পরিচয়-চুরি




১. পরিচয়-চুরির প্রচলিত ধারণা বনাম গভীরতর সত্য

সাধারণভাবে পরিচয়-চুরি বলতে বোঝানো হয়—ইন্টারনেট জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড হ্যাকিং, মানিব্যাগ বা পার্স হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু মানুষের জীবনে এর চেয়ে অনেক বড়ো এক পরিচয়-চুরি ঘটে—যেটা বাইরের নয়, ভেতরের।

এই চুরি ঘটে তখন, যখন মানুষ নিজের আসল সত্তাকে ভুলে যায়। তখন “আমি” বলতে বোঝায় শুধু ভাবনা, যুক্তি, বিশ্লেষণ—যেন মানুষ কেবলই এক চিন্তাশীল মেশিন ছাড়া আর কিছু নয়। এখানেই ঘটে আসল ডাকাতি।

২. ব্যক্তিত্বের ছাঁচ ও জীবনকৌশল

দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, প্রতিটি মানুষ একধরনের ব্যক্তিত্বধারা বেছে নেয়। এই ধারা সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা যায়—নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, যোগাযোগ-দক্ষতা ও প্রভাববিস্তার, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতা।

মানুষ যে-কোনো একটি ধারাকে প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে, আর বাকিগুলো পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবহার করে। এভাবেই গড়ে ওঠে “জীবনকৌশল”।

কিন্তু কেউ কেউ কোনো নির্দিষ্ট ধারা বেছে নিতে পারে না। তখন তারা হয়তো এক রংহীন জীবন কাটায়—যেখানে থাকে, সেখানে নিজেকে মানিয়ে নেয়। এমনকি তাদের কাছে “পছন্দ” বা “অঙ্গীকার” করার প্রশ্নটাই থাকে ঝাপসা। এই অবস্থায় ব্যক্তি যেন এক গিরগিটি, পরিস্থিতির সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যায়।

৩. সামাজিক শর্তারোপ ও বুদ্ধিবাদের ফাঁদ

এই ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে সমাজ ধীরে ধীরে মানুষকে বাধ্য করে এক বিশেষ পথে চলতে। শৈশবের শুরু থেকেই শেখানো হয়—“বেশি ভাবো, সব কিছু বিশ্লেষণ করো, যুক্তি ছাড়া কিছু মেনো না।”

ফলে ধীরে ধীরে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে—“আমি মানে আমার ভাবনা, আমার যুক্তি, আর কিছু নয়।” এই ভ্রান্ত বিশ্বাসই হলো আসল পরিচয়-চুরি।

কারণ, আসল পরিচয় অনেক বড়ো—যেখানে যুক্তি আর অন্তর্দৃষ্টি, দুই দিকই সমান ভারসাম্যে থাকে। এবং, এর ভেতরেই থাকে সেই জন্মগত সংযোগ, যাকে কেউ বলে ঈশ্বর, কেউ বলে পরমসত্তা, উৎস, উচ্চতর আত্মা বা আত্মস্বরূপ। কিন্তু সামাজিক চাপ মানুষকে সেই সহজাত সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

৪. শূন্যতার অভিজ্ঞতা

যতই সাফল্য আসুক, অর্থ, সম্পদ, সম্মান বা পদমর্যাদা—নিস্তব্ধ মুহূর্তে প্রায় সবার মনেই ভেসে ওঠে এক সংশয়—“কিছু যেন হারানো গেছে।” বন্ধু, সম্পর্ক, সামাজিকতা থাকা সত্ত্বেও একাকিত্ব থেকে যায়। এক অদৃশ্য শূন্যতা টেনে নেয় ভেতরে ভেতরে।

এই শূন্যতা মানুষকে ঠেলে দেয় নানাভাবে পূর্ণতা খুঁজতে—আরও অর্থ, আরও সম্পদ; নতুন নতুন সম্পর্ক; বড়ো গাড়ি, বড়ো বাড়ি, বড়ো কাজ; শরীরের আকার-আকৃতিতে মোহ; মদ, মাদক, নেশা।

কেউ পড়ে যায় কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্কে, কেউ ডুবে যায় হতাশা ও অবসাদে, কেউ আসক্তির শিকার হয়, কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবুও, নির্জনতার মুহূর্তে সেই অচেনা শূন্যতা থেকেই যায়।

৫. পলায়নপরতা ও নীরব হতাশা

মানুষ চেষ্টা করে পালাতে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। কারণ তাদের মনে হয়—“আমার নিজের কোনো কণ্ঠ নেই। কেউ আমাকে বোঝে না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা নিয়ম আমাকে মুক্তি দেয়নি। আর কোনো সমাধানও নেই।”

যুক্তি ও অহংকারের প্রভাবে মনে হয়—“আমি জানি না আমি কে, আর কোথায় যাব।” এই অবস্থায় মানুষ নিজের ভেতরে অনুভব করে পরিচয়ের সম্পূর্ণ চুরি।

৬. মুক্তির পথ

তবে কিছু মানুষ খুঁজে পায় মুক্তির পথ। তারা পৌঁছে যায় এক জাগ্রত শিক্ষকের কাছে—যিনি নিজেও আগে সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সেই শিক্ষক তাদের পথ দেখান—ফেরার রাস্তা।

কোথায়? সেই পূর্ণ মানুষ-এর কাছে, যে হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সবসময়ই ঈশ্বরের ভেতরে ছিল। এখানেই পুনরুদ্ধার হয় চুরি-যাওয়া পরিচয়।

৭. শেষ অবলম্বন

প্রায়ই, মানুষ এই পথে আসে শেষ অবলম্বন হিসেবে—যখন সমস্ত অজুহাত ফুরিয়ে যায়, সমস্ত সম্পর্ক ভেঙে পড়ে, “হৃদয়ভঙ্গ হোটেল”-এর কক্ষে থাকা অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন তারা প্রস্তুত হয়—শেষবারের মতো বেরিয়ে যাবার জন্য—কখনো-বা জীবিকা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও।