প্রোজ্‌ঝিত-কৈতব ধর্মের পথে

কী দুঃখভার নিয়ে তোমার কাছে এসেছি, তা তো তুমি দেখছ। এই দুঃখটা কার? দুঃখটা আমারই। কিন্তু আমি তো তোমার; আমার দুঃখ কি তবে তোমার‌ও নয়? আমার আত্মত্ব, আমার আত্মজ্ঞান, আমার বিশ্বত্ব, আমার বিষয়জ্ঞান সবই তো তোমার। তোমার যতটুকু আমার জীবনরূপে প্রকাশিত করো, ততটুকুকেই আমি ‘আমি’ বলি। তোমার প্রকাশ-অপ্রকাশ ক্রমাগতই চলছে। জ্ঞান-অজ্ঞান, স্মৃতি-বিস্মৃতি, জাগ্রতাবস্থা-নিদ্রা, তোমার এই লীলা... সব‌ই অবিশ্রান্ত। এই লীলাতেই আমার আমিত্ব।




তুমি এই পরিবর্তন-প্রবাহের অতীত। তুমি নিত্যজ্ঞান, ধ্রুব স্মৃতি, অনিদ্র, চিরজাগ্রত। তোমার এই নিত্যরূপ উপলব্ধি করামাত্রই তোমাতে আমাকে মিশিয়ে দেওয়ামাত্রই, আমার দুঃখাগ্নি নিভে যায়। তোমার স্বরূপগত পূর্ণ শান্তি, পূর্ণ আনন্দ এসে আমার হৃদয়ের ভার সরিয়ে দেয়, আমাকে দুঃখাতীত করে। তাই আমি এলাম তোমার সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া করতে। আমি আমার মধ্যে আর কোনও ফাঁকি, কোনও অবাস্তবতা, কোনও কৈতব রাখতে চাই না।




আমাকে আজ 'প্রোজ্‌ঝিত-কৈতব' ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমাকে তোমার সঙ্গে অভঙ্গযোগে যুক্ত করতে হবে। এ-ই তো সেই অভঙ্গযোগের অবস্থা। যে অসংখ্য বিচিত্রতায় আমার যোগ ভঙ্গ হয়, তা দূর করে এই অন্ধকারের মধ্যে, এই অন্ধকারকে প্রকাশিত করে তুমি আত্মারূপে প্রকাশিত হয়েছ। তোমাতে আমাতে কোনও ব্যবধান নেই, বিচ্ছেদ নেই। এই আবার তুমি অন্ধকার দূর করে, তোমার বিচিত্র বিশ্বরূপের কতক অংশ নিয়ে, বিশ্বাত্মারূপে, অথচ আমারই নিজ আত্মারূপে প্রকাশিত হয়েছ। তোমার বিশ্বাত্মারূপকে আমি আমার আত্মারূপেই দর্শন করছি।




তোমার বিশ্বাত্মারূপকে আমি নিজ আত্মারূপে দেখে ভিন্নরূপে ভাবতেই পারছি না। আমার এই আপাত-ক্ষুদ্র আত্মজ্ঞান প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র নয়, এ তোমার সর্বাধার, সৰ্বাশ্রয় আত্মজ্ঞানেরই প্রকাশ। আমি যে এতে দেশ, কাল ও সসীম ব্যক্তিত্বের সীমা দেখছি, তোমার জ্ঞানে সে সীমা নেই। আমি যে সীমা দেখছি, সে সীমাকেও তোমার অসীম স্বরূপের অন্তর্গত বলেই জানছি। দেশ ও কাল-গত জগৎ একটা পর্দা হয়ে আমাকে তোমা থেকে স্বতন্ত্র করে দিচ্ছিল, তুমি সে ব্যবধান দূর করলে।




আমি তোমারই রইলাম, তুমি আমারই রইলে। আমার অজ্ঞানতা, বিস্মৃতি, নিদ্রা আমাকে তোমা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারল না। এগুলি তোমার নিত্যজ্ঞান, অনন্ত স্মৃতি, অনাবৃত জাগরণের লীলামাত্র, এগুলিতে আমার কিছু নষ্ট হয় না, আমার সবই তোমাতে থাকে। আমি তোমার অমরত্বে অমর। তোমার স্বরূপে আমার স্থিতি দেখে আমার মৃত্যুভয় চলে যাচ্ছে। আমি তোমার জ্ঞানে জ্ঞানী, তোমার প্রেমে প্রেমিক, তোমার ইচ্ছায় ইচ্ছাযুক্ত, তোমার শক্তিতে শক্তিমান, এই দেখে আমার সব রকম ভয়ই চলে যাচ্ছে।




আমি সর্বক্ষণ তোমার কোলে, আমার অমঙ্গল অসম্ভব। আমি তোমার অনিমেষ দৃষ্টি হারাই, তোমার স্পর্শ হারাই, তোমার গাঢ় আলিঙ্গন অনুভব করি না, তাই অত ভয়, অত দুঃখ ভোগ করি। তুমি আমায় দূরে যেতে দিয়ো না, তোমায় ছাড়তে দিয়ো না। আমাকে তোমার সঙ্গে অভঙ্গযোগে যুক্ত করে চিরশান্তিতে, চিরআনন্দে প্রতিষ্ঠিত করো।