ধ্যান কী?
ধ্যান কোনো কার্যকলাপ নয়—এ এক "অক্রিয় অবস্থান"।
না চাওয়া, না ভাবা, না কল্পনা করা—এ এক নিঃশব্দ প্রত্যাবর্তন: নিজের কাছে।
উপনিষদ বলেন:
"যঃ পশ্যতি ন চ চিন্তয়তি—সঃ মুনিঃ।"
—যে দেখে, কিন্তু চিন্তা করে না—সে-ই ঋষি।
ধ্যান সেই দর্শন—যেখানে চিন্তার তলদেশে খুলে পড়ে নীরব আত্মবোধের দরজা।
ধ্যানের স্তর—এ এক অন্তঃসলিল মানচিত্র।
এক: বাইরে থেকে অন্তরে প্রবেশ।
প্রথমে বসে থাকো—নীরব, স্থির।
দেহের হালকা হাওয়া-চলাচল অনুভব করো—
নাক দিয়ে বাতাস ঢোকে, আবার বেরিয়ে যায়।
এইটুকুতে থেকেই নিজেকে আলতো করে ছুঁয়ে দাও।
দুই: মনুষ্যসত্তার সরীসৃপ মোহ।
মন আনবে চিন্তা—
“আজ কী করবো?”, “কাল কী হবে?”, “আমি ভালো তো?”
ধ্যান বলে—এসব ভাবনা কেবল ছায়া।
তুমি তাদের দ্রষ্টা, অংশগ্রহণকারী নও।
তিন: মৌন স্পন্দনের আত্মবোধ।
চিন্তা স্তব্ধ হলে, এক স্পন্দন টের পাবে—না শব্দ, না আলো—তবু একটা “আছি” অনুভব।
উপনিষদে একে বলে—“সাক্ষিচেতন”—তুমি সেই সাক্ষী, যা দেখে, জানে; তবু নিঃসঙ্গ ও পরিপূর্ণ।
চার: স্বঘোষিত সত্তার বিলয়।
এই স্তরে "আমি" বলে কিছু আর থাকে না। শুধু চেতনা নিজে নিজেকে উপভোগ করে।
শঙ্করাচার্য বলেন:
“নাহং দেহো ন মে জ্ঞানেন্দ্রিয়াণি।”
…আমি দেহ নই, ইন্দ্রিয় নই, মনও নই—
তবে কে আমি?
—শুধু সেই, যা সব কিছুকে জানে, অথচ কিছুর মধ্যে পড়ে না।
পাঁচ: তুরীয়—ধ্যানের অতীত ধ্যান।
এখানে সময় নেই, স্থান নেই, অভিজ্ঞতা নেই—শুধু এক অচঞ্চল, বিশুদ্ধ “অস্তিত্ব”।
তাকে ধ্যান বলেও ডাকা যায় না—কারণ ধ্যানও সেখানে অবলুপ্ত।
এই "তুরীয়"—চতুর্থ অবস্থান—উপনিষদীয় সর্বোচ্চ উপলব্ধি।
ধ্যান মানেই: মিলন নয়—আত্মবিস্মরণ।
ধ্যান মানে ঈশ্বরদর্শন নয়, কল্পনায় শান্তি নয়—ধ্যান হলো নিজেকে ভুলে যাওয়া,
যাতে প্রকৃত নিজেকে মনে পড়ে।
ধ্যান হলো চোখ বন্ধ করে জাগ্রত হওয়া।
ধ্যান হলো—নিজেই নিজের কাছে ফিরে যাওয়া।
শেষে উপনিষদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এক শান্ত ধ্বনি—
"অহমেবাহং ম আম্যহং"—আমি কেবল আমি—আর কিছু নয়।
এসো, এক স্বপ্ন-চিত্রে আত্মবোধের সাক্ষী হই।
দৃশ্য ১: বৈরাগ্য—“সাঁঝের নদীতে এক নৌকা”
আকাশে অস্তরাগ, নদী শান্ত।
এক নৌকা ভেসে যাচ্ছে ধীরে—
পেছনে পড়ে থাকছে ঘর, নাম, মুখ, সুর, প্রিয়জন, স্বপ্ন।
নাবিকের চোখে জল নেই—তবু শূন্যতা ভেসে আছে দৃষ্টিতে।
সে জানে, কোনো কূল নেই—তবু নৌকাটি চলছেই।
বৈরাগ্য মানে কি ত্যাগ?
না—এ তো বোঝা—সব কিছু শেষ হয়—তবু আমি থাকি।
তাই আমি যা থাকি, তা কিছুতে বাঁধা নয়।
দৃশ্য ২: জ্ঞান—“দুটি আয়নার মাঝখানে দাঁড়িয়ে”
এক স্বপ্নঘরে দাঁড়িয়ে আছ তুমি—
দু-দিকে দুটি আয়না—
একদিকে অতীত, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ।
...প্রতিটি আয়নায় ভেসে ওঠে স্মৃতি, ভয়, আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনা।
তুমি হাঁটতে থাকো—এক আয়না থেকে আরেক আয়নার দিকে—
কিন্তু হঠাৎ থেমে যাও—
আয়নার বাইরে এক নীল আলো ফুটে ওঠে—
যেখানে প্রতিবিম্ব নেই, কেবল নিজের অনুভব।
জ্ঞান মানে কি জানা?
না—জ্ঞান মানে জানার ঊর্ধ্বে ওঠা, যেখানে "জানতে চাওয়া"-টিও মিলিয়ে যায়।
দৃশ্য ৩: সমাধি—“আলোর শূন্য গুহা”
এক পাহাড়ের গায়ে গুহা—
ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাও না কিছুই।
তবু গভীরে যাবার পর হঠাৎ এক শূন্যতা—
যেখানে আলো আছে, কিন্তু তা চোখে পড়ে না।
তুমি নেই, চিন্তা নেই, অনুভব নেই—
তবু কিছু রয়ে গেছে—যা "কিছু" নয়।
এ-ই হলো সমাধি—
যেখানে 'তুমি' নিজেই নিজেকে ভুলে গিয়েছ,
তবু কিছু আছে, যা সব কিছু জানে,
তবু কিছুই ধরে না।
এই তিনটি দৃশ্য একত্রে প্রকাশ করে—চেতনার সেই তিন ধাপ, যেখানে ত্যাগ, অবচেতনা, এবং অসীমতা একাকার হয়ে যায়।
আত্মার মৌনযাত্রা মুক্তির দীপ্ত বাতিঘরের দিকে—আলোকবর্তিকা: এক রূপক-আখ্যান
১. আত্মা: এক যাত্রী, যার কোনো নাম নেই
সে জেগে ওঠে গভীর ঘুম থেকে—
চারপাশে কুয়াশা, বাতাসে নামহীন বিষাদ।
সে জানে না সে কে, কোথা থেকে এসেছে—
তবু তার বুকের ভেতর বাজছে এক স্পন্দন—
"ফিরে যেতে হবে। কোথাও ফিরতে হবে…"
২. মন: এক উত্তাল সমুদ্র
তার পায়ের নিচে ছড়িয়ে পড়ে এক বিশাল সমুদ্র—
চঞ্চল, ঝড়ো, অস্থির।
এ সমুদ্রই তার মন—
যেখানে ঢেউ হলো চিন্তা,
জোয়ার-ভাটা হলো আশা-নিরাশা,
আর আকাঙ্ক্ষা—এক অতল গর্জন, যা তাকে টেনে নিয়ে যায় গভীরে।
সে চিৎকার করে—“শান্তি কোথায়?”
আর সমুদ্র হেসে ওঠে—“যতক্ষণ তুই আমাকেই সত্য ভাবিস, শান্তি আসবে না।”
৩. আকাঙ্ক্ষা: এক ঝড়, যা কানে ফিসফিস করে
ঝড় আসে—বৃষ্টির মতো নয়,
বরং স্মৃতির মতো—
একেকটা দৃশ্য, মুখ, গন্ধ, কণ্ঠ, ব্যর্থতা, ভয়—
যা তাকে আবার ঠেলে দেয় অস্থিরতায়।
ঝড় ফিসফিস করে:
“তুই এখনও চাস কিছু…?
তোর এখনও চাওয়ার অভ্যাস মরেনি…
তুই এখনও একা হতেই ভয় পাস।”
৪. আত্মজাগরণ: নির্জনে একটি দ্বীপ
ঝড়ের শেষে সে পড়ে যায় এক দ্বীপে—
শুধু শিলার মতো স্তব্ধতা,
একাকিত্ব, নির্জনতা, এবং
এক প্রাচীন নিঃশব্দতা।
তিন দিন, তিন রাত (কিংবা আরও বেশি) কোনো শব্দ নেই—
চতুর্থ দিন, সে চুপচাপ বসে পড়ে,
চোখ বন্ধ করে—
আর নিজের ভেতর এক আলো দেখতে পায়।
৫. মুক্তি: এক বাতিঘর দূরে জ্বলে ওঠে
সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে সে দেখে দূরে—
এক আলোকবর্তিকা জ্বলছে…
সেই আলো কাউকে কাছে ডাকে না,
কোনো পথ দেখায় না—
তবু তাকে এক অভ্যন্তরীণ টানে ডাক দেয়।
সে বুঝে যায়—এই আলো কোথাও বাইরে নেই—
এ তো তার নিজের ভেতরের আলো—
যা সবসময় জ্বলছিল, শুধু সে দেখেনি।
শেষ পঙ্ক্তি:
সে হাঁটে না আর—
সে থাকে।
শুধু থাকা—এ-ই তো ফেরা।