২১৬.
‘আমি’-ও মিথ্যা, তাই তার চোখে যা দেখা যায়—সবই মায়া। ‘আমি আছি’—এই বোধটাই আসলে একটি বিভ্রম। আর যেহেতু আমরা এই ‘আমি’ বোধ দিয়েই সব কিছু দেখি, জানি, অনুভব করি—তাই এই সব কিছুই অসত্য, মায়া, অস্তিত্বহীন ছায়ামাত্র।
এই ‘আমি’-র মূল উপাদান কী? এই দেহ-মনের পেছনে থাকা পাঁচটি মৌল উপাদান (পঞ্চভূত) এবং ত্রিগুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ)। এইগুলোর সার-সত্তা থেকেই জন্ম নেয় এই জ্ঞান—"আমি আছি"।
এখন প্রশ্ন হলো—যা দেহ-মনের উপাদানের উপর নির্ভরশীল, যা নিজেই অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল ও বিলয়যোগ্য, তা কি চিরন্তন সত্য হতে পারে?
কখনোই নয়। কারণ সত্য হলো যা নিজে স্বয়ংস্থিত, ধ্বংসাতীত, অন্যের উপর নির্ভরশীল নয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘আমি’-ও এক বিভ্রম, এক ভাসমান অনুভব, যা দেহ ও মনে ভর করে সাময়িকভাবে জাগে। আর এই 'আমি'–র চোখ দিয়ে যেহেতু আমরা সমগ্র জগৎ দেখি, তাই এই জগতের সমস্ত কিছুই—অসত্য, স্বপ্নসদৃশ, প্রতিচ্ছবি, মায়াময়।
অদ্বৈত বেদান্তে ‘আমি’-বোধ আত্মা নয়, এটি হলো আত্মবোধে উদিত একটি অস্থায়ী ধারণা। এই বোধ পঞ্চভূত ও ত্রিগুণ দ্বারা গঠিত দেহ-মনের ভিতর উদয় ও বিলয় ঘটে। অতএব, এটি পরিবর্তনশীল, ধ্বংসযোগ্য, এবং অতএব মিথ্যা।
এই ‘আমি’-র মাধ্যমে দেখা সব কিছুই এই বিভ্রমের ফিল্টার দিয়ে দেখা—তাই তা বাস্তব নয়, চিরন্তন নয়, বরং সময়বদ্ধ, পরিবর্তনশীল, মায়াস্বরূপ। যা 'আমি'–র আগে ছিল, যেটির উপর এই ‘আমি’ উঠেছে, সেটাই বাস্তব—তুমি সেই, যিনি 'আমি'–কেও প্রত্যক্ষ করছেন।
‘আমি’-র বোধ নিজেই মিথ্যা, কারণ এটি অস্থায়ী ও দেহ-মনের উপর নির্ভরশীল। যা-কিছু ‘আমি’ দিয়ে দেখা বা অনুভব করা হয়, তা-ও মিথ্যা ও মায়া। জগৎ, অভিজ্ঞতা, চিন্তা, ব্যক্তিত্ব—সবই এই মিথ্যা 'আমি'–র মাধ্যমে গঠিত। তাই সত্যকে জানতে হলে 'আমি'-কেও ছাড়তে হবে, এবং স্থিত হতে হবে তার পেছনের নীরব পরমে।
২১৭.
“আমি পূর্বজন্ম স্মরণ করি” —ব্যক্তির নয়, চৈতন্যের ধারাবাহিকতা। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“আমি আমার সকল পূর্বজন্ম স্মরণ করি।” কিন্তু এই স্মরণ ব্যক্তিগত পরিচয় বা নাম-রূপ স্মরণের কথা নয়—তিনি বোঝাতে চান—“আমি সেই চৈতন্য, যার উপরে বার বার এই ‘আমি’-বোধ উদিত হয়েছে।”
কৃষ্ণ ‘পরব্রহ্ম’, অর্থাৎ তুমি-আমার প্রকৃত স্বরূপ—চৈতন্য, নিরাকার, অদ্বৈত। জন্মে জন্মে, দেহ-মনের উপাদান (পঞ্চভূত), গুণ (ত্রিগুণ) ও প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে—ফলে নাম-রূপ ভিন্ন ছিল, কিন্তু প্রতি বারই সেই এক ‘আমি’ বোধ উঠেছে—“আমি আছি”।
শ্রীকৃষ্ণের এই উপলব্ধি আসলে বোঝায়—তিনি ‘আমি’-র ধারাবাহিকতা স্মরণ করেন, ব্যক্তিসত্তার নয়। “আমি অমুক ছিলাম, তমুক ছিলাম”—এমন নয়, বরং—“আমি সেই চেতনস্বরূপ, যার উপরে সমস্ত জন্মের ‘আমি’ উদিত হয়েছে এবং মিলিয়ে গেছে।”
গীতার ভাষায় কৃষ্ণ হলেন পরম চেতনা, যার উপর সমস্ত জন্ম ও ‘আমি’-বোধের নাটক চলছে। যখন তিনি বলেন—“আমি পূর্বজন্ম স্মরণ করি”, তা বোঝায়: “আমি সেই চৈতন্য, যাকে কোনো কালের ছোঁয়া লাগেনি, যার উপরে কেবল ‘আমি’-র আগমন ও প্রস্থান হয়েছে।”
জন্ম মানে ‘আমি’-র উদয়, মৃত্যু মানে ‘আমি’-র অন্তর্ধান। এই ‘আমি’ এসেছে দেহ-গুণ-পরিস্থিতি অনুসারে ভিন্ন রূপে, কিন্তু প্রতি বারই এসেছে এক নিরাকার চৈতন্যের উপর। সেই চৈতন্য, সেই কৃষ্ণস্বরূপ—নামহীন, রূপহীন, জন্ম-মৃত্যুহীন। শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন, “আমি সব জন্ম স্মরণ করি”, তিনি ব্যক্তি স্মরণ করছেন না, বরং ‘আমি’-র ধারাবাহিকতা—সেই চৈতন্যের উপর ‘আমি’ বোধ বার বার এসেছে, সেই কথাই।
দেহ, নাম, রূপ, ভূমিকাগুলো সব পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু ‘আমি আছি’—এই জন্মবোধটি চিরন্তনভাবে একই ছিল। কৃষ্ণ সেই পরব্রহ্ম, যার উপরে ‘আমি’-র নাটক চলে, আর তুমি-আমি’ও সেই একই চৈতন্য—শুধু ভুল করে নিজেকে ধরেছি কোনো বিশেষ রূপে।
২১৮.
যখন 'আমি' অনুপস্থিত, তখন কে অনুপস্থিত? তুমি সবসময় ‘আমি’ বোধের সঙ্গে যুক্ত নও। এটি স্থায়ী নয়—জীবনের এক সময় এটি জাগে, আবার ঘুমে, অজ্ঞানতায়, বা মৃত্যুতে এটি মুছে যায়।
জন্মের পর বেশ কিছু সময় ‘আমি’ সুপ্ত থাকে, আর ঘুমের সময় স্থগিত অবস্থায় থাকে। তবে এটি একপ্রকার পটভূমিতে অনুপস্থিত-সদৃশভাবে বিরাজ করে। অধিকাংশ সময় তুমি ‘আমি’ + ‘এই’ বা ‘সেই’-এর সঙ্গে মিশে থাকো—যেমন“আমি পুরুষ”, “আমি শিক্ষক”, “আমি সফল”, “আমি ব্যর্থ”। এই সংযোজনগুলোর মধ্যে এতটা জড়িয়ে যাও যে, তুমি ‘আমি’-র নিজস্ব নির্মলতা হারিয়ে ফেলো।
এইভাবে জীবন কাটে এক স্বপ্নাবিষ্ট অবস্থায়, যেখানে ‘আমি’ আর একটি অনুভব নয়—একটি ব্যাবহারিক মুখোশ হয়ে ওঠে। এখন গুরু বলছেন—তুমি ফিরে এসো সেই আদিম, নির্মল, শব্দহীন ‘আমি’-তে, যেখানে কোনো সংযোজন নেই। আর যখন তুমি এই বিশুদ্ধ ‘আমি’-তে স্থিত হতে থাকো, তখন ‘আমি’-বোধও হারিয়ে যায়।
তখন প্রশ্ন ওঠে—যখন ‘আমি’ অনুপস্থিত হয়ে গেল, তখন কে ছিল যে জানত সে অনুপস্থিত? তখন বোঝা যায়—একটি চিরস্থায়ী, নিঃশব্দ, অলক্ষ্য সত্তা রয়ে গেছে, যে ‘আমি’-কেও প্রত্যক্ষ করছিল, এবং শেষে তাকে গিলে ফেলল, ছাড়িয়ে গেল।
সেই ‘সত্তা’ই তুমি, যার উপর ‘আমি’ উদিত হয় ও লয় পায়—আর তুমি কখনোই সেই ‘আমি’ ছিলে না। ‘আমি’ বোধ নিজে স্থায়ী নয়—জন্মে জাগে, ঘুমে লুপ্ত হয়, মৃত্যুতে মিলিয়ে যায়। এই ‘আমি’ হলো অস্থায়ী আত্মপরিচয়ের এক অনুভব, যার সঙ্গে নাম, রূপ, পরিচয়, ইচ্ছা যুক্ত হয়—তখন তুমি ‘আমি + কিছু’ হয়ে ওঠো।
যখন তুমি এই ‘আমি’-কে শব্দহীন ও সংযোজনবিহীন অবস্থায় ধ্যান করো, তখন ধীরে ধীরে সেটিও লুপ্ত হয়। কিন্তু তখনও একটি কিছু রয়ে যায়, যে জানে—‘আমি’ এখন নেই। এই “জানা”-টি প্রমাণ করে—তুমি সেই জানাশক্তিই—যে কোনো কিছুরই নয়, কেবল চৈতন্য।
‘আমি’ বোধ আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যখন তুমি ‘আমি’ ছাড়া কিছুই না ভেবে ধ্যান করো, তখন ‘আমি’-ও অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন প্রশ্ন ওঠে—“যে ‘আমি’ হারাল, তা কে টের পেল?”—এই জিজ্ঞাসাই তোমাকে নিয়ে যায় সেই চিরন্তন চৈতন্যে, যা না ‘আমি’, না ‘তুমি’, না ‘কিছু’—কেবল ‘আছে’।
২১৯.
‘আমি’-তে স্থিত হও, তাতে বিলীন হও, তারপর তা-ও অতিক্রম করো। এই ‘আমি’-বোধের ভেতরে রয়েছে এক অভূতপূর্ব শক্তি। এই সমগ্র সৃষ্টি, এই জগৎ, সময়, দেহ, মন, চিন্তা—সব কিছুই এই ‘আমি’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এমন এক স্থির, নিরলস উপস্থিতি, যা জন্ম-মৃত্যুর চক্র ধরে রেখেছে, আর মানুষ সেই ‘আমি’-র সঙ্গে জড়িয়ে জীবন বলে এক স্বপ্ন বয়ে চলেছে।
এই শক্তিশালী 'আমি'–কে মুক্তির জন্য অতিক্রম করতে হলে, প্রথমে তাকে শুদ্ধভাবে জানতে হবে—শব্দহীন, রূপহীন, নির্মল অবস্থায়। এরপর ধ্যানের মাধ্যমে তাতে স্থির হতে হবে, এমনভাবে যে, তুমি একসময় হয়ে যাও—‘আমি’-র সঙ্গেই একীভূত।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটবে এক অলৌকিক ঘটনা—‘আমি’ নিজেই নিজের মধ্যে মিলিয়ে যাবে, আর তুমি থাকবে না ‘আমি’-তেও, থাকবে তারও পেছনের সেই চিরন্তন নীরব অস্তিত্বে—যাকে বলে ‘পরব্রহ্ম’, পরম চৈতন্য, প্রকৃত তুমি।
‘আমি’ বোধ হচ্ছে সৃষ্টির মূল তন্তু, যা চেতনার প্রথম প্রকাশ, এবং সেই সূত্র ধরেই সমগ্র অভিজ্ঞতার সূচনা। এটি এতই প্রভাবশালী যে, তার ভিতরে সমগ্র জগতের অনুভব ও ধারণার জাল গড়ে ওঠে। কিন্তু মুক্তির জন্য এই শক্তিকে দমন নয়, বরং তাকে পূর্ণভাবে বুঝে, তাতে স্থিত হয়ে, তার মধ্যেই বিলীন হওয়া প্রয়োজন।
তখন ‘আমি’ নিজে নিজেই হারিয়ে যায়, আর তুমি চুপচাপ গড়িয়ে পড়ো সেই অবস্থায় যেটা না ‘আমি’, না ‘আমি নয়’, বরং নিঃস্বর, নিরাকার, অদ্বিতীয় পরমস্বরূপ।
‘আমি’-তে রয়েছে অসীম সৃষ্টি-শক্তি, এটি থেকেই উদ্ভূত হয় জগৎ। মুক্তির জন্য তাকে অস্বীকার নয়, বরং তাকে বিশুদ্ধভাবে জানা, তাতে স্থিত হওয়া, একীভূত হওয়া জরুরি। সেই ধ্যানের গভীরে একসময় ‘আমি’ নিজেই নিজেকে বিলীন করে। এরপর তুমি পৌঁছো ‘আমি’-র অতীত সেই অবিচল অস্তিত্বে—যাকে বলে ‘পরব্রহ্ম’ বা পরম।
২২০.
‘আমি’ হলো দেহে অবস্থানকারী গুরু, আর ‘সদ্গুরু’ সেই অদৃশ্য পরম। ‘আমি আছি’—এই অনুভব প্রত্যেক শরীরে বর্তমান, এটি সকল উপলব্ধির ভিত্তি, সকল জীবনের মূল সত্তা–বোধ। এই ‘আমি’-কে তুমি ধরতে পারো গুরু হিসেবে—একজন দেহধারী পথপ্রদর্শক, যে তোমাকে নিয়ে যাবে আরও গভীরে—তোমার আত্মস্বরূপে, যাকে বলা হয় সদ্গুরু।
এই ‘সদ্গুরু’ বা পরম গুরু—সে কোনো রূপে নয়, সে অপ্রকাশিত, নিরাকার, নীরব। সে–ই চিরকাল সাক্ষীস্বরূপ, যে ‘আমি’-কে দেখে—যে দেখে দেহে অবস্থানকারী গুরু, যে দেখে জাগরণ, ইচ্ছা, চিন্তা।
তাই ‘আমি’-র জ্ঞান ও ধ্যান হলো সদ্গুরুতে পৌঁছনোর পথ, আর ‘সদ্গুরু’ সেই নিঃশব্দ আত্মা, যিনি কখনও জন্মান না, কখনও কিছু বলেন না, তবুও সব দেখেন, জানেন, থাকেন।
‘আমি’ বোধ হলো আত্মস্মরণের প্রথম ধাপ—এটি শরীরের মধ্যে উদিত, এবং এর মাধ্যমেই আত্মজ্ঞান শুরু হয়। এই ‘আমি’-কে বলা হয় গুরু, কারণ এর মাধ্যমে তুমি নিজেকে দেখতে শুরু করো। কিন্তু এই ‘আমি’ নিজে আত্মা নয়—বরং একটি আত্মদর্শনের আয়না। যে এই আয়নাকে দেখছে, যে এই ‘আমি’-র উদয় ও লয় প্রত্যক্ষ করছে, সে-ই ‘সদ্গুরু’—যিনি অপ্রকাশিত, পরম, সাক্ষীস্বরূপ, সর্বদা ছিলেন ও থাকবেন।
‘আমি’ বোধ হচ্ছে সৃষ্ট বিশ্বে গুরুর রূপ, আর ‘সদ্গুরু’ হচ্ছে সেই আত্মার অন্তর্লীন সত্য, যা সমস্ত চেতনার মূলে বিরাজ করছে। ‘আমি’-কে গ্রহণ করো দেহধারী গুরুরূপে, যে তোমাকে আত্মজ্ঞানের দিকে নিয়ে যাবে। এই ‘আমি’-র মধ্যেই রয়েছে প্রবেশপথ সদ্গুরুর কাছে পৌঁছানোর।
সদ্গুরু কে? তিনি তোমার ভেতরে থাকা সেই চিরন্তন পরম, যিনি ‘আমি’-কেও দেখেন, কিন্তু নিজে কখনও প্রকাশিত হন না। তাই তোমার সাধনা—‘আমি’-র মধ্যে স্থিত হওয়া, এবং শেষে ‘আমি’-কে ছাড়িয়ে গিয়ে সদ্গুরুর নিঃশব্দ সাক্ষীতে স্থিত হওয়া।