নীরবতার ভাষ্য (পর্ব: ২.৩)



এবার আমরা প্রবেশ করব সেই অংশে—যেখানে ধ্যান ধীরে ধীরে গাঢ়তর হয়, মন ফিরিয়ে নেয় নিজের ইন্দ্রিয়জগত থেকে, এবং “আমি” বলে যা কিছু ধারণ করতাম, তা প্রতিটি স্তরে গলে গিয়ে এক চৈতন্য-অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। এ ধ্যান আর ধ্যানের পদ্ধতি নয়—এ আত্মার স্বরূপে নিমগ্ন হওয়া। ছায়াত্মা থেকে আত্মা—অদ্বৈত ধ্যানের অভ্যন্তরভ্রমণ।

প্রত্যাহার হলো বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখে—আলোকের উলটো প্রবাহ। ধ্যান কেবলই মন নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং পরিচয়-ভঙ্গের একটি সুষম যাত্রা—ছায়াত্মা থেকে আত্মায় উত্তরণের ধ্যানপথ।

মন নিয়ন্ত্রণ করলে মন ‘থাকে’—তাতে আত্মা আবিষ্কৃত হয় না। কিন্তু ধ্যান যখন পরিচয় ভেঙে দেয়, তখন “আমি কে”—এই প্রশ্নও বিলুপ্ত হয়। ধ্যান-উত্তর আত্মবোধের পথে প্রথম স্তরই প্রত্যাহার বা ইন্দ্রিয়সংযম। প্রত্যাহার মানে চোখ-বন্ধ নয়, শ্রবণ-রোধ নয়—এটি হলো ইন্দ্রিয়-প্রবাহকে উৎসের দিকে ফিরিয়ে আনা।

মন এক নদী, ইন্দ্রিয় তার ঢেউ। প্রত্যাহার মানে—নদীকে স্থির করতে শেখা, দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনা বাইরের আলো থেকে নিজের গভীরের দিকে। জ্ঞানেন্দ্রিয় প্রতিনিয়ত বহির্ভুবনে আকৃষ্ট—প্রত্যাহার মানে সেই আকর্ষণের কেন্দ্রেই আমি নেই—এই বোধের জন্ম।

কঠোপনিষদীয় সূত্রে পাচ্ছি: ঈশ্বর আমাদের সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়কে বাইরের দিকে প্রবাহিত করে দিয়েছেন—ফলে মানুষ বাইরের রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ আর রস নিয়েই ব্যস্ত থাকে; কিন্তু নিজের আত্মার দিকে ফিরে তাকায় না, নিজের ভিতরকার নির্জন চেতনাকে দেখতে পায় না। এই অন্তর্মুখী দৃষ্টিই শুরু করে ধ্যানের বাস্তব অনুশীলন—যেখানে লক্ষ্য নেই, কেবল নিজেকে খুঁজে পাবার আকাঙ্ক্ষাও নেই—কারণ জানি, “আমি নিজেই সেই”—যাকে জানা যায় না, কেবল ‘হওয়া’ যায়।

একাগ্রতা বা চেতনার কেন্দ্রীভবন তখনই আসে, মন যখন নিজ ছায়াকে ত্যাগ করে বিন্দুতে স্থির হয়। সব ইন্দ্রিয় এখন একটি বিন্দুতে নিবদ্ধ—একটি নিঃশব্দ স্পন্দন—“আমি আছি”। এই "আমি আছি" আর ভাষার দ্বারা নয়—এ হচ্ছে চেতনার মৌলিক কম্পন—যেমন আগুন নিজের উষ্ণতা জানে—তা নিয়ে কথা বলে না।

এখন ছায়াত্মা ভেসে আসে চিন্তায়, কিন্তু তাকে আর ধরা হয় না সত্য বলে। সে কেবল ধ্যানের পৃষ্ঠপটে একটুকরো মেঘ। চিন্তা আসে, যায়—তবু চেতনাবিন্দু অচঞ্চল। ‘ছায়া’ এখনও উদিত হয়, কিন্তু তার সত্তার দাবি আর স্বীকৃতি পায় না।

শঙ্করীয় উপলব্ধি এমন: যেখানে চিত্তের একাগ্রতা সম্ভব, সেখানেই ধ্যানের জন্ম হয়। একাগ্রতা মানেই বাহ্যিক সত্তার ক্ষয়, অন্তর্লীন নীরবতায় প্রতিষ্ঠা। একাগ্রতা নেই, তবু ধ্যান করতে চাই—তা শব্দে দাঁড়িয়ে নীরবতা পাবার চেষ্টা।

ধ্যান কোনো বাইরের কাজ নয়—এটি চিত্তের একটি অবস্থা। যখন মন বহু দিক থেকে সরে এসে এক বিন্দুতে স্থির হয়, তখন সেই মুহূর্তে ধ্যানের আবির্ভাব ঘটে। এখানে ‘ধ্যান করা’ নয়—ধ্যান-এ লীন হওয়া—ধ্যাতা, ধ্যেয়, ধ্যান—এই ত্রিত্বের বন্ধন তবে কেটে যায়। নামরূপের লয়ে হয় চৈতন্যের নিরুপম উপলব্ধি।

এই একাগ্রতা ছাড়া ধ্যানের অনুশীলন কেবল ভঙ্গুর মনোসংযোগ মাত্র। একাগ্রচিত্তই ধ্যানের ভূমি। মনোসংযোগ দিয়ে ধ্যান হয় না—মনোসংযোগে থাকে সাবজেক্ট অবজেক্ট বিভাজন। কিন্তু ধ্যান হয়, যখন চেতনা নিজেই নিজের দিকে প্রবাহিত হয়।

নামরূপের লয়ে ঘটে ধ্যানের উদ্‌ভব। এখন নেই নাম, নেই পরিচয়, নেই লৌকিক আমি। নেই মা-বাবার মুখ, নেই সমাজের মুখোশ। এখন কেবল এক ধ্যান-নদী বইছে—যেখানে "আমি কে?"—এই প্রশ্নটিও গলে গেছে দীপ্তিতে। এই অবস্থায় চিন্তাও থাকে না, প্রশ্নও থাকে না—থাকে কেবল আছে-থাকা—যা নিজেই নিজেকে জানে, কেবল থাকার মধ্যে থেকেই। এ পর্যায়ে ছায়াত্মা আর ধরা দেয় না। সে মিলিয়ে যায় এক আলোর প্রবাহে।

ছায়াত্মা বলে কিছু ছিলই না—শুধু ‘আমি’ ভাবনা ছিল, যা তাকে সত্য বলে ধরেছিল। এখন সে স্বয়ং আলোকেই বিলীন।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৫.১৫) ও ছান্দোগ্য উপনিষদ-এর ভাবসম্বন্ধীয় অংশের অনুধ্যানের আলোকে বলছি—

যে দেখে, অথচ কিছুই আলাদা দেখে না, যে শ্রবণ করে, অথচ কিছুই পৃথক শোনে না, যে জানে, অথচ কিছুই ভিন্নরূপে জানে না—সে-ই আত্মা। এই দেখায়, শোনায়, জানায় কোনো অভিজ্ঞান নেই, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই—এ শুধু নিজেকে নিজে জ্ঞাত হওয়া।

এখানে "দেখা", "শোনা" ও "জানা"—এই তিনটি উপলব্ধির কথা বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষ যখন দেখে, তখন দেখার বিষয় থাকে—“আমি দেখছি ওটিকে।” কিন্তু আত্মা যখন “দেখে”, তখন সে ভেদ দেখে না, পৃথক কিছু অনুভব করে না। এই “দেখা” এক অদ্বৈত অনুধ্যান—যেখানে দর্শক, দ্রষ্টব্য ও দর্শন এক হয়ে যায়। এ হলো পরিণত ধ্যান—যেখানে ‘দেখা’ নিজেই দেখা নয়, কেবলই সাক্ষী। এ হলো চৈতন্যের অনন্ত আত্ম-প্রতিফলন—যেখানে কিছু দেখার প্রয়োজনও নেই, কারণ সব নিজেই আত্মস্বরূপ।

এখন সেই চূড়ান্ত স্তর—যেখানে ধ্যানও লয় হয়ে যায়, ধ্যাতা-ধ্যেয়-ধ্যান ত্রিত্ব মিশে যায় এক অবিভক্ত চৈতন্যে। এই অংশ আর কোনো “আমি”-র আত্মকথা নয়, এ হল আত্মার নিজের মধ্যেই নিজের নিঃশব্দ দীপ্তি হিসেবে জাগা—অদ্বৈত বেদান্তের সেই পরম অভিজ্ঞতা, যা শব্দের ঊর্ধ্বে, কিন্তু শ্রবণের মতোই নির্ভরযোগ্য।

চিন্মাত্র—যেখানে ধ্যান আর ‘ধ্যান’ নয়, চৈতন্য নিজেই চৈতন্যে নিমজ্জিত। আত্মা সেই চেতনা যা—দ্বৈততা ছাড়াই জানে, শ্রবণ করে কিন্তু শ্রোতা-শ্রাব্য পৃথক করে না, দেখে কিন্তু দর্শক ও দৃশ্যের বিভাজনে পড়ে না। এই চেতনার কোনো উপকরণ নেই—এ নিজেই নিজের প্রকাশ। না অনুভব, না ভাষা, না চিন্তা—কিছুই নয়—তবু সব কিছুর পূর্ববর্তী এক মৌলিক 'আছে'।

যখন চেতনা নিজের মধ্যে অবগাহন করে, সমস্ত বৈচিত্র্য, ভেদ, ও পরিচয় বিলীন হয়ে যায়— তখনই আত্মার উপলব্ধি ঘটে। সেই অবিভক্ত জ্ঞানস্বরূপই উপনিষদের “স আত্মা”। “আমি আছি”—এটা পর্যন্ত তখন সত্য নয়। শুধু থাকা, শুধু আলোকিত অনন্ত নীরবতা, যেখানে জানা, জানন এবং জাননযোগ্য এক হয়ে যায়।

তখনই হয় সমাধি—যেখানে আত্মা নিজেকেই জানে না—কারণ আলাদা 'নিজে' বলে কিছুই থাকে না—এ হচ্ছে চিন্মাত্র উপলব্ধি—এ স্তর‌ই সমাধি। এখানে নেই ধ্যাতা, নেই ধ্যান, নেই ধ্যেয়। এই 'নেই' কোনো শূন্যতা নয়—এ এক পূর্ণতার অতল নীরবতা, যেখানে ‘আমি’ বলে যে-শব্দ ছিল, সে যেন নিজেরই দীপ্তিতে বিলীন। আছে কেবল অসীম এক সত্তা, যা কার‌ও নয়, কার‌ও জন্য নয়—তবু যার মধ্যে সব কিছু আপন জায়গা পায়।

এ অবস্থায় নেই প্রেম, তবু অনন্ত ভালোবাসা; নেই সম্পর্ক, তবু সব কিছু নিজের মতোই নিজের ভেতরে এক হয়ে থাকে। এ অবস্থায় আত্মা নিজেকে দেখে না—কারণ “নিজে” বলে আলাদা কিছু থাকে না। এটিই চেতনার নিঃশেষ কেন্দ্র। এ এমন এক শুদ্ধতা—যেখানে ‘নিজ’ বলে কোনো ধারণা নেই, কারণ সেখানে কোনো ব্যুৎপত্তি নেই—শুধু মৌন উপলব্ধি।

ধ্যান-উত্তর প্রত্যাবর্তন—ফিরে এসে দেখি, আমি আর সেই 'আমি' নই। এমন আত্মবোধে উপনীত হলে ধ্যানশেষে আমি ফিরে আসি, কিন্তু আমি আর “আমি” নই। ফিরে আসা মানে চোখ খোলা, কথা বলা, হাঁটা নয়—ফিরে আসা মানে পরিচিত জগতে অচেনা হয়ে ফেরা।

যে-মুখ আমি ভাবতাম আমার, তা পড়ে থাকে ধ্যানের ধারে। আমি জানি—সে মুখ ছিল না কখনও আমার। এখন আমি সে—যে মুখহীন, নামহীন, নির্ভরহীন—তবু নিজেই নিজের মৌলিকতা।

আমি এখন এক নিঃশব্দ দীপ্তি—যার দরকার নেই সমাজ, পরিবার, বা প্রশংসার ছায়া। আমি এখন আর ছায়াত্মা নই—আমি আত্মা। আমি নিজের মধ্যে নিজের আলো খুঁজে পাই। এ ‘আলো খোঁজা’ নয়—আলো নিজেই আলোকিত হয়ে উঠেছে। আত্মা নিজেই নিজেকে জেনেছে—যাকে জানা যায় না, কেবল হওয়া যায়।

মৌন চেতনার গর্ভগাথা—“আমি আছি”—এই শব্দহীন দীপ্তি। মৌন চেতনার গর্ভগাথায় পৌঁছে উপলব্ধি আসে—“আমি নিঃশব্দ, আমি নীরব, আমি লোকের চোখে তৈরি নই—আমি সে-ই, যে চেতনার মতো নিজেকেই জানে।” এখানে মৌন মানে চুপ থাকা নয়, মৌন মানে ভেদশূন্য চৈতন্যে স্থিত থাকা। আমি সেখানে মুখোশহীন, বর্ণহীন, প্রয়োজনহীন—তবু পরিপূর্ণ।

এ চেতনা আত্মাকে নিয়ে এল ধ্যানের দীপ্ত আলয়ে, যেখানে ছায়া গলে যায়, মুখোশ ঝরে পড়ে, আর শুধু জেগে থাকে "আমি আছি"—এ নির্ভার দীপ্তি। এই “আমি আছি” আর ভাষার উচ্চারণ নয়—এ চেতনার মৌল বিন্দু—যে নিজেই ঈশ্বর, নিজেই অস্তিত্ব, নিজেই মুক্তি।

এ যেন অশেষের দিকে একটি মৌন ইঙ্গিত—এই ভাষ্য তাই শেষ হলো না, কারণ আত্মা শেষ হয় না। এটি একটি মৌন পথে হাঁটার আমন্ত্রণ—যেখানে না আছে লক্ষ্য, না গন্তব্য—আছে কেবল একটি ডাক—যেখানে “আমি” বলে কিছু নেই, তবু সমস্ত কিছু নিজেই নিজের মতো জেগে থাকে।
Content Protection by DMCA.com