পাখিদের কাছে বসে

নিমেষে উধাও হতে হয় এক জায়গাতে থেকে,
বসে বসেই দৌড়োনো যায়,
দৌড়ে দৌড়েও বসে থাকা যায়।




কালোতর সময় আসলে সাদা সাদা হয়ে শূন্যতায় মিশে যেতে পারে না।
সময়ের বিজ্ঞাপিত মুহূর্ত—
এক-শো ফুট চওড়া রাস্তা বেয়ে
এক-শো মাইল বেগের বাতাসের মিছিল।




ওপারে অন্ধকার।
সূর্যডোবার পর এপারে বৈদ্যুতিক বাতির ঝিলিক।
তবুও রাত গড়ায়।




সেতুর প্রকট অভাবে শহর ওপারে যেতে পারে না;
এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারে পৌঁছোনোর সেতু নেই।




পরিচয় কিছু নয়—
হাতের ভেতরে হাতের স্পর্শ এবং পরস্পরের নাম বলাবলি।




প্রসারিত ঠোঁটে চোখ-মুখ-দাঁতের সীমানায় হাসিময়তার ছড়াছড়ি,
অথচ ভেতরের দেশে জলহীন মানচিত্র।
কিছু আলো গড়িয়ে ওপারে যাবে—
উন্নতিশীল দেশ।




সাঁঝের বেলা থেকে তাদের বিছানায় না যাওয়া পর্যন্ত মোটামুটি সিংহাবলোকনে চরাচর আলোময় থাকবে—তাবৎ অঞ্চল,
তথা উন্নতি উন্নতি!




খবরের কাগজে মন্ত্রীদের ভবিষ্যৎকাল দিয়ে কথাবলার চর্চা,
সকালে ছাপানো গুজবের বহর আয়তাকার নিউজপ্রিন্টে,
সত্য-মিথ্যার জাল বোনাবুনি দিয়ে এক মসলিন কাপড়
সে ইতিহাসে ডুব দিয়ে ছিল—
আবার এসেছে।




রাজনীতি
পৃথিবীর যাবতীয় খেলাধুলার সমষ্টিগত ব্যাকরণহীন এক গতিময় উপকরণহীন শক্তিশালী খেলা,
অথচ উপঢৌকনে ভরপুর—
অর্থনৈতিক, বৈদ্যুতিক;
মাটির তলদেশে, সমুদ্রের অগাধে।




আকাশের সীমানা ছোঁয়াছুঁয়িতে সিমেন্টের বহুল ব্যবহার,
কৃষিজমির ক্রমাগত সংকোচননীতি, দারিদ্র্যের প্রকট প্রসার;
জনসংখ্যাস্ফীতি—
যে-দেশে যত বেশি জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার, সেই দেশ লিখিত-পড়িতভাবে তত বেশি অশ্লীলতার বিশাল ময়দান।




অন্যঅঙ্গে জড়াজড়ি এক উপায়হীন বেঁচে থাকার বিকল্প সুধা,
শ্রেণীতে শ্রেণীতে প্রকট সংগ্রাম, যোগ-বিয়োগ, দ্বন্দ্ববাদ, দড়ি টানাটানি…
অথচ সবাই যোদ্ধা।




সেই সমানুপাতিক ওজনের উচ্চকৌশল এখনও হয়ে উঠছে না।
চারিদিকে শূন্যতার কাচবৎ দ্রাঘিমা—
বস্তুত মাটির এক ইঞ্চি উপর থেকেই আকাশের শুরু।




সবাই তো এক্ষেত্রে নিজের শরীরের উচ্চতা দিয়ে আকাশ যাচাই করে।
শরীরের দীর্ঘতা উদ্‌বাহু, যা স্পর্শের বাইরে।
তৎক্ষণাৎ আকাশ স্পর্শের আওতাভুক্ত—সবই—
পৃথিবী-খাদ্য-স্তন-দেয়াল—
সেইসব—যাবতীয়গণ।




চক্ষুদ্বয়ের সমান্তরাল দৃষ্টিপথ।
ওই তো পাহাড়ের পেলব শরীর,
ভেতরে লুকোনো সময়ের সুডৌল মনন,
খননে প্রাকৃতিক সম্পদ—
খনিজ ব্যবহার।




ওই তো
ভোরের রং—
ভেজা ভেজা জলউড়না-মেঘ।




সাঁঝের বাতাস…
দিগন্ত উবু হয়ে বেঁকে গেছে পৃথিবীর বৃত্তাকারে,
আড়ালে জানালাহীন কাহাদের লুক্কায়িত মুখভঙ্গি?
তাহারা কি আমাদের পরিচিত নামাবলি গায়ে বালুকাবেলায় সমুদ্রস্নানরত?




ঢেউয়ে ঢেউয়ে মন এবং আসবাবপত্র ছিটাইয়া-ছড়াইয়া দেয়
বাতাসির জল-ভাস্কর্য—ঢেউ।




আদিগন্ত চক্ষুভ্রম জুড়ে বিমূর্ত কর্মপদ্ধতি—
সংস্কারহীন বালুকণা, সমুদ্রের পাখি;
কিছু রোগাক্রান্ত খেয়ালি শরীর…
মিছিল মিছিল—প্রাগৈতিহাসিক—মিছিল।




সমাধানহীন-প্রকৃতি-অপারগ
শব্দনিনাদ, প্রতিবাদ, না কি যৌনাকাঙ্ক্ষারূপ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্নসঠিকের মন্দাকীর্ণ ক্রমান্তর গতি?




হে রাজনীতি, প্রেমের মতো সহজ হও।
প্রতিটি সুইচ্ছার মূল্যায়ন হোক।
বিশুদ্ধ একটি ব্যারামের মন্বন্তর হোক।
সুমহামারী উদ্ভূত একটি ব্যাপক ভিক্ষার অভাব,
যেখানে কার‌ও ভিক্ষা করতে হবে না, এমন একটি পরিবেশ হোক।




দিনের সারাক্ষণ—
কর্মক্লান্তি, অতঃপর হে—
রাত্রির অন্ধকারে শিশির-বীর্য-স্বেদ-নিঃশ্বাস-বিশ্রাম-সিক্ত হয়ে
যথাক্রমে ঘাম-যোনি-শরীর-চুম্বন-নিদ্রা-মণ্ডিত হয়ে
ভিজে উঠুক।




ইহা এক ক্রমাগতের জীবন-চালানো খেলা,
চলিষ্ণু-মনোহর সারাংশ—
আগামীর ভোরের স্বাস্থ্যের জন্য,
যাহাতে তাহারা সারাদিন দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে
প্রাতঃকালীন দশটা,
মধ্যাহ্নের নিদাঘী একটা।




অপরাহ্নের বিড়ালনম্র সাড়ে পাঁচটার
প্রান্তসীমা ছুঁইয়া ছুঁইয়া
মধ্যরাত্রির ছোট্ট মেয়েটির ঘুমের ভিতরে হাসির মতো মিষ্টি উদ্দেশ্য
কাহার জন্য, হে অন্ধকার?




তবুও
অনেক কিছুই উড়তে পারে,
তার মধ্যে কিছু কিছু পাখি;
তার বিশাল হৃদয়বিক্ষত ডার্টবোর্ড,
ফুলে-ওঠা মার্জিত যোনির গোলাপ চাউনি,
ষাঁড়ের অন্তর্ভেদী চক্ষু, বিষময় শিশ্নধনু।




তবুও
কিছু কিছু জোনাকি
আঁধারের ভিতর আরও কিছু
ঘনিষ্ঠ ও গাঢ়তম অন্ধকার খুঁজে খুঁজে মরে,
এবং বস্তুত
সেই মানুষটির আর খোঁজ হয়নি।




অপ্রয়োজনীয়।
ঘটনার আগের দিন সে আপিসে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছিল এবং যৌন ও অযৌন সম্পর্কিত যাবতীয় আত্মীয়কূল বন্ধুবিজনদের প্রত্যেকের সঙ্গে অকারণে দেখা করেছিল।




তারপর সে তার প্রিয়তম বইপাণ্ডুলিপিগুলো সবুজ লনের মাঝখানে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে সাধের ফুলবাগানটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গোড়া থেকে কেটে কেটে পরিষ্কার করে ফেলল। যাবতীয় জামাকাপড় কাঁচি দিয়ে কেটে ছিঁড়ে একাকার করে ফেলল। বালিশ-বিছানার তুলোদের পাখির আদরে ঘরের বৈদ্যুতিক পাখাকে সম্পূর্ণগতি সম্পন্ন করে বাতাসের ভেতর উড়িয়ে দিল।




তৈজসপত্র, উপহার, হরিণের চামড়া, বাঁশের লাইটশেড, পিতলের ছাইদানি, বন্ধুশিল্পীর পেইন্টিং, নিজের প্রিয় বিষয়বস্তুর বড়ো করে বাঁধানো আলোকচিত্র, প্রবাসী বান্ধবীর রঙিন চিঠি, বেতের ঝুলন্ত দোলনা, চেয়ার, লেখার টেবিল, চটের কার্পেট—সব কিছু উলটে-পালটে পুরোনো এক গোডাউনের মতো করে ফেলল।




সমস্ত লাইটের গোলবালব ভেঙে দিল। বাথরুমের বেসিন, শাওয়ারের জলের ট্যাপ, নিচে—কার জলকল;
কমোডের হাতল ছেড়ে সব জল ছেড়ে দিল। ফোনের তার এক হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলল। ঘরের জানালার কাঁচগুলো সব ভেঙে দিল।




তারপর সে তার প্রিয়তম শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে উদ্‌বাহু একটি রক্তবন্যার বিকট চিৎকার দিল। মুখের রক্ত বিচ্ছুরিত আঁধারের আলোয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূর্যসজ্জিত। জনৈক সুস্থ বিবেকবোধ-অনুভবসম্পন্ন স্বাস্থ্যমনকর্মক্ষম কে যেন দেখেছিল, একজন হাত-উঁচু-করা মানুষ পাখি হয়ে আকাশে সাবলীলভাবে উড়ে গেছে। তারপর সে অসুস্থতার যাবতীয় লক্ষণে আক্রান্ত হলো।




তাহার সহিত আরেক জন বিকৃত মস্তিষ্কের দৃষ্টিগোচরে উড্ডীয়মান পক্ষীটি উড়ন্ত হইল। অতঃপর সে সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিল। বস্তুত উড্ডয়নকালে পক্ষীটির চক্ষুতে বিবমিষার রক্তাক্ত চিহ্ন ছিল এবং তাহার সম্পূর্ণ বাড়িতে বহুদিন যাবৎ কেহই বসতিতে ছিল না।
Content Protection by DMCA.com