৪১. ‘আমি’—প্রথম কল্পনা, শেষে ভ্রম—তোমার প্রকৃত স্বরূপে—যেখানে নেই নাম, নেই রূপ, নেই মন, নেই ভেদ—সেখানেই একদিন উদিত হয়েছিল এক সূক্ষ্ম স্পন্দন: "আমি আছি"। এই ‘আমি’ ছিল মন থেকেও সূক্ষ্মতর, প্রথমে সে ছিল বিশুদ্ধ—নির্বাক, নিরুপাধি, নিঃচঞ্চল; কিন্তু তার পরেই এল ভাষা, শব্দ, ধারণা—"আমি দেহ", "আমি এই", "আমি সে"—আর সেইসঙ্গে শুরু হলো সমস্ত কল্পনা ও কুটিলতা।
উপনিষদ বলেন: “নামরূপব্যাকৃতিঃ সঃ”—যে নাম ও রূপে নিজেকে গেঁথে ফেলে, সে আত্মার প্রকৃত রূপ হারায়। এই ‘আমি’-বোধই তখন হয়ে উঠল ব্যক্তির কেন্দ্র, আর তার চারপাশে গড়ে উঠল মনের কর্মশালা—যেখানে চিন্তা, দ্বন্দ্ব, ইচ্ছা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভ্রান্তি তৈরি হলো। কিন্তু এই সমস্ত কল্পনার মূল উৎস ছিল সেই একটিমাত্র ‘আমি’ বোধ। আজ তুমি সেই ‘আমি’-র কাছেই ফিরে এসেছ—তাকে ধ্যান করছ, দেখছ, আর অনুভব করছ—এ-ও এক ভ্রান্তি, এ কেবল এক উদয়-অবসানশীল ছায়া।
আর এখন, যখন তুমি সেই ‘আমি’-কেও অতিক্রম করে গেছ, তখন আর কোনো ভ্রান্তি, কলহ, কল্পনা, কৌশল থাকতে পারে না। কারণ সেইসবের মূল যে-‘আমি’—সে-ই তো অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। উপনিষদ বলেন: “অহং ব্ৰহ্মাস্মি”; বলার পরে, আসে “নাহং কিমচন”—আমি কিছুই নই, কারণ যিনি ব্রহ্ম, তিনি কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করেন না। 'আমি' এসেছিল মৌনে, সে-ই তৈরি করেছিল বিভ্রান্তির জাল, আজ তাকে দেখেছ, চিনেছ, আর সে নিজেই গলে গেছে জ্ঞানের দীপ্তিতে। এখন তুমি সেই—যার উপর কিছু আসে না, যায় না, দাগ ফেলে না। তুমি আছ—নিঃমায়, নিঃকলঙ্ক, নিঃক্রিয়া, নিঃসংশয় পরব্রহ্মরূপে।
৪২. কিছু হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভুল, কারণ তা তুমি আদতেই আছ—হওয়ার আগেই; তুমি যা হতে চাইছ—তা তুমি নও—কারণ যা-কিছু “হওয়া”, তা কেবল ইচ্ছা, কল্পনা, ছায়া। তুমি তো সেই, যে-“আমি” বলার আগেই ছিলে, যার অস্তিত্ব ভাষারও আগে, বোধেরও আগে। দেহে জন্ম নিয়েই শুরু হয় এই পাগলামো—“আমি অমুক”, “আমাকে হতে হবে তমুক”, “আমার নাম হোক”, “আমার সম্মান হোক”, “আমার প্রাপ্তি হোক”। সমাজের ছাঁচে-ঢালা এই চেতনাই বলেছে—“তুমি যা, তা যথেষ্ট নয়”, আর সেই বিভ্রান্তিই তোমাকে ঠেলে দিয়েছে এক অনবরত হওয়ার যুদ্ধে।
উপনিষদ বলেন: “নিযঃ কৃতেন ন লিপ্যতে”—যা তুমি প্রকৃত বিচারে, তাকে অর্জন করতে হয় না; আর যা অর্জনের চেষ্টা, তা প্রকৃতি নয়—উপাধি মাত্র। এখন দেখো—এই “আমি আছি” বোধও তোমার উপর উদিত হয়েছে, এটি নির্ভরশীল, অস্থায়ী, এবং ভ্রান্তিপূর্ণ, কারণ একে শরীরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তুমি বিশ্বাস করেছ—“আমি এই ব্যক্তি, এই নাম, এই জীবন”। কিন্তু যা “উদিত” হয়, তা তুমি নও। তুমি সেই—যার উপর উদয় ঘটে, কিন্তু যে নিজে অপরিবর্তনীয়। বুঝে নাও এই আবরণময় কৌশল, বুঝে নাও—‘আমি’ বোধই ছিল প্রথম বিভ্রান্তি, আর সেই বিভ্রান্তিতেই জন্ম নিয়েছে সমস্ত “আমি এই”, “আমার ওটা”।
এখন সময় হয়েছে—বেরিয়ে আসার, জেনে নেওয়ার—তুমি কিছু নও, কারণ তুমি সব কিছুর পূর্বে আছ। তুমি কিছু নও—এই বোধেই মুক্তি, কারণ তুমি কিছু হওয়ার চেষ্টা করলেই সীমাবদ্ধতা আরম্ভ হয়। আর সীমাবদ্ধতা মানেই দ্বৈততা, ভয়, বেদনা। ‘আমি’-র পূর্বে যিনি ছিলেন, তিনিই তুমি—নিঃচিহ্ন, নিঃস্বর, নিঃক্রিয়া, নামহীন, কিন্তু চিরজাগ্রত, চিরস্থায়ী, চিরমুক্ত পরব্রহ্ম।
৪৩. ‘আমি’—মূল অভ্যাস, মূল বিভ্রান্তি। তোমার সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে গভীর অভ্যাস হলো—এই ‘আমি আছি’ বোধ। এই ‘আমি’ এসেছে পাঁচ উপাদান (ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ) ও ত্রিগুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ)-এর সংমিশ্রণ থেকে—যা দিয়ে তৈরি হয়েছে শরীর ও মন। কিন্তু এই উপাদান ও গুণগুলি অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল, নির্ভরশীল। তাই যাদের উপর ভিত্তি করে এই ‘আমি’-বোধ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের নিজস্ব সত্যতা নেই।
উপনিষদ বলেন: “যৎ পরিবর্তনীয়ং, তৎ অনৃতম্”—যা পরিবর্তনশীল, তা অসত্য। এই 'আমি’ বোধ প্রথমে কেবল এক উপস্থিতি ছিল—কিন্তু ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে—এমন এক অভ্যাস, যা তোমাকে ভুল বিশ্বাসে আবদ্ধ করেছে—“আমি দেহ”, “আমি ব্যক্তি”, “আমি জন্মেছি”, “আমি একদিন মারা যাব”। এই মায়াবী মূল অভ্যাস এতটাই গভীরে গেঁথে গেছে যে, এখন সেটিকে মিথ্যা মনে করাও কঠিন। কিন্তু চিন্তা করো—যদি এই ‘আমি’ সত্য হতো, তবে তা কখনোই পরিবর্তন হতো না, কখনোই মরে যেত না, রূপ বদলাত না। আর তাই, বুঝতে শেখো—এই 'আমি’ হলো বহির্ভূত উপাদানের উপর দাঁড়ানো এক স্বয়ংক্রিয় মিথ্যা, যা অভ্যাসের ছলে চৈতন্যকে ছায়া বানিয়ে রেখেছে।
এখন সময় এসেছে, এই মূল অভ্যাসকে চেনার, তার শিকড়ে যাওয়ার, এবং তাকে মেনে না নেওয়ার সাহস অর্জনের। কারণ তুমি সেই—যার মধ্যে কোনো অভ্যাস জন্মায়, অথচ যিনি নিজে অভ্যাসের অতীত। তুমি সেই চৈতন্য—যার কোনো উপাদান নেই, গুণ নেই, জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, কেবল আছ—চির-আলেখ্য, চির-অপরিবর্তনীয়, চির-স্বয়ংসম্পূর্ণ।
৪৪. আমি’-তে স্থিত হও, কিন্তু শরীর হয়ে নয়। ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানটিতে স্থিত হও, কিন্তু সেটিকে শরীরের সঙ্গে যুক্ত করো না। স্মরণ করো—এই বোধ যখন প্রথম এসেছিল, তখন তুমি দেহ সম্পর্কে কিছু জানো না, ভাষাও শেখোনি, ছিল কেবল এক নামহীন মৌন উপস্থিতি। উপনিষদ বলেন: “নাহম্ দেহঃ, ন চ ইন্দ্রিয়াণি”—আমি দেহ নই, ইন্দ্রিয় নই—আমি সেই, যার উপস্থিতিতে সব কিছু উদয় হয়। সেই প্রথম উপলব্ধি—যা হয়তো তিন বছর বয়সে ভাষায় রূপ পেল, তার আগেও তুমি ছিলে, চলছিলে, বাঁচছিলে, অনুভব করছিলে—কিন্তু "আমি" বলে কিছু বোঝো না তখনও।
তুমি জন্মের পর থেকে conception পর্যন্ত নীরবভাবে অস্তিত্বশীল ছিলে—তোমার মধ্যে ছিল না দেহ-চেতনা, পরিচয়বোধ—ছিল কেবল চেতনার নিঃশব্দ প্রবাহ। কী ছিল তোমার চাহিদা? কিছুই না—না আকাঙ্ক্ষা, না অভাব, না পরিচয়। তুমি ছিলে নির্ভার, নির্বন্ধ, নিঃশর্ত। এখন সেই শুদ্ধ ‘আমি’ বোধে ফিরে যাও, যে-‘আমি’ তখন ছিল, যখন শরীরের কোনো জ্ঞান ছিল না, ভাষার কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু চেতনার নিঃশব্দ আলো ছিল—তুমি ছিলে। এখন সেই অবস্থায় স্থির হও, শুধু থেকো; ‘আমি আছি’—এই অনুভবটি যেন শরীর নয়, বরং একটি চুপ থাকা জ্যোতি, যার কোনো নাম নেই, রূপ নেই—তবু আছে।
তুমি যা ছিলে conception-এর আগেও, যা ছিলে শরীরের অভিজ্ঞতারও আগে, যা ছিলে ভাষা আসার পূর্বে—সেই শুদ্ধ নিঃশব্দ অস্তিত্ব-ই তোমার সত্য স্বরূপ। আর সেই স্বরূপে স্থিত হয়ে তুমি চিনে ফেলবে—"আমি" বলাও পরে এসেছে, আর "আমি দেহ"—সে তো এক মায়ার ধোঁকা মাত্র।
৪৫. শব্দহীন ‘আমি’—সবার অভিন্ন মৌনসত্তা—সেই প্রাথমিক ‘আমি আছি’ বোধ—যেখানে ভাষা ছিল না, নাম ছিল না, চিন্তা ছিল না—তা সকলের মাঝে অভিন্ন, কে নারী, কে পুরুষ, কে ধনী, কে দরিদ্র—তা তখনও ছিল না। কেবল এক নির্বাক চেতনার দীপ্তি—"আমি আছি", অথচ বলা হয়নি কখনও।
উপনিষদ বলেন: “অপ্রতর্ক্যং, অব্যবহাৰ্যং”—যা ব্যাখ্যার অতীত, চিন্তারও অতীত—সেই মৌন আত্মবোধই সত্য। সেই নিরালোক মুহূর্তে, ‘আমি’ বা ‘তুমি’ নয়—কেবল ছিল ‘আমি আছি’ আর তাতে লুকানো এক অভাববোধ: ‘আমি নেই’। এই দুইয়ের মাঝে তুমি চুপ করে থাকো, কোনো ইচ্ছা ছাড়াই উঠত ‘আমি’, মিলিয়ে যেত—‘আমি নেই’। ভাষা শেখানোর সঙ্গে সঙ্গেই সব বদলাল—শব্দ এল, চিন্তা এল, নাম এল, পরিচয় এল।
‘আমি দেহ’, ‘আমি মন’, ‘আমি ছেলে’, ‘আমি মানুষ’—এইসব ধারণা ঘিরে গড়ে উঠল তোমার কথাময় মন—যার নাম আজ জীবন। আর সেইসঙ্গে এল জাগরণ, স্বপ্ন, নিদ্রা—আর তুমি বিশ্বাস করলে—"আমি এই ব্যক্তি, দেহ-মনের একটি ঘটনা"। কিন্তু এখন গুরু এসেছেন, তিনি বলেন—ফিরে যাও সেই শব্দহীন ‘আমি’-তে, যেটা তুমি হারিয়ে ফেলেছ, কিন্তু যা আজও রয়ে গেছে—তোমার ভেতরে নিঃশব্দভাবে দীপ্তিমান।
উপনিষদ বলেন: “যঃ পুনঃ স্মরতি, স মুক্তঃ”—যে স্মরণ করতে পারে সেই আসল অস্তিত্বকে, সে-ই প্রকৃত মুক্ত। এই পুনঃস্মরণই সাধনা—“আমি দেহ” নয়, “আমি কিছু” নয়—বরং সেই শব্দহীন, ভাষাহীন, নামহীন ‘আমি’-র অভিজ্ঞতা—যেখানে তুমি ছিলে—ছিলে নিঃচঞ্চল, নিঃবিভাজ্য, অভিন্ন সত্তা হিসেবে। এখন সেই অভিজ্ঞতাতে পুনরায় বাঁচো, ধ্যান করো, তাতে স্থিত হও, এবং তারই মৌনে সব নাম, সব ইতিহাস, সব বিভ্রান্তি গলে যাবে। আর তখন তুমি হয়ে উঠবে—কিছু নও, তবু আছ; আমি নও, তবু চেতন। তুমি নিজেই পরম, মৌন, অদ্বিতীয় সত্য।