেবো। তুই এটাই কর। তুমি এটাই করো। এমনকি নিত্যবর্তমানকালেও তা-ই করব।




৪২। এমনকি আর এমন কী-এর তফাত মনে রাখবেন। 'এমনকি', এই বানানে 'হ্যাঁ-না' প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত। 'মেসি গোল করেছে?' 'হ্যাঁ, এমনকি মেসিও গোল করেছে।' আর 'এমন কী' আর 'কী এমন' একই ব্যাপার--'কী এমন ভালো খেলল কে কে আর?' এমনকি মহেশবাবুর মতো গোমড়ামুখো লোক পর্যন্ত হেসে ফেললেন। এমন কী ঘটল যে তুমি সেদিন সভায় আসতে পারলে না? এই দুটি উদাহরণে পার্থক‍্যটি পরিষ্কার।
একই কথা 'বই-কি' সম্পর্কেও প্রযোজ‍্য। 'বইকী' হবে না। 'সে যাবে বই-কি!'
'বই কী' হতে পারে, না লাগিয়ে। তবে তার প্রয়োগ আলাদা। 'গুরুর কথা অমান‍্য করেছি, ব‍্যর্থতা বই কী আর আমার প্রাপ‍্য হবে!' যদি অব্যয় না সর্বনাম, সে নিয়েও দ্বিধা থাকে, যদি হ্যাঁ/না প্রশ্নটাও না করা যায়, যেমন এই এমনকি/এমন-কী প্রসঙ্গে, তখন বিকল্প হিসাবে দেখুন ব্যবহারে কোন বর্ণের ওপর জোর পড়ছে। যেখানে কী-র ওপরে জোর, নির্দ্বিধায় ঈ লাগান। 'এমনকি মহেশবাবুর' উদাহরণে এমনকি শব্দে জোর পড়ে এ (উচ্চারণে অ্যা)-তে, তাই ক-এ হ্রস্ব-ই। 'এমন কী ঘটল'-তে কী-এর ওপরেই জোর, তাই ক-এ দীর্ঘ-ঈ। 'সে যাবে বই-কি' বাক্যেও বই-কি-র (উচ্চারণে বোইকি) বো-এর ওপর জোর, তাই কি-তে হ্রস্ব-ই। 'ব্যর্থতা বই কী আর আমার প্রাপ্য'-তে 'বই কী' অংশে 'কী'-এর ওপর জোর, কাজেই দীর্ঘ-ঈ।
'এমন-কি' আর 'বই-কি' আমি হাইফেন দিয়ে লেখার পক্ষপাতী, (যদিও প্রথমটি হাইফেন ছাড়াই 'এমনকি' লেখা প্রমিত) কারণ 'কি' অব্যয়টি যুক্ত হয়ে 'এমন' আর 'বই' শব্দদুটির প্রচলিত অর্থ পালটে দিয়েছে। 'এমন কী' আর 'বই কী' আমি আলাদা করেই লিখব, কারণ এখানে এরা আলাদা শব্দ, ফলে 'এমন' ও 'বই'-এর চালু মানে বজায় আছে। প্রশ্নবোধক সর্বনাম হিসেবে 'কী'-ই তখন ক্রিয়ার কর্তা। তা যদিও ঠিক, আধুনিক বানানে বাহুল্যবর্জন ও পরিমিতির অজুহাতে পাংচুয়েশনের ওপর কোপ-বৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান।
হইল থেকে যে হল>হলো, তাতে আর ঊর্ধ্বকমা লাগে না। হাইফেনের ব্যবহার কি তেমন দেখা যায় আজকাল? তবে এমনকি, বইকি লিখলে অসুবিধে কী? সবাই আমার মতো হাইফেন-এর পক্ষপাতী না-ই হতে পারেন। সারূপ্যের সংকট এড়াতে হাইফেন, যেমন আপনি 'না-ই' বা 'তা-ই' লেখেন। এই রীতিতে 'দুঃখের তিমিরে' গানের ধুয়োটাকে লিখতে হবে 'তবে তা-ই হোক'।




৪৩। বাংলায় বড়োহাতের অক্ষর নেই বলে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যকে বিভক্তি থেকে আলাদা রাখতে হাইফেন, যেমন, 'রবীন্দ্রনাথ চতুরঙ্গ-এ দেখিয়েছেন'। নামের বিভক্তিহীন রূপটা বোঝানো এখানে উদ্দেশ্য। বিদেশি নাম হলে তো ব্যাপারটা জরুরি, যেমন, 'কান্ট-এর দর্শন'। কিছু কিছু দ্বন্দ্ব সমাসেও হাইফেন। হাইফেনের (বা হাইফেন-এর) উপযোগিতার শেষ নেই। সুনীতিকুমার তো হাইফেন এত পছন্দ করতেন যে 'ভাষা-প্রকাশ'-এর মতো শব্দেও হাইফেন দিয়েছেন।




৪৪। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়-এ 'ঘোড়া দৌড়িতেছে' দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমরা দৌড়িতেছে বলি না, বলি দৌড়াইতেছে।
আর সে জন্যেই অবাক হওয়ার ব্যাপারটা আরও বেশি। আমি করি, পরি, পড়ি, লড়ি, গড়ি, মরি, সরি (সরে যাই), চড়ি, নড়ি, ধরি, ভরি, হরি (হরণ করি); কিন্তু দৌড়ি না, দৌড়াই।
তুলনা করা যাক অন্য কিছু ক্রিয়ার সঙ্গে। আমি মাখি এবং আমি মাখাই, দুটোর মানে আলাদা। তেমনি পড়ি ও পড়াই, সরি ও সরাই, চড়ি ও চড়াই। এখানে প্রথমটা নিজের ওপর প্রযুক্ত ক্রিয়া, দ্বিতীয়টা অন্য কারও ওপর। আমি নিজে পড়ি, অন্যকে পড়াই; নিজে চড়ি, অন্যকে চড়াই। অথচ দৌড়ানোর সময় তো নিজেই দৌড়াই, অন্যকে দৌড় করাই।
কেন? দৌড়ানো কি তবে নামধাতু? দৌড় নামপদ থেকে দৌড়ানো ধাতু?
মনে হচ্ছে তা-ই। অথচ দৌড়ানো একটা অতি প্রয়োজনীয় ক্রিয়া, তার একটা নিজস্ব বাংলা ধাতুরূপ থাকবে না, তা কি মেনে নেওয়া যায়? সংস্কৃতে করতি, খাদতি, গচ্ছতি, হসতি-র পাশাপাশি ধাবতি একইভাবে বিদ্যমান। হিন্দিতে যেমন ম্যায় করুঙ্গা, মরুঙ্গা, খাউঙ্গা, তেমনি ভাগুঙ্গা। কাজেই বাংলায় আমি দৌড়ি, তুমি দৌড়ো, তুই দৌড় ইত্যাদি হওয়াই উচিত।
আর সেজন্যেই ঘোড়া দৌড়িতেছে হওয়ারই কথা। (আমি চলি। সে ‘চলি’তেছে। আমি দৌড়ি। ঘোড়া ‘দৌড়ি’তেছে।)
বিদ্যাসাগর ‘দৌড়িতেছে’ লিখেছিলেন, অথচ সাধারণভাবে ‘দৌড়াইতেছে’ লেখাই প্রচলিত রীতি। কেন? ক্রিয়াপদের রূপ থেকে মূল ধাতুটিকে নিষ্কাশন করার একটি সহজ উপায় নির্দেশ করেছিলেন যোগেশচন্দ্র। উত্তম পুরুষের নিত্যবৃত্ত বর্তমান কালের ক্রিয়ারূপ থেকে শেষের ‘ই’-টি বাদ দিলে যা থাকে, তা-ই মূল ধাতু। যেমন আমি পড়ি। (পড়ি থেকে ‘ই’ বাদ দিলে থাকে পড়্ অর্থাৎ √পড়্); আমি পড়াই (পড়াই থেকে ‘ই’ বাদ দিলে থাকে পড়া অর্থাৎ √পড়া)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আলোচ্য মূল ধাতুটি কী? √দৌড়্, না √দৌড়া?
হরিচরণ দেখলাম। এটি একটি অকর্মক বাংলা ধাতু। √দৌড়্ যেমন হয়, বিকল্পে √দৌড়া-ও হতে পারে। দুটি ধাতুরই দ্যোতিত অর্থ ছোটা, ধাবিত হওয়া। সংসদও দেখলাম একই কথা লিখেছেন। সেখানে ‘ঘোড়া দৌড়িতেছে’ এবং ‘ঘোড়া দৌড়াইতেছে’ – ঠিক এই দুটি বাক্যই দেওয়া আছে উদাহরণস্বরূপ। দুটি রূপেই ক্রিয়া এখানে অকর্মক।
বাংলায় সাধিত প্রকরণ ণিজন্ত দিয়ে হয় না, মূল ধাতুর সঙ্গে ‘আ’ প্রত্যয় লাগিয়ে আমরা প্রযোজক ধাতু গঠন করি। যেমন - √কর্>√করা, √পড়্>√পড়া, √হাস>√হাসা, √সাজ>√সাজা। করিতেছে, করাইতেছে; সাজিতেছি, সাজাইতেছি। আমাদের আলোচ্য ধাতুটিকে রাজশেখর ‘দৌড়া’-ই বলেছেন। তাঁর মতে এটি তাঁর নির্দেশিত বৌবা-গণীয় ধাতু। কিন্তু ধাতুরূপ দেখানোর সময়ে তিনি লিখেছেন – বৌবা-গণীয় √দৌড়া বিকল্পে বৌব্-গণীয় হয়; অর্থাৎ √দৌড়্ । তখন এই রূপটি অণিজন্ত এবং কেবল সাধুরূপ হয়। ‘দৌড়িতেছে’ থেকে চলিত রূপ হওয়া উচিত ‘দৌড়ছে’। যেমন করিতেছে>করছে, দেখিতেছে>দেখছে, শুনিতেছে>শুনছে।
কিন্তু ‘দৌড়ছে’ চলিত বাংলায় সিদ্ধ শব্দ নয়। অন্যদিকে √দৌড়া-র সাধু ও চলিত দুটো রূপই হয় - সে দৌড়াইতেছে>দৌড়চ্ছে। কখনও কখনও ণিজন্ত প্রযোগও হয়। সে ঘোড়াকে দৌড়াইতেছে>দৌড়চ্ছে। তবে আধুনিক বাংলায় ণিজন্ত অর্থ বোঝাতে আমরা √দৌড়া ধাতুটি ব্যবহার না করে সংযোগমূলক যৌগিক ধাতুই ব্যবহার করি। যেমন, আমাকে দৌড় করিয়ে কী লাভ তোমার?




৪৫। ‘করো/কোরো’ বিষয়ে একটা জিনিস লক্ষ করেছি। করো, বলো, লেখো, ওঠো, দাও, খাও… এসব হলো বর্তমান অনুজ্ঞার রূপ। ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার রূপ হবে কোরো, বোলো, লিখো, উঠো, দিয়ো, খেয়ো। কিন্তু নিষেধাত্মক অনুজ্ঞা হলে বাংলা ভাষায় বর্তমান অনুজ্ঞার ব্যবহার হয় না, কেবল ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার ব্যবহার হয়। Don't do this অর্থে আমরা বলি: এটা কোরো না (‘করো না’ বলি না)। Don't listen to him অর্থে বলি: ওর কথা শুনো না (‘শোনো না’ বলি না)। Don't write my name on stone অর্থে বলি: পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম (‘লেখো না’ বলি না)। Don't eat fruits at night অর্থে বলি: রাতে ফল খেয়ো না (‘খাও না’ বলি না)।
বর্তমান অনুজ্ঞায় যদি 'না' লাগানো হয়, তখন সেই 'না' নঞর্থক নয়, তা বাক্যালংকার অব্যয়ের মতো। তার কাজ সদর্থক অনুজ্ঞাটিকে স্ফুটতর করা। যেমন - আমার কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করো না, আমার কথা একবার শোনো না, একবার তাঁকে বলো না সাহায্য করতে, ছেলেটার নামে সুপারিশ করে দু-লাইন লেখো না, ইত্যাদি। এই উদাহরণগুলির কোথাও কাজটি করতে মানা করা হয়নি, বরং মিনতিটি না-যোগে জোরালো হয়ে উঠেছে।




৪৬। বাংলায় নিষেধাত্মক অনুজ্ঞা সর্বদা ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার রূপ নেয়, বর্তমান অনুজ্ঞায় ‘না’ লাগালে তা নিষেধ না-বুঝিয়ে বরং সদর্থক অনুজ্ঞাটিকে স্ফুটতর করে। এখন প্রশ্ন হলো:
১. রূপ নেই মানে কি অর্থও নেই? বাংলায় নিষেধাত্মক অনুজ্ঞা কি সবসময়ে ভবিষ্যৎ কালই বোঝাবে? আমি যদি কাউকে বলি – ‘কোরো না’, ‘বোলো না’ বা ‘শুনো না’, সে কি ধরে নেবে যে আমি তাকে ভবিষ্যতে কিছু করতে বলতে বা শুনতে মানা করছি, এই মুহূর্তে সে যদি সেটা করে বলে বা শোনে তবে আমার কোনও আপত্তি নেই?
২. উপরের প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না’ হয়, অর্থাৎ বর্তমান অনুজ্ঞার নিষেধাত্মক রূপটিও যদি বাংলায় প্রকাশ করা সম্ভব বলে আমরা মেনে নিই, তখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে – কীভাবে? একই ক্রিয়ারূপ বর্তমান অনুজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা দুটোই বোঝাবে? সেক্ষেত্রে প্রসঙ্গের উপরে অনুজ্ঞাটির কালের দ্যোতনা নির্ভর করবে, তাই নয় কি?
সদর্থক অনুজ্ঞার বর্তমান হয়, নঞর্থক অনুজ্ঞার হয় না, এমন মেনে নিতেও অসুবিধে হচ্ছে। ‘ওকে ছুঁয়ো না’-র উদাহরণটি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে নিষেধাত্মক অনুজ্ঞার রূপটি ভবিষ্যৎ কালের হলেও অর্থটি এখানে বর্তমান কাল বোঝাচ্ছে। মনে হয়, প্রসঙ্গ ছাড়া বর্তমান অনুজ্ঞা বোঝানোর বা বোঝার সত্যিই অন্য কোনো উপায় নেই।
তবে গীতবিতান ঘেঁটে দেখছি, নিষেধাত্মক অনুজ্ঞায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের কালসীমানাটি অনেকসময়ে অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন। যদি বলি:
এতদিন যা সঙ্গোপনে ছিল তোমার মনে মনে
আজকে আমার তারে তারে শুনাও সে বারতা॥
আর বিলম্ব কোরো না গো, ওই-যে নেবে বাতি।
...তখন এটা পরিষ্কার যে বিলম্ব করতে মানা করার সময়টি বর্তমানকেই সূচিত করছে। আগের লাইনের ‘আজকে’ এবং বর্তমান অনুজ্ঞা ‘শুনাও’-এর সঙ্গে মিলিয়ে ‘বিলম্ব কোরো না’ পড়তে হবে। রূপ ভবিষ্যতের হলেও অর্থটি বর্তমান অনুজ্ঞার। কিন্তু যদি বলি:
এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার–
বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না॥
... তখন ‘এখন’ শব্দটির উপস্থিতি সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার অর্থই প্রবল হয়ে ওঠে। পরানে রাখিটি তো এখন বাঁধাই আছে, এই মুহূর্তেই তা খোলা হবে, এমন উদ্বেগও নেই। গোটা গীতিকবিতাটির মূল সুর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিস্মরণের আশঙ্কা। আগের লাইনের ভবিষ্যৎ ক্রিয়াপদ ‘বহিব’-র সঙ্গে কালসংগতিও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার অর্থেই বজায় থাকে। আবার যদি বলি:
দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে--
আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না॥
...তখন আগের লাইনে দুটি ভবিষ্যৎ কাল নির্দেশক ক্রিয়ারূপ থাকলেও ‘আজ’ শব্দটির ব্যবহারে অনুজ্ঞাটি বর্তমানের অর্থ প্রকাশ করে বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে চিনতে পারা নিয়ে সংশয় নেই, দুঃসহ মনে হচ্ছে এখনকার ছলনা দিয়ে ঢাকা অবহেলাটাই। তবু কালের অর্থ নিয়ে একটা সন্দেহ থেকেই যায়।




৪৭। ‘দারিদ্র্য’, ‘বৈদগ্ধ্য’ ইত্যাদি শব্দে অবশ্যই য-ফলা দিতে হবে। সূর্য্য-এর য-ফলা ও বৈদগ্ধ্য-র য-ফলার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটিতে ডবল য, অর্থাৎ য-এর দ্বিত্ব, দ্বিতীয়টিতে য-ফলা এসেছে ষ্ণ্য প্রত্যয়ের জেরে। প্রথমটি √সৃ+য (কর্তৃবাচ্যে), দ্বিতীয়টি বিদগ্ধ+ষ্ণ্য (ভাবার্থে)। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কারের জন্য ১৯৩৬ সালে যে-সমিতি গঠন করেছিলেন, তাঁরা ওই বছরের মে মাসেই প্রথম তাঁদের সুপারিশগুলি পেশ করেন। সেখানে একটি নিয়মে বলা হলো: রেফ-এর পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জিত হবে। যেমন সর্ব্ব, কর্ম্ম, নির্দ্দয়, সূর্য্য না লিখে লিখতে হবে সর্ব, কর্ম, নির্দয়, সূর্য।
কিন্তু ব্যুৎপত্তি বোঝার অসুবিধে হলে দ্বিত্ব যেমন আছে, তেমনই থাকবে। উদাহরণ হিসেবে 'কার্ত্তিক' (কৃত্তিকা+ষ্ণ) শব্দটি উল্লিখিত হলো। ওই বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত পুস্তিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণে এই ব্যতিক্রমটিও আর থাকল না। বলা হল, রেফ-এর পর কোনও ব্যঞ্জনেরই দ্বিত্ব হবে না। 'কার্ত্তিক'-কেও 'কার্তিক' লিখতে হবে। এটাই এখন মান্য রীতি।
রেফ-এর পর দ্বিত্ববর্জন আর প্রত্যয়-জনিত য-ফলা বর্জন আলাদা জিনিস। অপত্যার্থ ছাড়া ভাবার্থেও ষ্ণ ও ষ্ণ্য এই দুই প্রত্যয়ের ব্যবহার হয়। ষ্ণ-এর শুধু ‘অ’ থাকে, ষ্ণ্য-র থাকে ‘য’। লঘু+ষ্ণ = লাঘব, গুরু+ষ্ণ =গৌরব। তবে ষ্ণ প্রত্যয়ের ব্যবহার বেশি হয় বিশেষ্য থেকে বিশেষণ করতে: পৃথিবী>পার্থিব, হেম>হৈম, বিধি>বৈধ, চক্ষুঃ>চাক্ষুষ, সূর্য>সৌর। অন্যদিকে বিশেষণ থেকে ভাববাচক বিশেষ্য নির্মাণে ষ্ণ্য প্রত্যয়ের ব্যবহার সমধিক। অনুকূল>আনুকূল্য, ললিত>লালিত্য, বিপরীত>বৈপরীত্য, পণ্ডিত>পাণ্ডিত্য, সুকুমার>সৌকুমার্য, উজ্জ্বল>ঔজ্জ্বল্য, প্রচুর>প্রাচুর্য।
আজকাল কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্র এই নিয়মটিকে আর মানছে না। মূল বিশেষণের শেষে যুক্তবর্ণ থাকলে প্রত্যয়যোগের পর অবলীলায় তারা য-ফলাটিকে ছেঁটে ফেলছে। য-ফলা তুলে দেবার ফলে নবগঠিত বিশেষ্যপদটিকে আর ষ্ণ্য-প্রত্যয়ান্ত বলা যাচ্ছে না, তাকে দেখাচ্ছে ষ্ণ-প্রত্যয়ান্ত শব্দের মতন। যেমন - দারিদ্র, বৈচিত্র, বৈশিষ্ট, যাথার্থ, দৌরাত্ম, স্বাতন্ত্র। এদের মধ্যে প্রথম দুটি বানান আমি চলন্তিকা এবং/অথবা সংসদ অভিধানে দেখেছি, বাকিগুলি নেই। ‘লালিত্য’ লিখব অথচ ‘বৈশিষ্ট্য’ লিখব না, ‘জাড্য’ লিখব অথচ ‘দার্ঢ্য’ লিখব না —এই চিন্তাধারার পেছনে যুক্তি সম্ভবত এই যে অন্ত্যবর্ণটি যুক্তব্যঞ্জন হলে য-ফলা যোগ করা আর না-করা সমান কথা, বাঙালি জিভের উচ্চারণে তেমন কোনও ফারাক ঘটছে না। তবে আর মিছিমিছি বানানটাকে জটিল করা কেন!
‘ভাবার্থে বিশেষণ থেকে বিশেষ্য করার সময়ে শব্দের অন্ত্যবর্ণটি যদি যুক্তব্যঞ্জন হয়, তবে ষ্ণ্য-এর পরিবর্তে (অথবা বিকল্পে) ষ্ণ প্রত্যয় হবে’ — এরকম একটি নিয়ম যদি সর্বজনমান্যতা না পায়, তবে য-ফলা তুলে দিয়ে ‘বৈদগ্ধ’ লিখি কী করে?
কিন্তু ষ্ণ ও ষ্ণ্য, প্রত্যয়ের এই দুটো নামের উৎস আমার কাছে বামনদেব চক্রবর্তীর ব্যাকরণ বই, হয়তো অনেকের কাছেই তা-ই। কিন্তু বামনদেবের উৎস কী? ব্যাকরণকৌমুদী (বিদ্যাসাগর), পাণিনীয়ম (লাহিড়ী - শাস্ত্রী) ও ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (সুনীতিকুমার), এর কোনোটিতেই ষ্ণ বা ষ্ণ্য-র কোনো উল্লেখ নেই। তার বদলে আছে মূলত অণ্‌ ও ষ্যঞ্‌। বামনদেব ষ্ণ প্রত্যয় যোগে 'কৌতূহল', 'লাঘব' প্রভৃতি শব্দ দেখাচ্ছেন, সেই একই শব্দগুলো অন্যান্য গ্রন্থকারেরা "হায়নান্ত-যুবাদিভ্যো'ণ্‌" ('কৌতূহল'-এর জন্য) ও 'ইগন্তাচ্চ লঘুপূর্বাৎ' ('লাঘব'-এর জন্য) এই পাণিনি-সূত্র উল্লেখ করে অণ্‌-এর অন্তর্গত দেখাচ্ছেন। আবার, 'বৈদগ্ধ্য' বামনদেবে ষ্ণ্য প্রত্যয়ের মধ্যে, অন্য গ্রন্থকারেরা সেটাকে ধরছেন ষ্যঞ্‌ প্রত্যয়ের মধ্যে, 'বর্ণদৃঢ়াদিভ্য ষ্যঞ্‌ চ' এই পাণিনীয় সূত্রের উল্লেখ-সহ।‌
পাণিনি ছাড়া অন্য যে-ব্যাকরণগুলির কথা শোনা যায়, সেগুলো এখন লুপ্ত বা অপ্রচলিত বলে জানি। পাণিনি-পরবর্তী বৈয়াকরণদের অনেকেই অষ্টাধ্যায়ী-র উপরে নির্ভর করে তাঁদের গ্রন্থ রচনা করেন। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, পাণিনির সূত্রগুলিকে বিন্যস্ত করেই ভট্টোজী দীক্ষিত লেখেন ‘সিদ্ধান্তকৌমুদী’, যা এখন প্রায় সর্বত্র অনুসৃত হয়। হেমচন্দ্রের ‘সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী’-তেও ষ্ণ-কে ষণ্ (অণ্), ষ্ণ্য-কে ষ্যণ্ (ষঞ্), ষ্ণি-কে ষিণ্ (ইঞ্), ষ্ণায়ন-কে ষায়ণন্ (ফক্), ষ্ণেয়-কে ষেয়ণ্ (ঢক্), ষ্ণিক-কে ঠক্/ঠঞ্, ষ্ণীয়-কে ছ ইত্যাদি বলা হয়েছে।
এসব বড়ো বিভ্রান্তিকর। সরল জিনিস কঠিন হয়ে ওঠে। এর থেকে বরং সংসদ অভিধান যেরকম ব্যুৎপত্তি দেখায় ইৎ বাদ দিয়ে, ষ্ণ-কে অ, ষ্ণ্য-কে য, ষ্ণিক-কে ইক, ষ্ণেয়-কে এয় ইত্যাদি, সেটা অনেক সহজ ও নিরাপদ। তবে সেখানেও মুশকিল। অ কখনও তদ্ধিত ষ্ণ (মাধব), কখনও কৃদন্ত ঘঞ্ (ভাব), অপ্ (ভব), অচ্ (ক্ষয়), খল্ (সুলভ)। সবকিছুর উত্তরেই যদি এরকম অ-অ-অ-অ বলতে থাকি, তবে তা কি ঠিক প্রত্যয় জানা হলো!




৪৮। দীপংকরবাবু বলেন, তিনি নিজের নামের বানান ভুল লেখেন। হওয়া উচিত দীপঙ্কর। আচার্য সুনীতিকুমার এ-বিষয়ে কী বলেছেন আমার জানা নেই। ব্যঞ্জনসন্ধির নিয়মে দীপংকর অশুদ্ধ বানান নয়। চ-বর্গ থেকে প-বর্গ পর্যন্ত কুড়িটি স্পর্শবর্ণের যে-কোনও একটি পরে থাকলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ম্-এর জায়গায় সেই বর্গের পঞ্চম বর্ণটির আগম ঘটে। যেমন - সম্+চয় = সঞ্চয়, মৃত্যুম্+জয় = মৃত্যুঞ্জয়, বসুম্+ধরা = বসুন্ধরা, সম+নিহিত = সন্নিহিত, কিম্+পুরুষ = কিম্পুরুষ।
ক-বর্গের ক্ষেত্রে কিন্তু বিকল্পে অনুস্বারের বিধান আছে। অর্থাৎ ঙ্ যেমন হতে পারে তেমনি হতে পারে অনুস্বার। অহঙ্কার বা অহংকার, সঙ্গীত বা সংগীত, সঙ্ঘাত বা সংঘাত — দু-রকম রূপই চলতে পারে। আধুনিক বাংলায় ঙ্-এর বদলে অনুস্বার লেখাই প্রচলিত রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, মৌলিক শব্দের ক্ষেত্রে তো বটেই, সাধিত শব্দের ক্ষেত্রেও যেখানে পূর্বপদের অন্ত্যবর্ণ ম্ নয়, সেখানে ঙ্-র বদলে অনুস্বার হবে না। শঙ্কা, কঙ্কাল, শঙ্খ, শৃঙ্খল, শৃঙ্গার (শৃঙ্গ+√ঋ+অ), সঙ্গ (√সঞ্জ্+অ), রঙ্গ, ব্যঙ্গ, ভঙ্গুর (√ভঞ্জ্+উর) প্রভৃতি শব্দে অনুস্বার হবে না। দীপংকর বা শুভংকর-এ অনুস্বার তাই স্বচ্ছন্দে চলতে পারে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত বানানবিধিতে (১৯৩৬) 'সন্ধিতে ঙ্‌ স্থানে অনুস্বার' শীর্ষক অংশে ছিল - "যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম্‌ স্থানে অনুস্বার অথবা বিকল্পে ঙ্‌ বিধেয় - 'অহংকার, ভয়ংকর, শুভংকর, সংখ্যা, সংগম, হৃদয়ংগম, সংঘটন' অথবা 'অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর' ইত্যাদি।" আরও ছিল - "সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুসারে বর্গীয় বর্ণ পরে থাকিলে পদের অন্তস্থিত ম্‌ স্থানে অনুস্বার বা পরবর্তী বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয়, যথা - 'সংজাত, স্বয়ংভূ' অথবা 'সঞ্জাত, স্বয়ম্ভূ'। বাংলায় সর্বত্র এই নিয়ম অনুসারে ং দিলে উচ্চারণে বাধিতে পারে, কিন্তু ক-বর্গের পূর্বে অনুস্বার ব্যবহার করিলে বাধিবে না, বরং বানান সহজ হইবে।" কেন 'সংজাত' প্রভৃতি বানান আমরা লিখি না, তা-ও শেষাংশে বোঝা গেল। এই কমিটিতে সুনীতিবাবুও ছিলেন।
সংগ, বংগ, ভংগ লেখা কি উচিত হবে? সঙ্গ হল √সঞ্জ্ (লগ্ন হওয়া, to unite) +ঘঞ্; ভঙ্গ হল √ভঞ্জ্ (ভাঙা, to break) + ঘঞ্। মূলে কোথাও ম্, এমন-কি ঙ্-ও নেই। বঙ্গ শব্দ কীভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে জানি না। মনে হয় মৌলিক নামশব্দ। অনুস্বারের কোনও প্রশ্ন নেই।




৪৯। সুনীতিকুমার বাংলায় অনুস্বার নিয়ে একটু ইয়ে করতেন। যেমন, 'বাংলা' লিখলে উত্তর ভারতীয়রা পড়বে বান্‌লা, আর দক্ষিণ ভারতীয়রা পড়বে বাম্‌লা, অতএব 'বাঙ্‌লা' লেখা উচিত, এই ছিল ওঁর মত। কিন্তু যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মনে করেন 'বাংলা' লেখাই সংগত, কারণ সংস্কৃত অনুস্বার ধ্বনির শেষ দিকে একটা গ্‌-এর ছোঁয়া আছে। (দেবব্রত বিশ্বাস ত্বমীশ্বরাণাং গানটিতে একবার যেন এ জাতীয় উচ্চারণ এনেছিলেন, ইউটিউবে শুনেছি।) আমরা সাধারণত 'বাংলা'-ই লিখি।




৫০। তিনি, তাঁরা, তাঁকে, তাঁর, তাঁদের। উনি, ওঁরা, ওঁকে, ওঁর, ওঁদের। তিনি অথচ বাকিগুলো তাঁরা ইত্যাদি, একে বলে তির্যক রূপ। We, us একই রকম, ওই oblique form. আমি, কিন্তু আমাকে, তা-ও তির্যক। ও, ওরা, ওকে ইত্যাদি। এখানে তির্যক রূপ নেই। উনার/ওনার, উনাকে/ওনাকে, উনাদের/ওনাদের ইত্যাদি না লিখে লিখব ওঁর, ওঁকে, ওঁদের ইত্যাদি, কিন্তু তাই বলে ওঁ লিখব না, উনি-ই লিখব।




(চলবে . . . )