ডেটলাইন ২১ জানুয়ারি ২০১৫ কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র একেবারে প্রথম লাইনে পাই, “আলো ক্রমে আসিতেছে।” এত চিরন্তন সহজিয়া প্যাথোসে ভোর শুরু হবার কথা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি দেখি না। ফরাসি কবিতায় এই সুর খুব কমন। ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনে স্থান পাওয়া ‘দ্য রিভার’ ছবির শুটিংয়ে কলকাতায় এসে আমাদের গুরু সত্যজিৎ রায়ের গুরু জ্যঁ রেনোয়াঁ মুগ্ধ হয়েছিলেন ফরাসিতে সুপণ্ডিত কমলকুমারে। তিনি বলেছিলেন, কমলকুমারের মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য-স্মৃতি তাঁর জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যাক এসব কথা। যে-ভাবনা থেকে লাইনটার কথা মাথায় এল, সেটাতে যাই। আজ ভোরবেলা আমি আমার রুমমেটের আগেই উঠে উনি ওঠার জন্য অভ্যস্ত অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একটা সময়ে ওঁর ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। দু-জন একসাথে পিটি করতে গেলাম। কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হলো, এমন তো হবার কথা নয়! তবে কি আমি পাঞ্চুয়াল হয়েই গেলাম? এ-ও সম্ভব! রুম থেকে বের হয়ে দেখি, সুনীল-গুরু কমলকুমারের সেই আলো তখনও আসেনি। কুয়াশায়-ঘেরা আবছা অন্ধকার। প্রকৃতির প্রচ্ছন্ন আলোআঁধারি খেলা দেখতে দেখতে সবাই পিটি’র জন্য জড়ো হলাম। অনুভব করলাম, জলের তীর এসে মাথায়, মুখে বিঁধছে—বৃষ্টি নয়, কুয়াশা। হাঁটতে গিয়ে দেখি, ওয়াকিং-ট্র্যাকটিও ভেজা। এতটাই যে, দেখলে মনে হবে, বুঝি কাল রাতে বেশ একপশলা ঝরে গেছে। ঠিক বোঝা যায় না, ওই রাস্তা বৃষ্টিস্নাত নয়, শিশিরস্নাত। পিএটিসি’তে প্রথম দিনে আমরা কীভাবে চলব, কীভাবে চলব না, এসব নিয়ে নর্মস-সেটিংয়ে আমরা কথা দিয়েছিলাম, Pacta sunt servanda, মানে ‘চুক্তি রাখতেই হবে’। চুক্তিগুলোর মধ্যে ‘ফুল ছেঁড়া যাবে না’, এটা ছিল না; ‘গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখা যাবে না’, এমনটাও ছিল না। ফুল ছেঁড়া যায় না, ঠিক আছে; কিন্তু পাতা তো ছুঁয়ে দেখাই যায়। ছুঁলাম। ঠান্ডায় জমে-যাওয়া আঙুলে শিশিরে-ভেজা পাতা হঠাৎই কী যে শিহরন জাগায়, সেটা লিখে বোঝানো যাবে না। মন তখন আওড়ে যাচ্ছে, পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির...পাখি নেই, ওরা ঘুমিয়ে তখনও। পাখিদের পিটি নেই, ওদের শীত আছে। কুয়াশায় একটু দূরের জিনিসও চোখে পড়ে না। ওই ওখানটায় গোলপোস্টে কী একটা যেন ঝুলছে। কী? কী ওটা? লাশ নয়তো? মাঠের দিকে একটু এগিয়ে কুয়াশার ধুলোমাখা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখলাম, গোলপোস্টে যা ঝুলছে, সেটা বড়োসড়ো ওভারকোট; ওটার ঘাড়ের দিকের ফাঁকে চোখে পড়ে পোস্টঅফিসের দোতলায় গতরাতে কে যেন আলো নিভিয়ে যেতে ভুলে গেছে। শীতের রাত আর ভোরের সঙ্গমসুখের ধূসরিমা-মাখা বুড়ো মাঠ। ধুলোর সাথে হিমকণার মিতালি। সপ্তপদী’র পুরো সেটটাই আছে, উত্তমও আছে, সুচিত্রাই শুধু নেই…হা হা হা। সূর্যের সুখঘুমে আমাদের হাঁটাহাঁটি কিংবা কাঁপাকাঁপি। ঠোঁটে কাঁপছে ‘মুক্তিস্নান’...“সুরের আসর থেকে মন নিয়ে এসেছি গো ফুলের বাসরঘরে (বন্ধু)—পারো তো ধরো না মোরে, বাঁধো না মালার ডোরে...” পাশেই শুনি, কলিগ গাইছে, “তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর তোমার সাথে ছিল পরিচয়, বুঝি ছিল পরিচয়...” না, এন্ড্রু কিশোরের কাছে হেমন্ত মার খেয়ে চুপ হয়ে গেল। ততক্ষণে সূর্য একটু একটু আড়মোড়া ভাঙছে। পেছনে লাবণ্য পুরুষকণ্ঠে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে...হেথা মোর তিলে তিলে দান,/ করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান/ হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।/ ওগো তুমি নিরুপম,/ হে ঐশ্বর্যবান,/ তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান–/ গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়।...রোদের একটুখানি উঁকিঝুঁকিতেই শুরু হয়ে গেল...বলো বীর- বলো উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!...বড়ো ভালো লাগল। সুরের ছোঁয়ায় পিটি’র সব অসুরত্ব ধুয়ে-মুছে গেল। কে বলে পুলিশের কণ্ঠে সুর নেই, মায়া নেই? আহা! ওই অসুরবিনাশী দ্বিভুজ দাদাকে আড়াই কাপ নেসক্যাফে খাওয়াতে হবে। লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ওধারের গাছগুলো লেকের স্যাঁৎসেঁতে পাড় পিছলে জলে পড়ে যাবার আগেই ধোঁয়া ওদের আটকে দিল; ও-ধোঁয়া আগুনের নয়, জলের। ওতে আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়াতে বড্ড ইচ্ছে হয়। জলের কায়ায় কুয়াশার ছায়া। জলের শরীর উড়ছে, কিন্তু ফুরোচ্ছে না। অপার্থিব এক দৃশ্য! একটু ওদিকটায় বনসাই আকৃতির ছোটো ছোটো করে ছাঁটা ঝোপের মতো গাছগুলো সীমানা দেখিয়ে দেয়। ওগুলো রঙ্গন নয়, রঙ্গনের ভাই। আচ্ছা, ওদের নাম কী? এই যে গাছের নাম না-জানাটা, এটা খুব অস্বস্তি দেয়! পিএটিসি’তে এসে ফুলমূর্খ আর গাছমূর্খ হওয়াটা ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছে। আমি গাছের নাম জানে, ফুলেদের কথা জানে, এমন কারও বন্ধু হব ভাবছি। আছেন কেউ এমন? ও-ধারে মাথা-নুয়ে-থাকা গাছগুলো রাস্তার দু-পাশে অরণ্যের আবহে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের শাখায় পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। এই ভোরটা দেখতে সন্ধের মতন। এই ক্ষণটায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র কথা মনে হলো; সুনীলের নয়, সত্যজিতের। আহা! ওই পথকে যে শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে! জীবনানন্দ এখানে এলে আবারও বলতেন, “এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি; সারারাত দখিনা বাতাসে আকাশের চাঁদের আলোয় এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি–কাহারে সে ডাকে!” হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, ডাকে! কে ডাকে? ট্রেইনারের বাঁশি ডাকে, একটু দূরে রাজহাঁস ডাকে। শেখাতে ডাকে, কিছু বলবে বলে ডাকে। কী শেখান? বডিস্ট্রেচিং, একটু ব্যায়াম, আধটু ছোটাছুটি। এই তো! পিটি শেষ, রাজহাঁসের ডাক নয়। ওরা ডাকে। মাথা নত না-করা শাদা শাদা ভালোমানুষের দল। (আমি ভাবছি অন্যকথা। এরপর থেকে রাজহাঁসের মাংস খাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে না তো? এই যে ভাবছি, এই শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে গিয়ে হাঁসের মাংস খাব, তার কী হবে? আচ্ছা, ওরা শুধু রাজহাঁসই রাঁধে নাকি?) ভোরের আকাশের ছায়ায় প্রজাপতির সাথে গোলাপের প্রেম দেখতে দেখতে রুমে ফিরলাম। ফেরার পথে এক কলিগ বললেন, “আজ অমুক স্যারের ক্লাস আছে। উনি ক্লাসে ‘হাসাতে হাসাতে মেরে ফেলেন’। ওঁর ক্লাস করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।” আমিও এই ভাবী সুখের মরণের সুখভাবনায় দুলতে দুলতে ডরমেটরির সিঁড়ি ভাঙলাম। হাসার জন্য খুব মন দিয়ে মনে মনে সব প্রিপারেশন নিতে লাগলাম। রুমবয় এসে জিজ্ঞেস করে, “স্যার, কী লাগবে?” আমি ওকে নিরাশ করে বলি, “কিছুই লাগবে না।” এভাবে করে ওকে প্রায়ই ফিরিয়ে দেওয়াটা হচ্ছে প্রতিদিনকার বেশিরভাগ সময়ের সিনারিও। কী করব! কিছু বই আর এই ল্যাপটপটা বাদে আর কিছু লাগে না যে! একটু পর ৭:২৫টায় আমার রুমমেট নাস্তা করতে বেরিয়ে গেলেন। রুমে আমি একা। এখন আমি ইচ্ছে করলে পিটিড্রেস কোনো লুঙি-টুঙি ইউজ না করেই সরাসরি বদলাতে পারি, ইচ্ছেমতো হাত-পা ছুড়ে নাচতে পারি, দরোজা খোলা রেখে শাওয়ার নিতে পারি, শাওয়ার নেবার সময় ইচ্ছেমতো চিৎকার করে পৃথিবীর সবচাইতে বিশ্রী বিশ্রী গানগুলো গলা ছেড়ে ধেড়ে-গলায় গাইতে পারি। এমনকী শাওয়ার নিয়ে বের হবার সময়ে টাওয়েল পেঁচাতে পারি শুধু শীত নিবারণ করতে, লজ্জা নয়। আদিমতায় ফিরে যেতে পারি ইচ্ছে হলেই। লজ্জাহীন নিঃসঙ্গতার সুখ বড়ো আনন্দ দেয়। শেভ করলাম, নাক-মুখ খিঁচিয়ে আয়নায় দেখলাম, নাক-মুখ খিঁচালে দেখতে গত বারের চেয়ে ভালো লাগে কি না। বাথরুমে শাওয়ারে গেলাম। কোত্থেকে যেন একটা গান মাথায় ঢুকে গেল। জলের কল ছেড়ে বালতিতে কলের জল পড়ার শব্দের স্কেলের সাথে আমার গলার স্কেল মিলিয়ে ওই গানটাই গলা ছেড়ে গাইতে লাগলাম। জল পড়ার শব্দের স্কেলই হলো আমার বাথরুম-সংয়ের স্কেল। শীতের সকালে স্নান করার একটা নিয়ম আছে। জলের দিকে তাকাতে হয়, একবুক সাহস সঞ্চয় করে জলের মগটা হাতে নিতে হয়, এরপর মগে জল নিয়ে সে জল নাচতে নাচতে উঃ উঃ শব্দ করে পায়ে ঢালতে হয়, পরের মগের জল বীরের মতো হুংকার ছেড়ে মাথায়-গায়ে ঢালতে হয়, এর পরের মগের চ্যালেঞ্জ কোনোরকমে উতরে যেতে পারলেই ব্যস্! কেল্লা ফতে! জিতে গেলেন! পরের মগগুলোকে আর আপনার গার্লফ্রেন্ডের ছবিতে লাইক-দেওয়া খ্যাত খ্যাত ছোকরাগুলোর মতন অসহ্য লাগে না। আজ স্নান করার মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে সবচাইতে সুখের আর শান্তির কাজ হলো, শীতের সকালে ‘মেরে সামনেওয়ালে খিড়কি মে এক্ চাঁদ কা টুকরা রাহেতা হ্যায়’ গানটি চিৎকার করে গাইতে গাইতে বরফঠান্ডা জল মাথায় ঢালতে থাকা। আহা, কী আনন্দ বাথরুমে বাথরুমে! না, টাওয়েল পেঁচিয়েই বের হয়ে রেডি হলাম। ক্লাসে যাব। প্রথম ক্লাসটা রেক্টর স্যারের সাথে। স্যার বরাবরই জীবনমুখী লেসন দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। আজকেও তা-ই। ওঁর ক্লাসে কেউ ঘুমায় না। একটা ট্রেনিংসেশনে ঘুম আসা না-আসা যতটা না ট্রেইনিদের উপর নির্ভর করে, তার চাইতে বেশি নির্ভর করে ট্রেইনারের উপর। স্যারের কিছু কথা আমার নিজের মতো করে শেয়ার করছি: # যদি তোমার কোনো জুনিয়র কলিগ তোমার নির্দেশে কোনো কাজ করে এবং সেই কাজটি নিয়ে পরবর্তীতে কোনো সমস্যার উদ্ভব হয়, তবে সেই কাজটির যাবতীয় দায়দায়িত্ব কাঁধে নেওয়াটা তোমার দায়িত্ব। # তোমার বসের বসকে তোমার বস সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথাবার্তা বলবে না। যদি এই বিষয়ে উনি জিজ্ঞেস করেন, তবে নিজের দোষটা স্বীকার করে নেবে। ওঁকে বলবে, তুমি নিজেকে শুধরে নেবার চেষ্টা করছ। # কেউ তোমার সাথে শত্রুতা করার চেষ্টা করলে যদি তুমি ওর দুষ্টুমিকে পাত্তা না দাও, ওর সাথে হাসিমুখে কথা বলো, আর তোমার যা কাজ তা নীরবে নিভৃতে করে যাও, তবে দেখবে, এটাই ওকে সবচাইতে বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দেবে। # যতটুকু সম্ভব পরিবারকে সময় দাও। লাঞ্চটা করা সম্ভব না হলেও ডিনারটা পরিবারের সবার সাথে একসাথে বসে করার চেষ্টা কোরো। সবার খোঁজখবর নাও। এতে করে তোমার পারিবারিক বন্ধনও দৃঢ় হবে, পরিবারের সদস্যদের সাথে গ্যাপ কমবে, এবং ছোটোখাটো সমস্যা টেবিলে বসেই সলভ করে ফেলতে পারবে। মাঝে মাঝে তোমার ছেলেমেয়ের বন্ধুবান্ধবকে তোমার বাসায় দাওয়াত দাও, ওদের সাথে গল্প করো, সময় দাও। তোমার ছেলেমেয়ে কার সাথে মেশে, এটা তোমার জানা প্রয়োজন। শেষের কথাটির প্রসঙ্গে আমার নিজের ফ্যামিলির কিছু কথা শেয়ার করছি। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে, ছোটোবেলায় আমাদের বাসায় আইপিএস ছিলো না। সন্ধেয় যখন কারেন্ট চলে যেত, তখন বাবা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসতেন। আমরা প্রতিদিন সন্ধেয় অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন কারেন্ট চলে যাবে। ছোট্ট আমি আর আমার ছোটো ভাই বাবার হাঁটুর ওপরে বসে বসে বাবার মুখে শুনতাম, বিজলি বাতি চাঁদের আলোকে চুরি করে নিয়ে কীভাবে আমাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে রেখেছে। বাবার কাছে তারা চিনতাম, চাঁদের আলো কীভাবে ছুঁয়ে দেখতে হয় শিখতাম, গাছের পাতায় চাঁদের আলো এসে পিছলে পিছলে গেলে তা দেখতে কেমন লাগে—বাবা এইসব কথা বলতেন। এমন একটাও ছুটির দিন ছিল না, যেদিন বাবা মাকে মাছ-তরকারি কুটা, ঘর ঝাড়মোছ করা, কাপড় ধোওয়া—এইসব ঘরের কাজে হেল্প করতেন না। বাবা হয়তো সবচেয়ে দামি খাবারটা নিয়ে ঘরে ফিরতেন না, কিন্তু সবচেয়ে দামিভাবে আমরা খাবারটা খেয়েছি। বাবা বলতেন, তোর মা সারাদিন ঘর সামলে রাখে বলেই তো আমি বাইরে কাজ করতে পারি। বাবাকে কখনোই মায়ের রান্নার সমালোচনা করতে দেখিনি। বাবা মাকে বলতেন (এবং এখনও বলেন) হোম মিনিস্টার। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বাসায় শুধু ডাল-আলুভর্তা রান্না করলে যে খাবারের টেবিলে বসে মাকে জিজ্ঞেস করতে হয়, “আর কিছু নেই?”...এটা ছোটোবেলা থেকে কখনোই শিখিনি। বরং মা যে সারাদিন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এই অসুস্থ শরীরেও ব্যস্ত সময় কাটান, বাবা সেটা অ্যাকনলেজ করতেন বার বার। মায়ের সব কাজের প্রশংসা করতেন। মা ছোটো বাচ্চাদের মতো খুব খুশি হয়ে উঠতেন আর সমস্ত কষ্ট ভুলে বাবার কাছে গল্প করতে বসে যেতেন, সারাদিনে কী কী হলো সব বলতেন। বাবা বলেন, মেয়েরা বড্ড ছেলেমানুষ হয়। ওদের মনে কষ্ট দিলে সেটা বহুগুণে ফেরত আসে। আমার মা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। এটা করতেন স্রেফ শখে। আমাদের নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করা, বাসার সব কাজ সামলে রাখা, সামাজিকতা ঠিক রাখা, এইসবও মা’কেই করতে হতো। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেন, তবে এর ফল আপনি না পেলেও আপনার ছেলেমেয়ে পাবে। ফ্যামিলিতে যিনি পয়সা আয় করেন না, তিনিও কিন্তু আপনার মতোই টায়ার্ড ফিল করেন। পয়সা আয় করা বা না-করার সাথে ক্লান্তিবোধ করা না-করার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি দেখেছি, বাসার সব কাজ করার জন্য বেতন দেওয়া হলে আমার মায়ের বেতন আমার বেতনের অন্তত ডবল হতো। জীবনের ছোটো ছোটো সুখগুলোকে যদি ভালোবাসা দিয়ে উপভোগ করা যায়, তবে জীবনের সব হিসেব তো মেলেই, সাথে বোনাসও মেলে। খাবার খেতে ভালো লাগে স্বাদে নয়, ভালোবাসায়। তাই বুঝি সবারই মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সবচে’ সুস্বাদু রান্না। যারা অনেক দিনের জন্য ঘরের বাইরে আছেন, তাঁরা তো জানেনই, মায়ের হাতের মসুরের ডাল আর বেগুন ভাজি খাওয়ার লোভে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্যকেও কত সহজেই গুডবাই বলে দিতে ইচ্ছে হয়! ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ছেড়ে আবারও পিএটিসি’তে ফিরে আসি। স্যারের ক্লাসশেষে করিডোর দিয়ে অন্য একটা ক্লাসরুমে যাবার সময় একধরনের বোকা ঈর্ষা জেগে উঠল। ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ মুভিতে ঝাউবনের কাছের বাগানে বৃদ্ধ প্রফেসরের জীবনের কিছু আগের আর বর্তমানের ঘটনার মন্তাজ-প্লটটার কথা মনে পড়ে? করিডোর পেরিয়ে গোলাপবাগানের ওপারের ঝাউবনের নেশাধরা সজ্জা দেখে ছুঁতে ছুটে যাব ভাবছি ভাবছি, এমন সময়ে চোখে পড়ল, গোলাপবাগানে দুইজন মালী গোলাপের রাঙা ছটার যত্ন নিচ্ছেন খুব কাছ থেকে। গাছের গোড়ার মাটি এদিক-ওদিক করে জল দিচ্ছেন। আমাদের বাগানে ঘোরার অনুমতি নেই। মনে হতে লাগল, গোলাপের কাছে যেতে যদি মালী হতেও হয়, আমি তাতেও রাজি। প্রিয়ার সান্নিধ্য পেতে প্রিয় কত কিছুই তো করে! এ তো সামান্য চাকরি! ছদ্মবেশী’র উত্তমকুমার আর পিএটিসি’র সুশান্ত পাল! মুভির প্রিয়া আর জীবনের ফুল। দুই-ই যে হৃদয়কে বাঁচিয়ে রাখে! মানুষ কীসে বাঁচে? মানুষ বাঁচে ভালোবেসে, ভালোবাসায়। উলটো রাজার দেশে ঘুরতে ঘুরতে টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট শিখতে এলাম; সরকারের একজন যুগ্ম সচিব মহোদয় শেখাবেন। কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্টে সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, সেটা শেখানোর সময় প্রোজেক্টরের লো কোয়ালিটির কারণে অডিয়ো-ভিজুয়াল সিস্টেম বার বার ফল করছিল। স্যার অনেক বিষয়েই বললেন। ওঁর একটা বুদ্ধি আমিও মেনে চলি। আমি সেটাকে বলি, Leave to Live. আপনার বাসায় পেরেকের কৌটোটিতে আপনি কয়েক বার দেখেছেন, সেখানে অনেক পেরেক আছে, যেগুলো কোনো কাজের নয়, কারণ সেগুলোর সরু অংশের দিকটা ভোঁতা কিংবা ডিফেক্টিভ। এখন কথা হলো, এর পরেও আপনি সেই জাঙ্কগুলোকে ফেলে দেননি কেন? কৌটোয় রেখে দিয়েছেন কেন? এগুলো কী কাজে লাগবে? বরং এগুলো ভালো পেরেক খুঁজতে দেরি করিয়ে দেয়। বাজে জিনিসের মায়া ছাড়তে না পারলে ভালো জিনিস হারিয়ে যায় কিংবা কাজের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। এইসব পুরোনো অভ্যেস আর সমস্যাগুলো একটু একটু করে প্রতিদিনই ঠিক করতে হবে। জাপানিরা একে বলে কাইজেন, মানে কোনো একটা সিস্টেমকে একটু একটু করে ভালো করে একটা সময়ে পুরো সিস্টেমটাকেই মানসম্মত করে ফেলা। কাইজেনের আরেকটি উদাহরণ হলো: ধরুন, আপনি একটা উপজেলার শিক্ষা অফিসার। আপনার অধীনে অনেকগুলো স্কুল আছে। সেই স্কুলগুলোর টয়লেটের দেয়ালে অনেক কিছু লেখা আছে। এই যেমন, P+R; বন্ধু, সুখে থেকো; তুমি আর আমি, বাকি সব হারামি; গাছের পাতা নড়ে চড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে...এরকম আরও অনেক কিছু। আপনি নিজ উদ্যোগে সেই দেয়ালগুলো রং করার ব্যবস্থা নিতে পারেন। খুব ছোটো কাজ, কিন্তু এর ইম্প্যাক্ট অনেক বড়ো। স্যার বেশ চমৎকার পড়ালেন। মজার ব্যাপার হলো, উনিই সেই আমার কলিগের ‘হাসাতে হাসাতে মেরে ফেলেন’ দাবি-করা স্যার। আমি খুব দমফাটানো হাসির সকল প্রস্তুতি নিয়ে-টিয়ে পরে রামগরুড়ের ছানার মতো স্যারের ক্লাস শেষ করলাম। আবারও বুঝলাম, কারও কথা বিশ্বাস করার আগে ভালো করে জেনে নিতে হবে, উনি কি কথাটি জেনে বলছেন, না কি শুনে বলছেন। শিওর হবার আগেই লাফালাফি শুরু করে দেওয়া যাবে না। এরপর ক্লাসে এলেন আজকের দিনের সবচাইতে মজার স্যার। উনি আমাদের ফিজিক্যাল এডুকেশনের উপর ক্লাস নিলেন। মিমিক্রি করার মতো এত ভালো এলিমেন্ট আর হয় না! Some are seriously humorous, some are humorously serious. স্যার সেকেন্ড দলে। ওঁর সিরিয়াসনেস যতটা না দেখার মতো, তার চাইতে ঢের বেশি উপভোগ করার মতো। পড়ানোর সময় শুধু ওঁর অঙ্গভঙ্গিমা দেখার জন্যও টয়লেট আটকে রেখে ক্লাসে বসে থাকা যায়। অন্য স্পিকারদের ঠোঁট কথা বলে, আর স্যারের শুধু ঠোঁটই না—চোখ, হাত, মুখাবয়ব, ঘাড়, পেট, পা, কোমর, চুল এমনকী টাই আর চশমাও কথা বলে! স্যার আমাদের সবাইকে এতটাই সিরিয়াস ভঙ্গিতে ইনভলভ করার চেষ্টা করছিলেন যে, মনে হচ্ছিল, বেচারা এখুনিই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবেন! চোখ-নাক-মুখ খিঁচিয়ে এমন অদ্ভুত ঢঙে পড়ান, মনে হয় যেন ‘দ্য কিড’ মুভিটা দেখছি। আমাদের মধ্যে একজন বলল, “স্যার, খুব শীত পড়েছে। অনেক কষ্ট।” স্যার বললেন, “Ah! We should not go against Nature. Respect Winter.” এটা বলেই উনি নিজের গায়ের কোটটি খুলে চেয়ারে রেখে দিলেন। বিভিন্ন ডিজিস নিয়ে পড়ানোর সময় ক্যানসার নিয়ে বলছিলেন। “একটা সময়ে মানুষ ভাবত, If there is cancer, there is no answer. কিন্তু এই কথাটি নিজেই একটা রং আনসার।” এরপর বিভিন্ন পর্যায়ের ক্যানসারের কথা বলতে বলতে গলার স্বরটা একটু অদ্ভুতভাবে নামিয়ে বললেন, তবে যদি কারও ফোর্থ ডিগ্রি ক্যানসার হয়, তখন তার একমাত্র কাজ: অলমাইটি গডকে স্মরণ করতে থাকা। ‘ধামাল’ মুভিতে প্লেনটা ক্রাশ করার আগে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে বলার সময় যে ঢং আর ভঙ্গিতে বলছিলেন, স্যারকে দেখতেও ঠিক ওরকমটাই দেখাচ্ছিল। স্যারের একটা মজার ব্যাপার আছে। কথা বলার সময় হুট করেই বলেন, “একটা কথা মনে পড়ে গেল...বলব?” একটা স্লাইড পড়াতে শুরু করার আগে “এই স্লাইডটা অতটা দরকারি নয়।”...এটা বলেও সেটা অনেকক্ষণ ধরে পড়ালেন। এরপর চট করে ৬টা স্লাইড স্কিপ করে পরের স্লাইডটাতে গিয়ে বললেন, “সময়ের অভাবে কিছু ইম্পরট্যান্ট স্লাইড বাদ দিলাম, যেগুলোর একটাও পরীক্ষার জন্য দরকার নাই।” একজন জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া ভালো, না কি মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া ভালো?” স্যার বললেন, “প্রয়োজনের সময় সবদিকেই নিবেন, সবদিকেই ছাড়বেন। কোনো ব্যাপার না!” পড়াতে পড়াতে বললেন, “শোনেন, আপনাদেরকে একটা গল্প বলি। আমরা সবাই ছোটোবেলায় একটা গল্প শুনসিলাম না, ওই যে বনে গিয়ে দুইটা ছেলে একটা বানর পাইসিল? এরপর কী হইসিল? কী আর হবে! যা হবার। তা-ই হইসিল...বুঝে নেন। হে হে...” স্যারের গল্প শেষ। ওঁর অদ্ভুত রকমের সিরিয়াসনেস আর বডি ল্যাংগুয়েজ দেখলে যে-কারুরই ‘কাল হো না হো’ মুভির প্রীতি জিনতার নানীর ক্যারেকটারটির কথা নির্ঘাত মনে পড়ে যাবে! যখন টিভি’র কথা বলেন, তখন এমন ঢঙে বলেন, মনে হয় যেন ওঁর হাতের নিচে সত্যি সত্যি একটা টিভি আছে। তাকানোর ধরন, কথা বলার ধরন, হাত-পা নাড়ানোর ভঙ্গি, মাথা আর শরীর এদিক-ওদিক দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলার ভঙ্গিমা, এসব কিছু যখন একসাথে আমাদের চোখের সামনে চলছিল, তখন মনে হচ্ছিল যেন কার্টুন দেখছি। স্যারের মৃত্যু নাই। আমি শিওর, স্যার মৃত্যুর পর ক্যাসপার হয়ে যাবেন। স্যার অমর। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা মনে আছে না? স্যারের ক্লাস সম্পর্কে একইভাবে বলছি, It was a lecture of the health, for the health, by the health. এখন আসল কথায় আসি। স্যারের নামের আগে ডক্টর লেখা। আমাদের বডি মেকানিজমের উপর স্যারের জ্ঞান আর বিভিন্ন ডিজিস নিয়ে অসাধারণ বলার ধরন দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, উনি অনেক বড়ো একজন ডাক্তার। এমন একজন মজার মানুষের কাছে গেলে রোগী এমনিতেই অর্ধেক ভালো হয়ে যাবে। স্যারের ক্লাসটা এতই ভালো ছিল যে, শিক্ষক মূল্যায়ন শিটে আমি স্যারকে সব ক্যাটাগরিতেই ‘এক্সসিলেন্ট’ লিখে দিয়েছি। স্যারের পরিচয় পরে জানতে পারলাম। উনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স। এরপর ফিজিক্যাল এডুকেশনের উপর একটা কোর্স করে একই বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। (উনি খুব সম্ভবত এই বিষয়ের উপর বাংলাদেশে একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রিধারী।) এই সেক্টরে উনি দেশের একজন ফেমাস কনসালট্যান্ট। একটু আগে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, ধূসর আলো-আঁধারিতেও চোখে পড়ে, এমন দূরের একটা ল্যাম্পপোস্টের নরোম নরোম আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেড়ে চলেছে রাত। বিকেলে শ্বেতভাল্লুকের দলের নিষ্ঠুর থাবায় মাড়ানো ঘাসের কষ্ট শুনতে কান পেতে দিয়েছে ঠকঠক কাঁপতে থাকা দয়ালু বয়েসি শীর্ণ রাতের ঘুম-নেই’রা। বোকার হদ্দ ঝিঁঝিরা পাজি শেয়ালগুলোর সাথে এই পাল্লা দিল বলে!