মানবজীবনের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা হলো—একদিন হঠাৎ জাগ্রত হয়ে জীবনের এক অনিন্দ্য আনন্দময় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া, যা মুক্তি এনে দেয় এমন স্তরে, যা কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। যুগে যুগে অগণিত আধ্যাত্মিক গ্রন্থে এই সম্ভাবনার বর্ণনা পাওয়া যায়। আর যারা সৌভাগ্যক্রমে এই জাগরণ লাভ করে, তারা যেন এক অপরিহার্য আহ্বানে বাধ্য হয়ে যায়—লিখতে, বলতে, প্রচার করতে কিংবা নীরবে উপযুক্ত শ্রোতার সাথে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত স্থানে তা শেয়ার করতে।
কল্পনা করা যাক—যদি জাগ্রত মানুষেরা সত্যিই রংধনুর শেষে কোনো জাদুকরী সোনার হাঁড়ি পেত, আর সেখান থেকে অবলীলায় “জাগরণের মুদ্রা” সবাইকে বিলিয়ে দিতে পারত, তখন যিনি এই মুদ্রা পেতেন, তিনিও নিজের পকেটে নতুন হাঁড়ি আবিষ্কার করতেন, আবার তা বিলোতেন অন্যদের। এভাবে একপ্রকার ঐশ্বরিক বহুস্তরীয় পরিকল্পনা (MLM—multi-level marketing!) চলতে থাকত, যতক্ষণ না পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে বলত—“জীবন সত্যিই সুন্দর।”
কিন্তু বাস্তবে আছে এক “rub”—প্রদীপ ছাড়াই ঘষা। আসল সত্য হলো—যদিও ক্রমবর্ধমান সংখ্যক গুরু, জাগ্রত শিক্ষক, আধ্যাত্মিক লেখক ও বক্তা পৃথিবীতে আসছেন, আর সবাই ভাগ করে নিতে চাইছেন “সুসমাচার”—জাগরণের বাণী—তবুও অন্যকে জাগিয়ে তোলা সহজ নয়।
শিক্ষকেরা আন্তরিকভাবে তাঁদের জীবনের গল্প বলেন এই আশায়—প্রতিটি শ্রোতাও সেই জাগরণের খোঁজ পাবে। কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার ছাত্র-শিষ্যের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া খুব কমই প্রকৃতভাবে জাগ্রত হয়—তা গুরু যতই বড়ো হোন না কেন। সম্ভবত এর কারণ—যদিও জাগরণ মানবজাতির ভাগ্যে লেখা, প্রকৃতির সময়সূচি মানুষের সময়ের মতো নয়। মানুষের জীবন তো মাত্র একটি চোখের পলক।
তবুও কেউ কেউ নিরুৎসাহিত না হয়ে এগিয়ে যান। কারও কারও ছাত্র সত্যিই জাগ্রত হয়, এবং সেই ক-জনের রূপান্তরই আধ্যাত্মিক শিক্ষার সত্যতাকে জ্যান্ত প্রমাণ করে।
এই অবস্থায় অনেক শিক্ষক বুঝতে পারেন—যদিও জাগরণ তাৎক্ষণিকভাবে সবার জন্য সম্ভব নয়, তবু তাঁদের শিক্ষা মানুষের মনোভাব, আচরণ, সম্পর্ক ও জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। তাই একধরনের প্রয়োগকৃত দর্শন গ্রহণ করা হয়—ধ্যান, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অভ্যাস পরিবর্তন, মানসিক শান্তি, এমনকি খেলার পারফরম্যান্স পর্যন্ত এতে করে উন্নত হতে পারে।
তবুও গভীরে রয়ে যায় সেই আকাঙ্ক্ষা—সোনার মুদ্রা হাতে তুলে দেওয়া, প্রদীপ ঘষে আনন্দে ভাসা। কিন্তু প্রদীপ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়—প্রদীপ ঈশ্বরের। কিংবা বলা যায়—প্রদীপ প্রত্যেকের নিজের ভেতরেই লুকানো। জাগরণের আলো ভাগ করে নেওয়া যায়, কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর কাজ প্রত্যেককেই নিজের ভেতরে করতে হয়।