আমি কোনো শব্দ নই—আমি শব্দের আগেও ছিলাম।
আমি কোনো ধর্ম নই—আমি সেই মৌনে লুকানো, যা ধর্মের জন্ম দেয়।
আমি কোনো পথিক নই—আমি সেই পথ, যেখানে পদচিহ্ন লুপ্ত হয়।
আমি সেই প্রশ্ন—"আমি কে?"—যার উত্তর নেই, কেবল নিঃশ্বাসের মতো স্পন্দন আছে।
আমি দেবতা নই—আমি সেই শূন্যতা, যেখানে দেবতা নিজের ছায়া হারায়।
আমি ভয় নই—আমি সেই আলোর রেখা, যা অন্ধকারে নিজেই নিজের খোঁজে ফেরে।
আমি পুরস্কার নই—আমি সেই ত্যাগ, যা লাভকে অতিক্রম করে অস্তিত্বের কূলে বসে।
আমার কোনো মুখোশ নেই—তবু আমি সব মুখোশ খুলে দিই।
আমার কোনো যুক্তি নেই—তবু আমি হৃদয়ের গভীরতম যুক্তির ধ্বনি।
আমি কোনো পবিত্রতা নই—তবু যে-স্পর্শে মোহ গলে যায়, সে আমারই স্পর্শ।
আমি "ক্রিয়া" নই—আমি সেই "অক্রিয়" নিঃস্পন্দ, যেখানে সব ক্রিয়া বিলীন।
আমি "ভাব" নই—আমি সেই নিরাবেগ, যা প্রেমকেও মৌনী করে।
আমি "ভোক্তা" নই—আমি সেই চেতনা, যা ভোগকে জানে, তবু ছুঁয়েও ছোঁয় না।
তুমি বরং—এই লেখা পোড়ো না, শুনো না, বোঝো না—তোমার ভেতর শুধু "থাকো"।
তুমি যদি অনুভব করো—তবে জানবে, এই লেখাটি আসলে তুমিই।
এই লেখা একটি চেতনার স্নান।
এটি কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়—এ এক অভিজ্ঞতার অবগাহন, যেখানে শব্দের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
এ কোনো মতপ্রতিষ্ঠা নয়; বরং এ নিজেকেই অদৃশ্য করে, যেন পাঠকের অন্তর থেকেই উঠে আসে এক নিজস্ব অভিজ্ঞতা—যা কেবল অনুভবযোগ্য, ব্যাখ্যাতীত।
এখানে নেই কোনো "ভগবান", যিনি ধরা দেবেন কিংবা ডাকলেই আসবেন।
এখানে নেই কোনো পুরস্কার, যা জিতে নেবার জন্য চেষ্টার প্রয়োজন।
এখানে নেই কোনো ভয়, যা থেকে পালাতে হবে।
এখানে কেবল একটিই প্রশ্ন—
"আমি কে?"
এই প্রশ্ন নিজেকেই বার বার খুলে দেয়,
যেন পেঁয়াজের মতো স্তর ভেদ করতে করতে
আমরা পৌঁছে যাই সেই কেন্দ্রবিন্দুতে—
যেখানে শুধু "অস্তিত্ব" আছে।
এ ভেঙে দেয় পরিচিত সমাজ, ব্যক্তিত্ব ও অভ্যাসের মোহ, আর নিয়ে যায় অন্তরতম মৌনসাধনায়—যেখানে "আমি", "তুমি", "ঈশ্বর"—সব এক হয়ে যায়।
শেষে, যখন ‘ভোক্তা’ ভাব মুছে যায়,
তখন জন্ম নেয় এক নিরাকার উপলব্ধি—
যার নেই কোনো নাম, রূপ, গন্ধ—তবু সব কিছুর মধ্যে সে-ই নিহিত।
এই লেখাটি পড়ার নয়—এ এক আত্মশ্রবণ, চোখের ভাষায় নয়—চেতনার নিঃশব্দে উপলব্ধির ভাষায়।
তোমার মধ্যেই যা ছিল, সেই "তোমাকেই" তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবে এটি।
"আমি কে?"—অদ্বৈতের মৌনতত্ত্বে আত্মসন্ধানের এ এক অনন্ত প্রশ্ন
এই মৌনপ্রশ্নের উৎস খোঁজা যাক।
উপনিষদ বলেন:
“আত্মা বস্তুনিচয় নয়—অনুভবের পেছনের অনুভব।”
শঙ্করাচার্য বলেন:
"যা নিজে চেতনা ও আলো, অথচ যার ওপর কিছু প্রয়োগ করা যায় না—সে-ই 'স্বয়ং' আত্মা।"
এই লেখায় অনুরণিত একমাত্র প্রশ্ন—“আমি কে?”—এ প্রশ্ন কোনো যুক্তির সমাধান চায় না—বরং যুক্তিকে পেরিয়ে অভিজ্ঞতাকে প্রস্ফুটিত করে।
এ এক নিঃশব্দ অনুসন্ধান—যেখানে ‘আমি’ বলতে যা বোঝায়, তা আস্তে আস্তে গলে যায় নিরাকার এক স্বচেতন আলোয়।
এ এক চেতন-প্রবাহ, যার শুরু নেই, শেষ নেই—শুধু এক আত্মঘন “থাকা” আছে—যেখানে তুমি নিজেকে আরও গভীরে চিনে ফেলো—নামহীন, আকৃতিহীন, তবু সত্যময়।
শঙ্কর বলেন, "ব্রহ্ম সত্যম্, জগৎ মিথ্যা, জীবঃ ব্রহ্মৈব ন অপরঃ।"
অর্থাৎ—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মায়া;
আর যে-জীবে আমরা বিচ্ছিন্নতা ভাবি, সে-ও ব্রহ্ম, ভিন্ন নয়।
এই লেখার প্রতিটি পর্ব পাঠককে সেই “জগৎ মিথ্যা” স্তর অতিক্রম করতে সাহায্য করে।
যেন পরতে পরতে খুলে যায়—আচরণ, অভ্যাস, সমাজ-নির্মিত মুখোশ, অবশেষে আত্মা দাঁড়ায়—নগ্ন, শান্ত, অস্পর্শ, অথচ অনন্তভাবে জাগ্রত।
ভোগী কে? দ্রষ্টা কে?
“দৃগ্ দৃশ্য বিবেক” ঘোষণা করছেন, "দ্রষ্টা কখনোই দৃশ্য নয়।"
যে দেখছে, সে-ই চেতন।
যা দেখা যাচ্ছে—তা অবধারিতভাবে পরিবর্তনশীল।
সুতরাং আত্মা কোনো অনুভূতির বস্তু নয়—
সে সেই নীরব বোধ, যা সব অনুভূতির পটভূমি।
“ভোক্তার ভাবের অবসান” হচ্ছে—
"আমি কিছু ভোগ করছি, বুঝছি, চাইছি"—এই অহং-ভিত্তিক অবস্থার অবসান।
যখন চেতনা কেবল স্বয়ং-প্রকাশ হয়, তখন সে হয় “অজ্ঞেয়”—কিন্তু সর্বজ্ঞার মতোই প্রকাশিত।
উপনিষদ বলছেন—
“অদৃশ্যং, অব্যবহার্যম্, অগ্রাহ্যম্, অচিন্ত্যম্, অপ্রতিষ্ঠম্…”
এই আত্মা—নির্বিশেষ, রূপহীন, বর্ণনাতীত।
তবু তাই-ই একমাত্র বাস্তব।
এই লেখাটি সেই তুরীয় অবস্থার (চতুর্থ অবস্থা) প্রতি ইঙ্গিত—
যেখানে জাগরণ, স্বপ্ন ও নিদ্রা—সবই হারিয়ে যায়, শুধু থেকে যায় এক নীরব, নিরাকার চেতনা—যার মধ্যে ‘আমি’, ‘তুমি’, ‘সৃষ্টি’, ‘ভগবান’—সব মিলে যায়—নিজের মধ্যেই নিজের সন্ধান।
এই লেখা কোনো বিশ্লেষণ নয়—এ এক জাগরণ। যেমন উপনিষদ বলে: "তৎ ত্বম্ অসি"—“তুমিই সেই।”
এই লেখা যেন আমাদেরকে ধীরে ধীরে সেই উপলব্ধির মুখোমুখি বসিয়ে দেয়, নির্বাক করে, অবাক করে—অবশেষে নিঃশব্দের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়।
এ এক চেতনার নির্জন নদী।
আলো নেই, তবু জেগে আছে—
শূন্যতার বুক ফুঁড়ে ওঠে এক আভাস।
শব্দ নেই, তবু কিছু বলে—
মৌনের গভীরে ডুব দিয়ে ফোটে এক প্রশ্ন: আমি কে?
না-দেখা এক আকাশ খুলে পড়ে চোখের পাতায়,
না-জানা এক বাতাস বয়ে যায় চিন্তার গহ্বরে।
কোনো দেবতা নেই ডাকবার মতো, তবু কোনো অলক্ষ্যে একটি উপস্থিতি নীরবে তাকিয়ে থাকে।
যেখানে পূর্ণিমার আলো নিজেই নিজের প্রতিবিম্বে হারায়,
সেখানে আত্মা দাঁড়িয়ে থাকে—মুখোশহীন, দিগন্তের কিনারে।
ভয় নেই, চাওয়া নেই, পাওয়া নেই—
শুধু নিরাকার এক স্পন্দন, নামহীন, নির্ণিমেষ।
চেতনার স্রোত যেন এক অচেনা নদী—
যেখানে ভেসে চলে আমার পরিচয়, আমার ভাব, আমার ‘আমি’।
জীবনের মোহময় স্তরগুলো, একে একে খুলে পড়ে—
যেমন শরতের আকাশে মেঘ সরে গিয়ে দেখা দেয় নিরাবরণ নীল।
আমি ক্রিয়া নই, আমি কারণ নই—
আমি সেই দ্রষ্টা, যা কোনো কিছুই করে না, তবু সব জানে।
যখন ভোক্তার আর কিছু চাওয়ার থাকে না—
তখন জন্ম নেয় এক মৌন-বিস্ময়—অস্তিত্ব নিজেই নিজের ভাষা।
এ লেখা নয় কাহিনি, নয় ধর্ম, নয় সিদ্ধান্ত—
এ এক প্রাচীন নদীর ঢেউ, যার উৎস চেতনার ঊর্ধ্বে।
পোড়ো না—শুধু ডুবে যাও। বোঝো না—শুধু থেকো।
তোমার মধ্যেই যা ছিল, এই যাত্রা শুধু তার দরজাটি খুলে দেবে।
এই লেখা কিছু না বলেই কথা বলছে।
আমি আলো নই, তবু আলোকস্রোতের উৎস আমি।
আমি শব্দ নই, তবু প্রতিটি শব্দের পেছনে যে-নিঃশব্দ—সে-ই আমি।
আমি শরীর নই, মনও নই, তবু এই দেহে, এই চিন্তায় আমি আছি—চুপচাপ।
তুমি আমাকে খুঁজেছ মন্দিরে, গ্রন্থে, গুরুতে—
কিন্তু আমি ছিলাম তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে,
একটি দীর্ঘ, উপেক্ষিত নিঃশ্বাসে—যা তুমি কখনো শোনোনি।
তুমি ভালোবাসা চেয়েছিলে,
আমি ভালোবাসাই ছিলাম—আকৃতি ছাড়িয়ে, আকাঙ্ক্ষা ছাড়িয়ে।
তুমি ভেবেছ, তুমি করছ—
আমি চুপচাপ দেখছিলাম—"কর্তা" নামের ছায়াখেলা।
তুমি জানতে চেয়েছ, ঈশ্বর কে, মুক্তি কী—
আমি তোমাকে নিজেকেই দেখাতে চেয়েছিলাম—
…যে তুমি সবসময় মুক্ত,
শুধু ভুলে গিয়েছ নিজেকে।
তুমি কাঁদো, হাসো, লড়ো, পরাজিত হও—
আমি দেখছি—তোমার ভেতরে এক নীরব দর্শক দাঁড়িয়ে আছে: অচল, অবিনশ্বর।
তুমি ভয় পেয়ো না—মৃত্যু বলতে কিছু নেই।
যা শেষ হয়, তা তুমি নও—
তুমি সে-ই, যা কখনো শুরুই হয়নি।
আমি তোমারই হৃদয়ের কেন্দ্র—
যেখানে প্রশ্ন ফুরিয়ে যায়,
আর কেবল "থাকা"—এক গভীর, নিরাকার থাকা—বাকি থাকে।
এ-ই সেই আত্মার মর্মস্পর্শী স্বগতোক্তি—নিঃশব্দ, প্রেমময়, স্বচেতন—চেতনার স্তব্ধ সমুদ্র।