আমি শিরা কেটে মরতে চেয়েছিলাম, ঝুলে মরতে চেয়েছিলাম। মায়া লাগে নিজের জন্যই। শেষবার দেড়পাতা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ফেলি। ওর বিয়ের পরদিন। এটাই লাস্ট-ট্রাই ছিল। ডিভোর্সের দিনে করা ভিডিওটা মাঝে মাঝে দেখি। সাদা শার্ট-পরা আমার নিহালকে দেখি। এটাই আমার কাছে থাকা ওর লাস্ট ভিডিও। সেই ভিডিওতে ব্যাকগ্রাউন্ডে হাউমাউ করে আমি কাঁদছি, সে কান্নাটা আমার এখনও থামেনি। একদিন সে আমার জন্য কেঁদেছিল স্বপ্ন দেখে। ওটার ভিডিওটাও দেখি কখনও কখনও। ওটা সে পাঠিয়েছিল ডিভোর্সের পর। ওর ছোটো আপুর ছবি দেখি, যে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে। আমাদের কাবিনের দিনে তোলা ছবি দেখি। ওর নতুন মানুষটি না আমার থেকে ফরসা, না আমার থেকে লম্বা, শুধু আমার থেকে একটু স্বাস্থ্যবতী। ওকেও দেখি মাঝেসাঝে। আমি ডিভোর্স দেওয়ার ধাপগুলি নিয়ে কুরআন-হাদিস বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা এবং সাহাবা-তাবেঈনের কর্মপন্থা থেকে প্রমাণিত যে তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো, স্ত্রী যখন হায়েজ (মাসিক ঋতুস্রাব) থেকে পবিত্র হবে, তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে তালাক দেবে। হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া এ জন্যই নিষিদ্ধ, যাতে তার উক্ত দুঃসময়ের কারণে তালাক সংঘটিত না হয়; বরং ভালো সময়ে বুঝে-শুনে তালাক সংঘটিত হয়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা : ২/১৩৯) ওরা এটাই ফলো করে নাই। আরও কিছু ধাপ আছে তালাকের আগে, যেগুলির একটাও নিহাল মানেনি। ইসলামের আলোকে যদি বলি, তবে আমাদের তালাকটা পুরোপুরিই অবৈধ, তাই নিহাল এখনও আমার স্বামীই আছে। প্রথম স্ত্রীর বর্তমানে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে কোন আইনে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকেই? সে আমাকে ভালোভাবে তালাক না দিয়ে জোর করে তালাক দিয়েছে, যা ইসলামে নিষেধ করা আছে। আমরা আগের বাসা পালটে নতুন বাসায় এসেছি। ভাই-ভাবি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে বিধায় তারা এখন থেকে আলাদা থাকবে। আব্বু, আম্মু, আমি ইনকাম ছাড়াই তিনজন বসে বসে খাই। ডিভোর্সি মেয়ে ঘরে রাখা আর-এক বিপদ। তাদের মেয়ের বয়স ৪ বছর। আমার ছায়া ওর উপর পড়তে পারে। আমাকে আবার বিয়ে দেওয়াও টাকার ব্যাপার। এইসব ভেবে ভাই-ভাবি চলে গেছে অনেক আগে। আমাদের খোঁজ নেয় না আর। এরপর প্রাইমারিতে আমার জব হলো। একাকিত্ব, ফ্যামিলির টেনশন, একা কীভাবে সংসার দেখব, সে অন্যের সাথে কীভাবে আছে…এরকম নানাবিধ টেনশনে আমি অনেকবার মুক্তির পথ খুঁজেছি। কোনও সাইকিয়াট্রিস্টও পাইনি। মেনটরও না। কয়েকবার ভেবেছি, ডিসিপ্লিনের স্যারদের কাছে যাব, কিন্তু বিজনেস স্টাডিজ তো, আদৌ হেল্প পাব, না কি উলটা বকা শুনে ঘরে ফিরি, এরকম নানান ভয়ে আর যাইনি। সারাদিন বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও দেখি আর বেঁচে-থাকার অর্থ খুঁজি। কান্নাকাটি করে ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে শেষ করেছি। আব্বু-আম্মু আরও ভুল বোঝে। আমাকে হ্যান্ডেল করতে পারে না ওরা, আরও তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আমি সারাদিনই কাঁদি। ১৩ এপ্রিল ফ্যান থেকে ঝুলে পড়ে পায়ের নিচ থেকে টুলটাও যখন সরালাম, তখন ওই শব্দ শুনে আম্মু দৌড়ে এসে আমাকে উঁচু করে ধরে মানুষ ডেকে আমাকে নামায়। এরপর পাশের বাসায় এক আন্টি-আঙ্কেল খুব আপন করে নেয় আমাকে। তবে ওরাও আমাকে অনেক বকাঝকা করেছে। পাবনায় পাঠাতে চেয়েছে। নানান কথা বলেছে। সেই আন্টি-আঙ্কেল আমাকে প্রতিদিনই অনেক বোঝায়। আমার এক বান্ধবী এসেছে আমাদের বাসায়। আজ ৮-৯ দিন যাবত আমার সাথে সাথে ঘুরছে। এ-ই হলো আমার বর্তমান অবস্থা। আমার কিছুই খেতে ভালো লাগে না। সারারাত ঘুমাতে পারি না। একটু পর পর ঘুম ভেঙে যায়, আর নিহালের কথা বলে বলে বিলাপ করে কাঁদি। দুদিন পর পর ফুড-পয়জনিং হয়। দুধ ডিম কলা কিচ্ছু খেয়ে হজম করতে পারছি না। সেই আন্টি-আঙ্কেল আমার সেই স্কুলফ্রেন্ড জনিকে বলেছে আমার সাথে সময় দিতে। ও এখন গ্রামে। আমাকে মাঝে মাঝে ফেইসবুকে নক দেয়। কেমন আছি, কী করছি, এটুকুই বলে। তবুও আমার ভালো লাগে না। ওরা মনে করে, জনি আমাকে সময় দিলে আমার ভালো লাগবে। আসলে তা-ও না। আমার খুব প্রাণ পোড়ে নিহালের জন্য। সব সময় মনে হয়, ও আমাকে ছেড়ে এভাবে যেতে পারে না। ও কিছুতেই অন্য কারও হতে পারে না। ওকে আমার কাছে ফিরতেই হবে। আমি ওর বিয়ের পর অন্য নম্বর দিয়ে ফোন করলে ও সেটা ধরেছিল। খুব আতঙ্কে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মেয়ে কি অনেক সুন্দরী?’ - না। - ওরা অনেক ধনী? - না। - অনেক ব্রিলিয়ান্ট? - এসব কিছুই না! - নাম কী ওর? - শুনতে হবে না। বলেই সে ফোনটা রেখে দেয়। পরে যে-দিন সময় হবে, সে-দিন ফোন দেবে বলল। হয়তো বউ জানেই না এসবের কিছুই। মেয়েকে বাপের বাড়ি নিয়ে নিহাল আর সে একসাথেই মেয়ের বাপের বাড়িতে থাকছে। ওভাবেই বাচ্চা নিয়ে এরপর হয়তো ফিরবে। এরপর নিজেদের মতো করে সব বলবে তাকে। কিংবা তা-ও বলবে না, চেপে যাবে। শুনেছি, ঢাকাতে নেবে বউকে। আলাদা বাসা নেবে। কমল ভাইকে সাথে রাখবে না। অথচ আমি থাকাকালীন আমার জন্য শর্ত ছিল, আমাকে রান্নাবান্না করতে হবে। কমল ভাইয়া সাথে থাকবে। টিউশনিও করতে পারব না। দিন-রাত বিসিএসের জন্য পড়ব। কনফিডেন্স উত্তরা শাখায়। এখন সে নতুন বউ নিয়ে যাবে, তাই কমল ভাই আর থাকতে পারবে না সাথে। আমি থাকাকালীন একটা মুরগির বাচ্চা কিনে দিতে বলেছিলাম সারাদিন একা একা ঘরে থাকি বলে। পাখি সে কিনে দেবে না, টাকা নষ্ট করবে না তাই। এরপর ১৫ টাকা দামের মুরগির বাচ্চা একটা কিনে দিতে বলেছিলাম, তা-ও দেয়নি। সেদিন কিছু ছবি দিয়েছিল আমাকে। সাদা একজোড়া খুব সুন্দর কবুতর কিনেছে নিহাল ওর নতুন বাসায়। নতুন বউয়ের জন্য সব কিনতে পারে সে। আমাকে ওরা মেরেছিল প্রথম তিন দিন পরই। সেই ব্যথা আড়াই মাস ছিল। তবুও একটা পেইন কিলারও দেয়নি। খুলনাতে এসে পরে ডাক্তার দেখাই। এক্স-রে করে দেখা গিয়েছিল, আমার বুকে রক্ত জমে গেছে। সেই ব্যথাটা যতটা না গভীর, তার থেকেও গভীর ব্যথা পেয়েছিলাম যখন আমি ওকে ডিভোর্সের পর কথাপ্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, সে এক কবরে আমরা দুইজন থাকার প্ল্যান করেছিল। ওদের পুকুরপাড়ের গাছটার নিচে। তখন সে অট্টহাসি দিয়ে বলেছিল, ‘হা হা হা! আরে পাগল, জীবনে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে প্ল্যান পালটাতে হয়, নইলে নিজেরই লস। তখন যা বলেছিলাম, তা বলেছিলাম সময়ের প্রয়োজনে। এখন যা করেছি, তা-ও সময়ের প্রয়োজনে। তুই বুঝবি না এসব, তোর মাথায় ঘিলু নাই। তোর বুকে শুধু ভালোবাসা আছে, মাথায় কিচ্ছু নাই। তোর মতন গাধির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি, এটাই আলহামদুল্লিলাহ!’ আমি এসব শুনে আরও গভীরভাবে আঘাত পেয়েছিলাম। ডিভোর্সের আগে অসংখ্যবার আমি ফোন করে বলেছিলাম, ‘প্লিজ, আমাকে ছেড়ো না।’ ও বলেছিল, ‘ছাড়ার প্রশ্নই আসে না, ধরিই নাই তোকে, ছাড়ব কী?’ আমি আম্মুকে দিয়ে রিকোয়েস্ট করিয়েছি অনেকবার। আম্মুর সাথেও চরম মিসবিহেভ করেছে। অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে আম্মুকে। আমাকে সে বলেছিল, আমার চোখে নাকি স্বপ্ন দেখে সে। আমি যেন আমি তা পূরণ করি। পরক্ষণেই বলে, আমি যেন আর তাকে টেক্সট না করি। কয়দিন আমি চুপ থাকলে সে আমাকে আবার নক করত। কেন মেসেজ করি না, কল করি না, জিজ্ঞেস করত। বলত, আর কখনও অন্য নারী আসবে না তার লাইফে। বেঁচে থাকলে যেন দেখি। অথচ করোনার কারণে যখন মানুষ ভয়ে আছে, তার ভেতরই সে তার বিয়েটা পিছাল পর্যন্ত না! আমি এই এপ্রিলের শুরুতে সেই চেয়ারম্যান আঙ্কেলকে অনেক রিকোয়েস্ট করি সম্পর্কটা ঠিক করে দিতে। উনি ওঁর আগের সব কথা উলটে দিলেন। আমাকে অনেক বকা দিয়ে আমার ফোননম্বরটা ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দেন। শেষে আমি অভিশাপ দিয়েছি যে আল্লাহ তাঁকে ছাড়বে না। উনি ধ্বংস হবেন গজবে। উনি বললেন, ‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।’ অথচ নিহালের জন্য অভিশাপ দূরে থাক, একটা কুচিন্তাও আমার মাথায় কখনও আসে না। আমি কোনও উপায় বাদ রাখি নাই। চেষ্টার কোনও ত্রুটি করি নাই। কোনও দিনই তাকে অবহেলা করি নাই। তাই ভুলতে পারি না। সব স্মৃতি মনের মধ্যে এসে চোখের সামনে ঝুলতে থাকে। আহা, আমার যদি এই মুহূর্তে স্মৃতিলোপ হয়ে যেত কোনও-না-কোনও কারণে! আমাদের সম্পর্ক তো ভালো ছিল। হুট করে ওর মিথ্যা আর বাসার বাড়াবাড়িতে নিমিষেই সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল! আমি আমার নিহালকে চাই। আমি যত ভাবছি, তত পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমি কোটি কোটি মেমোরিজ আর আমার স্যাক্রিফাইসগুলি ভুলতে পারছি না। কেন এমন হবে? কেন সে সব কমিটমেন্ট ভুলে এই করোনার মধ্যেও বিয়ে করে ফেলবে? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ওর ছোটো দুলাভাই-ই ওকে নষ্ট করে দিয়েছে। সে শুরু থেকে আমাদের ভেতর ঝামেলা করে আসছে। নইলে নিহাল এমন ছেলে না। আমার আম্মু আমাকে বলছে, ‘তুই না খেয়ে থাকলে কি ওই ছেলে বউ ছেড়ে তোর কাছে চলে আসবে? মেনে নে। মেনে তো নিতেই হবে!’ আমি কিছুই সহ্য করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, চার-পাঁচটা আজরাইল আমার কলিজাটা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। ওর কি বিচার হবে না আল্লাহর দরবারে? ওর হাজার হাজার কমিটমেন্ট গেল কই আজ? বিয়ের দুই দিন আগেও আমাকে মেসেজ করেছিল। বলেছিল, ‘আল্লাহর হুকুমে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠলেও উঠতে পারে, কিন্তু সে আমারই থাকবে, আর কারও হবে না।’ আমার দুমাসের সংসার, এক বছরের ফরমাল বিয়ে, দুই বছরের গোপন বিয়ে। সব শেষ! আমাদের ম্যারেজ-ডের মাত্র তিন দিন আগে সে আমাকে ডিভোর্স দেয়। এইসব মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! আমি আমার জীবনে ঘটে-যাওয়া অনেক কিছুই লিখতে পারলাম না। পুরোটাই লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দুঃখে আর ভয়ে আমি শেষ করতে পারিনি। তার ভেতর সে বিয়েও করে ফেলল। আমার পড়াশোনা কাজকর্ম ক্যারিয়ার সব শেষ হয়ে গেল। আমি আর কিচ্ছু করতে পারি না। এখন এক বান্ধবী এসেছে আমাদের বাসায় আমার মেনটাল সিকনেস দূর করার জন্য। সে আমাকে পড়াশোনায় ফেরানোর চেষ্টা করছে। তবু আমি সারাক্ষণই ওসব ভেবে ভেবে কষ্ট পাই। ইফতারে বা নামাজে বসে দুয়া করতে গিয়ে কিচ্ছু খুঁজে পাই না। শুধু কাঁদি। নামাজ শেষে মুনাজাতে কান্নায় চোখের পানি হাত উপচে গড়িয়ে পড়ে কনুইতে। ওজন আরও কমে গেছে। এমন অবস্থা যে একটা ডিম খেলেও সহ্য হয় না। এতটাই দুর্বল হয়ে গেছি আমি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কষ্টগুলি গলার কাছে দলা পাকিয়ে আটকে আছে। দম নিতেও কষ্ট হয়। বুকের ভেতরটা ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিয়ে ওঠে। শুধু আমি একাই কষ্ট পাই, এসব নিয়ে সে কোনও কষ্ট পায় না। আমার বান্ধবী বলে, ‘জীবন এখন থেকে শুরু, এটা মাথায় রাখ। মরীচিকার পেছনে ছুটে চলছিলি, বেঁচে গেছিস এখন!’ আর আমি ভাবি, ‘আল্লাহ কি আমার সমস্ত ত্যাগের কোনও প্রতিদান দেবেন না? আমি কি সত্যিই আমার নিহালকে আর ফিরে পাবো না?’ আপনারা আমার গল্পটা পড়ছেন, এটা আমার পরম সৌভাগ্য। আমার মতো অভাগিনীর কথা কেউ জানতে, শুনতে বা বুঝতে চায় না। আমার নিজের ফ্যামিলিও না। আমি অনেকটা ঘোরের মধ্যে আছি, এমন মনে হয়। তবে হিসেব করলে সত্যিই ওই সময়ের থেকে এখন ভালো আছি। তবুও যেন এইভাবে ভালো থাকতে আমি চাইনি কখনও। জীবন তবু জীবনের নিয়মে চলে। আমার নিজের উপর নিজেরই কেন জানি মায়া লাগে। এতটা দুঃখী কেউ হয় না বোধহয়! আমাকে একবিন্দুও মানুষের মতো ভাবেনি ওরা কখনওই। একটা মেয়ের জীবনের সব থেকে সুন্দর সময় ১৯-২৫ বছর বয়স আমি ওর পেছনে দিয়েছি। আমারও বন্ধুবান্ধব ছিল। এখন সবাই যার যার জীবন বা ক্যারিয়ার নিয়ে ছুটছে। আর আমি হলাম দলছুট। একাকিত্বের সমুদ্রে সে ডুবিয়ে দিয়ে গেল আমাকে, অথচ সে এখন নতুন বউ নিয়ে খুশিতে মৌজ মাস্তি করছে। সবাই আমাকে বলে, ‘তুমি বেঁচে গেছ। তুমি ধার্মিক বলে আল্লাহ একটা উছিলায় তোমাকে বাঁচিয়েছেন।’ কিন্তু আমি আমার জীবনে প্রথম সবকিছুই করেছি ওর সাথেই। প্রথম ঘুরতে যাওয়া, প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা, প্রথম পার্কে যাওয়া, প্রথম চুমু খাওয়া, এমনকি প্রথম কোনও ছেলের হাত ধরা, এরকম জীবনের সবকিছুতেই প্রথম ছিল সে। তাই সবকিছুতেই তাকে মনে পড়ে। আজ এক আন্টি এসে গল্প করছিলেন আমার সাথে। এরপর উনি চলে গেলে আমি একটা বই নিয়ে বসে ছিলাম, কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে পড়তে পারিনি। তবু আমি বেঁচে আছি, মানুষ বেঁচে থাকে। তবে কেমন আছি, আমি নিজেও জানি না। জোর করে চলছি নিজের সাথে। কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মতো অবশ অবশ লাগে সবকিছু। কেউ কেউ বলে, নিহাল ছোটোলোক। কিন্তু সে কি আসলেই ছোটোলোক, না কি পরিস্থিতির স্বীকার, আমি আজও জানি না। কেউ কেউ বলে, সে একটা সাইকোপ্যাথ। আমি এত কিছু বুঝতে চাই না। আমি শুধু এটুক বুঝি, আমি ওকে অন্য মেয়ের সাথে মানতেই পারি না। ডিভোর্সের আগের দিন ঢাকা থেকে ফেরার সময় আমি ওর হাত পা ধরে এটাও বার বার বুঝিয়েছি যে তার ভাগটাই শুধু আমি কাউকে দিতে চাই না, বাকি সব করতে আমি রাজি। সে কিছুই শুনল না আমার কথা। সেদিন দেখি, ওর আইডিতে আমার আগে যার সাথে ওর পাঁচ-ছয় বছরের রিলেশন ছিল, সেই মেয়েকেও অ্যাড করেছে ফেসবুকে। সে মেয়ে অবশ্য আমাদের ডিভোর্সের ২৯ দিন পর বিয়ে করেছে। গায়ে বিশাল বড়ো বড়ো গয়না পরে সে মেয়ে। সেদিন এক আপু বললেন, ‘সানজিদা, একটা ঘোরানো বুদ্ধি দিই। পারলে একটা প্রেম করো। মনের কষ্ট অনেক অনেক অনেক কমে যাবে।’ কিন্তু আমার ভালো লাগে না আর কাউকেই। অনেকে বলে ওকে ব্লক করে দিতে। আমার কষ্ট লাগে। আমি ওর সাথে কিচ্ছু যোগাযোগ করছি না এই আইডি থেকে। আর দেখছিও না ওর কিছু, সে আমার লিস্ট থেকে আনফ্রেন্ড করা আছে। তা-ও আমি সারাক্ষণই তার আইডিতে পড়ে থাকি। সে যেদিন আগের পরিচিত দুইজন বিবাহিত মহিলা, যাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল একবার, তাদের অ্যাড করে আমাকে নক দিয়েছিল, সেদিনই আমি ওকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলাম। আমার আগে সিরিয়ালে থাকা গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিহালের অনেক দিনের রিলেশন ছিল। কিন্তু ওকে সে বিয়ে করেনি। মেয়েটা নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়েছে। বয়সে বোধহয় আমার থেকে দুই বছরের জুনিয়র। নিহাল মেয়েটার সম্পর্কে দোষ দিয়েছিল এই বলে যে, মেয়ের আম্মু খারাপ, কারণ মেয়ের বাবা প্রবাসী। আর মেয়েটা ‘নিহালের বাবার চেহারা সুন্দর না’ এটা বলেছিল নাকি, তাই নিহালের মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে সে কখনও বলত না যে ওর কার কার সাথে রিলেশন ছিল। সব সময় বলত, তার লাইফে কোনও মেয়েই নাই। কোনও মেয়েফ্রেন্ড নাই। স্কুল ছিল বয়েজ স্কুল, কলেজ ছিল বয়েজ কলেজ। ভার্সিটিতে যেত না তেমন। চিনেও না কাউকে। আমিই সব অন্যভাবে জানতে পারি প্রমাণসহ। ওরই আইডিতে। তখন আবার সব বলতে বাধ্য হয়। নিহাল আমাকে ‘ড়িংচি’ বলে ডাকত। প্রথমে খ্যাপানোর জন্য বলত যে খুলনাতে শুধু চিংড়িচাষিরা থাকে। তাই আমরাও চিংড়িচাষি। পরে সে আমাকে ‘রোজ’ বলে ডাকত। আমাদের দুজনের একটা কমন ফেসবুক আইডি আছে। আমার মেইলে এখনো রিকভারি মেইলের জায়গায় নিহালের ই-মেইল আইডি দেওয়া। আমার মেইলের পাসওয়ার্ডও আগেরটাই আছে, যেটা ওর জানা। সেই মেইল দিয়েই আমার বর্তমান ফেসবুক আইডি চলে। নিহাল ভার্সিটির কোনও প্রোগ্রামে যায়নি কোনও দিন। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা যেমন স্মার্ট হয় বা একটা স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে, ও সেরকম না। ওকে দেখলে আমার মনে হয়, ও একটু বোকাসোকা সহজ ধরনের মানুষ। ও সবাইকে বলে যে, ওর কোনও মেয়েফ্রেন্ডই নাই। এমনকি নিজের ভার্সিটির র্যাগ-ডে’তেও সে যায় না। আমি আমার ভার্সিটির সরস্বতী পূজাতে বা অন্য কোনও প্রোগ্রামে সবার মতোই চাঁদা দিই। পুজাতে চাঁদা দেওয়া নিয়েও তার বিশাল আপত্তি। তাতে নাকি আমার ধর্ম চেইঞ্জ হয়ে যায়। অথচ সে নিজে এক ওয়াক্তও নামাজ কখনও পড়ত না। আমিই ওর হাতে পায়ে ধরে ওকে নামাজ পড়াতাম। থার্ড-ইয়ারে উঠে কোনও এক সিচুয়েশনে পড়ে আমি মেয়েদের ভলিবল খেলেছিলাম। তা নিয়ে তো সে আমাকে পুরো ধুয়ে দিয়েছিল! বলেছিল, আমি মেয়ে না, আমি হিজড়া, আমি চরিত্রহীন…হ্যান ত্যান! ২০১৭ সালে আমাদের ডিসিপ্লিন থেকে কক্সবাজার ট্যুরে গিয়েছিলাম। আমরা, মানে আমাদের ব্যাচ অ্যারেঞ্জ করেছিলাম। আমরা ছিলাম সিনিয়রমোস্ট ব্যাচ ওই ট্যুরে। আর বাকি সবাই ছিল জুনিয়র। তবু তার একটাই কথা, যাওয়া যাবে না। পরে অনেক বোঝানোর পর যেতে দেয়, অনুমতি দেয়। ট্যুরের পর সে আর-এক ঝামেলা বাধায়। বলে, রিলেশন রাখবে না। ট্যুরে গিয়ে নাকি আমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে! ওকে ছোটোবেলায় প্রাইভেটে পড়িয়েছে ওর বাড়ির লোকজন বা আত্মীয়স্বজন। ওর সব ডিসিশন ওর ছোটো বোন আর বোনাই নেয়। যেহেতু নিহালকে প্রাইভেটে পড়াতে তার ফ্যামিলিকে ধার-দেনায় যেতে হয়েছে, সেহেতু তার পক্ষে ফ্যামিলির সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া কঠিন। আর সব থেকে বড় কথা, নিহালের দুলাভাই যখন তখন তার বোনকে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দেয়, তাই সে যা বলে, বাড়ির সবাই সেটাই শোনে। ওদিকে ছোটো বোন স্বামীর বেতন সবাইকে বাড়িয়ে বলে আর দাবি করে, তার স্বামী অ্যাপেক্সের দোকানের ম্যানেজার, অথচ দুলাভাই সে দোকানের একজন কর্মচারী। সেই দুলাভাইয়েরও একটা সাত বছরের রিলেশন ছিল। সেটা বাদ দিয়ে হুট করে তার আব্বুর পছন্দে নিহালের বোনকে বিয়ে করেছিল। এবং, এখনও সেই মেয়ের সাথে সে মাঝে মাঝে থাকে। আপু জানে, তেমন কিছু বলে না বা বলার সাহস পায় না। দুলাভাইয়ের সাথে যখন কথা হতো, তখন এসব শুনতাম। সেদিন আমার আম্মুর এক দূরসম্পর্কের কাজিন আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আমার ব্যাপারটা মোটামুটি শুনে উনি আমাকে বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না, এরকম একটা চিড়িয়ার সাথে কোনও সুস্থ মানুষ থাকতে পারে? তুমি কীভাবে থাকলে? কিংবা এখনও থাকতে চাইছ? একে তো চিড়িয়াখানায় রাখা উচিত। কিংবা পাগলাগারদে। তোমার কাহিনি শুনলে কেউই বিশ্বাস করবে না যে এরকম কিছু আদৌ হতে পারে! সবাই গল্পই ভাববে!’ আমি ওঁকে বললাম, ‘খালা, আমার স্যাক্রিফাইসের লেভেলটা অনেক উঁচুতে। কেন করলাম অত কিছু তাহলে? কেন জীবনের সোনালি সব অধ্যায়ই ওর পেছনে খরচ করলাম? কেন সবকিছু মেনে নিলাম দিনের পর দিন? ওসবের কি কোনও দামই নেই? কেবল এসবই মনে আসে, এজন্যই ভুলতে পারি না। অনেক অনেক অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে আমাকে, শুধু সামনে হয়তো ভালো দিন আসবে, তার অপেক্ষায়।’ আমি নিহালকে খুব খুব খুব ভালোবাসি। আমার কাছে ওকেই সেরা মানুষ মনে হয়। একটা মেয়ের জীবনে ফার্স্ট-লাভ হওয়াটা অনেক সৌভাগ্যের। একটা মেয়ের কাছে তার প্রথম প্রেমিকের মারধরকেও ভালোবাসা মনে হয়। এখনকার মেয়েরা আবার এমনটা না। আমার সিধেসাদা চলন-বলন দেখে নাইনটি পার্সেন্ট মানুষই বুঝে উঠতে পারে না যে আমি খুলনা ভার্সিটির বিবিএ-এর স্টুডেন্ট। অবশ্য, সেও অনেক সাদাসিধা। এজন্যই রিলেশনটা জমেছিল। সে আমাকে লাস্টে এ-ও বলেছে, ‘আমরা আসলে এক ধরনের না, তবু কীভাবে জানি আমাদের মধ্যে বিয়েটা হয়ে গেছে ভুল করে, তাই ভেঙে গেছে।’ অথচ সে-ই সব সময় বলত, ‘আমরা আল্লাহর রহমতেই একসাথে। নইলে কোথায় খুলনা, আর কোথায় নড়াইল!’ ওর ফ্রেন্ডরা সবাই রুমডেট করেছে একাধিক মেয়ের সাথে। কিন্তু ও এরকম না, এটা বলত। সোনিয়ার সাথে ছয় বছরের রিলেশন ছিল, এটা আমি তিন বছর পরে জেনে যাই প্রমাণসহ। কিন্তু ও নিজে কখনও এটা স্বীকার করত না। আর ওর আলাভোলা ভাগনে আমাকে বলেছে, নিহাল তার কয়েকটা ভাবির সাথে ডিপ রিলেশনে ছিল। একদিন নিহালকে সন্ধ্যায় তার মামাত বোনের সাথে সে রুমে দেখেছে আপত্তিকর অবস্থায়। ক্লাস ফোর থেকে ওরা ফ্রেন্ডরা মিলে পর্নফিল্ম দেখে। ওর মেসের রুমে গিয়ে দেখেছি দূরবীন। জিজ্ঞেস করলে বলেছে, জানালা দিয়ে অন্য বাসায় সরাসরি দেখার জন্য ওটা কিনেছে। এমন ইজিলি সে এসব বলত যে আমি ভাবতাম, বোধহয় ছেলেদের ভেতর এটা কমন ব্যাপার। আর আমার এই সাদাসিধা ভালোবাসার মানুষটার আইডিওলজি যদি এমন হয়, তবে না জানি অন্য ছেলেরা আরও কতদূর যায়! কিন্তু মানুষ তো পারফেক্ট হয় না বা চিরদিন একরকম থাকে না! তখন তার বউ ছিল না। হয়তো তাই ভুল করে বেরিয়েছে। আমি নামাজ কুরআনের মাধ্যমে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নেব ভেবেছিলাম এবং এখনও ভাবি। আমি নিহালের অন্য মেয়ের সাথে থাকাটা নিতে পারছি না কোনওভাবেই! কীভাবে ওকে সরাব অন্য মেয়ে থেকে? কেউ এসে আমাকে একটু বলে দিক, পথ দেখাক! সে খুলনাকে খুব ছোট করে কথা বলে। এখানে পানি খারাপ, এটা এলাকা খারাপ। এসব বলত। খুলনা ভার্সিটি নিয়েও দুদিন পর পর নানান কথা বলত। এখন কিন্তু সে নিজেই ন্যাশনালে পড়ুয়া মেয়ে বিয়ে করেছে! একবার পরীক্ষা দেবো বলে দুজন মিলে টিএসসি’তে অপেক্ষা করছিলাম। তখন ওর এক ফ্রেন্ড ওকে ফোন দিয়ে সেইফ রুম খুঁজছে ওর থার্ড জিএফ’কে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মেয়েকে বাসায় নিতে পারছে না, কেননা সেক্ষেত্রে ওর বর্তমান সেকেন্ড গার্লফ্রেন্ডের কাছে বাসার আশেপাশের কেউ এটা ফাঁস করে দিতে পারে। নিহাল হোটেলের নাম বলে দিল একসেকেন্ডেই, এরপর একটা নম্বরও মেসেজ করে দিল। আমার সামনেই এমন তিন-চারটা ফ্রেন্ডকে হেল্প করেছে, কখনওবা ইমারজেন্সি পিল কিনে দিয়েও। আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘একে ও বিয়ে করবে?’ বলত, ‘আরে নাহ্!’ ‘তাহলে?’ ‘তাহলে কী আবার? দুজনেই সম্পূর্ণ সজ্ঞানে যা করার করেছে। তো অসুবিধা কী?’ নিহাল বলত, ‘শোনো, এরা মানুষ ভালো। খুবই হেল্পফুল। এখনি যদি আমি একটা রুম চাই, ওরা নিজের রুমের চাবি আমার হাতে দিয়ে বাইরে চলে যাবে কয়েক ঘণ্টার জন্য। সমস্যা শুধু একটাই, মাঝেমধ্যে মেয়ে পালটায়, এ ছাড়া কোনও সমস্যা নাই।’ শুনে আমার কাছে মনে হতো, ‘এটাই তো ভালো-মন্দের আসল জায়গা! নিহাল কী বলে এসব!’ আমি কখনও এত ডিপলি অন্য ছেলের সাথে মিশিনি। তাই এসব জানি না। ওর এসব দেখে আমি ভাবতাম, এসব বোধহয় ছেলেদের মধ্যে কমন ব্যাপার! আমি আজও সেটাই ভাবি। জানি না সেটা সত্য না কি মিথ্যা। এজন্য ভয়ে কখনও কোনও ছেলে বন্ধু, এমনকি কাজিনদের ফোনও আমি ধরি না। যা-ই হোক, ভালো মন্দ, আলো অন্ধকার সবকিছুর ঊর্ধ্বে…আমি আমার নিহালকে ভালোবাসি। কীভাবে পাব ওকে? আমার তো কোনও অপরাধ ছিল না। তবে সে এমনটা কেন করল আমার সাথে? সে শুধুই কি আমার ক্ষতি করেছে? আমার পুরো পরিবারটারই কোমর ভেঙে দিল সে! আমার আম্মু বলে, ‘তোর এখনও কিছুই হারায় নাই। বরং ওর সাথে থাকলে তুই দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাবি।’ কিন্তু ধ্বংস তো আমি এখনও হচ্ছি! তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি, স্মৃতিগুলো আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে। আমার কিছুই ঠিক হচ্ছে না! সমস্যা শুধুই বাড়ছে। আমি অপেক্ষায় আছি, হয়তো কোনও একদিন এই শোককে আমি শক্তি বানিয়ে ফেলতে পারব। সে আমাকে আমাদের কোনও ছবি কাউকে দেখাতে দিত না। আমি ফেইসবুকে কিছু দিলে তো তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিত। রীতিমতো তেলেবেগুনে জ্বলে যেত সে। সে অবশ্য আমার কথা তেমন কাউকে বলতও না। ভালো সময়ে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘এসব ছবি আমরা কাউকে দেখাব না। বিয়ের পর দেখাব আর বলব, দেখো, এ সবই আগের ছবি!’ দেখে সবাই অবাক হবে। আর বিয়ের পরে দিতে বললে বলত, ‘এখন না। বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে একসাথে দেখব আর তাদের কাছে আমাদের প্রেমকেচ্ছা বলব।’ আমি তার সবই মেনে নিতাম। ওকে আমি ভালোবাসি, মেনে নেওয়া বাদে আর কোনও পথ আমার সামনে কখনওই ছিল না। সে এটা খুব ভালো করেই বুঝত। মনের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে, নিজের সাথে যুদ্ধ করে করে এই কয়দিনে এই গল্পটা লিখলাম। অনেক কিছু বলার বাকি রয়ে গেল। সবকিছু বলার সাহসও আমার নেই। আমি আমার এই গল্পটা লিখলাম, কেননা এটা আমি রাখতে চাই। এই একমহাসমুদ্র সমান দুর্বলতা আমার শক্তি হোক। আমি চেষ্টা করব বেঁচে থাকবার। আর ছোটোবেলা থেকেই তো দেখছি, আমার জীবনে যুদ্ধের শেষ কখনও হয় না। ছোটোবেলায় অন্যের কাছ থেকে বইপত্র চেয়ে চেয়ে পড়াশোনা করেছি, বড়োবেলায় এসে অন্যের কাছ থেকে দুঃখ চেয়ে চেয়ে জীবন কাটিয়েছি। তবু আমি আমার চেষ্টাটুকু করতে চাই। আর জীবনের লক্ষ্য ছিল একটা এতিমখানা করা। আমি সেটা করতে চাই। তবে এর আগে যেন সুইসাইড বা স্ট্রোকের কবলে পড়ে না যাই! আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে আম্মুর সব কথা শুনব। আম্মু আমাকে সব সময় ডায়েরি লিখতে বলে। আম্মুও ডায়েরিতে লিখে রাখে সব সময় সবকিছু। ইদানীং অবশ্য লেখা অফ রেখেছে। এরপর থেকে আমি আমার বাকি জীবনের ইতিহাসও লিখে রাখব। বুড়োবয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকলে এসব খুলে দেখব।