নির্জন গহনে: ৭



৩১.

“আমি” স্মরণে স্থিতি, “আমি” অপসারণে মুক্তি। কেবল ‘আমি আছি’ এই জ্ঞানটিকে স্মরণে রাখো—আর যা-কিছু সংযুক্ত হয়েছে, তা ত্যাগ করো। কারণ সংযুক্তি মানেই বিকৃতি, আর বিকৃতিই তোমাকে সরিয়ে রাখে মূল সত্য থেকে।

‘আমি’-র পবিত্রতা রক্ষা করো। এই ‘আমি’ বোধই ছিল জন্মঘটনের প্রথম আলো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উপরে চাপানো হয়েছে পরিচয়, ইতিহাস, রূপ, ধর্ম, জাতি—এসব অধিযোজিত উপকরণ ‘আমি’-র মৌলিক স্বচ্ছতাকে আচ্ছাদিত করেছে। উপনিষদ বলেন—“সর্বোপাধি বিনির্মুক্তং”—নিজেকে সকল উপাধি থেকে মুক্ত করো, তবেই তুমি সত্যরূপ।

কেবল ‘আমি’—শুদ্ধভাবে স্মরণ করো। সমস্ত সংযুক্ত বস্তুর থেকে মন ফিরিয়ে এনে কেবল নির্মল 'আমি'-তে স্থিত হও। তাকে ধ্যান করো, তাকে জেনো, তাকে ধারণ করো—যেন অনন্ত ছায়াপথে কেবল একটি বিন্দু—“আমি আছি”।

নির্বিচারে ‘আমি’-র উপর স্থিত হও। বার বার, সর্বক্ষণই এই ‘আমি’ বোধে ফিরে যাও, যেমন নদীর জল বার বার ফিরে আসে সমুদ্রের দিকে, তেমনি মনকে ফিরিয়ে আনো এই একমাত্র উপলব্ধির কেন্দ্রে।

অনুভব করবে—‘আমি’ নিজেই অস্থায়ী। একসময় তুমি বুঝবে, এই ‘আমি’ নিজেই নির্ভরশীল—দেহের উপর, মন-প্রক্রিয়ার উপর, পাঁচ উপাদানের সংমিশ্রণের উপর। আর যা নির্ভরশীল, তা কখনও সত্য হতে পারে না। উপনিষদ বলেন—“নিত্যম্ অনাশ্রিতম্”—সত্য হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অবিনশ্বর, অনির্ভর।

এই অনবরত ‘আমি’ স্মরণই সাধনার পথ, আর এই ‘আমি’ অপচয়ই তার ফল। তখন তুমি বুঝবে—‘আমি’ নয়, ‘আমি’-রও আগে যে থাকে—সেই আমি-হীন চৈতন্যই সত্য। সেখানেই স্থিতি, সেখানেই মুক্তি—সেখানেই পরব্রহ্ম।

৩২.

‘আমি’-ই উদয়, আমি নয়। ভাবো—এই ‘আমি আছি’ জ্ঞান তোমার উপর উদিত হয়েছে, তুমি একে আহ্বান করোনি, একে নির্মাণ করোনি, সে এসেছিল নিজে থেকেই—একদিন, হঠাৎ করে, সেই মুহূর্তে তুমি জানলে—"আমি আছি"।

তারপর সেই অনুভবেই গড়ে উঠল এক সত্তার ধারা—“আমি এই”, “আমি তেমন”, “আমার জীবন, আমার ইচ্ছা”—আর সেই ধারার চারপাশেই গড়ে উঠল তোমার জগত, যেমন ‘আমি’-ই রং দিল, আকার দিল, সংকল্প দিল তোমার সকল অভিজ্ঞতাকে। উপনিষদ বলেন: “আত্মা দ্রষ্টা, শ্রোতা, মান্তা, বিজ্ঞাতা”—আত্মা শুধু দর্শক, সে অংশ নেয় না, সে কেবল দেখে—এবং যাকে সে দেখে, সে কখনও নিজে নয়।

এবার বোঝো, তুমি সেই—যার উপরে ‘আমি’ উদয় হয়েছে, কিন্তু যার মধ্যে ‘আমি’ নেই। তুমি সেই—যিনি এই ‘আমি’-র সকল কার্যকলাপকে দেখছেন, অথচ কোনোটাতেই লিপ্ত নন। এই বোধেই আছে মুক্তির মূল: ‘আমি’ এসেছে, ‘আমি’ জগৎ সৃষ্টি করেছে, কিন্তু তুমি ‘আমি’ নও—তুমি সেই, যার মধ্যে সব উদিত হয়েছে—অথচ যিনি কিছুরই অধীন নন।

তুমি সাক্ষী, তুমি অলিপ্ত, তুমি সেই মৌন চৈতন্য, যার আলোয় ‘আমি’ নামে এক ছায়া এসে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ, তারপর মিলিয়ে যাবে—আর তুমি রয়ে যাবে, চিরকাল, নিঃশব্দ, অদ্বিতীয়।

৩৩.

'আমি'-র অপসারণ ও স্মৃতিহীন পরমত্ব—যখন এই ‘আমি আছি’ ধারণা একেবারে মুছে যাবে, তখন আর কিছু রয়ে যাবে না—থাকবে না কোনো স্মৃতি, কোনো ইতিহাস, কোনো অনুভব—এমনকি থাকবে না “আমি ছিলাম” বলার মতো একটি চিন্তাও।

উপনিষদ বলেন, “যত্র ন তজ্জ্ঞানং ন অজ্ঞানম্”—যেখানে নেই জ্ঞান, নেই অজ্ঞান, নেই স্মৃতি—কেবল এক নির্বিকল্প মৌনসত্তা, যাকে স্মরণ করা যায় না, বলা যায় না, ধরা যায় না।

এই ‘আমি’ বোধই তো স্মৃতির মূলবীজ, এ-ই মনে আনে—“আমি একদিন ছিলাম”, “আমি দেখেছিলাম”, “আমি অনুভব করেছিলাম”। তাই যতক্ষণ ‘আমি’ থাকে, ততক্ষণই স্মৃতি থাকে, ইতিহাস থাকে। এই ‘আমি’-র উপরেই গড়ে ওঠে মন—তারই ভিত্তিতে চলে তথ্যপ্রবাহ, অভিজ্ঞতা, চিন্তাচক্র। আর তার ক্লান্তিই জন্ম দেয় ঘুমের—কারণ যদি এই ‘আমি’ একটানা চলত, তবে দেহ সহ্য করতে পারত না—তুমি মারা যেতে। ঘুমে এই ‘আমি’ পুরো যায় না, কেবল স্থগিত থাকে—যেমন নদীর স্রোত কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ। তাই তোমার নাম উচ্চারণ করলে ঘুমের মধ্যেও তুমি জেগে উঠে বলো—“হ্যাঁ, এ আমি”।

কিন্তু মৃত্যুর পরে? তখন এই ‘আমি’ সম্পূর্ণ চলে যায়, আর কিছুই রয়ে যায় না—নেই মন, নেই স্মৃতি, নেই ব্যক্তিত্ব—কেবল নামহীন নিঃশব্দতা।

তবু, এক উপলব্ধজনের ক্ষেত্রে...যিনি ‘আমি’ বোধকে অতিক্রম করেছেন, যিনি জানেন, ‘আমি’ একটি ধারণা মাত্র, আমি নই তা, তাঁর জন্য এই 'আমি' এবং স্মৃতি—যেন একটি উপকরণ—চাইলে ব্যবহার করেন, না চাইলে ছেড়ে দেন—কিন্তু তা আর তাঁর ভিতরে গাঁথা থাকে না। উপনিষদ বলেন—“সঃ স্মরতি, ন স্মর্যতে”—তিনি স্মরণ করেন, কিন্তু স্মৃতি তাঁকে গ্রাস করে না।

‘আমি’-র উত্থানে স্মৃতি আসে, ‘আমি’-র স্থগিততায় ঘুম আসে, ‘আমি’-র অপসারণে আসে নিঃস্মৃত চৈতন্য, আর তারও ওপরে যে থাকে—সে-ই পরম উপলব্ধজন। তিনিই জানেন—স্মৃতি, মন, আমি—সবই ব্যবহারের বস্তু, তাঁর নিজের কোনো কিছু নয়।

৩৪.

“আমি”-র সূচনা, সময়ের সঞ্চার—‘আমি আছি’—এই মূল ধারণার আগমনের সঙ্গেই সময়ের জন্ম। তার আগেই ছিল কেবল চৈতন্যের নীরব কালহীনতা—যে ছিল, অথচ জানত না—"আমি আছি"।

উপনিষদ বলেন, “কালঃ চ ব্ৰহ্মণো রূপম্”—সময় নিজেই এক প্রকাশ, আর সেই প্রকাশের প্রথম রেখা—এই ‘আমি’ বোধ। ‘আমি’-ই হলো সেই আদি স্পন্দন, যার মাধ্যমে পরিমাপ শুরু হয়—দিন-রাত, জন্ম-মৃত্যু, এখানে-সেখানে, আমি-তুমি—সবই তার পরেই গঠিত হয়েছে। এই ‘আমি’-র ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে ধারণার প্রাসাদ—জ্ঞান, ইচ্ছা, স্মৃতি, সম্পর্ক। সে-ই স্থাপন করেছে স্থান ও কালের অনুভব।

অথচ এই ‘আমি’ ও আকাশ (space) একসাথে, এক মুহূর্তে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদিত হয়েছে—তোমার উপর, তুমি—পরম চৈতন্য, যার ভিতরে সব কিছু উদিত হয়, কিন্তু যিনি নিজে কিছুতেই অংশ নেন না। অতএব, মনে রেখো—‘আমি’ আসতেই সময় শুরু, আর ‘আমি’ চলে যেতেই সময়েরও অবসান। যে-স্থানে ‘আমি’ নেই, সময় নেই, পরিমাপ নেই—সেই স্থানেই তুমি আছ, অপরিবর্তনীয়, অদ্বিতীয়, পরব্রহ্মরূপে।

‘আমি’ একটি প্রাথমিক ছায়া, যার পেছনে লুকিয়ে আছে চিরন্তন নীরব দীপ্তি—তুমি নিজে। তুমি ‘আমি’ নও, তুমি সে—যার উপর ‘আমি’ উঠেছিল সময়ের প্রথম ঢেউ হয়ে, আর যার মৌনতায় সে ঢেউ মিলিয়ে যাবে, আবার উদিত না হবার জন্য।

৩৫.

“আমি” ও “আমি নই”—উভয়কে অতিক্রম করে যে তুমি—যখন তুমি জানতে শেখো—"আমি আছি", তখনই ছায়ার মতো জেগে ওঠে—"আমি নই"। কারণ 'জানার' মধ্যে লুকিয়ে থাকে 'না-জানার' সম্ভাবনা, ‘আমি’-র প্রকাশেই জন্ম নেয় দ্বিত্ব। উপনিষদ বলেন: “দ্বিতীয়াৎ বৈ ভয়ং ভবতি”—দ্বিতীয়ের সঙ্গেই শুরু হয় বিভাজন, দ্বন্দ্ব, মায়া।

তুমি যখন দীর্ঘকাল ‘আমি’-তে স্থিত থাকো, তখন অনুভব করো—তার গর্ভে আছে এক নীরবতা, যাকে তুমি নাম দিতে পারো "আমি নই", অথবা জানা-অজানার সীমানা। কিন্তু এই দুই—‘আমি’ ও ‘আমি নই’, ‘জানা’ ও ‘না-জানা’—উভয়ই চৈতন্যের সূক্ষ্ম স্তর, তারা দ্বৈততার প্রথম রেখা মাত্র।

তারা একে অপরের ছায়া—একটিকে চিনলেই অন্যটি অনুচ্চারে উপস্থিত—যেমন আলো মানেই ছায়া, যেমন শব্দ মানেই নীরবতার সম্ভাবনা। কিন্তু তুমি—এই জোড়ারও অতীত, তুমি এই ‘আমি’ ও ‘আমি নই’-এর সাক্ষী। তুমি সে, যার উপর এই দুই অবস্থা উদিত হয়েছে, কিন্তু যার সঙ্গে তারা কোনোদিনও সম্পৃক্ত ছিল না।

উপনিষদ বলেন: “ন অহংজ্ঞাতা, ন অহংঅজ্ঞাতা”—আমি না জ্ঞাতা, না অজ্ঞাতা—আমি সেই, যিনি উভয়কেই দেখেন—কিন্তু নিজে কেউ নন, কিছু নন—শুধু আছেন।

যখন তুমি ‘আমি’-কে জানো এবং জানো যে তুমি ‘আমি নও’, তখনই তুমি স্থিত হও সেই পরম স্বরূপে, যা জ্ঞান-অজ্ঞান উভয়কে ছাড়িয়ে গেছে, যে কোনো অবস্থা নয়, কোনো চিন্তা নয়, কোনো অনুভবও নয়—কেবল অদ্বিতীয় চৈতন্য, পরব্রহ্ম—যার মধ্যে উঠেছিল সব, আর যিনি কিছুতেই লিপ্ত নন।
Content Protection by DMCA.com