পিএটিসি ডায়েরি: ২০ জানুয়ারি

ডেটলাইন ২০ জানুয়ারি ২০১৫

আমার এমনিতে কখনোই খুব ভোরে ঘুম ভাঙে না। আজ পিটি শুরু হবার কথা ৫টা বেজে ৫৯ মিনিট ৬০ সেকেন্ডে। রাতে ঘুমোনোর সময় মোবাইলে ৫টা অ্যালার্ম সেট করে শুয়েছিলাম। ৫:২৫, ৫:৩০, ৫:৩৫, ৫:৪০, ৫:৪৫। মজার ব্যাপার হলো, ভোর সোয়া ৫টায় আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে অ্যালার্ম কখন বাজবে, সেই মুহূর্তটার জন্য ওয়েট করতে লাগলাম। ঘুম ভেঙেছে; জানি-ই, উঠে যাব, কারণ উঠতে হবে, কিন্তু বিছানা ছাড়ছি না। এর ব্যাখ্যা কী, আমি জানি না। পুরোপুরি উঠেও গেলাম না, আবার ঘুমিয়েও পড়লাম না। চোখেমুখে তন্দ্রা আর না-দেখা স্বপ্ন মেখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কীসের জন্য? তা-ও জানি না।

‘তেরে নাম’ মুভিটার কথা মনে আছে না? পাগলা ঘণ্টা বাজালে সবাই গিয়ে এক জায়গাতে জড়ো হত। পিএটিসি বেলে চলে। ঢং ঢং...ঢং ঢং ঢং...ঘড়িতে তখন সাড়ে ৫টা বাজে। আমাদের জাগিয়ে দেবার জন্য এই ব্যবস্থা। সবাই ঘুম ভেঙে শাদা ট্র্যাকস্যুট পরে শাদা জুতো-মোজায় ৬টার আগেই পিটি গ্রাউন্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে এক দারুণ দৃশ্য! মনে হচ্ছিল, খুব ভোরে শাদা ক্যাডারের পাল ওই গোলাপবাগানের রাজহাঁসের দলের মতো জড়ো হয়ে প্যাঁকপ্যাঁক করছে। ‘ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কাকুস নেস্ট’ মুভিতে সবাই যখন শাদা পোশাকে জড়ো হয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে খোশগল্প করে, তখন দেখতে যেমনটা লাগে, আমাদের পুরো দলটাকে এই ভোরবেলায় ঠিক তেমনটাই দেখাচ্ছিল। শুরু হলো ২.২ কিলোমিটার ট্র্যাকে হাঁটা। অডিটোরিয়ামের সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম, ঝোপের মতো গাছগুলো যেন কুয়াশায় নিজেদের ঢেকে রেখেছে। প্রচ্ছন্ন একটা আবহ যেন টেনে নিয়ে যেতে চায় সেখানে! হাঁটতে হাঁটতে আরও দেখলাম, গ্রিনহাউজের মতো আকৃতির কিছু কটেজ। সেখানে কীসব লতানো গাছ ঝুলছে। নিচে কিছু বেতের সোফা বিছানো। খুব ইচ্ছে করছিল, লো ভলিয়্যুমে কিটারো ছেড়ে দিয়ে পাশে বড়ো বড়ো মাটির গামলায় রাখা জলে যেখানে লতার ছায়া খেলছে, সেদিকে অলসভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কফির মগে ভাবনাহীন চুমুকে একটা বিকেল কাটাই। ট্র্যাক শেষ হলে আমরা এসে টেনিস গ্রাউন্ডে বসে পড়লাম। সেখানে হাজারিকা মহোদয় আমাদের সাথে ইন্সট্রাক্টরদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেখলাম, সবাই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা। খুবই আন্তরিক আর সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার। যখন আমরা সবাই পিটি’র ড্রেস পরে একসাথে হই, তখন নিজেদেরকে স্কুলবয় ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না; এমনকী আমরা বাচ্চাদের মতো আচরণও করতে শুরু করি। এই যেমন, বাচ্চারা যেমন কথা বলার সময় কথা শেষ করতে না দিয়েই পরের কথাটা জিজ্ঞেস করতে থাকে, আমরাও আজ হাজারিকা স্যারের সাথে একই আচরণ করছিলাম! ভাগ্যিস স্যার বড্ডো ভালোমনের মানুষ। সারামাগোর 'ব্লাইন্ডনেস' উপন্যাসের অন্ধদের মতো আমাদেরও একটা কমন ইন্সটিঙ্কট ডেভেলপ করেছে। আমরা সবাই একঘরের কাছের মানুষ। আমাদের সকল পাগলামি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পদ। এ নিয়ে আমরা কারও কথা শুনব না।

৭:১০টায় পিটি শেষ হলো। শাওয়ার নিয়ে প্রাতরাশ সেরে ক্লাসে যেতে হবে ৮:২৫টার মধ্যেই। রুমে ফেরার সময় আবার সেই গোলাপের বাগান প্রতিদিনের মতো দেরি করিয়ে দিল। গোলাপকে আমরা যে-নামেই ডাকি না কেন, তা গোলাপই থাকবে। কিন্তু কেন যে-কোনো নামেই ডাকব? কী আশ্চর্য সুন্দর সব নাম ওদের! গোলাপের প্রতিটি সারির পাশেই নিচে ওদের নাম-লেখা প্লেট আছে। করিডোরের পাশ দিয়ে যাবার সময় আমি এমনিতেই একটু ধীরে ধীরে হাঁটি। আজ দেখি, ডালিয়াও দেরি করিয়ে দিল! কত রঙের প্রজাপতি ওর ওপরে খেয়ালখুশিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হতে লাগল, আহা! ডালিয়ারাও এত সুন্দর হয়! মায়ের হাতে লাগানো গাছে ফুল ফুটলে মা খুশিতে ফুলের মতোই হাসতে থাকেন। হাসলে মাকে যে কী চমৎকার দেখায়! মায়ের কথা মনে পড়ল। ইসস! এই বাগানে মাকে নিয়ে আসতে পারতাম! ৭:২৫টায় রুমে ফিরলাম। এসে ভাবলাম, আরে, অনেক সময় আছে। স্নান-টান সেরে ৮টার দিকে বের হলেই চলবে। ডাইনিংয়ে যেতে লাগবে ৩ মিনিট, ব্রেকফাস্ট করতে লাগবে ৫ মিনিট, অনায়াসেই এরপর ক্লাসে ঠিকসময়ে পৌঁছে যাব। আমি সারাজীবনই ইলেভেন্থ আওয়ারে কাজ-করা মানুষ; কিন্তু ওদিকে আবার আমার রুমমেট খুবই পাঞ্চুয়াল মানুষ। উনি সময়ের কাজ সময়ের অনেক আগেই করে ফেলেন; সাথে আমাকেও করতে বলেন। এরকম পাঞ্চুয়াল রুমমেট পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। এমন একজন পাশে থাকলে অনেক শোকজের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যায়। সাড়ে ৭টার মধ্যেই রেডি হয়ে আমাকে বললেন, “দাদা, চলুন।” আমি বললাম, “আপনি যান, আমি আসছি।” রুম থেকে বের হতে হতে বললেন, “দাদা, আপনি এরকম করলে কিন্তু একসময় শোকজ খেয়ে ফেলবেন।” আমি হাসলাম। উনি বের হয়ে গেলে আমি রেডি হয়ে রওনা হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ঠিক সময়েই ক্লাসে পৌঁছলাম।

সাড়ে ৮টা। ক্লাস নিতে এলেন রেক্টর স্যার। প্রথম ক্লাসটা ছিল: ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কী, কেন—এ নিয়ে। স্যার অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জ্ঞানী মানুষ। আজও আমাদের মুগ্ধ করে রাখলেন। আমি ক্লাস করে বুঝলাম, একজন সচিবের কাছ থেকে ওঁর অভিজ্ঞতা শুনতে পারাটা আমাদের মতো জুনিয়রদের জন্য সত্যিই অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অনেকেই অনেক বেশিই প্রাজ্ঞ। আজকের এই ক্লাসটার কিছু কিছু কথা আমি আমার নিজের মতো করে শেয়ার করছি:
# তুমি তোমার জীবনে যে খারাপ জিনিসগুলো দেখেছ, যদি সবসময়ই সেগুলোর অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে ভালো কিছু শেখার চেষ্টা করো, তবে ভালো কিছু তোমার উপর অতটা প্রভাব ফেলতে পারবে না, যতটা তুমি চাইছ।
# মানুষ আইন মানে না, নিয়ম পছন্দ করে না। অথচ, আইন মানলে মানুষ বড়ো হয়, যাঁরা মানেন, আমরা তাঁদেরকেই বেশি মনে রাখি।
# সিএসপি অফিসার মঞ্জুরুল করিম ১৯৫৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ইস্ট পাকিস্তান বোর্ডে রেকর্ড মার্কস পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। পরের বছরই, মানে ১৯৫৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ট্রান্সলেশন এসেছিল, “মঞ্জুরুল করিম ১৯৫৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ইস্ট পাকিস্তান বোর্ডে প্রথম হন।” এ যে কী দুর্লভ সম্মান, যে পায়নি, সে বুঝবে কী করে? (স্যার এই উদাহরণটা দেবার সময় আমার জসীম উদ্‌দীনের ‘কবর’ কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁর 'কবর' কবিতা প্রবেশিকার পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। ক-জন কবির ভাগ্যে এত অল্পবয়সে এই সম্মান জোটে?)
# মাঝে মাঝে অফিস থেকে বের হয়ে খেয়াল করে দেখবে, কোনো গরীব অসহায় মানুষ তোমার দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কি না। হয়তোবা তোমার চাপরাশি ওঁকে তোমার রুমে ঢুকতেই দেয়নি কিংবা উনি তোমার কাছে আসার সাহসই পাচ্ছেন না। যদি ওঁর তোমার সাহায্যের দরকার হয়, তবে ওঁর কথাগুলো শুনবে, ওঁকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে। এতে তোমাকে যদি কেউ অতিউৎসাহীও বলে, বলুক। আমার রুমের সামনে একবার এক মহিলা চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিলেন। কেউ ওঁকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছিল না। আমি ওঁকে রুমে ডাকলাম। কথা বলে জানতে পারলাম, ওঁর বড়ো ভাই ছিলেন মৃগীরোগী। আজ সকালে রিকশা চালানোর সময় অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। ওঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে ওঁর ৫০০ টাকা দরকার। একটু ভেবে দেখো, তোমার-আমার কাছে ৫০০ টাকা কিছুই না। আমরা ধার চাইলে ৫ লক্ষ টাকা দেবার মতো লোকও আছেন। কিন্তু অনেক দরিদ্র অসহায় মানুষ আছেন, যাঁদেরকে এই ৫০০ টাকা ধার দেবার মতোও কেউ নেই। আমাদের দেশের মানুষ দরিদ্র। ওদের চাহিদাও সামান্য। ওদেরকে সন্তুষ্ট করা খুব কঠিন নয়। এরকম কাউকে খুশি করার সুযোগ কখনোই নষ্ট কোরো না। এতে তুমি যে ভালোলাগাটুকু পাবে, তাতে শারীরিক আর মানসিকভাবে অনেক সুস্থ থাকতে পারবে।
# একজন মানুষ ২ বার মৃত্যুবরণ করেন। এক। যখন তিনি রিটায়ার করেন। দুই। যখন তিনি মারা যান। সবসময়ই রিটায়ার্ড লোকজনদের সম্মান করবে, হেল্প করবে। একবার এক রিটায়ার্ড ভদ্রলোককে আমার অফিসেরই একটা কাজে হেল্প করেছিলাম। উনি এটা মনে রেখেছিলেন। পরে আমার একটা কাজে সচিব মহোদয়ের হেল্প দরকার হচ্ছিল। ওঁর কাছে কথা প্রসঙ্গে এই কথা বলাতে উনি একটা ছোট্ট কাগজে কিছু একটা লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা দেখিয়ে সচিব মহোদয়ের সাথে কথা বলুন।” আমি এটা নিয়ে মিনিস্ট্রিতে গেলাম। সচিব মহোদয় তখন কিছু ফরেন ইনভেস্টরের সাথে একটা জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমি ওঁর পিএস’কে কাগজটা দিয়ে ওঁকে দিতে বললাম। উনি এটা দেখেই মিটিং ফেলে বেরিয়ে এলেন এবং ফোন করে আমার কাজটা তখুনি করে দিলেন। পরে জানতে পেরেছিলাম, সচিব মহোদয় ওই রিটায়ার্ড ভদ্রলোকের মেয়েজামাই।
# সবসময়ই মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করবে। দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা যখন তোমার কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নিতে চাইবে, তখন যদি সেটা না পায়, তবে তোমাকে বিভিন্নভাবে ইন্সটিগেট করে তোমার কাছ থেকে কৌশলে খারাপ ব্যবহার আদায় করে নিয়ে পরে সেটাকেই তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। একবার আমার উপর ক্ষুব্ধ এক সাংবাদিক আমাকে ফোন করে বললেন, “আপনি একটা বাজে লোক। আপনি একটা হনুমান।” আমি ভাবলাম, এখন যদি আমি রিঅ্যাক্ট করি, আর ওঁর সাথে বাজে ব্যবহার করি, সেটা উনি ফোনে রেকর্ড করে রাখতে পারেন, পরে সেটাকেই আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। আমি ওঁকে ঠান্ডা মাথায় বললাম, “ভাই, আপনি বোধ হয় এখন কিছুটা রাগান্বিত, আমরা পরে কথা বলি, কেমন?” এটা বলেই ফোন রেখে দিয়েছিলাম।
# জীবনে হারতে শেখো। কিছু কিছু হার বিজয়ের চাইতেও সম্মানজনক। (‘বাজিগর’ মুভির একটা ডায়লগ আমার খুব প্রিয়। “কাভি কাভি কুছ জিতনে কে লিয়ে কুছ হারনা ভি পড়তা হ্যায়...আউর হার কার জিতনেওয়ালে কো বাজিগর ক্যহতে হ্যায়...ক্যায়া ক্যহতে হ্যায়???” আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারও বলেন, “জিততে চাইলে সবসময়ই জিততে যেয়ো না।” আমার নিজের একটা কথা আছে: “To fail successfully is an art.” জীবনে জয়ী হতে হলে ভুল যুদ্ধে সঠিক সময়ে হেরে যাওয়াটা খুব জরুরি।)
# আমার এক বস ছিলেন, মেট্রিকে থার্ড ডিভিশন, ইন্টারে থার্ড ডিভিশন, ডিগ্রিতে রেফার্ড পাস। ওঁর মনমানসিকতা ছিল অত্যন্ত বাজে। আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্টক্লাস-পাওয়া; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। কিন্তু কোনোদিনই ওঁর সাথে কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে যাইনি। আমি ভাবতাম, ওঁর সবচাইতে বড়ো যোগ্যতা, উনি আমার আগে সার্ভিসে এসেছেন। বসকে সম্মান করতে হবে। ওঁকে এটা বুঝতে দেওয়া যাবে না যে, তুমি ওঁর চাইতেও বেশি জানো, বোঝো। বসের সমালোচনা করতে যেয়ো না। An intelligent man never makes his boss furious.
# মালয়েশিয়ান সিভিল সার্ভিসে বলা হয়, একজন সিভিল সার্ভেন্টের ৪টা প্রধান গুণ হলো: আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, সততা, পেশাদারিত্ব। তোমরা খেয়াল করে দেখো, এখানে মেধার কথা কোথাও বলা হয়নি। আমাদের দেশেও তা-ই।
# তোমরা যখন কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করাবে, তখন সেই কাজটা তুমি নিজে করলে যতটুকু ভালো করে করতে পারতে, তার চাইতেও ভালো কাজ ওর কাছ থেকে আশা করতে পারো, কিন্তু সেরকম করতে না পারলে, ওকে শাস্তি দিতে পারো না। সবাই সব কিছু পারে না। তুমি ম্যানেজার, যদি বুঝতে না পারো, কে কী করতে পারে, কোন কাজটি কাকে দিয়ে কীভাবে করাতে হবে, তবে সেটা তোমার ব্যর্থতা। একটা গল্প বলি। এক ছেলে খুব চুপচাপ স্বভাবের। সে কারও সাথেই মিশতে পারে না। শ্বশুরের সাথে খুব একটা কথাবার্তাই বলত না। একদিন এই ব্যাপারটা ছেলের বাবাকে জানিয়ে উনি বললেন, “বেয়াই সাহেব, আমাদের জামাই তো সবদিকেই ভালো, কিন্তু আমার সাথে তো কথাই বলে না। এটাই সমস্যা।” বাবা ছেলেকে ডেকে বকা দিয়ে শ্বশুরের সাথে গল্প করতে বললেন। ছেলেটা পরের দিনই শ্বশুরের কাছে গিয়ে গল্প জমানোর চেষ্টা করল...আব্বা, আপনি বিয়ে করেছেন?
# সেদিন পেপারে একটা মেয়ের লেখা পড়লাম। সে লিখেছে, “আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ঠিকমতো হচ্ছিল না, তাই আমরা একসাথে থাকতে পারিনি। কিন্তু ও অনেক ভালো একজন মানুষ। ওর মনমানসিকতাও অনেক ভালো।” এই মেয়ের উদারতা আর নৈতিকতা থেকে শেখার আছে। উদার হও, মানুষ তোমাকে সম্মান করবে।
# তুমি যখন ১ কেজি কুল কেনো, তখন রাস্তার পাশে যে-ছেলেটি তোমার কুলের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকে কয়েকটা কুল দিয়ো। ওর হয়তো কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি কুলগুলো দেবার পর ওর যে তৃপ্তি, ওতে তুমি হজের সওয়াব কিংবা গয়াকাশীর পুণ্য অর্জন করবে। কাজটি করে দেখো, মনেও শান্তি পাবে।

ক্লাস শেষ হলো। আরেকটা শুরু হবে। আমরা এই সময়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে যাই। পিএটিসি’তে আমরা সব কিছুই করি লাইনে দাঁড়িয়ে, ওয়াশরুমেও লাইন ধরে ‘বিসর্জন করতে’ যাই। আজ ওয়াশরুমে টয়লেট-টিস্যু শেষ হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ বলছিল, “টিস্যু শেষ। ওরা টিস্যু দেয় নাই কেন? কাজ চালাব কীভাবে?” একজন বললেন, “কেন ভাই? ওরা আপনাকে একটা টাই দিসে না? টাইটাকে একটু নিচে টান মেরে কাজ চালায়ে দেন।” আহা! বাঙালি বড়ো রসিক জাতি! এরপর এক সৌম্যদর্শন স্যারের ক্লাস। উনি সরকারের একজন যুগ্ম সচিব। ওঁর লেখা প্রায় ৩০-৩৫টা বই বেরিয়েছে। বেশ মজা করে কথা বলেন। আমার নিজের মতো করে দু-একটা বলি:
# আমার ক্লাসে কারও ঘুম এলে ঘুমিয়ে পড়তে পারো। তবে ২টা শর্ত আছে। এক। ঘুমোনোর সময়ে নাক ডাকা যাবে না। দুই। ঘুমোতে ঘুমোতে পাশের জনের গায়ের উপর পড়ে গিয়ে ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না।
# ব্রিটিশদের গালাগালি কোরো না। ওদের আইনই এখনও চলছে। আমরা তো আর বানাতেও পারিনি, সংশোধনও করতে পারিনি। ওদের আইন এখনও বহাল আছে বলেই যে-অপরাধ করলে তোমার অন্তত ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হওয়া উচিত, সে অপরাধ করে মাত্র ২০০ টাকা দিয়েই ছাড় পাচ্ছ। ওরা এখনও আমাদের টাকা বাঁচিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। (এটা শুনে মন চাইছিল, পাগলের মতন শব্দ করে হাসি!)
# আমার ওয়াইফ, মানে তোমাদের ডিয়ার ভাবী একজন ‘হাইলি প্রোডাক্টিভ’ ভদ্রমহিলা। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও-ই দেখে। আমার ছোটো মেয়েটা আমার ছেলের চাইতে বছর তিনেকের ছোটো। ও একটু অল্পবয়সে পড়াশোনা শুরু করায় মেট্রিক পরীক্ষা দেবার সময় বয়স এক বছর বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। আমার অতিবুদ্ধিমতী বউ বুদ্ধি করে এক বছরের জায়গায় দু-বছরের মতো বয়স বাড়িয়ে দিল। পরে হিসেব করে দেখা গেল, আমার মেয়ে আমার ছেলের চেয়ে আড়াই মাসের ছোটো। কীভাবে সম্ভব! ভাগ্যিস, এই কথা পরিচিতরা কেউ জানে না। (স্যারের রসবোধ সত্যিই অনেক উঁচু স্তরের! তাঁর কথা শুনে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার আমরা বান্দরবান বেড়াতে গেছি। নীলাচল যাবার সময় আমার বন্ধুর স্ত্রী আমার ছোটোভাইকে বললেন, “বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। তোমার ক্যামেরায় তো প্রটেক্টর নেই, আমারটাতে আছে। তোমার ক্যামেরাটা বাসায় রেখে যাও। আমি ক্যামেরা নিচ্ছি। তোমারটা লাগবে না।” আমার ভাই কী যেন মনে করে তবুও ক্যামেরাটা সাথে নিল। পরে নীলাচলে গিয়ে ছবি তোলার সময় ভাবী আবিষ্কার করলেন, ওঁর ক্যামেরার ভেতরে ভুলে ব্যাটারি ঢোকানো হয়নি। আমি বলি, মেয়েদের সব বুদ্ধি শুনতে হয়, আর কাজ করতে হয় নিজের বুদ্ধিতে।)
 
এরপর এলেন ভূপেন হাজারিকা স্যার। নিউট্রিশন অ্যান্ড ফিজিক্যাল ফিটনেসের উপর ক্লাস। স্যারের আজকের কথা বলার ধরনটা ছিল ‘ধনরাজ তামাং’ মুভির উৎপল দত্তের মতো। খুবই বিচিত্র ভঙ্গিমায় পুরো শরীর নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছেন। কথার মধ্যে সারল্য বেশ স্পষ্ট; দেখলে শুধুই ভালো লাগাতে ইচ্ছে করে। স্যারের কিছু কথা আমার নিজের মতো করে শেয়ার করি:
# আপনারা আপনাদের বাচ্চাদেরকে মোটা বানাবেন না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মোটা বাচ্চারা স্লিম হয়ে গেলেও কিন্তু পরবর্তীতে বড়ো হয়ে মোটা মোটা বাবা হয়।
# আমাদের ছেলেবেলা ছিল অনেক সুখের। আমাদের মায়েরা দেখত, আমরা দুপুরে খেয়েছি কি না। এরপর সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়াই আর যা-ই করি, এ নিয়ে মায়েদের কোনো মাথাব্যাথাই ছিল না। শুধু সন্ধের আগে ঘরে ফিরে এলেই হতো। আর কিছুই না। অবশ্য মাঝে মাঝে হাতে একটা বেত নিয়ে চোখের সামনে ধরে বলত, “যা, ঘুমাতে যা! এক্ষুনি! চোখ বন্ধ কর, চোখ বন্ধ কর!” এইটুকুই। (হুমায়ূন আহমেদের ছোটোবেলাও ছিল কিছুটা এরকমই। আমার নিজের ছোটোবেলাও কিছুটা এভাবে কেটেছে। আমি বাইরে টোটো করে বেড়াতাম আর বাসায় মা উত্তমকুমারে বুঁদ হয়ে থাকতেন।)
# ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যাবার সময়ে নিজের গতি কতটা বৃদ্ধি পায়, খেয়াল করে দেখেছেন? আপনারা দুপুরে ক্যান্টিনে যাঁরা ভাত খেতে যান, তাঁদের মধ্যে দু-ধরনের মানুষ আছেন:
এক। ওঁরা সাধারণত খুব দ্রুত ক্যান্টিনে যান। ক্যান্টিনে ঢুকেই প্লেটে বেশি করে ভাত নেবেন, খুব দ্রুত দেখে নেবেন, মাছের কোন পিসটা বড়ো, সবজি ২ চামচের জায়গায় কেউ-না-দেখে-মতো ৩ চামচ নেবেন; এরপর দেখবেন, কোন টেবিলের ডালের গামলাটা এখনও কেউ ধরেনি। এরপর ওটাতে বসেই বেশ কিছু সালাদ প্লেটে নিয়ে নেবেন। ডালের ঘন অংশটুকু বেশি করে নেবেন। ওঁরা খাবার চিবিয়ে খান না, গিলে ফেলেন। খাবারের টেস্ট কেমন হলো, এটা ওঁদের দেখার বিষয় নয়। খাবার নিয়ে ওঁদের কোনো কমপ্লেইন নেই, খেতে পারলেই হলো। ওঁরা গাপুসগুপুস করে অনেক খাবার খেয়ে ফেলতে পারেন। অ্যাবজর্ব করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এ ধরনের মানুষ বন্ধুবৎসল, হাসিখুশি হয়। ওঁদের কেউ টিজ করলে ওঁরা খুব একটা গায়ে মাখেন না। ওঁরা টিজিংটাও অ্যাবজর্ব করে ফেলতে পারেন।
দুই। ওঁরা ক্যান্টিনে আসেন হেলেদুলে। এসে দেখেন, খাবারের ঘ্রাণটা কেমন, রংটা কেমন। ওঁরা বাসায় মাছের যে-পিসটা খান, সেই পিসটাই খুঁজতে থাকেন। সেটা পান না, তখন যে-কোনো একটা পিস প্লেটে নিয়ে খেতে বসে যান। খেতে বসে দেখেন লবণ-মরিচ-হলুদ-মসলা ঠিক আছে কি না, ভাতগুলোকে আস্তে আস্তে মেখে তরকারির টেস্ট বুঝতে বুঝতে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবার খান। ওঁরা গেলেন না, খান। ওঁরা খাবার নিয়ে কমপ্লেইন করেন।
# আপনারা খাবার পরিমিত খাওয়ার চেষ্টা করুন। বেশি খেতে ইচ্ছে করলে মুড়ি খান। আরেকটা কথা, মুটিয়ে যাওয়া রোধ করতে কম কম ছ্যাঁকা খাবেন, মন খারাপ কম করবেন, হাসিখুশি থাকবেন। মানুষ অনেকসময় বিষণ্ণতা থেকেও অতিভোজন করে।

এইটুকু বলার পর ক্লাসের টাইমকিপার বেল বাজাল। পিএটিসি বেলে চলে। টাইমকিপারের কাজ হলো, ক্লাস শেষ হবার ৫ মিনিট আগে বেল বাজিয়ে স্যারকে সতর্ক করা। ক্লাস শেষ করে ডাইনিংয়ে গেলাম। যাবার পথে দেখলাম, এই ৪ দিনে আজই প্রথম রোদ উঠেছে। হাত বাড়িয়ে রোদ ছুঁতে ছুঁতে আঙুল নাচাচ্ছিলাম। আজ খাওয়ার টেবিলে মেয়েদের সাথে বসেছিলাম। আমি মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম আর ওরা কে কী বলে, খেয়াল করছিলাম। মেয়েরা যে কী মজার মজার কথা বলতে পারে! ওদের বেশিরভাগ কথা নিজের স্বামীকে নিয়ে, বাচ্চাকে নিয়ে, কাপড় শুকোতে দেবার কাহিনি নিয়ে, পেপার থেকে রান্নার রেসিপি দেখে রান্না করলে কালার ঠিকমতো আসে না কেন সেটা নিয়ে, শাড়ির কালার ম্যাচিং নিয়ে, কোন মেয়ের জামাই কীরকম ওটা নিয়ে...এরকম আরও অনেক কিছু! অবশ্য আমরা ছেলেরা যা নিয়ে গল্প করি, ওরা তা নিয়েও বলে; কিন্তু কিছু স্টেরিওটিপিক্যাল মেয়েলি গল্প থাকেই!

সোয়া ২টায় ক্লাসে এলাম। কোর্স ডিরেক্টর স্যার খুব ইতস্তত মার্জিত ভঙ্গিতে আমাদের কিছু ছোটোখাটো দোষত্রুটি ধরিয়ে দিলেন। আমাদের ভুলগুলো বলার সময়ে স্যার খুব বিব্রতবোধ করছিলেন; এতটাই যে, আমরাই লজ্জা পেয়ে গেলাম। ওইসময়ে আমার মনে পড়ছিল, দণ্ডিতের সাথে, দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে...স্যার খুব কম কথা বলেন। যা বলেন, সেগুলোই অনেক ভারী। ‘র‍্যাম্বো’ মুভিতে সিলভেস্টার স্ট্যালোন সাবস্টেইনশিয়াল ডায়লগ দেয় মাত্র কয়েকটা, কিন্তু প্রত্যেকটাই মাথায় একেবারে ভেতরে গিয়ে বাড়ি দেয়। স্যারের কথাগুলোর ওয়েটও অনেকটা সে ধরনের। এরপর এলেন কোর্স কো-অর্ডিনেটর স্যার। উনি ২২ ব্যাচের বিসিএস অ্যাডমিনের একজন অফিসার। এত চমৎকার করে ফর্মাল অথচ কনভিন্সিং ওয়েতে কথা বলে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতে আমি খুব বেশি মানুষকে দেখিনি। ওঁর স্মার্টনেস আর ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ার মতো। স্যার এলেন আমাদের কমিটি ঠিক করে দিতে। মেস কমিটি, কালচারাল কমিটি, স্যুভেনির কমিটি, এনভাইরনমেন্ট কমিটি, আইসিটি কমিটি, অডিট কমিটি। মহাউৎসাহে কমিটি গঠন করা হলো। প্রত্যেক কমিটিতে এক জন করে প্রেসিডেন্ট আর মেম্বার সেক্রেটারি হলেন। মেস কমিটির প্রেসিডেন্টকে বলা হয় পিএমসি (প্রেসিডেন্ট অব দ্য মেস কমিটি)। মেস কমিটি বাজার করা থেকে শুরু করে ডাইনিং সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্বে থাকেন। অন্যান্য স্টুডেন্ট পিএমসি’র কাজের মূল্যায়নস্বরূপ কমপ্লেইন খাতায় খাবার নিয়ে নানা অভিযোগ লিখতে পারেন। কোর্স কো-অর্ডিনেটর স্যার আগের ব্যাচের মেস কমিটির কিছু মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। ৫৫তম ব্যাচে (আমাদের ব্যাচটা ৫৮তম) খাবারের মেন্যু সিলেকশন নিয়ে কিছু মজার কমেন্ট এসেছিল: “কই মাছে কাঁটা এত বেশি কেন?” “এত বেশি বেশি গরুর মাংস খাওয়ানো হচ্ছে কেন? সুবোধ গরুগুলোকে মাঠেই চরতে দিন না!” পরে জানা গেল, পিএমসি’কে বকা খাওয়ানোর জন্য কমিটিরই সদস্যরা অন্যদের কনভিন্স করে ওসব কথা লেখাচ্ছিল। কেন? ওদের অভিযোগ ছিল, পিএমসি ওদেরকে পাত্তা কম দেয়।

আমিও একটা কমিটিতে আছি। সেটা হলো নো-কমিটি। মানে, আমি কোনো কমিটিতেই নেই। কেন? আমি ঠিক করেছি, পিএটিসি ট্রেনিংয়ের ৬ মাসে আমি শুধু ২টি কাজ করব। এক। যে-কাজটি না করলেই নয়; যেমন, পরীক্ষায় পাশ করা। দুই। যে-কাজটি করতে ভালো লাগে; যেমন, প্রতিদিন ‘পিএটিসি ডায়েরি’ লেখা (যদি সময় পাই আর লিখতে ইচ্ছে করে)। আর কিছুই করব না। আমার রুমমেট এনভাইরনমেন্ট কমিটিতে আছে। অতএব, রুমের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তাই নেই। আহা! আরেকটা কাজ কমল! শান্তি!

I'm gonna make him an offer he can't refuse. Okay? I want you to leave it all to me. আমাদের কোর্স অ্যাডভাইজর স্যারের কথা বলার স্টাইল ভাবলেও আমার গডফাদার-এর ডন করলিওনের কথা মাথায় ঘুরতে থাকে। আজ ক্লাসে সবার শেষে এলেন কোর্স অ্যাডভাইজর স্যার। স্যার এসে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলাপ করলেন। একজন বলছিলেন, ওঁর বালিশটাতে সমস্যা। ওঁর ঘাড়ে সমস্যা আছে, তাই নরম বালিশ দরকার। স্যার ওঁকে সাজেস্ট করলেন, ওঁর স্পনডিলাইটিস সমস্যা থাকলে ৩-৪ বছরের বাচ্চারা ঘুমোনোর সময়টাতে যে-পাশবালিশ নিয়ে শোয়, সেটা ঘাড়ের নিচে দিয়ে শুলে কিছুটা আরাম পাবেন। (আমার খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিল, “কিন্তু স্যার, ৩-৪ বছরের বাচ্চাটি কি ওর পাশবালিশটা দিতে রাজি হবে?” জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। আহা! কত কত দুষ্টুমির ইচ্ছে গিলে হজম করে ফেলতে হয়!) স্যারের একটা কথা অসম্ভব রকমের ভালো লেগেছে। “তোমাদের যে যা-ই বলুক, আমি বলছি, Enjoy your six-month stay here. ওসব রেক্টর অ্যাওয়ার্ড আর টপ থার্টিতে এসে দেশ-বিদেশ ঘোরার চিন্তা করে করে তোমার দিনগুলোকে মাটি করে দিয়ো না। এখানে যতদিন আছ, সময়টাকে উপভোগ করো, কিছু শেখার চেষ্টা করো, নিজের জীবনকে গঠন করতে শেখো।”

পিএটিসি’তে অনেক তালি দিতে হয়। কেন? সবাই যে দিচ্ছে, তাই। কিন্তু স্যারের ওই কথাগুলো শোনার পর আমি নিজের অজান্তেই প্রাণখুলে হাসছিলাম আর খুব জোরে জোরে তালি দিচ্ছিলাম। ওগুলো যে হুবহু আমারই মনের কথা। আমি এখানে নিজেকে প্রমাণ করতে আসিনি, আমি এখানে এসেছি, এই ট্রেনিংটা চাকরির প্রয়োজনে করতে হয়, একটা সার্টিফিকেট লাগে, তাই। আমি এখানে এসেছি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে, চাকরি আর জীবন সম্পর্কে ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স ডেভেলপ করতে। আর কিছুই নয়। স্যারের কথা শুনে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনেক অনেক বেড়ে গেল।

৫টায় স্পোর্টসে গেলাম। কুয়াশা-নামা মাঠের উপর আমরা শ্বেতভল্লুকের দল বসে আছি। ভূপেন হাজারিকা স্যার আমাদের স্পোর্টস টিম ঠিক করে দিলেন। সবাইকে মোট ৮টি দলে ভাগ করে প্রত্যেক দলের নাম দেওয়া হলো। নামগুলো নদ-নদীর। মজার ব্যাপার হলো, মেয়েদের দলের নামগুলো প্রধান নদীর, যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; আর ছেলেদের দলের নামগুলো শাখানদীর, উপনদীর, যেমন করতোয়া, কপোতাক্ষ, পায়রা, তিস্তা। আমরা সারি করে বসেছিলাম। প্রথম সারি থেকে নাম বলতে বলতে যখনই আমাদের আগের দলের নাম বললেন—’গড়াই’, আমি তখন আস্তে করে বললাম, “জি স্যার, গড়ান।”
Content Protection by DMCA.com