এখানে সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠরা আর কোনো সুখ চান না, শুধু এই জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুক্তি পেতে চান—যা তাদের কাছে শুধুই দুঃখে ভরা। রাজারা তাঁদের সিংহাসন বিসর্জন দিয়েছেন এর জন্য। ধনীরা এর জন্য তাঁদের প্রিয়তম সম্পদ ত্যাগ করেছেন। সমস্ত পার্থিব বন্ধন ছিন্ন হয়েছে, আর যাঁরা এর দিকে সামান্যতম অগ্রসর হয়েছেন, তাঁদের দেবতার মতো পূজা করা হয়েছে, মহাত্মা (মহান আত্মা) হিসেবে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। তাঁদের সম্মানে মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে, আর তাঁদের কর্মকাণ্ডকে মানবজাতির অনুসরণের আদর্শ হিসেবে ধরে রাখা হয়েছে।
এ কি কেবলই মরীচিকা, না কি আসলেই কিছু-একটা—যা সর্বোচ্চ মেধা ও প্রজ্ঞার মানুষদের আকর্ষণ করে? ভোগে নিমগ্ন সাধারণ মানুষের কাছে যেটি কেবল দিশেহারা করে-দেওয়া আলো বলে মনে হয়, সেটিই কি তবে বাস্তব? দর্শন উত্তর দেয়—মরীচিকা হলো এই জগৎ নিজেই, অসীমের উপলব্ধি নয়—যা আসে ‘আমি’-র বিস্মরণের মাধ্যমে।
যদি আমাদের ইন্দ্রিয়ই একমাত্র বাস্তব হতো, যদি দেহের অবসানের পর আর কিছু না থাকত, যদি তাড়াহুড়ো, উত্তেজনা আর প্রতিযোগিতায় ভরা জীবনই জীবনের একমাত্র মূল্যবান রূপ হতো, তবে আধুনিক মানুষ অতীতের মানুষদের চেয়ে বহুগুণ সুখী হতো এবং কখনও সহজতর ও অন্তর্মুখী জীবনের জন্য আকুল হয়ে উঠত না। কিন্তু বাস্তব দেখা যায় একেবারেই উলটো। সব জায়গায়ই, মানুষ প্রতারিত হয়ে ভাবে, সুখ রয়েছে বাইরের জগতে, অথচ অভিজ্ঞতা—যে এক কঠোর শিক্ষক—তাকে বাধ্য করে ভেতরের দিকে ফিরতে, সত্যিকার আনন্দের সন্ধানে।
এমন মানুষের জীবনপথের দিশারি হিসেবেই কাজ করে বেদান্ত। এটি মানুষকে কোনো অদ্ভুত প্রতিশ্রুতি দেয় না, বা কলমের একআঁচড়ে তার দুঃখ দূর করবে বলে প্রতারণা করে না। এটি তাকে শেখায় সেই কঠিনতম শিক্ষা—স্ব-অস্বীকার, স্ব-ত্যাগ, আর স্ব-বিস্মরণ—যার মধ্য দিয়েই সে পৌঁছতে পারে সেই লক্ষ্যে, যা সে ইন্দ্রিয়জগতে ব্যর্থভাবে খুঁজে ফেরে। ভোগে-নিমগ্ন মানুষের কাছে বেদান্তের শিক্ষা হয়তো কেবল স্বপ্নের প্রলাপ মনে হয়। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই এক সময় আসে, যখন তাকে থেমে ভাবতেই হয়—বেদান্তের আচার্যরা কী বলছেন।
ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যখন বিতর্ক ওঠে, তখন বোঝা যায়—বুদ্ধি শুধু পথপ্রদর্শক নয়, এরও অতীত কিছু আছে। বুদ্ধির ওপারে আছে জীবাত্মা, যা দেহকে অধিষ্ঠান দেয়। যদি আত্মার কাছে সেই পরমাত্মা উদ্ভাসিত হয়, তবে কর্ম আর প্রয়োজনীয় থাকে না।
পাঁচ ইন্দ্রিয় যথেষ্ট নয়; তাদের কার্যকর হতে ষষ্ঠ সত্তা—মন—প্রয়োজন। কিন্তু মনও যথেষ্ট নয়; মনকে উপলব্ধি করাতে বুদ্ধির দরকার। বুদ্ধিরও অতীত কিছু আছে—চৈতন্যমূলক অহংকার। এভাবে স্তর স্তর অতিক্রম করতে করতে দেখা যায়, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, অহংকার—সবই সীমিত, পরিবর্তনশীল।
বস্তুবাদ বলে, সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিন গুণের ভিন্ন ভিন্ন সংযোগ থেকেই জগৎ প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রকৃত দৃষ্টি বলে—সব কিছুরই অন্তর্নিহিত ভিত্তি আছে, যা দশম তত্ত্ব: পরমাত্মা। তাঁর মাধ্যমেই বস্তু বিদ্যমান বলে মনে হয়, তাঁর বাইরে নয়। “দশম তত্ত্ব” বলার পেছনে আসলে একটা দার্শনিক গণনা-পদ্ধতি আছে।
প্রথমে ধরা হলো পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, চর্ম)। এর সাথে যোগ হলো পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, হাত, পা, মল-মূত্র নিঃসরণ, জননেন্দ্রিয়)। এই দুই মিলে হলো ১০টি ইন্দ্রিয়তত্ত্ব। এরপর যোগ করা হলো মন → ষষ্ঠ। তার ওপরে বুদ্ধি → সপ্তম। তার ওপরে অহংকার → অষ্টম। আবার বলা হলো, প্রকৃতির তিন গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) এর মিশ্রণে নবম স্তর হিসেবে জগৎ প্রকাশিত। এখন, এই সব কিছুর ওপরে দাঁড়িয়ে যে-সত্য সব কিছুর উৎস ও ভিত্তি—তাকে বলা হলো “দশম তত্ত্ব: পরমাত্মা।”
বস্তুবাদী যুক্তি: ৯টি নীতি (ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, অহংকার, গুণের সংযোগ) মিলেই যথেষ্ট। এর বিপরীতে বলা হলো: না, এগুলো সবই পরিবর্তনশীল, নির্ভরশীল। যে-একটিকে মানলে সব কিছুর ভিত্তি বোঝা যায়, সেটিই দশম তত্ত্ব—পরমাত্মা। তাহলে “দশম” মানে সংখ্যা নয়, প্রতীক। প্রথম ৯টি হলো সীমিত স্তর; আর দশম হলো সীমাহীন, সর্বব্যাপী সত্য—যা বাকিগুলোকে টিকিয়ে রাখে।
ইন্দ্রিয় ও কর্মের সমষ্টি দিয়ে কিছুই সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। সর্বত্র বিরাজমান পরমাত্মাকেই চূড়ান্ত সত্য বলা যায়—যিনি উপলব্ধ হন সত্য, সংযম, তপস্যা, শুভেচ্ছা, লজ্জা, ক্ষমাশীলতা, বিদ্বেষহীনতা, যজ্ঞ, দান, একাগ্রতা ও ইন্দ্রিয়নিয়ন্ত্রণের মতো গুণের মাধ্যমে।
সময়ের প্রসঙ্গ এলেও, মুক্তির জন্য শুধু সময় যথেষ্ট নয়। মুক্তি ঘটে যখন অজ্ঞানের মেঘ সরে যায়, আর আত্মা উপলব্ধ হয় সুখ ও দুঃখের অতীত হিসেবে। তখন মন, অহংকার, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়—কোনোটিই আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এইভাবে দর্শন জানায়—যা-কিছু সীমিত, তা পর্যায়ক্রমে অতিক্রমযোগ্য; এবং যাকে সীমাহীন বলা যায়, সেটিই একমাত্র সত্য।
মুক্তির জন্য প্রয়োজন ইন্দ্রিয়বস্তুর প্রতি বিমুখতা—সেগুলোকে বিষ ভেবে। আর সত্য, ক্ষমা, ন্যায়, দান ও সন্তোষকে ধারণ করতে হবে যেন তা জীবনধারণের অপরিহার্য জল। যখন দেহ থেকে আলাদা হয়ে আত্মায় স্থির হওয়া যায়, তখনই প্রকৃত আনন্দের আবির্ভাব ঘটে।
তখন বোঝা যায়, যে-আলো এক দেহকে আলোকিত করে, সেই আলোই সমস্তকে উদ্ভাসিত করছে। আত্মা এক ও অবিভাজ্য; সমগ্র জগৎই যেন নিজের, আবার কিছুই নয়। তবু বিস্ময় থেকে যায়—একত্ব উপলব্ধ হবার পরও মন কেন জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়? কেন কামনা সহজে মিলায় না?
যখন আত্মা চিনে ফেলা হয়, তখন কর্মফল আর আঁকড়ে ধরতে পারে না। স্বাধীনতা আসে, সংসার বোঝা মনে হয় না। দৃশ্যমান সব কিছুকে আত্মায় উদিত ও লীন হতে দেখা যায়, কিংবা বোঝা যায়—আসলে কিছুই উদিত বা লীন হয় না।
আত্ম-জ্ঞান প্রস্ফুটিত হলে অভিজ্ঞতা আকাশের মতো সীমাহীন হয়ে ওঠে। সবই ভেতরে প্রতিভাত হয়। জগতের তরঙ্গ ওঠে ও মিলিয়ে যায় অসীম সত্যের সাগরে, অথচ অন্তরে শান্তি অটল ও অবিচল থাকে।
যতক্ষণ মন আসক্তি আঁকড়ে ধরে, ততক্ষণই বন্ধন। মন যখন সম্পূর্ণ কামনাহীন হয়, তখন মুক্তি উদ্ভাসিত হয়। “আমি”-ভাবই শৃঙ্খল, আর “আমি নই”-এর উপলব্ধিই মুক্তির দ্বার।
ত্যাগ মানে শুধু সংসারী কর্ম ত্যাগ নয়, জীবনের আকাঙ্ক্ষাকেও ছাড়তে হয়। যা মানুষকে জগতে বেঁধে রাখে, তা একদিন-না-একদিন ঝরে যাবেই যাবে; তাই স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলে স্বাধীনতা ও শান্তি অচিরেই আসে।
সত্য এই—আনন্দ বা দুঃখ, ধন বা দারিদ্র্য সবই পূর্বকর্মফল, ঈশ্বর-নিয়ন্ত্রিত বিধান। যখন এই উপলব্ধি স্পষ্ট হয়, তখন জগতের কোনো কিছুর প্রতি টান আর থাকে না। কর্ম ও কর্মবিরতি উভয়ই অবিদ্যার খেলা; মন যখন সব কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত হয়, তখনই সত্যিকারের জ্ঞান ও আনন্দ উদ্ভাসিত হয়।
যে সমস্ত আসক্তি লীন করে, তার জীবন স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহে পরিণত হয়। যা সামনে আসে, তা-ই ঘটে, কিন্তু কোনো বন্ধন আর থাকে না। তখন শান্তি জন্ম নেয় নিজের আত্মাকে সবার সাক্ষী হিসেবে জানার ভেতর দিয়ে। মুক্তির লালসা বা বন্ধনের বিরাগ, উভয়ই মিলিয়ে যায়।
আসল আনন্দ পাওয়া যায় সর্বজনীন বিস্মৃতির ভেতর—যেখানে স্মৃতি, আসক্তি ও পরিচয়ের ভিত্তি মুছে যায়। তখন ইন্দ্রিয় শুদ্ধ হয়; সুখ-দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না। জীবনের প্রতি অনুরাগ থাকে না, মৃত্যুভয়ও থাকে না। জগত টিকে থাকুক বা বিলীন হোক—কোনো ভেদ থাকে না।
শান্তি আসে কেবল সর্বজনীন ত্যাগে। জগত আসলে মনের প্রতিফলন—আমরা যেমন দেখি, তেমনই তা প্রতিভাত হয়। যখন “এটাই আমি” আর “এটা আমি নই”-এর দ্বন্দ্ব ভেঙে যায়, তখনই সত্য শান্তি উন্মোচিত হয়। তখন আর পালানোর প্রয়োজন হয় না।
যিনি আত্মায় বিশ্রাম পেয়েছেন, তাঁকে পূজা করলে অহংকার জন্মায় না, অবজ্ঞা করলে আঘাত লাগে না। তিনি সম্মানযোগ্যকে সম্মান দেন, কিন্তু মনে বাঁধেন না। তিনি সুখে ঘুমান, সুখে জাগেন, সুখে চলেন—কারণ তিনি আত্মার আশ্রয়ে স্থির। এমন একজন দেহে জীবিত হয়েও দেহের প্রতি মৃত; তিনি উচ্চতর আত্মায় জীবিত। রাজ্য শাসন করুন বা ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘুরুন—যদি কামনা জয় করেছেন, তবে তিনিই সত্যিকার সুখী।
আত্মজ্ঞাতার চূড়ান্ত অভিজ্ঞতায় জগত, দ্বৈত বা অদ্বৈত, কামনা বা অভাব, জ্ঞান বা অজ্ঞান—কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বিভ্রমের গভীরে গেঁথে-থাকা সেই পেরেক উপড়ে যায়। অবশিষ্ট থাকে কেবল মুক্তি, কেবল আনন্দ।
শেষে সমস্ত শিক্ষা লীন হয় এক অনন্ত নীরবতায়—যা যুগে যুগে মুক্তিকামী সাধকের পথ আলোকিত করে। শব্দ কেবল ইঙ্গিত দিতে পারে; চূড়ান্ত সত্য কখনোই শব্দে আবদ্ধ নয়।