অনেক অনেক বছর আগে,
এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম।
গিয়ে জানতে চাইলাম,
মহাশয়, এই জীবনের দামটা বলবেন? কী হয় বেঁচে থেকে?
তিনি বললেন, বলে দেব, তবে একটি শর্ত আছে। জীবনের দামে কিছু সোনার পয়সা চাই!
আমি তাঁকে পয়সা দিলাম, নিখাদ সোনার। এরপর,
আমার ডানহাতটা তাঁর চোখের সামনে মেলে ধরে সেই অমূল্য সত্যটি জানতে চাইলাম।
তিনি খুব ধীরে চোখ বন্ধ করলেন, আরও একটু সময় পর তাঁকে বলতে শুনলাম,
তুমি এ পৃথিবীর সবচে’ ধনী মানুষটি হবে, তবে সেজন্য লাগবে অপেক্ষা! বাড়ি ফিরে যাও, ধৈর্য ধরো!
আমি তা-ই করলাম। প্রস্থান ও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্তগ্রহণ।
দিন ফুরিয়ে বছর ঘুরল। একের পর এক। আমার কিছুই হল না, আমি আগের অবস্থাতেই রয়ে গেলাম।
একটা পরিবর্তন এল বটে! অবাধ্য ভুঁড়িটা বাড়ল, আর কিছু নয়।
আরও কিছু দিন ফুরোতেই হঠাৎ এক তাঁতি এলেন কোত্থেকে যেন!
দেখলাম, তাঁর ঝোলাভর্তি কাপড়, তাঁর চোখ অনেক খুশি।
খুব কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইলাম, আপনি কি ধনী হবার কোনও মন্ত্র জানেন? কোনও গোপন মন্ত্র, যা জানে না কেউই?
উত্তর পেলাম, আমি তোমায় ধনী হবার মন্ত্র দিতে পারি,
তবে তার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে কিছু কাপড় কিনতে হবে।
দেরি না করে কিছু কাপড় কিনলাম এবং বললাম, মন্ত্রটি কী, তবে?
তিনি হেসে বললেন, মন্ত্র কী আবার? কাপড় বুনতে শেখো, আর পৃথিবীর সবার কাছে বেচো। ব্যস্!
এরপর তিনি ঝোলাকাঁধে চলে গেলেন।
ধনী হবার মন্ত্রটা কী, তা তো জানলাম, তবে কাপড় কীকরে বুনতে হয়, সেই কৌশলটিই তো জানা হল না!
আরও কিছুদিন গড়াল। একদিন এলেন এক দুঃখী কৃষক। এসে জানালেন, তিনি ধনী হবার কৌশল জানেন, তবে সেটিকে কাজে লাগাতে পারছেন না।
শুনে খুব আগ্রহভরে কারণটা জানতে চাইলাম।
জানলাম, সেই বেচারার কাছে লাঙ্গল নেই, তাঁর একটি লাঙ্গল লাগবে। সেই লাঙ্গল দিয়ে চাষ হবে, সোনা ফলবে!
আমি তাঁকে লাঙ্গল তৈরির কিছু কাঠ দিয়ে ফসল ফলানোর কৌশলটি জানতে চাইলাম।
তিনি কথা দিলেন, তিনি আমায় তা জানাবেন, তবে কিছুদিন পর।
অবশেষে দিনটি এল। তিনি কিছু শস্য সাথে নিয়ে আমার কাছে এলেন, আর বললেন,
যদি শস্য ফলাতে পার, তবে তা বিক্রি করে ধনী হয়ে যাবে খুব সহজেই! শস্য দিয়েই যে পৃথিবী ঘোরে!
সেই কাঠের বদলে তাঁর শস্য পেলাম, তবে শস্য ফলানোর কৌশলটাই আর জানা হল না!
আমি শস্য বেচে ধন কিছু পেলাম বটে, তবু
ভাগ্য আমার আর এল না! আরও নতুন শস্য ফলাব কীকরে?
দিন কিছু আরও কেটেই গেল। একদিন এক দরবেশের দেখা পেয়ে তাঁর কাছেও একই উত্তর জানতে চাইলাম।
তিনি অভুক্ত ছিলেন, দুমুঠো খাবার চাইলেন।
তাঁকে পেটপুরে খাইয়ে বিশ্রাম করতে দিয়ে ভাবলাম,
আমিও একটু জিরিয়ে নিই এই ফাঁকে।
ঘুম ভেঙে দেখি, দরবেশ নেই। আমায় ফাঁকি দিয়ে তিনি চলে গেছেন।
বুঝে গেলাম, কিছু মানুষের জন্মই হয়েছে প্রতারণা করতে, বাকিদের, প্রতারিত হতে।
মানুষকে অবিশ্বাস করতে শিখে গেলাম, যেন পাপী হয়েই বিশ্বাসমুক্ত হলাম!
বিশ্বাসের ভারটা বড্ড বেশি!
ভাবলাম, একাই থাকব এখন থেকে! এই নগর আর আমার নয়। আমি অরণ্যে যাব!
ধনী হতে আর চাই না আমি, আমি কেবল নিজেকে আড়ালে রেখে দিতে চাই।
আমি বনের দিকে হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের নিচে থেমে সেখানেই কিছুদিন থেকে গেলাম।
একদিন এক যুবক এল।
এবার আমি আর কিছুই জানতে চাইলাম না। সেও একই পথে হাঁটল।
দুজন মিলে জমিয়ে আড্ডা হল। কেবলই নির্মল আড্ডা, কিছু চাওয়া নয়, কিছু পাওয়া নয়, আড্ডা কেবলই!
আমরা সেই আড্ডায় অনেক হেসেছিলাম, পরস্পরকে দেখেছিলাম। আর কিছু নয়।
এরই মাঝে কী যেন ঘটে গেল! সেই যুবকটি বিদায় নেবার সময় কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই তাকে বিদায় জানালাম।
তার কাছে আমার কিংবা আমার কাছে তার কিছু চাইবার ছিল না, ফলে বিদায়টি ছিল নির্ভার ও স্বস্তির।
সেদিনই আমি শিখে গেলাম কীকরে ধনী হতে হয়!
যুবকটি এল, আর আমায় শিখিয়ে গেল ধনী হবার মন্ত্র!
আমি জানলাম, কোনও কিছু পাওয়ার আশা না রেখে ভালোবাসতে জানলেই লোকে ধনী হয়ে যায়!
দৌলতের খোঁজ ধনে মিলে না, কেবল মনেই মিলে!
আমি যেন মুঠোয় ভরে পৃথিবী পেলাম! স্বার্থ ভুলে ভালোবাসা, এইটুকই, ব্যস্!
প্রত্যাশা সব বিদায় করেই ভালোবাসতে শিখলাম। মানুষকে ও প্রকৃতিকে।
আকাশকে, ঝর্ণাকে, নদীকে, পাহাড়কে, ফুলকে ও পাখিকে।
সাথে ছিল গাছের পাতা, চাঁদের আলো, সূর্যের তেজ, হাওয়ার গুঞ্জন।
যত দ্বিধা সব, উবে গেল যেন! অসীম নির্দ্বিধা এসে ভর করল। ভালোবেসে ফেললাম সব কিছুকেই!
এমন এক আশ্চর্য পরিক্রমায় ঘুরে আমি কীভাবে জানি নিজেকেই ভালোবাসতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম!
সেই ভুলে ঠিক মানুষের মতো দেখতে একটি পশুকে ভালোবাসতে গিয়ে
নিজেকে হারিয়ে ফেললাম পুরোপুরিই! ভালোবেসে যাওয়া আর হল না আমার! আজ বুঝি,
ভালোবাসলে পশুকেও ভালোবাসা যায়, তবে মানুষের মতো দেখতে পশুকে কখনও নয়!
ভালোবাসার হাজিরাখাতায় প্রথম নামটা নিজেরই হবে!
হারিয়ে গেলে নিজেই আগে, ভালোটা কে বাসবে তবে?