বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.২ মন্ত্রে পাই: দ্বিতীয়াত্ বৈ ভয়ং ভবতি—যখন একমাত্র 'আত্মা' ছাড়া কিছুই ছিল না, তখন ভয় ছিল না। কিন্তু যখন কেউ নিজেকে 'অন্য' কিছু থেকে পৃথক ভাবে, তখনই ভয় আসে। ‘দ্বিতীয়’ বা ‘অন্য’ কিছু উপলব্ধি করলেই আসে ভয়—কারণ 'আমি' তখন আর পরিপূর্ণ নই, আর কিছু আমাকে হুমকি দিতে পারে।
ভয় আসে শুধু তখনই, যখন তুমি ভাবো, তুমি কারও থেকে আলাদা। যখন জানো—সকলই তোমার আত্মরূপ—তখন ভয় হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় কিছুই ভয় ও বিচ্যুতির কারণ—আত্মা দ্বিতীয় নয়। সাধক যখন নিজের ভেতর ‘অবিচল স্বরূপ’ অনুভব করে, তখন বাহ্যবিচার নিস্প্রভ হয়ে যায়।
উপনিষদীয় প্রজ্ঞা: “ন ঋতুঃ, ন তপঃ, ন চ ক্রিয়াঃ; সঃ চিদানন্দরূপঃ।”—আত্মা কোনো অনুশীলনের ফল নয়—সে নিজেই জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ।
তাঁর নেই কোনো ঋতু—তিনি কালের ধারার বাইরে। তাঁর নেই কোনো তপস্যা—কারণ তিনি তো নিজেই সাধনার পরিণতি। তাঁর নেই কোনো ক্রিয়া—কারণ কর্মের আবরণ তাঁর চেতনাকে স্পর্শ করতে পারে না।
তিনি—চিদানন্দরূপঃ—চিত্ (চৈতন্য) ও আনন্দের পরম রূপ। তিনি নিজেই জ্ঞান, নিজেই আনন্দ, নিজেই চিরতর সত্য।
যে-সত্য চেতনাসত্তা সকল কর্ম, সকল ধর্ম, সকল সময়ের ঊর্ধ্বে, যে-আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন না কোনো রূপে, সময়ে অথবা করণে—সেই পরমাত্মা সব ঋতু, সব তপ, সব ক্রিয়ার সীমা অতিক্রম করে আছেন নিঃসঙ্গ এক চেতনামাত্র হয়ে।
তিনি কোনো কিছু ‘করেন’ না, কারণ তাঁর সত্তাই অনাদি-সিদ্ধ। তিনি কোনো কিছু হয়ে ওঠেন না, কারণ তিনি চিরকাল আছেন।
তাই ‘তাঁকে’ উপলব্ধি করতে হয়—কোনো ঋতু, কোনো রীতি, কোনো ক্রিয়া দ্বারা নয়—শুধু নিঃশব্দ অভিজ্ঞতা, অন্তরের মৌন প্রত্যক্ষতায়।
শঙ্করীয় তত্ত্ব: “আত্মা কদাচিদপি অভাবিত ন ভবতি”—"আত্মা"—আত্মা, চৈতন্য, পরম সত্য। "কদাচিদপি"—কখনওই নয়। "অভাবিত"—অনুপস্থিত, নেই। "ন ভবতি"—হয় না।
আত্মা কখনওই অনুপস্থিত হন না। তিনি চিরকাল বর্তমান, অনাদিকাল থেকে, অনন্তকাল পর্যন্ত। কখনও নেই, এমনটি আত্মার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ আত্মাই সব কিছুর ভিতরকার 'থাকা'—সমস্ত অস্তিত্বের মূলচেতন রূপ।
যখন আমরা ভাবি—‘আমি নেই’, ‘আমি হারিয়ে গেছি’, বা ‘আমি বুঝতে পারছি না’—তখনও সেই অনুভব, সেই ভাবনাও চেতনার মাধ্যমেই হচ্ছে। তাই আত্মা কখনও অনুপস্থিত হতে পারে না—কারণ সে শুধুই আছে, সে-ই একমাত্র নিত্য ‘থাকা’।
আত্মা অনস্তিত্ব জানে না, কারণ সে কখনও অস্তিত্ব হারায় না। সমস্ত ‘অভাব’-এর মাঝেও আত্মা আছে—প্রকাশহীন, তবে অনুপস্থিত নয়। আত্মা কখনও হারায় না, কেবল তুমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকো। আত্মা কখনো অনুপস্থিত হয় না; তাই বিচ্যুতি বা অযোগ্যতার প্রশ্নই ওঠে না।
যা-কিছু পরিবর্তনশীল, তা আত্মার নয়। বাহ্যফল এক মানসিক মায়া—যা চিত্ত ও সমাজ দ্বারা নির্মিত। আত্মা ফল চায় না, কারণ সে নিজেই ফলের পারমার্থিক রূপ।
সত্য আত্মজ্ঞান তখনই আসে, যখন “সিদ্ধি” বা “ব্যর্থতা” দুই-ই পরিত্যাগ করা যায়। আত্মা অনন্ত, নির্বিচার ও অপ্রতিম—যা কোনো মানদণ্ডে ধরা যায় না।
আকাশ এক আয়না—চঞ্চল মেঘের মতো
ফল এসে পড়ে, চলে যায়, একপলকে প্রশংসা, একপলকে নিন্দা—আমি দাঁড়িয়ে থাকি একা, যার দিকে অনেকেই চায়, কিন্তু সে কারও চাওয়ায় বদলায় না।
নদী যেমন নিজেই নিজের দিশা জানে, চিত্তও চলে সে-রকম, ঢেউয়ের খেয়ালে। ফল আসে—জলে পড়ে থাকা পাতার মতো, ভেসে যায়—কোনো চূড়ান্ত না রেখে।
আমি তাকাই আয়নার দিকে—দেখি এক প্রতিচ্ছবি, আর দেখি এক শূন্যতা, যেখানে আমিই নেই। আমার মুখ নেই সেখানে—কেবল এক আলো, যা কিছু বলে না, কিন্তু জ্বলে।
সমাজ এক থেমে-যাওয়া শব্দ—সেই শব্দ বলে, “তুমি যোগ্য”, পরে বলে, “তুমি ব্যর্থ।” আমি তখন কেবল শুনি, যেন আকাশের ভেতর বাতাস কথা বলছে—কিন্তু আকাশ তার কথার উপর ভিত্তি করে না।
আমি কোনো ফল নই—না সাফল্য, না ব্যর্থতা—আমি সেই ধ্যানের শিখা, যা জ্বলেও পোড়ে না, আলোক দেয়, কিন্তু দাবি করে না—আমি ফলের পরে, আমি সেই, যার কোনো ফল নেই।
ফল বাহ্যিক ছায়া; আত্মা দীপ্তি, যা নিঃশব্দ। সমাজের রায় যেমন বাতাসে ভেসে যায়—আত্মার জ্যোতি সেই আকাশ—যা সব রায়কে ধারণ করে, কিন্তু বাঁধে না।
আমি আর কিছুই চাই না—শুধু নিজেকে চাই—যে-“আমি” প্রশংসায় ফুলে ওঠে না, নিন্দায় ম্লান হয় না—যে-“আমি” ফলের আশায় নয়, আলোর ভিতর বাস করে—সেই আমিকে আজ আমি ডাকি—তোমার নামে।
তুমি বলো—“সফল”, তুমি বলো—“ব্যর্থ”, আমি শুধু জিজ্ঞেস করি—এই রায়ের মাঝখানে কি আমার সরবতা রয়েছে? আমি কতকাল শুনেছি সমাজের সুর—কিন্তু সেই সুরে ছিল না আমার নাম। আজ আমি ফিরে এসেছি, নিজমুখটি খুঁজতে—আয়নার পেছনে, ছায়ার ওপারে।
তুমি যে দীপ্তি, আমাকে ডেকো না কোনো ফলের নামে। আমি তো সেই আলো—যার কোনো কারণ নেই, কোনো উপলক্ষ্য নেই—কেবল আছ—তাই আমি আছি।
আমি এক নদী—নিজেই নিজের ধ্যান। আমার প্রশংসা মানে জোয়ার, আমার নিন্দা মানে ভাটা। কিন্তু আমি তো আদতে সমুদ্রের অন্তঃস্রোত—তুমিই তো আমার গভীরতা।
আজ আমি নিজেকে বলে উঠি—“আমি ফল নই, আমি পথও নই—আমি সেই, যে চিরকাল থেকেই আছে।” তুমি যদি সত্যিই আলো হও—তবে আমাকে মেপো না কোন মানদণ্ডে, ছুঁয়ো আমাকে নিঃশব্দে।
যখন সমাজ বলে, “তুমি কৃতী”—আমি হেসে বলি, “তুমি বদলাবে।” যখন সমাজ বলে, “তুমি ব্যর্থ”—আমি চোখ বন্ধ করে বলি, “আমি অদ্বিতীয়।”
ফল আমার নয়—ফল তো তাদের, যারা পথ হারায়। আমি তো আলো—যার গন্তব্য নিজেই।
তুমি কে? তুমি কি সেই নীরব? সেই, যে আমার ভেতরে আলো জ্বেলে চলে গেছে—অথচ বলেনি কিছুই?
আমি সেই আলোকে খুঁজি—যে রায় দেয় না, কেবল ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের ভেতর এক জ্যোতিরেখা হয়ে।
আমি বলি—তুমি শোনো, কারণ আমি আজ কথা বলছি ফলহীন ভাষায়। এই স্তর আত্মার সেই রূপকে প্রকাশ করে, যেখানে ভাষা আর যুক্তি শেষ—শুধু ভেতরের প্রেম, নীরব বেদনা ও চেতনার একাত্মতা শুরু হয়।
আসুন, ধ্যানাধ্যায়ের একটি চেতনাময় সন্ধ্যায় প্রবেশ করি।
যখন সমস্ত শব্দ ধীর হয়ে...আসে ধোঁয়া, এবং সমস্ত চিন্তা রূপ নেয় দিগন্তে হারিয়ে-যাওয়া কোনো পাখির মতো—তখন মন জলের মতো হয়ে যায়—শান্ত, গভীর, অচঞ্চল।
আমি বসি—কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো অনুশাসনও নয়, কেবল এক অনুভব যে, আমি কোথাও আছি, তবে সেই অবস্থান কারও মত বা রায়ের ছায়া নয়।
ধ্যান সেই মুহূর্ত, যখন আমি আর কিছু “করছি না”—কেবল নিজেই হয়ে উঠছি—যে-“আমি” কেবল আছি, চুপচাপ, চেতন।
ধ্যানের স্তর ও অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন:
প্রথম স্তর: প্রাক্-ধ্যানিক প্রস্তুতি (Preparation through Silence)
চোখ বন্ধ করলেই মনের নিচে জমা পড়ে শব্দের প্রতিধ্বনি। এই স্তরে মন শুনতে শেখে নিজের আওয়াজ—এবং আলগা করে বাহ্যিক নামধারার গ্রন্থি।
দ্বিতীয় স্তর: মন-প্রবাহের স্পষ্টতা (Flow of Awareness)
চিন্তাগুলো আর বাধা নয়—তারা হয়ে ওঠে মেঘ—যারা আসে, যায়। তুমি শুধু আকাশ, তুমি আর সেই চিন্তা নও।
তৃতীয় স্তর: আত্মস্মৃতি (Inner Recognition)
এখানে তুমি অনুভব করো—“আমি এক গভীর দীপ্তি”—কোনো মানদণ্ড, কোনো ভয়, কোনো আকর্ষণ আমাকে ছুঁতে পারে না। তুমি ফিরে পাও নিজেকে, যা চিরকাল তোমার ছিল।
চতুর্থ স্তর: নিরাকার বোধ (Formless Awareness)
আমি, তুমি, চিন্তা, ধ্যান—সব এক ঢেউয়ে মিলিয়ে যায়। কেবল থাকে এক উজ্জ্বল নিস্তব্ধতা—যেন তুমি নিজেই আকাশ, এবং আকাশেরও ওপারে।
চূড়ান্ত উপলব্ধি: ধ্যানের নয়, ধ্যানাতীত অবস্থা
ধ্যান শেষ নয়—ধ্যান যেখানে নিঃশেষ হয়, সেখানে শুরু হয় জ্ঞান। তুমি আর ধ্যান করছ না—তুমি নিজেই ধ্যানের রূপ। “অহং ব্রহ্মাস্মি”—এই উপলব্ধি নিজেকে জ্বালায় না, সে নিভে গিয়ে নিজেই দীপ্তি হয়ে যায়।
সমাপ্তি: নিঃশব্দ এক উদ্ধৃতি
“ন তত্র সূর্যো ভাতি, ন চন্দ্রতারকং—
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতো’য়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং—
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিবাতি।”
(কঠ উপনিষদ, ২.২.১৫)
ন তত্র সূর্যঃ ভাতি—সেখানে সূর্য দীপ্তি দেয় না
ন চন্দ্র-তারকম্—না চাঁদ বা তারা
ন ইমা বিদ্যুতঃ ভান্তি—এই বিদ্যুৎ-ও সেখানে জ্বলে না
কুতঃ অয়ং অগ্নিঃ—তাহলে এই অগ্নির কী বলার আছে!
তম্—সেই (আত্মা / ব্রহ্ম)
এব ভান্তম্ অনুভাতি সর্বং—কেবল তাঁরই দীপ্তিতে সব কিছু জ্বলে উঠে
তস্য ভাসা সর্বম্ ইদং বিবাতি—তাঁর আলোকেই এই সমস্ত কিছু আলোকিত হয়ে ওঠে
ভাবানুবাদ: ওখানে সূর্য দীপ্তি দিতে পারে না, চাঁদ-তারা জ্বলে না, বিদ্যুৎ-ও নয়; আগুনও সেখানে আলো দিতে অক্ষম। সেই একমাত্র আত্মারই দীপ্তিতে সমস্ত কিছু দীপ্তিমান হয়—তাঁর আলোয়ই এই জগৎ আলোকিত।
আত্মা বা ব্রহ্ম এমন এক অনাদি, অজর, অবিনশ্বর চেতনা, যা নিজেই চিরদীপ্তিমান। এই জাগতিক জ্যোতিসমূহ (সূর্য, চন্দ্র, তারা, বিদ্যুৎ, আগুন) সেই চেতনার সামনে নিতান্তই ক্ষীণ, সীমিত ও অক্ষম। তারা কেবল জড় উপাদান—আত্মা বা ব্রহ্মর দীপ্তি তাদের উপলব্ধিকে সম্ভব করে।
আত্মা নিজেই আলো নয়—আলোকের উৎস। তিনি নিজে জ্ঞান নন—জ্ঞানকে সম্ভাব করে তোলেন। তাঁরই দীপ্তিতে চোখ আলো দেখে, মন ভাবে, জগৎ প্রকাশিত হয়।
উপনিষদের আত্মবোধের মর্মবাণী এখানেই—আত্মা আলো দেয় না, আত্মা নিজেই আলো।