সোশ্যাল মিডিয়ার, বিশেষ করে ফেইসবুকের, একটি চমৎকার ফিচার হলো—নিজের মানসিকতার মানুষদের খুঁজে পাওয়া এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা। এই অভিজ্ঞতার নাম দেওয়া যাক: “পবিত্র সঙ্গ” (Holy Company) খুঁজে পাওয়া। সমমনা মানুষের সাথে প্রতিদিনই আধ্যাত্মিক জাগরণ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা, সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রিয় উক্তি ও প্রিয় লেখকের দর্শন ভাগ করে নেবার সুযোগ যেন ভালোবাসার এক সতেজ স্নান।
প্রচলিত ধর্মসমূহের বহু প্রতিষ্ঠান ধর্মের মূল শিক্ষাগুলোকে কীভাবে বিকৃত করে চলেছে, সে বিষয়ে অভিযোগ না তোলাই ভালো; হ্যাঁ, তারা নিয়মিত একটি প্ল্যাটফর্ম তো অন্তত দেয়—যেখানে ভক্তরা তাদের বিশ্বাস আর ভক্তি প্রকাশ করে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেকক্ষেত্রেই এটি পরিণত হয় উগ্রতা, বিভাজন এবং সংঘাতের অজুহাতে।
“পবিত্র সঙ্গ” অনন্য এক মূল্য বহন করে। জাগরণে একধরনের স্থায়িত্ব ও অপরিসীম আনন্দ আসে ঠিকই, কিন্তু ওতেও চতুরতা এবং প্রলোভনের জগৎ লুকিয়ে থাকে। তাই, এমনকি আলোকিত সাধকেরাও মাঝে মাঝে হোঁচট খান, ভুল করেন, এবং অল্প সময়ের জন্য সংশয় ও অনুতাপে নিমজ্জিত হন। শাস্ত্র পড়লে বা গুরুদের নিয়ে বিতর্কিত খবরগুলো দেখলে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না।
এই কারণেই গুরুর (অতীত বা বর্তমান) উপস্থিতিতে থাকা, তাঁদের বাণী পড়া ও শোনা, আর নিজের পবিত্র সঙ্গের সাথীদের কথায় আশ্বাস পাওয়া—জাগরণের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করে, সেই আলোকিত উপলব্ধিকে আরও দৃঢ় করে।
ভক্তিযোগের ধারায় শিষ্য চিরকৃতজ্ঞ থাকে সেই গুরুর প্রতি, যিনি তার অন্তরের দ্বার খুলে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি ভক্তি অটল থাকে, কারণ গুরুর বাণীতে এমন এক অনুরণন আছে, যা শিষ্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এই সত্যটি প্রায় সব আধ্যাত্মিক ধারাতেই দেখা যায়, বিশেষত মরমি শাখাগুলোতে।
তবে একটি সূক্ষ্ম ও বিতর্কিত বিষয় আছে—পপ-বই বা ইন্টারনেটের অনেক শিক্ষা আধখাওয়া আপেলের সত্যের মতো; এর মধ্যে একটি হলো—“কোনো কিছু খোঁজার দরকার নেই—এ-ই সব।” এই শিক্ষা হতাশ ও শান্তির খোঁজে ব্যাকুল মানুষের কোনো কাজে লাগে না। কারণ, জাগরণ কেবল “অন্বেষণ ছেড়ে দেবার” নাম নয়। বরং জাগরণে যে শক্তিশালী সাক্ষীস্বরূপ উপলব্ধি আসে, তা এক অপ্রকাশ্য আনন্দ ও প্রজ্ঞা দেয়, যা যুক্তির বাইরে হলেও অভিজ্ঞতায় অত্যন্ত বাস্তব। এর জন্য নিরলস অন্বেষণ ও চেষ্টা জরুরি।
প্রকৃত পবিত্র সঙ্গই নৈরাশ্যক্লিষ্ট মানুষকে জানাতে পারে—শান্তি ও আনন্দ সম্ভব, জীবন কেবলই এক শুষ্ক সমঝোতার নাম নয়। শেক্সপিয়রের কথাতেই ধরা পড়ে এই সত্য—“হোরাশিও, স্বর্গ ও পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, যা তোমার দর্শনের সীমার বাইরে।” আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের বিশ্বাস ও বোঝার বাইরেও অনেক সত্য আছে, সৌন্দর্য আছে।