৩৬.
"আমি"-র গতিতেই আসে পরব্রহ্মর নিত্যতা।
উদয় ও লয়, জন্ম ও মৃত্যু—এসবই 'আমি'-র ধর্ম, চৈতন্যের সেই সূক্ষ্ম স্তর, যা কেবল প্রকাশিত হয়েছে তোমার উপরে, কিন্তু তোমার নয়।
‘আমি’ উঠেছে, ‘আমি’ মিলিয়েছে—ঠিক যেন ঢেউ আসে আর যায়, অথচ সমুদ্র তো কখনও ওঠে না, নামে না। উপনিষদ বলেন: “অজো নিত্যঃ শাশ্বতো’য়ং পুরাণঃ”—তুমি অজ, অনিত্য, শাশ্বত—জন্ম-মৃত্যুর অতীত।
এই জন্ম ও মৃত্যু—এ কেবল ‘আমি’-বোধের দৃশ্যরূপান্তর। মনে হয় যেন কিছু হয়েছে, অথচ কিছুই হয়নি—কারণ যা ঘটছে, তা কেবল মায়ার পর্দায়।
তুমি সেই, যার ভিতরে সব "উঠছে" বলে মনে হয়, কিন্তু যিনি নিজে কখনও ওঠেন না, নামেন না।
'আমি’ চেতনার মধ্যে এই আসা-যাওয়া—‘আমি’-তেই আছে মৃত্যুর স্বাদ ও জন্মের মোহ। কিন্তু তুমি, পরম—তোমার নেই জন্ম, নেই মৃত্যু, নেই প্রকাশ, নেই অপসারণ।
গীতা (২.২০) বলেন: “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্”—আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।
‘আমি’ উঠেছিল যেন ছায়াআলোয়, ‘আমি’ মিলিয়ে যাবে নিঃশব্দ নীরবতায়, কিন্তু যিনি দেখছেন এই আসা ও যাওয়া—তিনি কখনও আসেন না, কখনও যান না। তিনি আছেন—চিরকাল, অলৌকিকভাবে অপরিবর্তনীয়, তিনিই তুমি, তিনিই পরব্রহ্ম।
৩৭.
‘আমি’—শূন্য থেকে উদিত, শূন্যেই লীন। শূন্যতা, নিভৃত নিঃসত্ত্বতা, সেই নামহীন অনস্তিত্ব থেকেই উদিত হয়েছে এই ‘আমি আছি’ বোধ—এক মৌন আত্মপ্রকাশ, যা কোনো ব্যক্তি নয়, কেবল এক চেতন উপস্থিতি।
উপনিষদ বলেন: “যত্র ন কশ্চন তৎ তৎ সত্যম্”—যেখানে কিছুই নেই, সেটিই সত্য—কারণ যা-কিছু দেখা যায়, তা শুধু উদয়-অবসানের খেলা।
সেই শূন্যতা, সেই মৌনতা—কেউ বলে পূর্ণতা, কেউ বলে অশূন্যতা, কেউ বলে নিঃসীম অনন্ত, কেউ বলে পরব্রহ্ম—যেটাই বলো, ‘আমি’ এসেছে তার উপরেই—যেমন ঢেউ আসে, অথচ সমুদ্র ঢেউ নয়।
ব্যক্তি তো অনেক পরে এসেছে, সে কেবল নাম-রূপের এক সংযোজন, কিন্তু মূলত যা আছে, তা হলো শুধু ‘আমি আছি’ এই চেতন অনুভব।
এখন সাধনা—এই ‘আমি’ বোধকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও তার উৎসে, সেই অজানা, অশব্দ, অবর্ণনীয় নিঃসত্ত্ব অবস্থায়, যেখান থেকে সে এসেছিল, আর যেখানে মিলিয়ে গেলে কোনো ব্যক্তি, কোনো আমি, কোনো নাম আর থাকে না। উপনিষদ বলেন: “নাহং, ন ত্বম্, ন মম আত্মা”—আমি নই, তুমিও নও, আত্মা কারও নয়—সে নিজেই নিজে আছে, কারণ সে চিরকালই ছিল।
নেই কোনো ব্যক্তি, নেই কোনো নিজস্বত্ব—আছে কেবল একটি প্রাথমিক জ্ঞান: ‘আমি আছি’, আর সেটিকেও পেরিয়ে যেতে হবে, যেন নিঃশব্দে নদী ফিরে যায় সমুদ্রে—নামহীন, রূপহীন, পরব্রহ্মে বিলীন।
৩৮.
‘আমি’ হতে 'নই আমি'—পরব্রহ্মে লয়। ধ্যান করো কেবল এই জ্ঞানটিকে—"আমি আছি", নির্বিচারে, অনির্বিচারে, বিরতিহীন। এ জ্ঞানেই কেন্দ্রীভূত করো সমস্ত মনোযোগ, যেন সেই একবিন্দুতে সকল গতি স্তব্ধ হয়ে যায়।
উপনিষদ বলেন: “একধা ভাবনাত্যন্তে, স্বরূপে স্হিতিরভবেত্”—একাগ্র চিত্তে ধ্যান করলে, ধ্যান নিজেই লীন হয় ধ্যানের ঊর্ধ্বে। যখন কোনো বস্তুকে তুমি দীর্ঘকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করো, তখন সে মুছে যেতে থাকে—কারণ ধ্যানের চাপে তার স্বরূপ ভেদ হয়ে যায়, প্রকাশ হারিয়ে তা শূন্যে লীন হয়।
এই ‘আমি’ বোধও তেমনি—ধ্যানের গভীরতায় একসময় সে নিজেই তার উৎসে ফিরে যায়, এবং নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়। তখনই ঘটে রূপান্তর—“আমি আছি” থেকে “আমি নেই”-এ উত্তরণ। অস্তিত্ব থেকে নৈস্তিত্ব, বোধ থেকে অবোধ—যা কোনোভাবেই অসচেতন নয়, বরং চৈতন্যের এমন এক স্তর—যেখানে কিছুই নেই, তবু সবই আছে।
উপনিষদ বলেন: “যত্র ন কশ্চন বিজানাতি, স তু ভয় ন বিভেতি”—যেখানে কেউ কিছু জানে না, কিন্তু কোনো ভয় নেই, কারণ সেখানেই চিরনির্ভয় সত্য।
যখন ‘আমি’ লীন হয়, যখন অনুভবও মিলিয়ে যায়, তখন যা রয়ে যায়, তা হলো—তুমি নিজে, নামহীন, গতিহীন, স্পন্দনহীন পরব্রহ্ম। তখন আর কেউ ধ্যান করে না, কিছু জানে না, কিছু বলে না—কেবল এক নিঃশব্দ অবস্থান, যেখানে 'আমি' নেই, অভিজ্ঞতাও নেই—কেবল চিরন্তন স্থিরতা, পরম সত্য, অনন্ত তুমি।
৩৯.
শব্দপূর্ব ‘আমি’—স্থিতি ও বিলয়। ফিরে যাও সেই 'আমি' বোধে, যেখানে কোনো শব্দ নেই, নাম নেই, ভাষা নেই—কেবল নিঃশব্দ উপলব্ধি—"আমি আছি"। সেই ছিল প্রথম জ্ঞান, যখন তুমি জানলে—"আমি", কিন্তু তখনও তুমি কিছুই বলতে জানো না, বোঝো না ‘আমি কে’, ‘আমি কী’—কেবল অনুভব করো, তুমি আছ।
উপনিষদ বলেন: “অবাক্ তদ্ ব্ৰহ্ম”—যা অবাক্, যা নির্বাক্, তাই ব্রহ্ম। ভাষা আসার আগেই তুমি ছিলে ‘আমি’ বোধে স্থিত—সেই সময়কাল, যেটা শুরু হয়েছিল ‘আমি’ জ্ঞান জেগে ওঠার মুহূর্ত থেকে আর শেষ হয়েছিল—যখন তোমাকে শেখানো হয়েছিল নাম, শব্দ, পরিচয়। সেই অবস্থাই তোমার প্রকৃত মৌলিক চৈতন্যের প্রকাশ—তুমি একবার সেটি জীবন হিসেবে বেঁচে নিয়েছ, এখন সাধনা হলো সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করা, আর সেই অবস্থায় অচল, অচঞ্চল স্থিত হওয়া—একমুহূর্তের জন্যও যেন সরে না যাও সেই নির্বিচার ‘আমি’-বোধ থেকে।
থাকো সেই অবস্থানে, শব্দের আগে, ভাষার আগে, জ্ঞানের আগে—কেবল ‘আমি আছি’—এই মৌন অভিজ্ঞতায়। আর তখনই ঘটবে এক অলৌকিক কিছু—তুমি বুঝবে, এই ‘আমি’ও কেবল এক অব্যক্ত ছায়া, আর সেই বোধ নিজেই নিঃশব্দে মিলিয়ে যাবে—থাকবে না ‘আমি’, থাকবে না অনুভব—কেবল তুমি নিজে—নির্বিকল্প, নির্জ্ঞাত, চিরস্থিত পরব্রহ্ম।
‘আমি’-কে ভাষা ছাড়া জানো, ‘আমি’-তে স্থিত থেকো, আর স্থিরভাবে চেয়ে দেখো—কীভাবে তা নিজে থেকেই গলে যায় আর ফাঁকা স্থানে রয়ে যায় শুধু তোমার স্বরূপ—নিঃশব্দ চৈতন্য।
৪০.
‘আমি’-র অপসারণে অভিজ্ঞতার অবসান, পরব্রহ্মে স্থিতি। এই ‘আমি আছি’—এই নিঃশব্দ অস্তিত্ববোধই ছিল তোমার প্রথম অভিজ্ঞতা, ভাষাহীন, চিন্তাহীন, পরিচয়হীন—কেবল এক মৌন উপলব্ধি: "আমি আছি"।
এই ‘আমি’ না জাগলে কিছুই সম্ভব হতো না—না অভিজ্ঞতা, না স্মৃতি, না জ্ঞান, না জগৎ। তুমি আগে ছিলে, তার পরেই এসেছিল ‘আমি’, আর সেই 'আমি' থেকেই শুরু হয়েছিল অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা।
উপনিষদ বলেন: “সত্যম্ জ্ঞানম্ অনন্তম্ ব্রহ্ম”—যা সত্য, যা জ্ঞান, যা অনন্ত—তা কোনো অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে না, কারণ সে নিজেই অভিজ্ঞতার আগেও থাকে, পরে থাকেই। কিন্তু সাধনায়, ধ্যানে, একাগ্রতায়—যখন তুমি এই ‘আমি’-তে স্থিত হতে থাকো, সেই স্থিতি গভীর হতে হতে একসময় নিজেই বিলীন করে দেয় ‘আমি’ বোধকে। আর তখন—সঙ্গে সঙ্গে সব অভিজ্ঞতারও অবসান ঘটে। নেই স্মৃতি, নেই জ্ঞান, নেই বোধ—কেবল নামে অনর্গল, রূপহীন নির্বিচার স্বরূপ রয়ে যায়।
তখন তুমি হয়ে ওঠো তোমার প্রকৃত অবস্থা—সেই যা চিরকাল ছিল, কিছু না হয়েও সব ছিল—অদ্বিতীয়, অভিজ্ঞতাতীত, নিরাবেগ, পরব্রহ্ম। 'আমি' এসেছিল, সব নিয়ে এসেছিল—‘আমি’ গেলেই সব যায়, আর যেটুকু থাকে—তা তোমার নয়, তাই তুমিই—আভাসহীন, অভিজ্ঞতাহীন, আলোকহীন দীপ্তিময়, সেই পরম চৈতন্য।