পিএটিসি ডায়েরি: ১৭, ১৮ জানুয়ারি


ডেটলাইন ১৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

আসার আগে থেকে শুনে আসছিলাম, এখানে অনেক ঠান্ডা। কতটা, তা শুনিনি। গতকাল যখন এখানে এসে পৌঁছলাম, তখন দুপুর ২:১৫টা। এসে দেখলাম, তখনও সবুজ পিএটিসি কুয়াশায় ভিজে ধূসরিত সবুজ হয়ে আছে। বুঝলাম, এখানে ভোর ৫টায় ওঠা আর সকাল ৮টায় ওঠা কমবেশি একই কথা। ছোটোবেলায় বলতাম, ছাত্রজীবন বড়োই মজা যদি না থাকত পরীক্ষা। এখন বলছি, চাকরিজীবন বড়োই মজা যদি না থাকত ট্রেনিং। শাহরুখ খান টুইটারে একবার লিখেছিলেন, “You can love me or hate me but.. you can't ignore me.” পিএটিসি যেন এই চ্যালেঞ্জটাই সব সিভিল সার্ভেন্টের প্রতি ছুড়ে দেয়!

গেটেই আমাদের রজনীগন্ধা দিয়ে বরণ করা হলো; ওতে কাঁটা নেই। একেবারে শুরুতেই কাঁটা দিয়ে বরণ করলে পরের কাঁটাগুলোর বেঁধার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তাই হয়তো এই ব্যবস্থা! সাড়ে ৩টায় রেজিস্ট্রেশন হলো। হালকা টিফিনের পর সন্ধেয় রেক্টর স্যার আমাদের উদ্দেশে স্বাগতবক্তব্য রাখলেন। স্যার পিএটিসি’র প্রধান এবং সচিব পদমর্যাদার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে প্রশাসনে যোগদান করেন। প্রায় ৩২ বছরের বর্ণাঢ্য চাকরিজীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেছেন। স্যারের অভ্যর্থনা ছিল কুয়াশায়-ভেজা লাল গোলাপের মতো উষ্ণ—সমস্ত অনুভূতি শীতল হয়ে যায়, অথচ ‘কাঁটার আকর্ষণ’ উপেক্ষা করা যায় না, এমন। স্যার গত ৩২ বছরের কর্মজীবনে এক দিনও অফিসে ১ মিনিটও দেরি করে আসেননি। পিএটিসি’তে ৯টা বাজে ঠিক ৮টা ৬০ মিনিটে, ৯টায় নয়। প্রেমিকার প্রেমপত্র যতটা অনিশ্চিত, পিএটিসি’র শোকজ লেটার ততটাই নিশ্চিত। এরকম আরও অনেক কিছু জানলাম। আশার কথাও অবশ্য ছিল। এই যেমন, এই ট্রেনিংয়ে পরীক্ষায় যারা প্রথম ৩০ জনের মধ্যে থাকতে পারবে, তাদেরকে বিদেশ ঘোরাতে নিয়ে যাওয়া হবে। (এটা শুনে আমি মনে মনে বললাম, স্যার, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষটি হলো, যার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যাকে ঈর্ষা করার কেউ নেই। আমি কারও প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাই না। আমি একটা নীতিতেই বিশ্বাসী... সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা ... ওরা থাকুক না ওদের মতো করেই সুখী! আমি নাহয় শেষ ৩০ জনের মধ্যে থেকে ওদের মতো পরদেশে না হোক, অন্তত নিজের মনের দেশেই ঘুরে বেড়িয়ে সুখে থাকব। কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, “দাদা, এই ছয় মাসে কী করবেন ঠিক করেছেন?” আমি বললাম, “আমি এই ছয় মাস স্রেফ কাটাব বলে ঠিক করেছি, আর কিছু নয়।” আমি নির্ভাবনায় নিঃশঙ্ক হয়ে থাকতে চাই। কর্নেল তাহেরের একটা কথা আমার খুব খুব প্রিয়: “নিঃশঙ্ক চিত্তের চাইতে বড়ো বিত্ত আর নাই।”) স্যারের কাছ থেকে একটা জিনিস শিখলাম: শিক্ষককে অসীম শ্রদ্ধা করা। যাঁর কাছ থেকে একটা অক্ষরও শিখেছি, তিনিই আমার শিক্ষক। স্যার তাঁর চাকরিজীবনে যাঁদেরকে সিনিয়র হিসেবে পেয়েছেন, এবং যাঁদের কাছ থেকে সততা, নিষ্ঠা, কর্মকুশলতা-সহ নানান গুণের দীক্ষা পেয়েছেন, তাঁদের সকলের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধাবোধ শেখার মতো।

এরপর এলেন আমাদের কোর্স উপদেষ্টা স্যার। উনি অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার। ওঁর মতো এতটা বিনীত ভঙ্গিতে অবিচলিত জলদগম্ভীর ফর্মাল টোনে কঠিন কঠিন কথা বলতে আমি খুব বেশি মানুষকে দেখিনি। প্রতিটি শব্দ একেবারে বুকের ভেতরে আলাদা আলাদা দ্যোতনার সৃষ্টি করে যেন! কথার মধ্যে একটা আশ্চর্য রকমের আন্তরিকতা আছে, যেটা কাছে টানে, অথচ কাছে যেতে দেয় না। উনি আমাদের ফ্রেন্ড বলে সম্বোধন করেন। বলেন, “বন্ধুরা, তোমরা একটা শেয়ালকে লেজ ছাড়াও কল্পনা করতে পার, কিন্তু একজন কোর্স কো-অর্ডিনেটরকে ব্ল্যাকবুক ছাড়া কল্পনা করার মতো কল্পনাশক্তিও তোমরা রেখো না।” আমাদের কোর্স কো-অর্ডিনেটর মোট ৮ জন। আমাদের মোটামুটি ধারণা দেওয়া হলো, ওঁরা সবাই হিটলারের সুযোগ্য বংশধর। সহজ সাবলীল ভঙ্গিমায় কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলায় ওঁরা সিদ্ধহস্ত। আমাদের সবাইকে ৬টা সেকশনে ভাগ করে দেওয়া হলো। প্রত্যেকটা সেকশনের দায়িত্বে এক জন করে কোর্স কো-অর্ডিনেটর, সার্বিক দায়িত্বে আরেক জন। ওঁরা সবাই সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার। শেষের জনের কথা বলি। বেশ পুরু ফ্রেমের চশমার আড়ালে কঠিন চোখজোড়াকে ঢেকে অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলেন। পঞ্জিকা খুলে দিনক্ষণ দেখে হাসেন বোধ হয়। ওঁকে এখন পর্যন্ত হাসতে দেখেছি সাকুল্যে ৫-৬ বার। তবে কথার ধরনে বোঝা যায়, বেশ আন্তরিক এবং দায়িত্ববান; ওঁর বাহ্যিক রূপটি আমাদের ট্রেনিংয়ের প্রয়োজনেই, ভেতরটা নরোম। এটাও আমলাতন্ত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন প্রাক্তন সচিব বলতেন, “তুমি যদি কোনো অফিসকে ঝামেলা ছাড়া চালাতে চাও, তবে সেই অফিসের দায়িত্ব নেবার পর প্রথম দিকেই একটা কাটখোট্টা ইমেজ দাঁড় করিয়ে ফেলো।”

ও হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম। ব্ল্যাকবুক হলো একটা নোটবুক, যার মলাটটা কালো রঙের। সেটি নিয়ে কোর্স কো-অর্ডিনেটর স্যাররা প্রায়ই ক্লাসের পেছনটাতে গিয়ে বসে থাকেন। কেউ দেরি করে এলে, অসদাচরণ করলে, ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়লে, পাশের জনের সাথে গুঁতোগুঁতি মানে খুনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, ক্লাসরুমটাকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে গেস্ট-স্পিকারকে দর্শক ভেবে বসে থাকলে এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে সেই ব্ল্যাকবুকের ‘হল অব ফেম’-য়ে নাম উঠে যায়। স্যারের লেকচারের শেষের অংশে ছিল নর্মস-সেটিং। সেই পার্টটা ছিল সত্যিই উপভোগ্য! একেবারে পিওর বিনোদন! আমরা আগামী ৬ মাস ট্রেনিং করার সময়ে কী কী নর্ম মেনে চলব, সেটা আমরাই ঠিক করে দেবো। সেটা হোয়াইট-বোর্ডে লেখা হবে এবং পরবর্তীতে প্রিন্ট করে সব জায়গাতেই নোটিশ বোর্ডে কিংবা দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হবে। এই সেশনে বেশ কিছু মজার প্রস্তাব ছিল। যেমন, ক্লাস শুরু করতে যেমন লেট করা যাবে না, তেমনি ক্লাস শেষ করতে লেট করা যাবে না। ক্লাসগুলো পুরোপুরি ইন্টারঅ্যাক্টিভ করা যাবে না, মানে কেউ যদি ক্লাসে ঘুমিয়ে-টুমিয়ে পড়ে, তবে তাকে ক্লাসের শেষে ক্লাস নিয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করা যাবে না। সবাইকে তাদের ইচ্ছেমতো ট্রেনিংটা করতে দিতে হবে। প্রত্যেক ট্রেইনি নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। (আমি নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হু উইল চেক?) একটা ভয়ংকর প্রপোজাল এসেছিল। সেটি হলো, ক্লাস যতক্ষণই চলুক না কেন, ক্লাস চলাকালে কোনোভাবেই টয়লেটে যাওয়া যাবে না! যা-ই হোক, এই সেশনটা চমৎকারভাবে শেষ হলো। কোর্স ডিরেক্টর স্যারের কথা একটু বলি। স্যারের সাথে নিরবচ্ছিন্ন কোনো সেশন আমাদের হয়নি, তবে স্যার মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়েছেন। উনি উপসচিব পদমর্যাদার। খুব কম কথা বলেন। অত্যন্ত ভদ্র আর বিনয়ী স্বভাবের। ওঁর কথা বলার একটা বিশেষ আর্ট আছে। খুব স্পষ্ট উচ্চারণে একটু থেমে থেমে গুছিয়ে কথা বলেন। অল্পকথা, কিন্তু ভারী।

আজকের সেশন শুরু হলো ঠিক সাড়ে ৮টায়। প্রথম সেশনটা ছিল রেক্টর স্যারের সাথে। এই সেশনটাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ ছিল। যতটুকু মনে আছে, আমার নিজের মতো করে কিছু শেয়ার করছি:

# দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে সবার আগে। (আমি নিজেও তা-ই মনে করি। আমি প্রায়ই বলি, আপনি এতদিন ধরে যা করে এসেছেন, যদি সেটাই করে যান, তবে আপনি এতদিন যেমন ছিলেন, তেমনই থেকে যাবেন।)
# নিয়ত ভালো না হলে, কাজের ফলাফল ভালো হয় না—বড়োজোর মাঝারি মানের হতে পারে।
# স্যারের ভাতিজা তাঁর গ্রামের স্কুলের সেকেন্ড বয় ছিলেন। উনি পরবর্তীতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে এফসিপিএস এবং এমডি কমপ্লিট করেন। অথচ সেই একই স্কুলের ফার্স্ট বয় ক্লাস এইটের পর দারিদ্র্যের কারণে আর পড়াশোনাই করতে পারেননি। পরবর্তীতে উনি জীবিকার প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান এবং সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। এই যে আমরা বেঁচে আছি, পড়াশোনা করার সৌভাগ্য হয়েছে; যেখানে লক্ষ লক্ষ বেকার মানুষ একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেখানে আমাদের একটা চাকরি আছে, আমাদের পেছনে সরকার এত পয়সা খরচ করছে, আমাদের হতাশায় ডুবে থাকা দুঃখবিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
# আমরা যারা জীবনের কোনো-না-কোনো পর্যায়ে সরকারিভাবে অল্প টাকায় পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি, তাদের ভেবে দেখা উচিত: আমরা পড়াশোনা করেছি দরিদ্র জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। এখন সময় এসেছে আমাদের দায়শোধ করার। একজন সরকারি, আধাসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী হিসেবে আমরা কেউই এই দায় এড়াতে পারি না।
# যে-হাইজ্যাকাররা রাস্তায় মানুষের পয়সা লুট করে, তাদের সম্মান নেই, সামাজিক নিরাপত্তা নেই। অথচ আমাদের সবই আছে। আমরা কেন লুটেরা হব? ওদের চাইতে আমাদের উৎকর্ষ তবে কোনদিক দিয়ে?
# আমাদের দেশের অনেক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের এমনই হাল, যদি সুযোগ থাকত লোকজন প্রয়োজনে বিমান ভাড়া দিয়ে সেই সেবা আমেরিকা থেকে নিয়ে আসতেন, তবুও ঘর থেকে বের হয়ে দু-পা ফেলেও সেই সেবাটা নিতেন না।
# আমি মাঝে মাঝেই একটা কথা বলি। পরশ্রীকাতরতা এমন একটা শব্দ, যেটার ইংরেজি হয় না। হবে কীভাবে? এতে যে বাঙালির একক অধিকার! আজ রেক্টর স্যার বললেন, তোমরা যারা ভাবছ, অমুক অমুক চাকরি তোমার নিজের চাকরি থেকে ভালো, তুমি বঞ্চিত, তুমি তাই রাগ করে জনগণকে তাদের প্রাপ্য সেবা দিচ্ছ না, তোমাদের জিজ্ঞেস করছি, এই চাকরি দেবার জন্য কি তোমার বাসায় র‍্যাব-পুলিশ গিয়েছিল? তোমাকে তো জোর করে এই চাকরি দেওয়া হয়নি। তুমি জেনেশুনে নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছ। যদি মনে করো, তুমি এর চাইতেও বেটার কিছু পাবার যোগ্যতা রাখো, এই চাকরিতে তোমার পোষাচ্ছে না, তবে চাকরিটা ছেড়ে দাও। এখনই! তোমাকে আমাদের দরকার নেই।
# কোনো এক শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলেন। তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া দরকার। একটি দরখাস্ত নিয়ে আহত অধ্যাপকের স্ত্রী স্বাস্থ্য সচিবের বাসায় গেলেন। সচিব মহোদয় সব শুনে দরখাস্তের গায়েই লিখে দিলেন, “আজ সরকারি ছুটির দিন। অফিস খুলে জিও জারি করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই আমার এই লেখাকে জিও হিসেবে গণ্য করে আবেদনকারীর স্বামীর সিঙ্গাপুরগমনে সহায়তা করার জন্য সকল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি।” একজন সরকারি কর্মকর্তাকে তাঁর বিবেকবুদ্ধির সাহায্যে দায়িত্ব নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
# শুধু আর্থিক স্বচ্ছতা একজন কর্মকর্তার যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। স্বজনপ্রীতি, সময়জ্ঞানের অভাব, কাজ ফেলে রাখা, দায়িত্ব এড়ানো কিংবা অবহেলা—এসব ব্যাপার বরং আরও বেশি ক্ষতিকর।
# যদি আপনি আপনার বসের কোনো একটি অন্যায় সিদ্ধান্তকে মেনে না নিয়ে সঠিক কাজটিই করেন, তবে সেটা পরবর্তীতে সবাইকে বলে বেড়াবেন না। জিহ্বাকে সংযত রাখতে জানাটা চাকরি করার অন্যতম পূর্বশর্ত।

এরপর এলেন আমাদের শরীরচর্চা এবং খেলাধুলার দায়িত্বে যিনি আছেন, উনি। ওঁকে দেখে প্রথমেই মনে পড়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ মুভির পাহাড়ি স্যানালের কথা; চেহারায় একটা নেপালি নেপালি ভাব আছে। যখনই কথা বলতে আরম্ভ করলেন, তখন বার বারই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি উনি গাইতে শুরু করবেন, মানুষ মানুষের জন্য... পোশাকে, অবয়বে ঠিক যেন ভূপেন হাজারিকা! খুব সারল্য নিয়ে কথা বলেন। সে কথায় স্নেহ আছে, মায়া আছে। ওঁকে দেখে একটা জিনিস শেখার আছে। সেটা হলো আত্মবিশ্বাস। ইংরেজিতে খুব একটা সাবলীল না হয়েও প্রায় এক ঘণ্টা অবিচলভাবে ইংরেজিতে কথা বলে গেছেন। ওঁর একটা কথা ভালো লেগেছে। “আপনাদের সকালবেলার পিটি শুরু হবে ঠিক ৬টায়। ৬টা মানে, ৫টা বেজে ৫৯ মিনিট ৬০ সেকেন্ড। হিয়ার উই কাউন্ট টাইম বাই সেকেন্ডস।” ওঁকে আমার ভালো লেগে গেছে। খুব ন্যাচারাল ধরনে হাসেন, কথা বলেন। হুট করে কত সারল্য নিয়ে বলে ওঠেন, “আহ ইয়েস! আই হ্যাভ টাইম! আই ক্যান টেল মোর!” ওঁর আরেকটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। উনি “কোনো সমস্যা নাই”-কে বলেন, “কোনো সন্দেহ নাই।”

এরপর অরিয়েন্টেশনে এলেন আমাদের লাইব্রেরিয়ান। খুব ভীতসন্ত্রস্ত কথা বলার ধরনে কথা বলে যান। কথা বলার সময় তাকিয়ে থাকেন পেছনে, যেখানে কোর্স অ্যাডভাইজর স্যার আর কোর্স ডিরেক্টর স্যার বসেছিলেন। একেবারে বইয়ের ভাষায় কথা বলেন। মনে হচ্ছিল যেন সামনে ওই কথাগুলো কোথাও টাইপ করা আছে। ভয়ে কিছু কিছু পয়েন্ট বলতে ভুলে গেলে কোর্স অ্যাডভাইজর স্যার যখন মনে করিয়ে দিলেন, তখন কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “থ্যাংক য়্যু, স্যার; ওয়েলকাম, স্যার; সরি, স্যার; আমি এটা ভুলে বলি নাই, কিন্তু আমি বলার জন্য নোট করে নিয়ে আসছিলাম, স্যার।” লোকে অনেকক্ষণ ধরে চেপে-রাখা টয়লেট সারার পর চোখেমুখে যে-স্বস্তি ফুটে ওঠে, একই ধরনের স্বস্তি নিয়ে উনি ওঁর নিজের না-বলা কথাগুলো বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন! যা-ই হোক, এই কাঁচুমাচু সাহেব একসময় কথা শেষ করলেন। ওঁর কাছেই জানলাম, আমাদের লাইব্রেরিতে বই আছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার।

সবশেষে ছিল কিট অ্যালাওয়েন্স বিতরণ। আমাদের সবাইকে পোশাক-কেনা ও অন্যান্য খরচবাবদ ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হলো। আহা! কী অসাধারণ মনোমুগ্ধকর একটা সেশন! The best one so far! এই সেশনটা যদি প্রতিদিন থাকত, তবে ৬ মাস কেন, ৬ বছরও ট্রেনিং-যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করা যায়।

পিএটিসি’তে এসে একটা জিনিস বুঝলাম। If you have any excuses, show them to yourself, not to your authority. এখানে আমাদের একমাত্র কাজ, ভেড়ার মতো বেড়াকে অনুসরণ করা। বেড়া মানে স্যাররা, যাঁরা আমাদেরকে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করছেন। এখানে ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে করিডোরে হাঁটার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। পিএটিসি’তে আসার পর থেকে আমার সবচাইতে প্রিয় কাজ এখানকার করিডোরগুলো দিয়ে হাঁটা। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হয় ডান দিকে। মজার ব্যাপার হলো, ভুলে বাম দিকে হাঁটলেও একটু পরেই নিজের কাছেই কেমন জানি বেখাপ্পা লাগে। করিডোরের মেঝেতে লাল রঙের ছোটো-ছোটো অ্যারো দেওয়া। আপনি বাম দিকে হাঁটলে দেখবেন, আপনি অ্যারোর উল্টোদিকে হাঁটছেন। সবচাইতে আনন্দের দৃশ্য: করিডোরের চারপাশে গোলাপের বাগান। শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। কী যে অসহ্য রকমের সুন্দর! এত বিচিত্র রঙের গোলাপ একসাথে বাংলাদেশের খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। লাল, সাদা, হলুদ, কমলা-সহ আরও হরেক রঙের আর ঢঙের গোলাপ। মনে হতে থাকে, পৃথিবীর সব সুখ এখানেই! সাথে বিভিন্ন রংবেরঙের সানফ্লাওয়ার। পাশেই ফুটে আছে থোকায় থোকায় স্নোবল ফ্লাওয়ার। কী যে এক ইশারায় ওরা ডেকে যায়, শুধু কাছে ডেকে যায়! ঘাসফুলের সাথে হলদে গাঁদার মিতালি। চোখ ধাঁধায়, মন ভোলায়।

এই বাগানের বাহার দেখে প্রথমেই মাথায় এসেছিল চট্টগ্রামের ওয়ার-সিমেট্রির কথা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হতে থাকে যেন থরে থরে সাজানো শান্তসমাহিত গ্রেভইয়ার্ড। A graveyard within a graveyard! (এটাকে আবার স্বগতোক্তি-টগতোক্তি ভেবে বসবেন না যেন!) করিডোরের দু-পাশে অর্কিড ঝোলানো। ওরা যেন হেঁটে-যাওয়া পথিকদের ক্লান্তি জুড়োতেই ব্যস্ত! নিচে সারিতে সারিতে অসংখ্য প্রজাতির রঙিন পাতাবাহারের সমারোহ। আপনি যখন সন্ধেয় করিডোর ধরে হাঁটবেন, তখন দেখবেন, করিডোরের দু-ধারে নিচে লকলকে আগুন লেগে গেছে! আপনাকে থমকে দেবেই! নিয়ে যাবে জাদুবাস্তবতার কোনো এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় রাজ্যে! বড়োই অবিশ্বাস্য সে দৃশ্য! আশ্চর্য আগুনের রক্তাভ পাপড়িগুলো সিলভিয়া গাছে ফুল হয়ে ফুটে আছে।

দুটো মজার ঘটনা বলি। আমাদের যে-কোনো প্রয়োজনে সেকশন কো-অর্ডিনেটর স্যারের সাথে যোগাযোগ করার নিয়ম। এমনকি, ‘বিকাশ’ কোথা থেকে করা যায়, সেটা পর্যন্ত! আজকে একজন কোর্স কো-অর্ডিনেটর বলছিলেন, আপনাদের মধ্যে যেসব ফিমেল অফিসার কিড নিয়ে এসেছেন, তাঁরা বাচ্চার প্রতি বিশেষ কেয়ার নেবেন। এই সময়ে ঠান্ডার প্রবলেম হতে পারে। বাচ্চাকে রোদে রাখবেন। বাচ্চা সুস্থ থাকবে। আমার পাশের এক লেডি অফিসার আমাকে বললেন, “ভাইয়া, এখানে তো সারাদিনে রোদই ওঠে না। বাচ্চাকে কীভাবে রোদে রাখবো?” আমি বললাম, “আপু, আপনি এই বিষয়ে সেকশন কো-অর্ডিনেটরকে ফোন দিতে পারেন। উনি রোদের ব্যবস্থা করে দেবেন।” এরপর দেখলাম, উনি আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছেন। (আমি ভাবতে লাগলাম, আঁই কিচ্চি?!) আমাদের এখানে সব খাবার ছুরি, চামচ আর কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে হয়। এমনকী লেবু চিপে রস বের করার কাজটিও আমরা ওভাবেই করি। আমাদের এক কোর্সমেট বৈষ্ণবধর্মের অনুসারী এবং উনি এখানকার কোনো খাবারই খান না, ওঁর খাবার আসে স্থানীয় একটা মন্দির থেকে। প্রথমে ওঁকে এই ব্যাপারটা অ্যালাউ করা হয়নি, পরে এই শর্তে অ্যালাউ করা হয়েছে যে, ওঁকে ওই প্রসাদ খেতে হবে ছুরি, চামচ আর কাঁটাচামচ দিয়ে! বাধ্য হয়ে উনি তা-ই করতেন!

এভাবে করে একটা দিন কেটে গেল! দিনের শেষে সন্ধেয় মুড়ি খেয়ে রুমে ফিরলাম (আক্ষরিক অর্থেই! ভাবার্থে কি না জানি না।)
Content Protection by DMCA.com