নীরবতার ভাষ্য (পর্ব: ২.১)



ছায়াত্মা: পরিচয়ের প্রতিচ্ছবিতে হৃত দীপ্তি

জন্মের মুহূর্ত থেকে আমরা অন্যদের নানান ভাষার মুখোমুখি হই, শব্দের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় আমাদের পরিচয়। একটি শিশুর প্রথম শব্দ তার নিজের নয়, তা আসে অন্যের মুখ থেকে—“তুমি আশীর্বাদ”, “তুমি গর্ব”, “তুমি ভালো ছেলে”, “তুমি আমাদের আলো”…

এই বহিরাগত শব্দগুলো যখন মানুষ বার বার শুনতে থাকে, তখন সে বিশ্বাস করতে শুরু করে, “আমি আসলেই এ-ই”। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় এক ‘আমি’—যে আমি আসলে অন্যের তৈরি। এই ‘আমি’ এক নির্মিত মুখোশ—যাকে আমি নিজের মুখ ভেবে ফেলেছি।

এই মুখোশেই বাস করে ছায়াত্মা। ছায়াত্মা মানে সেই প্রতিচ্ছবি, যা আত্মা নয়, কিন্তু আত্মার ভান ধরে থাকে।

উপনিষদ আমাদের জানান—আত্মা প্রশংসা ও নিন্দার ঊর্ধ্বে। সে নিরপেক্ষ, সে চেতন, সে নির্জন দীপ্তি। বাইরের শব্দে, রায়ে, নামকরণে আত্মার কোনো পরিচয় নেই।

তবু আমরা এক প্রতিচ্ছবির মধ্যে নিজের পরিচয় খুঁজি। আয়নায় দেখি এক মুখ—যা আমাদের সমাজ, পরিবার, ধর্ম, শিক্ষক—সবাই মিলে এঁকেছে। আমরা ভাবি, এটাই আমি। কিন্তু সেই আয়না যখন কাঁপে—মত বদলায়, পরিস্থিতি পালটায়, মন ভিন্ন কিছু চায়—তখন সেই মুখ আর আগের মতো থাকে না। আর আমরা বিভ্রান্ত হই—“তাহলে আমি কে?”

এই বিভ্রান্তির মাঝেই আসে শঙ্করাচার্যের সেই অনন্ত সত্য—“আত্মা স্বপ্রকাশ”—আত্মা এমন এক সত্তা, যাকে অন্যের চোখে দেখা যায় না, যাকে কেউ যাচাই করতে পারে না, যার অস্তিত্ব নিজস্ব। সে নিজের আলোকেই নিজেকে চেনে। অন্যের আলোয় সে প্রতিফলিত বা প্রকাশিত হয় না।

যে-পরিচয় গড়ে উঠেছে সমাজের চোখে, পরিবার-পরিসরে, সে পরিচয় কাচের মতো ভঙ্গুর। ছায়াত্মা সেই কাচের প্রতিচ্ছবি—যা ধরা পড়ে ভাষায়, গঠিত হয় স্মৃতিতে, আর বিচ্ছিন্ন থাকে আত্মার মূলতত্ত্ব থেকে।

গীতা (৩.১৭) বলছেন—যিনি নিজের মধ্যেই পরিতুষ্ট, যার অস্তিত্ব নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ, তিনিই প্রকৃত পুরুষ। যিনি নিজের মধ্যে পূর্ণ, তিনি বাইরের দৃষ্টিতে আকৃষ্ট হন না।

ছায়াত্মা সেই ‘আমি’, যে নিজের দীপ্তি ভুলে গিয়ে, অন্যের মুখে নিজের গুরুত্ব খোঁজে। সে নিজের আলোয় দাঁড়াতে শেখেনি, সে আলো খোঁজে বাইরের চাহনিতে। এই ‘আমি’—প্রতিক্রিয়াশীল, ভয়াতুর, প্রত্যাশানির্ভর।

আত্মাভাস মানে সেই মানসিক ‘আমি’, যা সমাজ-সংস্কৃতি-পরিচয়ের মিলনে তৈরি হয়। এটি এক গভীর বিশ্বাসের ছায়া—যা আত্মার মতো দেখতে, কিন্তু তার প্রকৃত অর্থে আত্মা নয়।

একদিন নিঃশব্দে বসে থেকে মনে হয়—“এই নাম, এই গৌরব, এই ব্যর্থতা, এই ভূমিকাগুলো—এসব কি সত্যিই আমি?”

মনের গভীরে তখন জেগে ওঠে এক অদৃশ্য আলো। সে কোনো শব্দ উচ্চারণ করে না, তবু বলে— “তুই তো কোনো সংজ্ঞা না। তুই মুখোশ নোস্‌, তুই আলো; যে নিজের জন্যই জ্বলে, যার পরিচয় কেউ লিখে দিতে পারে না।”

উপনিষদ আবার বলেন—“নেতি নেতি”—এই নয়, এই নয়। যেটা আমি ভাবি “আমি”, সেটা নয়। যেটা সমাজ বলে, সেটা নয়। যেটা অন্যেরা আমাকে ভেবে নেয়, তা-ও নয়। আত্মা কোনো সীমার মধ্যে ধরা পড়ে না। সে ভাষাতীত, বিচারাতীত, অভিজ্ঞতাতীত। সে এক ‘নিঃশব্দ চেতনা’।

এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় অভ্যন্তরীণ মুক্তির প্রক্রিয়া। আমি খুলতে শুরু করি মুখোশ— “আমি সন্তান”, “আমি ছাত্র”, “আমি গর্ব”, “আমি সম্ভ্রান্ত”—এক এক করে এই মুখোশগুলো আমি ছেড়ে ফেলি।

শেষে দেখি—আছে কেবল এক নিঃশব্দ দীপ্তি।

গভীর ধ্যানে পৌঁছালে ধ্যাতা, ধ্যেয় আর ধ্যান—এই তিনটি একাকার হয়ে যায়। তখন থাকে না কোনো কর্তা, কোনো উপাস্য, কোনো উপাসনা—থাকে কেবল এক চিন্মাত্র। এই চিন্মাত্রই আত্মা। এই চিন্মাত্রই নিজরূপ।

চিন্মাত্র (চিত্-মাত্র) শব্দটি মূলত সংস্কৃত থেকে আগত, এবং এটি অদ্বৈতবেদান্ত ও উপনিষদীয় দর্শনের একটি গভীর, মৌলিক ধারণা।


চিত্ মানে চেতন বা চৈতন্য — অর্থাৎ সচেতন সত্তা, জ্ঞান বা জ্ঞানপ্রকাশের ক্ষমতা। মাত্র মানে কেবল বা শুধু। চিন্মাত্র মানে—”শুধু চৈতন্য”, “নির্বিকার, নির্লিপ্ত, নিঃসঙ্গ, অদ্বিতীয় সচেতনতা”।

এটি এমন এক সত্তা বা বাস্তবতা, যার মধ্যে কোনো নাম, রূপ, গুণ, কর্ম, বিকার নেই। সে শুধুই চেতনা—যা সকল অভিজ্ঞতার সাক্ষী, সকল কিছুকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কোনো গুণ বা সীমার অধীন নয়।

বেদান্ত অনুসারে চিন্মাত্র:

চিন্মাত্রই পরম ব্রহ্ম। তা অবিনশ্বর, অদ্বিতীয়, সর্বব্যাপী, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির অতীত। সে জানে, কিন্তু জানার কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই। সে আলো দেয়, কিন্তু নিজে কখনও অন্ধকারে ডোবে না। সব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, অনুভব — তাকেই কেন্দ্র করে, অথচ সে নিঃসঙ্গ। যেমন, আপনি এখন কিছু পড়ছেন, অনুভব করছেন, চিন্তা করছেন—এই সমস্ত কিছুর পেছনে যে সচেতন উপস্থিতি, যার কারণে আপনি অনুভব করছেন—সেইটাই চিন্মাত্র।

এই আত্মবোধেই ছায়াত্মার বিলয় ঘটে। ছায়াত্মা এক স্বপ্নের মতো—যে জেগে ওঠে, সে দেখে স্বপ্নটি আর নেই। এই জাগরণ‌ই সব।

যখন আত্মজ্ঞানের আলো জ্বলে ওঠে, তখন নাম মুছে যায়, রূপ বিলীন হয়। “আমি করলাম”, “আমি ব্যর্থ”, “আমি গুরুত্বপূর্ণ”—এইসব কর্তা-ভাব আর থাকে না। আত্মা তখন নিজের মধ্যেই নিজেকে চেনে। এই আত্মচেতনার জাগরণই মোক্ষ। আর মোক্ষ মানেই ছায়ার বিলয়, আলোর প্রকাশ।

বাইরের স্বীকৃতি থেকে গঠিত ‘আমি’ আসলে এক আত্মাভাস। এই আত্মাভাস সমাজ, পারিবারিক ধারা, অভিজ্ঞতা, সংস্কার ও ভয়ের মিশেলে তৈরি। এটা এমন এক আমি, যাকে আমরা আত্মা বলে ভুল করি।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ (১.৪.১০) আমাদের শেখান—“আত্মা দর্শনীয়, শ্রবণীয়, মননীয়, নিদিধ্যাসনীয়।” অর্থাৎ আত্মা নিজের মধ্যেই নিজেকে উপলব্ধি করে। অন্যের চোখে আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

শঙ্করাচার্য বলেন—আত্মা কোনো মত, যুক্তি বা ভাষার দ্বারা ধরা পড়ে না। ছায়াত্মা হচ্ছে সেই মুখোশ, যা তৈরি হয়েছে যুগে যুগে, সমাজের মতে, পরিবারের কথায়।

গীতা (২.৫৭) বলছেন—“যিনি প্রশংসায় ও অপমানে, সুখে ও দুঃখে সমান, তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ।” ছায়াত্মা ঠিক তার উলটো—সে বাইরের প্রতিক্রিয়ায় কাঁপে। আত্মা কাঁপে না। সে অবিচল, নির্লিপ্ত।

ঈশোপনিষদ (৬)-এর অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—যিনি সমস্ত জীবের মধ্যে পরমাত্মাকে দেখেন এবং পরমাত্মার মধ্যে সমস্ত জীবকে দেখেন, তিনি কাউকে ঘৃণা করেন না।

এই দর্শনই বলে—আত্মা একতা, ছায়াত্মা বিভেদ। ছায়াত্মা হলো অহংনির্মিত ‘আমি’; আত্মা হলো নিরহংকার চেতন।

উপনিষদে ঘোষিত—“আমি দেহ নই, মনও নই—আমি চিদানন্দ, আমি শিব।”…এই বোধ ছায়াত্মাকে সরিয়ে দেয়, আত্মাকে প্রকাশ করে।

ছায়াত্মা হল সেই ঘন কুয়াশা, যা আত্মার আলোকে ঢেকে রাখে। এই কুয়াশা তৈরি হয় মানসিকতা, পরিচয়, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আর স্মৃতির জমাট আবরণ দিয়ে।

মুণ্ডক উপনিষদ বলেন—যে ভুলদৃষ্টিতে আত্মাকে দেখে, তার কাছে ব্রহ্মজ্ঞান আসে না। “আমি” যদি “সম্মান”, “পদ”, “পরিচয়”-এর চোখে নিজেকে দেখে, তবে সে আলোকপ্রাপ্ত নয়।

মুক্তি আসে তখন, যখন আমি জিজ্ঞাসা করি—“এই আমি, যা এতদিন ধরে ধরে রেখেছি, আসলেই কি আমি?” এই প্রশ্নই ছায়াত্মার দেয়ালে প্রথম ফাটল।

এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে শুরু হয় এক মৌন সংলাপ, যেটার শব্দ হয় না, কিন্তু অনুভূতি গভীর হয়।

অষ্টাবক্র গীতা (৩.৫) বলেন—যখন আর কিছু জানার, কিছু ধরার, কিছু ভাবার প্রয়োজন থাকে না, তখনই আত্মা নিজের মতো জ্বলে ওঠে।

উপনিষদের ভাষ্য অনুসারে—মায়া আত্মার আলোকে আড়াল করে রাখে। আর এই মায়ার ঘন আবরণেই জন্ম নেয় ছায়াত্মা।

যখন আমরা সেই মায়া ছেড়ে দিই—যখন অনাসক্ত চেতনার জ্যোতিতে নিজেদের চেতনার উৎসে পৌঁছাই—তখন ছায়াত্মা মুছে যায়।

ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে—“তৎ ত্বং অসি”—“তুমি সেই”। তুমি সেই চেতন, যাকে ভাষা বা সমাজ সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। তুমি দেহ ন‌ও, পরিচয় ন‌ও—তুমি এক বিশুদ্ধ, অখণ্ড চেতনা।

ছায়াত্মা এক নদী—যার প্রবাহ সমাজের মুখোশ দিয়ে তৈরি। আত্মা এক বাতিঘর—যা আলো দেয় কিন্তু চাপে না, নির্দেশ দেয় কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে না।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি এই নদী ও বাতিঘরের মাঝখানে। যখন আমরা একবার থেমে চুপ করে থাকি, তখন শব্দ গলে যায় নিঃশব্দে। ছায়া গলে যায় দীপ্তিতে।

তখন আমরা বুঝতে পারি—“আমি মুখোশ নই, আমি দীপ্তি।” “আমি প্রতিফলন নই, আমি অস্তিত্ব।” “আমি নেই কারও চোখে, নেই কারও রায়ে।” “আমি সেই—যে নিজের নীরবতায় নিজেকে চিনে।”
আর দূরে কোথাও, এক বাতিঘর ডাকছে— “ফিরে আয়, নিজ দীপ্তির দিকে।”

Content Protection by DMCA.com