কী গভীর অন্ধকার! বাতাস যদিও সুরভি-ছোঁয়া ফুল ফোটানোর সংবাদে বিহ্বল, প্রকৃতি তা নয়। নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ চারিধার। বিজ্ঞাপনের অনির্বাণ আলোর ক্ষীণ একটি ধারা দেয়ালের এককোণে লুটোপুটি খাচ্ছে। সুরভিত হাওয়া ওই আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা দিল উড়িয়ে। আমি অতীত হয়ে গেলাম প্রাচীন পৃথিবীর পরিক্রমায়।
এখানেও অন্ধকার। নিঝুম রাজপ্রাসাদ কপিলাবস্তুর। একটা ছায়া আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল রাজপ্রাসাদের দরজা অতিক্রম করে। গৌতমবুদ্ধ সংসার ত্যাগ করছেন তুচ্ছ জীবনকে মহত্তর করবার সাধনায়। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। নির্বাক সে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দৃশ্যটি।
হঠাৎ শুনি ভীষণ হইচই, কোলাহল। আলেকজান্ডার বের হচ্ছেন তাঁর বিশ্ববিজয়ে। চারিদিকে ছুটোছুটি কাণ্ড; মেসিডোনের ঘরে ঘরে উৎসব, প্রিয়জনকে বিদায়দানের পালা। অশ্বখুরের আঘাতে আঘাতে উঠছে ধূলির আবর্ত। বাতায়নে বিরহী প্রিয়ার চোখ অশ্রুসজল। ক্যালেন্ডারের আবছা পাতায় পড়তে পারলাম শুধু শতাব্দী—খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক।
আচ্ছন্নতার ভেতর দেখতে পেলাম এক সুন্দরীশ্রেষ্ঠা সিংহাসনে আসীন। দরবার পরিচালনা করছেন তিনি। চুপিচুপি দরবারের এক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কে?” উত্তর এল: “রানি ক্লিওপেট্রা, নীলনদের দেশ মিশরের অধিশ্বরী।" ক্লিওপেট্রার দরবারে এসে হাজির হলেন রাজা অ্যান্টোনিও। তাঁরা দুইজন দরবার ছেড়ে চলে গেলেন। কিছুদিন কারও দেখা নেই। অ্যান্টোনিও গভীরভাবে মুগ্ধ ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যে। অ্যান্টোনিও নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন।
হঠাৎ দেখি ক্লিওপেট্রার মৃতদেহ। চারিদিক শোকাচ্ছন্ন। শুনলাম, অ্যান্টোনিও ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর ভুল খবর পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তা শুনে ক্লিওপেট্রাও দুঃখে মৃত্যুবরণ করলেন। ক্যালেন্ডার ঘোষণা করছে: খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ অব্দ।
এত বেদনা, এত লাঞ্ছনা কেন দৈবনিপীড়িত মানুষের? কেন এত অর্থহীন এই ভাগ্যের খেলা? ওমর নির্জনে বসে ভাবেন। একাদশ খ্রিস্টাব্দের কবি ওমর খৈয়াম কবিতারচনায় মত্ত। অভিমানী কবি স্রষ্টার খেয়ালিপনায় উদ্বেল—
কাল নিতি আনে দুঃখের পসরা
পরান কখন মেলায় পাখা;
দুটো দিন বটে খুশিতে কাটাও
না হতে ও-দেহ শ্যামলে ঢাকা।
তারপর…কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিও কীসব যন্ত্র চোখে লাগিয়ে বসে আছেন আকাশের দিকে মুখ করে। তাঁরা যা বলছেন, তাতে তো দেশের লোক খেপে আগুন। গ্যালভানি আবার ব্যাং নিয়ে কী কীসব জানি করছেন!
আবার পটপরিবর্তন। আহা, অমন সুন্দর নির্দোষ মেয়েটাকে এমনভাবে মারছে কেন? ওরা কারা? মেয়েটাই-বা কে? ইস্, আর যে দেখা যায় না এ দৃশ্য দু-চোখ দিয়ে! খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই সেই জোয়ান অব আর্ক, ফরাসি দেশের বীরাঙ্গনা নারী, যাঁর বীরত্ব ফরাসিদের অনুপ্রাণিত করেছিল তাদের দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াতে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা তাঁকে পুড়িয়ে মারছে। ইস্, এ দৃশ্য আর সহ্য করা যায় না!
চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল আরও দৃশ্য, কত কবি, বীর মনীষীর ছবি, কত সংগ্রামের দৃশ্য, কত উত্থান-পতনের কাহিনি…
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে এল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পড়ার টেবিলে। তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিলাম? হয়তো-বা তা-ই। সামনে দেখি, ক্যালেন্ডার দুলছে বাতাসে, আর আলোতে তার অবয়ব ঝলমল করছে। শতাব্দীব্যাপী বাতাস তেমনিভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে অজানার সংবাদ। যুগ-যুগান্তরের অন্ধকারও তেমনি বিস্মৃতির, অবলুপ্তির মহারহস্যের অতলে নিবিড়।
ভাবলাম, আমাদের এক দুই তিন করে তিরিশটি দিন কেটে যায়। ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটায়। এমনিভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস। তারপর একদিন বছরের পর বছর শেষ হয়ে দিন ফুরোয়। অনেক দিন পরে মাটিতে আমাদের নশ্বর দেহ যখন হবে বিলীন, তখনও এমনি করেই ক্যালেন্ডার ঝুলবে দেয়ালে দেয়ালে।
প্রিয় ক্যালেন্ডার, বলো, তখন আমায় মনে রাখবে কি তুমি? না কি হারিয়ে যাব অসীমে অজানা অন্ধকারে, যেমন গিয়েছে আরও অনেক অনেক মানুষ!