নীলপদ্ম-শ্যাম কৃষ্ণ




আমরা লক্ষ করি, শ্রীকৃষ্ণকে সবসময় নীলবর্ণের রূপে চিত্রিত করা হয়। প্রশ্ন জাগে—এই অস্বাভাবিক প্রতীকের ব্যাখ্যা কী? কেন প্রেমের প্রভু, যিনি বনে রাধার সাথে বাঁশি বাজাচ্ছেন, তাঁর শরীর সর্বদাই নীলাভ আভায় দীপ্ত?

এ নিয়ে গুপ্ততত্ত্ববিদ ও আধ্যাত্মিক গবেষকদের মধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা হলো—নীল রং হলো ‘পিতা’র প্রতীক, তিনটি মূল রঙের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে।

সমস্ত মহান আধ্যাত্মিক সাধক এই “পিতার সুরক্ষায়” অবস্থান করেন। অথবা, প্রাচ্যের ভাষায় বললে—তাঁরা ব্রহ্মার চাদরে আবৃত হয়ে থাকেন। এই নীল আধ্যাত্মিক প্রাচীরই মহানদের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আলাদা করে।

ভারতীয় প্রতীকে এই রহস্যকে প্রকাশ করা হয়েছে এভাবে—বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণের দেহ নীলাভ রঙে আঁকা হয়—অর্থাৎ, সেই আত্মা আর জগতের মধ্যে একটি স্থায়ী প্রাচীর ছিল। যদিও কৃষ্ণ পৃথিবীতে এসেছিলেন, তবুও তিনি পৃথিবীর ছিলেন না; তিনি দেবলোকের বাসিন্দা ছিলেন।

এই প্রতীক জীবনের সমস্যার সাথেও সম্পৃক্ত। অনেকেই আছেন, যাঁরা পৃথিবীতে থেকে, দৃষ্টিতে আমাদের মতো হলেও, তাঁদের ভেতরে আমরা অনুভব করি—একটি দেয়াল আছে আমাদের আর তাঁদের মাঝে। এটি আত্মার প্রাচীর, আলোর প্রাচীর, সত্যের প্রাচীর। এটি জীবিতকে মৃত থেকে, জাগ্রতকে অজাগ্রত থেকে আলাদা করে।

যাঁরা আমাদের কাছে আসেন পর্দার আড়াল থেকে, তাঁরা আমাদের সাথে পথ চলেন বটে, তবু তাঁদের ঘিরে থাকে আত্মার নীল আভা। তাঁরা আমাদের সাথে শ্রম দেন, তবুও চিরকাল আচ্ছাদিত থাকেন অমরত্বের নীল পর্দার আড়ালে।

একদিন আমাদেরও এই নীল পর্দার আড়ালে প্রবেশ করতে হবে। তখন পিতার নীল আচ্ছাদন আমাদের রক্ষা করবে, জগত থেকে সরিয়ে নেবে, আর দেবে শান্তি। তখন আমরাও পৃথিবীতে মহৎকর্ম করব, তবে চিরকাল ঢাকা থাকব—মানব থেকে আধ্যাত্মিক বিভাজনে, নীলপদ্মবর্ণ কৃষ্ণের সেই চিরন্তন নীল আচ্ছাদনে।

এখানে শ্রীকৃষ্ণের নীলবর্ণ কেবল শারীরিক সৌন্দর্যের রূপক নয়—এটি আত্মা ও জগতের মধ্যে আধ্যাত্মিক প্রাচীর, দেবলোকীয় আশ্রয়, এবং অমরত্বের প্রতীক।