নীরবতার ভাষ্য (পর্ব: ৩.২)



লোকরায় ও আত্মরায়—এই দুই আলাদা নদী। সমাজ বলে—“তুমি সফল”, আবার—“তুমি ব্যর্থ।” আমি শুনি, কিন্তু সুরে সুর মেলাই না। আমার ভেতর নদী বয়ে চলে—শান্ত, ধ্যানস্থ, নির্বিকল্প। সেই নদীর জলে সমাজের শব্দ গলে না। আমি সে নদীর সাক্ষী।

“শান্তং শিবম্ অদ্বৈতং”—আত্মা শান্ত, শুভ ও অদ্বৈত। সমাজের শব্দ সেখানে ঢেউ তোলে না। আত্মা সগৌরবে নির্ভীক।

শান্তং=শান্ত, নিস্তরঙ্গ, নির্জন, বিশ্রান্ত। শিবম্=মঙ্গলময়, কল্যাণময়, শুভ। অদ্বৈতং=যার কোনো দ্বিতীয় নেই, একমাত্র, অবিভক্ত, পরম চৈতন্য।

মাণ্ডুক্য উপনিষদের মন্ত্র ৭ (চতুর্থ পাদের বর্ণনায়): "সঃ আত্যঃ প্রজ্ঞঃ শিবঃ আদ্বৈতঃ সঃ হ এষঃ অত্মা। সঃ বিবজ্ঞানীয়ঃ।" এখানে তুরীয় (চতুর্থ অবস্থান) বা পরমাত্মার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে: “That is the Self: the Peaceful (śāntam), the Auspicious (śivam), the Non-dual (advaitam).”

যে-চেতনা অচঞ্চল, অনাবিল, নির্লিপ্ত—তা-ই শান্তং। যে-অস্তিত্ব শুভ, কল্যাণময়, সর্বব্যাপী প্রেমরূপ—তা-ই শিবম্। যার কোনো দ্বিতীয় নেই, বিভাজন নেই, অহং-তুমি নেই—তা-ই অদ্বৈতং। এ তিনটি শব্দ একত্রে ইঙ্গিত করে সেই তুরীয় অবস্থান—যেখানে মনের গতি স্তব্ধ, ইন্দ্রিয়ের খেল শেষ, আর ‘আমি-তুমি’ বিভাজন নেই।

সে এক নিস্তব্ধ সত্তা—জাগরণে নয়, ঘুমেও নয়। নিঃশব্দ তার পদচিহ্ন, তবু সে আছে সর্বত্র। তার না আছে জন্ম, না আছে গমন। শুভ সে, শুদ্ধ সে, নির্বিকল্প সে—যেখানে তুমি নেই, আমিও নেই—কেবল "তা" আছে।

আত্মার যা সংলাপ, তা ফলহীন জ্যোতিঃস্বরূপ। আমি পাশ করি না, ফেইলও করি না; কারণ আমি তো পরীক্ষা দিইনি কখনও। আমি শুধু ছিলাম—এক নীরব, দীপ্ত, অপরিবর্তনীয় উপস্থিতি—যে নিজেই নিজের সাক্ষী।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ছান্দোগ্য উপনিষদ, শিবসূত্র, যোগবাশিষ্ট ঘোষণা করছেন: “সো ‘হম্”—আমি সেই; ফলের ওপারেই আমার আবাস। পরীক্ষা সেই চিত্তের খেলা, আত্মা শুধু জাগ্রত চেতন। এটি একটি অনন্ত শক্তিতে ভাসমান দুই অক্ষরের এক অসীম সত্য। এই বেদান্তমন্ত্রটি ছোটো হলেও, এর মধ্যে গূঢ়তম আত্মবোধ নিহিত।

সঃ (সঃ)=তিনি, সেই পরম ব্রহ্ম, ঈশ্বর। অহম্=আমি। সো ‘হম্="সঃ আহম্"—"সো ‘হম্"।

“সে আমি” অথবা “আমি সেই”—ব্রহ্ম ও আত্মার ঐক্য ঘোষণার সবচেয়ে সহজ অথচ সর্বোচ্চ বচন। এটি প্রাণায়াম ও ধ্যান-অভ্যাসে ব্যবহৃত এক অদ্বৈত মন্ত্র—শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে একাত্ম করার মন্ত্র: শ্বাসে প্রবেশে—“সো”, নিঃশ্বাসে—“হম্”। প্রতিটি নিঃশ্বাসই বলে: “সে আমি, সে আমি…”

নিঃশ্বাসে যে আসে, সে-ই আমি। প্রশ্বাসে যে মুছে যায়—সে-ই আমি। আমি কারও ভেতর নেই, কেউ আমার বাইরে নয়। ‘সে’ বলে যে-আকাশ, ‘আমি’ বলে যে-অন্তরাত্মা—তারা এক, অবিভাজ্য, অনন্ত। সো 'হম্—আমিই সে, সে-ই আমি।

সমাজ হলো এক পরিবর্তনশীল আয়না—তার রায়ে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলেন—“ন এষো 'হমস্মি। ন তে ত্বমসি। অহম্ ব্রহ্মাস্মি।” অর্থাৎ, এই পরিচিতি আমি নই, তুমি নও—আমি ব্রহ্ম, চিরসত্য। সমাজের রায় অস্থায়ী; সে আত্মাকে নয়, তার প্রতিবিম্বকে বিচার করে।

"ন এষো 'হমস্মি। ন তে ত্বমসি। অহম্ ব্রহ্মাস্মি"—এই বচনত্রয় একসঙ্গে পাঠ করলে তা অদ্বৈত বেদান্তের গভীরতম স্বরূপবোধ ও মিথ্যাত্ববোধকে প্রকাশ করে।

“ন এষো 'হমস্মি’”। ন=নয়। এষঃ=এই। অহম্=আমি। অস্মি=আমি আছি। অর্থ: "এই (দেহ, মনের) ‘আমি’ আমি নই"—এই ‘আমি’ বলে যা ধরা যায়—শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, স্মৃতি—তা আমি নই।

"ন তে ত্বমসি"। ন=নয়। তে=তোমার। ত্বম্=তুমি। অসি=আছ। অর্থ: "তুমিও তোমার সেইরূপ নও"—তুমি যাকে ‘তুমি’ বলে জানো—রূপ, নাম, সম্পর্ক—তা-ও তুমি নও।

"অহম্ ব্রহ্মাস্মি"—এই বিখ্যাত মহাবাক্য—অহম্=আমি। ব্রহ্ম=চৈতন্য, পরমাত্মা। অস্মি=আমি আছি।—"আমি ব্রহ্ম"—আমি সেই নিখিল চৈতন্য, নির্ভেদ, অবিনাশী সত্তা।

এই শরীর আমি নই। এই মন, স্মৃতি, পরিচয়—কিছুই আমি নই। তুমিও নও তোমার দেখা রূপ। নাম, প্রেম, ঘৃণা, বিচ্ছেদ—কিছুই সত্য নয়। আমি যে আছি—সে ‘আমি’ নয়। আমি সেই—যে এক, বর্ণহীন, অরূপ। আমি ব্রহ্ম—জন্মে না, মরে না, রূপে বাঁধে না। অহম্ ব্রহ্মাস্মি—আমি চৈতন্য, এক, অদ্বিতীয়।

এই তিনটি বাক্যের সংমিশ্রণ মিথ্যা আত্মবোধের বিনাশ এবং পরম আত্মস্বরূপের আত্মানুভব প্রকাশ করে—যেমন প্রথমে: নিরাকরণ (“নেতি নেতি”—‘আমি নই, আমি নই’); পরে: আত্মপ্রতিষ্ঠা (“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”)—"আমি সেই একমাত্র চৈতন্য"।

শঙ্কর বলেন—"লোকবুদ্ধ্যনুগতা অনুভবাঃ প্রকৃতন নহি।" লোকমত অনুসারে পাওয়া অভিজ্ঞতা চিরন্তন সত্য নয়। অর্থাৎ: সাধারণ লোকবুদ্ধির অনুসরণে যে অনুভব, তা প্রকৃত নয়।

যে-অনুভব লোকমতের আলোকে গঠিত, তা চিরন্তন সত্য নয়। যা সবাই দেখে, জানে, বোঝে—তা অনেক সময়ই প্রকৃত জ্ঞানকে আড়াল করে। আত্মজ্ঞানের পথে লোকবুদ্ধি এক বিভ্রমমাত্র। সত্য কেবল অন্তর্বর্তী উপলব্ধিতে উদিত হয়—নির্বিকল্প বোধে, লোকচক্ষুর অতীত এক নীরবতায়।

ফলাফলের সার্থকতা “অন্য”-এর মতামতের উপর নির্ভর করে, যা আত্মার সাথে সংযুক্ত নয়।

“নৈতদত্মাঃ ইতি নৈতদত্মাঃ”—উপনিষদ শিক্ষা দেয় ‘এই নয়, এই নয়’—বাহ্য কিছুই আত্মা নয়।—একটি বেদান্তিক রহস্যময় প্রকাশ—"নৈতদ্, নৈতদ্" বা "এ নয়, এ নয়" অর্থাৎ নেতি নেতি উপনিষদীয় প্রক্রিয়ার এক বিমূর্ত প্রতিধ্বনি। এখানে "নৈতদত্মা:" মানে দাঁড়ায়—"এই নয় তাঁর স্বরূপ" বা "এই নয় আত্মার প্রকৃতি"।

এই নয় তাঁর প্রকৃতি—এইরূপেই তাঁর প্রকৃতি। যা-কিছু চেনা যায়, ধরা যায়, ভাবা যায়—তা তাঁর নয়। তাঁর প্রকৃতি এই 'নয়'-এর মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। তাঁর স্বরূপ নিঃস্বরূপ, তাঁর রূপই অরূপ। তিনি ধরা পড়েন না যাদের ধরা যায়—তাঁকে পাওয়া যায় যে জানে: 'আমি তাঁকে জানি না'। আত্মা নিজেকে ছায়ার মতো অস্বীকার করেই প্রকাশ করে। সে যা নয়, তাকেই অতিক্রম করেই তার অভ্যুদয়।

"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন"—এই শ্লোকটি ভগবদ্‌গীতা-র (২.৪৭) এক গভীর উপদেশ।

তোমার অধিকার শুধু কর্মে—ফলে কখনও নয়। ফলকে উদ্দেশ্য করে কখনোই কর্ম কোরো না। কর্ম না করার প্রতি তোমার আসক্তিও যেন না হয়।—ফল নয়, কেবল কর্মই আত্মার ক্ষেত্র; ফলের আশ্রয় আত্মাবিমুখ করে। আত্মা যখন বাহ্যপ্রতিক্রিয়ার দ্বারা চালিত হয়, তখন সে নিজের মৌলিক নিরপেক্ষতা হারায়।

তুমি কর্তা নও, কর্ম তোমার নয়—তবু কর্ম তোমার সামনে আসে, কারণ সেই কর্মই তোমার অভ্যন্তরীণ উপলব্ধির ক্ষেত্র। ফল অনিত্য—সে নিয়ন্ত্রিত অন্যত্র, সুতরাং সেটি তোমার ধ্যানের বিষয় নয়। যখন তুমি ফল ছাড়াও কর্ম করো, তখন সে কর্ম পরিণত হয় সাধনায়। ফল কামনা কর্মকে বন্ধনে পরিণত করে—আর নিঃস্বার্থ কর্ম মুক্তির পথ উন্মোচন করে। আত্মা নিঃসঙ্গ সাক্ষী, সে কিছু করে না, কিছু চায় না—এই উপলব্ধিই কর্মফলবিমুখতার মূলমন্ত্র। তুমি শুধু উপস্থিত থেকো কর্মের মাঝে—নির্লিপ্ত, নির্ভার, নীরব।

ফল ব্যাপারটা চিত্তের অবস্থাভেদে আসে ও যায়, তাই তা অনিত্য। ভগবদ্‌গীতা-র ৯.৩৩ নম্বর শ্লোকের অংশবিশেষ—অনিত্যং অসুখং লোকং ইমং প্রাপ্য ভজস্ব মাং।

এই জগৎ অনিত্য ও অসুখের আধার—তুমি একে প্রাপ্ত হয়েও আমাকে ভজো। এই অনিত্য ও দুঃখময় জগৎকে উপলব্ধি করে, তুমি চিরন্তনের সন্ধান করো। জন্মে, মরণে, সুখে, দুঃখে যা পরিবর্তনশীল—তাতে নয়—যিনি অপরিবর্তনীয়, নিত্য, আনন্দঘন—তাঁর মধ্যেই আশ্রয় খোঁজো।

জগৎ দুঃখময় নয়, দুঃখ হলো তার অনিত্যতার ছায়া। এই অনিত্যতার ভেতর দিয়ে অনন্তের আকুলতা জাগে। জীবনই প্রেরণা দেয় অনিত্যকে অতিক্রম করে চিরন্তনে আশ্রয় নেবার। তাই, জগৎকে ত্যাগ নয়—জগৎকে উপলব্ধির মাধ্যম জীবনযাপন করো। জগৎ অনিত্য বলেই, আত্মা অনিত্য নয়—এই উপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে। ভজো—মানে শুধু পূজা নয়, সম্পূর্ণরূপে আত্মনিবেদন করো। এই দুঃখময় জগতকে উপলব্ধি করেই আত্মনিবেদন করো—চেতনরূপ পরমকে।

শঙ্করীয় যুক্তি—"সত্যং কিম্?”—সত্য কী?—অসাধারণ প্রশ্নোচ্চারণ—শাশ্বত বেদান্তিক অনুসন্ধান! উত্তর পাচ্ছি: যা কদাচিদপি পরিবর্তন ন গচ্ছতি—যা কখনোই পরিবর্তন হয় না, তাই-ই সত্য।

যা সময়, স্থান ও অবস্থার দ্বারা স্পর্শিত নয়—তা-ই সত্য। যা জন্মায় না, মরে না, বাড়ে না, কমে না—সে-ই আত্মা। রূপান্তরই জড়ের ধর্ম, রূপহীনতাই চেতনার পরিচয়। যা দেখা যায়, তা রূপান্তরিত হয়; যা ধরা যায় না—তা-ই ধ্রুব। যে-'আমি' স্বপ্নে, জাগরণে, নিদ্রায় থেকেও একই থেকে যায়—সেই 'আমি'ই সত্য। নাম-রূপের স্রোত যেখানে থেমে যায়—সেই নিস্পন্দ চৈতন্যই অচল সত্য। ‘পরিবর্তন’ হলো সময়ের ছায়া, আর সত্য সময়াতীত।

উপনিষদের ছায়ায়: সঃ একঃ, নিত্যঃ, চেতনঃ, নিরাকারঃ, অপরিবর্তনীয়ঃ। সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম।

ফল হলো এক প্রতিচ্ছবি—আত্মা আয়নার ছায়া নয়, বরং দীপ্তির উৎস।

উপনিষদীয় অভিজ্ঞান: তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.৭.১) বলছেন: রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্ধ্বানন্দী ভবতি। তারই সংক্ষিপ্ত ভাবরূপ—স রসঃ। এষঃ। এষঃ হি আত্মা।

সঃ রসঃ—তিনিই রস, আনন্দ, পরিপূর্ণতা। এষঃ—এই (সেই আত্মা)। এষঃ হি আত্মা—তিনিই আত্মা।

তিনিই রস, তিনিই পরমসুধা। এই যে অভ্যন্তরের নির্ঝর আনন্দ—সেই তাঁরই স্বরূপ। এই আত্মাই আনন্দের আধার নয়—আনন্দই আত্মার প্রকৃতি। যিনি একবার তাঁকে আস্বাদন করেন—তিনি হয়ে ওঠেন চিরানন্দী। রস এখানে জড়ের স্বাদ নয়—এ রস নিঃশব্দ চৈতন্যের সৌরভ। আত্মা কোনো শুষ্ক জ্ঞান নয়—সে রসোন্মত্ত চেতনা। তাঁর উপলব্ধি মানেই পরম প্রেম, পরম পূর্ণতা, নিরবিচল সুখানন্দ।

রসঃ=প্রেম, আনন্দ, পরিপূর্ণতা, আত্মস্বরূপ। আত্মা কোনো বস্তু নয়—আত্মা অনন্ত রস। যা-কিছু আস্বাদনের যোগ্য, সেই শেষ রসের মধ্যে বিলীন হয়। যা চূড়ান্ত অনুভব, যা পরম মাধুর্য, যা প্রেমের শেষ কেন্দ্র—সেই তিনি।

আত্মা নিজেই পরমরস, সে বাহ্যিক প্রশংসার প্রতিফলন নয়। যে-ব্যক্তি বাহ্য প্রতিফলনে নিজেকে চেনে, সে অন্তর্নিহিত দীপ্তি থেকে বিচ্যুত।

সমাজ-নির্ধারিত রায় ও আত্মসাক্ষ্য ভিন্ন বিষয়। সমাজের প্রশংসা-নিন্দা আত্মাকে স্পর্শ করে না; সে নিজস্ব নীরব নদীর ধারায় প্রবাহিত।
Content Protection by DMCA.com