বহু যখন মেশে একে

তোমার সঙ্গে এক হয়ে, তোমার সঙ্গে মিশে গিয়ে আমি বিনষ্ট হই না, নিজের প্রকৃত স্বরূপই উপলব্ধি করি। আমি তোমার প্রিয়। গীতায় তুমি বলছ, "মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।" এ তো এখন প্রত্যক্ষ দেখছি। আমাকে স্বরূপে জাগিয়ে স্পষ্টরূপে তা দেখাচ্ছ। আমিও বলি তোমাকে: “প্রিয়োহসি মে।” তোমার যে প্রকৃত স্বরূপ, আমার মাতৃরূপ, তা প্রকাশিত হলে তাকে আমি ভালো না বেসে থাকতে পারিনে। ভালো করে, স্পষ্ট হয়ে দাঁড়াও আমার সামনে আমার মা হয়ে; দাঁড়িয়ে দেখে নাও... তোমাকে সত্যি ভালোবাসি কি না।




এই তো আমার মা তুমি। তোমার সঙ্গে আমার নিত্য একত্ব, আর বুদ্ধিগত ভেদ, দুই-ই আমি স্পষ্ট দেখছি। আমার জীবনের প্রত্যেক স্পন্দনে এই ভেদাভেদ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমার কাজ মাত্র দেখে সন্তুষ্ট নই। তোমার হৃদয়টা প্রত্যক্ষভাবে দেখতে চাই। তা-ও তুমি দেখাচ্ছ। এ-ই তোমার হৃদয়, যাকে আমি কেবল আমার হৃদয় বলে ভুল করছিলাম। এ হৃদয় কেবল আমার নয়, এ তোমারও হৃদয়। কেবল তোমার নয়, আমারও বটে। মা-ছেলে একত্র না হলে হৃদয় হয় না। এ-ই মা-ছেলে'র মিলিত হৃদয়।




আমি ঘুমিয়ে পড়লেও এই হৃদয় তোমাতে থাকে। আমার ঘুম তো প্রায় অভঙ্গ। কিন্তু আমি না থাকলে, তোমার কোলে নিদ্রিত সন্তান না থাকলে তোমার হৃদয় থাকত না, তোমার কোনও কাজও থাকত না। তোমার হৃদয় তো নিত্যকালই রয়েছে। সন্তান জাগ্রত হোক বা নিদ্রিতই হোক, তার জন্যেই তুমি কাজ করছ। কিন্তু যতক্ষণ সন্তানকে জাগ্রত রাখো, কেবল বাইরের জাগরণে জাগ্রত নয়, যতক্ষণ তার হৃদয় জাগ্রত, যতক্ষণ তোমার সন্তান-স্নেহ সে জানে, সে স্বীকার করে---কেবল বুদ্ধিতে স্বীকার নয়, হৃদয় দিয়ে তোমাকে ভালোবেসে স্বীকার করে, ততক্ষণই তোমার সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তোমার অনন্ত জীবন ধন্য হয়।




তোমার প্রেম লাগি তাহাতে,
তাহার প্ৰেম লাগি তোমাতে,
আনন্দলহরী তাহে উঠে বার বার;
মিশে নদী জলধিতে হয় একাকার।




আমার জীবনে এরূপ মুহূর্ত ক্বচিৎমাত্র আসে। তাই জীবনটাকে ব্যর্থ বলেই মনে হয়। প্রেম না আসাতে অশান্তি যায় না, দুঃখ যায় না, পাপ যায় না... জীবনের ব্যর্থতা আর কাকে বলে? এমন জীবনকে দিয়ে তোমার তত্ত্ব, তোমার ধর্ম প্রচার করবার অভিপ্রায় তোমার কেন হলো? তোমার অভিপ্রায় তো ভুল হতে পারে না। আমার জীবন বুঝি তবে সার্থক হবে? এই ব্যর্থতাবোধের ভেতর দিয়েই বুঝি সার্থকতায় নিয়ে যাবে? এই ব্যর্থতাবোধ, দীনতাবোধ তো সকল সময় থাকে না। মুহূর্তের প্রেমানুভূতি আর প্রেমের ব্যাখ্যা নিয়ে অনেকসময়ই সন্তুষ্ট থাকি, দীনতা ভুলে যাই। গাঢ় দীনতাবোধের ভেতর দিয়েই বুঝি ধনী করবে?




ধনী তো হয়েই আছি। তোমার পূর্ণপ্রেম তো প্রত্যেক সন্তানেরই সম্পত্তি, সেই সম্পত্তি অর্জনে তবে দীর্ঘপ্রক্রিয়ার দরকার না হতেও পারে? একদিন ঘরের চাবি খুলে বলবে, “এসব তোমার, আমার যা-কিছু সব‌ই তোমার।” সেদিন থেকেই কি অবাধ সম্ভোগ আরম্ভ হবে? আমাকে চেষ্টা-চরিত্র করে তোমার প্রেম অর্জন করতে হবে, এই ভ্রম থেকেই বুঝি যত কষ্ট আর যত সংগ্রাম আসে। এই ক্লেশ আর সংগ্রামটা বুঝি আমার শৈশব ও বাল্যের জন্য‌ই অনিবার্য? আমার নাবালকত্ব যেদিন শেষ হবে, সেদিন বুঝি একমুহূর্তের মধ্যেই দেখব, আমার বিনা চেষ্টায়, বিনা সাধনে, তোমার অহেতুকী কৃপায় আমি তোমার অতুল অনন্ত প্রেমধনে ধনী হয়েছি? সেদিন, সে মুহূর্ত কবে আসবে? মিথ্যা তৃপ্তি দূর করে, সেদিন, সেই মুহূর্তের জন্যে প্রতীক্ষা করতে সমর্থ করো তবে।