নীরবতার ভাষ্য (পর্ব: ৩.১)



ফলাভাস–ফলের মায়াবাদী প্রতিচ্ছবি

ছায়াত্মার ফল মানে, বাইরের জগৎ কী ভাবছে আমার সম্পর্কে। কে বলল, আমি উত্তীর্ণ? কে বলল, আমি ব্যর্থ?—সেই সমাজ—যে নিজেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, বিভ্রান্ত, দ্বিধান্বিত।

আজ যে-মানদণ্ডে প্রশংসা হয়, কাল সেই মানদণ্ডই অন্য কারও জন্য ব্যর্থতার রায় দেয়। সমাজের এই বিচারে যদি আত্মার মূল্যায়ন হয়, তবে সে হবে সীমাহীন অনিশ্চয়তায় বাঁধা এক ভ্রান্ত সাধনা।

বাস্তবিকই, এই বাহ্যিক ফলাফল কখনও ধ্রুব নয়। কারণ—এটি তো “অন্য”-এর মতের উপর নির্ভরশীল। আজ যে-গুণ প্রশংসিত, কাল সেটাই উপহাসের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। এমন ফলাফলের আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে আত্মজ্ঞান লাভ কীভাবে সম্ভব?

অদ্বৈত বেদান্ত বলে—যে-ফল চিত্তের অবস্থাভেদে আসে ও যায়, তা মিথ্যা। সত্য কখনও অবস্থান পরিবর্তন করে না।

এই ফলকে সত্য ভাবা মানে “অহং”-কে কেন্দ্র করে বাঁচা—যেখানে আত্মা নিজের স্থান ত্যাগ করে দাঁড়ায় সমাজের দরবারে; অথচ আত্মা তো নিজেই স্বয়ংফল, সিদ্ধ, সম্পূর্ণ।

যিনি সত্যরূপে নিজেকে চেনেন, তিনি জানেন—“আমি কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই না, ব্যর্থও হই না। আমি তো কখনোই বিচ্যুত হইনি—আমি তো চির-সিদ্ধ, চির-জ্যোতির্ময় চেতনা।”

সমাজ যতই বলুক, “তুমি যোগ্য” বা “তুমি ব্যর্থ”—সেই রায় আত্মার নয়, শুধুই এক মানসিক সংস্কার। যেমন একটি আয়না, যা আলো-ছায়ায় নিজ রূপ পালটায়, কিন্তু আয়নার মূল স্বচ্ছতা অপরিবর্তনীয়। ফলাফলের আসক্তি মানুষের চেতনাকে বাইরের প্রতিক্রিয়ায় বাঁধা রাখে। যিনি মুক্ত, তিনি নিজের গভীর অনুভবেই প্রতিষ্ঠিত—ফল নয়, তিনি খোঁজেন স্বরূপ।

বাহ্যিক ফলাফল তখনই অর্থহীন হয়ে পড়ে, যখন ব্যক্তি নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখে—
“এই ফল কি আমার চিরন্তন অস্তিত্বকে প্রকাশ করে?”
“এই ব্যর্থতা কি সত্যই আমার চেতনাকে স্পর্শ করেছে?”
“এই সাফল্য কি আমাকে নিঃশব্দের কাছাকাছি এনেছে?”

উত্তর সবসময় হয়—“না”। কারণ আত্মা কখনোই পরীক্ষার বিষয় নয়। সে পরীক্ষা নেয় না, কোনো মানদণ্ডে নিজেকে মাপে না। আত্মা শুধু “আছে”—চিরনির্ভর, চিরচেতন, চিরদ্যুতিময়।

ছায়াত্মার ফল কী?

বাহ্যসমাজ বলে—“তুমি উত্তীর্ণ”, আবার কেউ বলে—“তুমি অকৃতকার্য”। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই সফলতা বা ব্যর্থতার মানদণ্ড কে স্থির করে? যে-সমাজ নিজেই চঞ্চল, পরিবর্তনশীল, সময়ভেদে মানদণ্ড বদলায়, তার বিচারে কি চিরন্তন সত্য নির্ধারিত হতে পারে?

যে-ছায়াত্মার ভেতর দিয়ে আমি যাই, তার ফলও সমাজ-নির্ধারিত। ফলে সেই ফলাফল আমাকে আত্মিক উন্নতির পথে কতটা এগিয়ে দেয়, সে প্রশ্ন সর্বদা অনির্ণেয় থেকে যায়।

আজ যদি কেউ আমাকে প্রশংসা করে, কাল সে-ই নিন্দা করতে পারে। এই প্রশংসা-নিন্দার আবর্তে আত্মা এক অচেনা ছায়াপথে হারিয়ে যায়। যে-'আমি' এই বাহ্য ফলাফলের উপর দাঁড়িয়ে, সেই আমি ক্ষণিক, দুর্বল ও বিভ্রান্ত।

অদ্বৈত দর্শন বলে—যে-ফল কখনও মেলে, কখনও মেলে না; যে-ফল কারও মতের উপরে নির্ভর করে—সে ফল মিথ্যা, এবং তার পেছনে ছুটে বেড়ানো হলো পরাধীনতা।

আত্মা ফলের আশ্রয় চায় না, কারণ সে নিজেই ফলের পরিণত রূপ। যে নিজেকে সত্যরূপে চেনে, সে জানে—তার কোনো বাহ্য পরীক্ষায় পাশ বা ফেইল নেই, কারণ তার মধ্যে তো কখনোই কোনো বিচ্যুতি ঘটেনি—সে তো চিরজাগ্রত, চিরসিদ্ধ, চিরস্থির।

ছায়াত্মা মানুষকে সমাজের একটি ছাঁচে ফেলতে চায়—এই ছাঁচে মাপা হয়: "কে কেমন", "কার কত যোগ্যতা", "কে কতটা ধার্মিক"। কিন্তু এই পরিমাপক সবই পরিবর্তনশীল; অথচ আত্মসত্তা যে ধ্রুব, অচঞ্চল, অপরিবর্তনীয়—তার বিচার কখনও পরিবর্তনের নিয়মে হয় না।

যে-মানুষ সমাজ-স্বীকৃতির ওপর দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতে চায়, সে এক ভুল পথের যাত্রী। সে জানে না, তার মধ্যেই রয়েছে এমন এক স্বরূপ—যা কাউকে সন্তুষ্ট করতে চায় না, বরং সমস্ত সন্তোষের উৎস হয়ে নিজেই নিজেকে উপলব্ধি করে।

ছায়াত্মার ফল: বাহ্যপ্রভা ও মায়ার ছায়া

সমাজ এক আয়না, যার চেহারা প্রতিদিন বদলায়। সেই আয়নায় যখন আমি নিজেকে দেখি, আমি আর আমি থাকি না। আজ সে বলে—“তুমি শ্রেষ্ঠ”, কাল সে-ই বলে—“তুমি নিকৃষ্ট।” যে-রায়ের ভিত্তি চঞ্চলতার উপর—সে রায় কি সত্যের আলো বহন করে?

এখানে সমাজকে একটি রূপান্তরশীল আয়না হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা আত্মজ্ঞানকে বিকৃত করে। উপনিষদের পথ ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চারণ করছেন: “অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও।”—“অসতো মা সদ্‌গময়”—অসত্যের ছায়া থেকে সত্যের দিকে যাত্রা। এই ছায়া হলো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।

ফল—যা “অন্য”-এর উপর নির্ভর করে

বাহ্যিক ফল সেই চিঠি, যা কেউ অন্যের হাতে লিখে দেয়। সে চিঠির ভাষা বোঝার আগে, চিঠিও বদলে যায়। কখনও তা জয়গানের, কখনও অপমানের—অথচ, আমি কি সত্যিই সেই চিঠির গল্প?

“সত্যম্ জ্ঞানম্ অনন্তম্ ব্রহ্ম”—তৈত্তিরীয় উপনিষদের অন্তর্গত (২.১.১) এই মহাবাক্যটি ব্রহ্মস্বরূপের সবচেয়ে গভীর ও মৌলিক পরিচয়।

সত্যম্ অর্থ: যা সর্বকালে, সর্বত্র এবং সর্বপ্রকার অবস্থায় অপরিবর্তিত—সেই চিরস্থায়ী সত্তা।—যা কখনও নষ্ট হয় না, যা কোনো কল্পনার উপরে নির্ভর করে না, যা কালের খেলার অংশ নয়—তা-ই সত্য। এই জগতের সব কিছুই অনিত্য, পরিবর্তনশীল—একমাত্র আত্মা, ব্রহ্ম‌ই—অনাদি, অনন্ত এবং অপরিবর্তনীয় সত্য।

জ্ঞানম্ অর্থ: নিজেই যা জ্ঞানস্বরূপ এবং যা সব কিছুর জ্ঞানকে আলোকিত করে।—জ্ঞান যেখানে বস্তু নয়, জানার উপকরণ নয়, বরং জ্ঞান-প্রক্রিয়ার আদিস্থলে যে-চেতনা—সে-ই আমি। এই জ্ঞান অন্য কিছুকে জানায় না, সে নিজেকেই জানে এবং সে জানার মধ্যেই জগত লীন।

অনন্তম্ অর্থ: যার কোনো সীমা নেই—যা কাল, দেশ, ও অবস্থা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।—সীমা যেখানে নেই, সেখানে দ্বিতীয় কিছু নেই। আমি কোথাও শুরু হই না, কোথাও শেষ হই না—আমি সমস্ত সীমাবদ্ধতার নীরব প্রত্যক্ষদর্শী, এই অনন্ততাই আমি, যাকে কখনও জানা যায় না, কিন্তু যিনি জানার পেছনে সর্বদা উপস্থিত।

ব্রহ্ম অর্থ: সর্বব্যাপক, সর্বতত্ত্বের উৎস, একমাত্র পরম সত্তা।—যা একমাত্র আছে, সব কিছুর মধ্যেও যার অস্তিত্ব, এবং যা সব কিছু ছাড়িয়েও আছে। সেই ব্রহ্ম আমি—নয় দেহ, নয় মন, নয় ইন্দ্রিয়—আমি সেই স্বয়ং-প্রভা, চিরচেতন, বিভেদ-রহিত আমি।

সত্য যেখানে রূপ নয়, জ্ঞান যেখানে জ্ঞাতার ঊর্ধ্বে, অনন্ত যেখানে কোনো দিকেই বাঁধা নেই, সে-ই ব্রহ্ম—আমি।

চিত্তের রং বদলালে ফলও বদলায়। যে-ফল চিত্তের ঢেউ দেখে আসে ও যায়—সে তো চিরন্তনের সংবাদ নয়। চিরসত্য কখনও ঢেউয়ের মতো ওঠে না, নামে না। তাই ফল নয়—আমি খুঁজি ফল-অতিক্রমী ধ্রুবতা।

চিত্তের অবস্থাভেদে অনুভব বদলায়, কিন্তু আত্মা অপরিবর্তনীয়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৩/৮) জানাচ্ছেন—"ন হি গত্যন্তরং তস্মাত্"—তাঁর (পরম ব্রহ্মের) কোনো কারণ নেই; তাঁর চেয়ে ঊর্ধ্বে কিছু নেই; তাঁর কোনো জন্মদাতা নেই, অধিপতি নেই। তাঁর ব্যতিরেকে অন্য কোনো গতি (মুক্তির পথ) নেই।”

যা আছে, তার বাইরেও আর কিছু নেই। যাত্রার শেষ যেখানে, সে-ই শুরু। সমস্ত গমনরেখা যেখানে নিঃশেষ, সেই এক অগম্য তুঙ্গতায়—সে নিজেই গন্তব্য। জ্ঞান, ভ্রান্তি, সাধনা, বিচ্যুতি—সবই অবশেষে তারই দিকে ফিরে আসে। তাই ওর বাইরে যাবার মতো কিছুই নেই। ফল আত্মার পরিচয় নয়।

আয়নার ছায়া নয়, আয়নার পারাপার—বাহ্যফল এক আয়নার প্রতিচ্ছবি—যে নিজেকে সেই প্রতিচ্ছবিতে দেখে, সে জানে না আয়নার ওপারেই আছে নিঃশব্দ দীপ্তি। আমি সে দীপ্তি—যা ফলের অপেক্ষায় নয়, বরং নিজেই পরিণত এক চেতনার ফসল।

আত্মা আয়নার ছায়া নয়—সে আয়নার অন্তরে আত্মান্বেষার দীপ্তি। “দ্রষ্টা দৃশ্যভেদো নাস্তি”—দেখা ও দ্রষ্টার দ্বৈত নেই। দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। আত্মা নিজেই চিরপরিপূর্ণ।

দ্রষ্টা=দেখনেওয়ালা, সাক্ষী, চেতনা (The Seer or Witness)। দৃশ্য=যা দেখা যাচ্ছে, জগৎ, চিন্তা, অভিজ্ঞতা (The seen)। ভেদঃ=পার্থক্য। নাস্তি=নেই।

জ্ঞানচক্ষুতে যখন সব কিছু পরিণত হয় একমাত্র চেতনার প্রকাশরূপে, তখন আর ‘আমি দেখছি এই জগৎ’—এই ভেদবুদ্ধি থাকে না। তখন জানা যায়, "দ্রষ্টা আমি" এবং "যা দেখা যাচ্ছে"—দুটোই একমাত্র চেতনরূপেই বিদ্যমান।

দেখছে কে?—সে-ই তো নিজেকে দেখছে। দৃশ্য যা—তার বাইরে কিছুই নয়, সে চেতনারই প্রতিচ্ছবি। ভেদ যেখানে, সেখানে আমি নেই। আমি যদি দ্রষ্টা, তবে যা দেখছি তা-ও আমি—দ্রষ্টা-দৃশ্যের ভেদ বিলীন চৈতন্যতায়।
Content Protection by DMCA.com