: নীল, বলো তো, জীবন বড়ো কঠিন, না কি মানুষ?
: জীবনের কোনো অবয়ব নেই, মানুষের আছে। জীবনটা তো মানুষেরই হয়, মানুষ তো আর জীবনের হয় না।
: বেশ বললে। মানুষই বড়ো কঠিন, জটিল! নীল, মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি জীবনানন্দ হতাম, তবে সুরঞ্জনাকে একান্তে ডেকে কী বলতাম! হয়তো বলতাম, চলো, আজ মেঘের পথ ধরে হাঁটি...অথবা শুধুই, ভালো থেকো, সুরঞ্জনা!
তোমাকে বোঝা কঠিন, নীল। এর চেয়েও বেশি কঠিন নিজেকে বোঝা। তোমাকে বুঝতে না পারার এই জটিলতা আমাকে সুখ দেয়! কিন্তু নিজেই নিজেকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতা যে বড্ড যন্ত্রণা দেয়! সুখ বুঝি না, দুঃখ বুঝি না, কষ্ট বুঝি না…নীল, আমি আমার নিজেকে কিছুতেই বুঝতে পারি না! তুমি বুঝতে পারো আমায়? আমায় একটু নেবে তোমার ছায়ায়? ভালোবাসতে হবে না, মায়া করতে হবে না, যত্ন করতে হবে না, খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলে জড়িয়েও ধরতে হবে না, শুধু আমায় একটু বুঝতে চেষ্টা করবে?
জীবনানন্দ দাশ, হেলাল হাফিজ, কৃষ্ণজীবন, জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ, হার্সকেল ও হেনরিয়েটা…এই মানুষগুলোকে আমার খুব দুঃখী মনে হয়, জানো! ওঁদের পড়লে বুঝি, জীবন মানুষকে দুঃখ দেয় না, মানুষকে কেবল মানুষই পাহাড়সমান দুঃখ দিতে পারে, কষ্টে-যন্ত্রণায়-বিরহে নিঃশব্দে নিঃশেষ করে দিতে পারার অসীম ক্ষমতা রাখে!
আচ্ছা নীল, স্মৃতিও কি ঠিক জীবনের মতন হয়? না কি মানুষের মতন? এত দুঃখের গাথা কি সুখ লুকিয়ে রাখতে পারে! নাগচাঁপার গাছটায় জল দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, স্মৃতি মূলত বিগত সত্তা, মানুষ হলো তার ডাকবাক্স! মানুষ নিজের খেয়ালে একটা একটা করে স্মৃতি জমায়, সুখের না দুঃখের, জমানোর সময় এক বারের জন্যেও ভাবে না—জীবনভর শুধু জমিয়েই যায়! অথচ, সবচাইতে সুখের স্মৃতিও একটা সময় পর এতটাই ভীষণ কষ্ট দেয় যে, মানুষটা আর মুখোমুখি দাঁড়াতে অবধি পারে না!
মানুষ শুধু মানুষের কাছ থেকে পালায় না, মানুষ স্মৃতির কাছ থেকেও পালায়! কখনো কখনো কিছু স্মৃতি মানুষের ভেতরের নির্যাসটুকু পর্যন্ত শুষে নেয়! সেই মানুষটা সৌভাগ্যবান, যার একটা ঠিক নিজের মানুষ হয়, যার অস্তিত্ব স্মৃতির এই তীব্রতাকেও ম্লান করে দেয়।
নীল, তুমি কী আমার ঠিক সেই নিজের মানুষটা, যে কিনা টেস্টটিউবের গোলাপি দ্রবণে চুরি-করে-আনা পেপারোমিয়া গাছের শেকড় ডুবিয়ে, সারারাত জেগে গাছের জল খাওয়া দেখে! আরেকটা পেপারোমিয়া গাছের জন্য, স্কুল পালিয়ে রুনু আপাদের বাড়ির ভূতুড়ে বাগানটায় বিকেল গড়িয়ে বাড়ি ফিরে বেধড়ক মার খায়! যে সোনালু ফুলের পরাগদণ্ড ছিঁড়ে অমলতাসের হার বানায়!
ইস্, তুমিই তো আমায় বলেছিলে, জানেন, সোনালু ফুলের আরেক নাম অমলতাস। ভাগ্যিস, ভোম্বল দাস হয়নি! আর আমি কিনা গুরুর কাছে শেখা বিদ্যেয় গুরুকে ঘোল খাওয়ানোর প্রয়াসে ছিলাম!
নীল, কিছুই যে বলছ না বড়ো! হঠাৎ মৌনী হয়ে গেলে তোমায় খুব অচেনা লাগে যে! ওহ্! বলবে কী করে? তুমি তো আর আমার নেই, সেই কোন সুদূরে মেঘেরও ওপারে তোমার ঘরবাড়ি পাতানো আছে কোন জ্যোৎস্নাজলে, কে জানে! শুধু পেপারোমিয়া গাছটাই রেখে গেলে ভুলে!