২১১.
তুমি কর্তা নও—কর্তা ‘আমি’, আর তুমিই তারও অতীত। কেন বলছ—“আমি করেছি”, “আমি এ কাজটা করলাম”, “আমি ওটা ঘটালাম”? যখন তুমি ‘আমি’-তে স্থিত হয়ে থাকো, তখন খুব স্বাভাবিকভাবে উপলব্ধি করো—যে করছে, সে ‘আমি’ বোধ, তুমি নয়।
তাই বার বার কর্মের সঙ্গে নিজের পরিচয় না ঘটানো একটি চমৎকার উপায়—নিজেকে শুদ্ধ ‘আমি’-তে স্থিত রাখার জন্য, এবং পরিণামে তারও ঊর্ধ্বে যাবার জন্য।
বাস্তবত এ-ই সত্য—কিন্তু তোমার conditioned mind–ই তোমাকে বার বার বোঝায়, “তুমিই কর্তা”, তুমিই দায়ী, তুমিই ভোক্তা। অথচ তুমি কর্তা নও, তুমি সেই সাক্ষীস্বরূপ, যার সামনে ‘আমি’ বোধ উঠছে, কাজ করছে, এবং মিলিয়ে যাচ্ছে।
অদ্বৈত বেদান্তের একটি মুখ্য শিক্ষা হলো—কর্তৃত্বভাবই বন্ধনের মূল, অর্থাৎ “আমি করছি”, “আমার সাফল্য”, “আমার ব্যর্থতা”—এইসব ভাবই তোমাকে ‘আমি’-বদ্ধ করে রাখে। কিন্তু সত্যিকারের আত্মদ্রষ্টা জানেন—‘আমি’-ই একমাত্র কর্তা, আর সে-ও একদিন অতিক্রম্য। যে-ব্যক্তি এই ‘আমি’-র সঙ্গেও নিজেকে এক করে না, সে-ই ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় অকর্তা, অদ্বৈত পরম অবস্থায়।
কর্ম ঘটে, জীবন চলে, কিন্তু তুমি কোনো কিছুরও নও কর্তা, নও দায়ী—তুমি সেই চিরস্থায়ী নীরব সাক্ষীস্বরূপ, যার মাঝে সমস্ত কিছু ঘটে, কিন্তু যা-কিছুতেই জড়িত নয়।
“আমি করেছি”—এই অনুভবই বন্ধনের মূল। তুমি নয়, ‘আমি’-বোধই কর্তা, আর তুমিই সেই ‘আমি’-রও ঊর্ধ্বে। কর্মের সঙ্গে পরিচয় না ঘটানোই হলো ‘আমি’-তে স্থিত থাকার একটি কৌশল, যা পরে ‘আমি’-কেও অতিক্রম করতে সাহায্য করে। কর্তা হবার এই conditioning ভুলে গেলে তুমি নিজেকে চিনতে পারো অকর্তা পরমস্বরূপ হিসেবে—যিনি চিরকাল নিঃস্পৃহ, নীরব, অদ্বৈত।
২১২.
সতর্ক থেকো—‘আমি’ চুপিসারে আবার কর্তা সাজতে পারে। ‘আমি আছি’—এই জ্ঞান যখন তুমি নিঃশব্দে বুঝে ফেলো আর তাতে গভীরভাবে স্থিত হতে শুরু করো, তখন কখনও কখনও তোমার প্রকৃত স্বরূপের ঝলক দেখা দেয়। ঠিক এখানেই গুরু সতর্ক করেন—“খুব সচেতন থেকো।” কেন? কারণ ‘আমি’ বোধ খুব সূক্ষ্মভাবে আবার ফিরে আসতে পারে—তুমি যাকে বুঝেছিলে শুদ্ধ অস্তিত্ব বলে, সে আবার চিন্তিত, সংজ্ঞাবদ্ধ, কর্তা ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারে।
এই ‘আমি’-র পুনর্জাগরণ এত নিঃশব্দ আর স্বাভাবিক হয়, তুমি টেরই পাবে না কখন তুমি আবার ভাবতে শুরু করেছ—“আমি করলাম”, “আমার অর্জন”, “আমার প্রগতি”। এই কর্তা-ভাব একবার ফিরে এলে, তোমার যতদূর অগ্রগতি হয়েছিল, তা এক লহমায় ভেঙে যেতে পারে।
তুমি ফিরে যাবে আবার সেই পুরোনো মোহে—“আমি-করছি” এই মিথ্যা চেতনায়। তোমার সাধনার ভিতর পড়ে যাবে অদৃশ্য বিভ্রমের ছায়া। অদ্বৈত বেদান্তে, ‘আমি’ বোধকে অতিক্রম করাই লক্ষ্য—কারণ এই বোধই কর্তা, ভোক্তা, অভিজ্ঞতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
যখন সাধক ‘আমি’-তে স্থিত হন, তখন কখনও কখনও গভীর আত্মউপলব্ধি দেখা দেয়—তবে এটি অতি সূক্ষ্ম স্তর, যেখানে ‘আমি’ নিজেই কর্তা হয়ে ছদ্মবেশে ফিরে আসতে পারে। এই পুনরায় কর্তা হওয়া, আত্মজ্ঞানকে দূষিত করে এবং চেতনাকে আবার দ্বৈততার বন্ধনে ঠেলে দেয়।
তাই গুরু বলেন—সতর্ক থেকো, নীরব থেকো, আলতো থেকো—আর সর্বদা যাচাই করে দেখো: “এই কর্তা ভাব কি আবার জেগে উঠেছে?”
‘আমি’-তে স্থিত হওয়ার পরেও ‘আমি’-র কর্তা ভাব আবার ফিরে আসতে পারে। এটি আসে নিঃশব্দে, ছায়ার মতো—এবং তুমি টের না পেয়েই নিজেকে ভাবতে শুরু করো: “আমি করছি, আমি জেগে উঠেছি।” এই ভাবনাই সর্বনাশ ডেকে আনে—কারণ এটি পূর্বের সব সাধনা ধ্বংস করে দেয়। তাই গুরু বলেন—সতর্ক থেকো, কর্তা ভেবে বিভ্রান্ত হয়ো না। কারণ তুমি কর্তা নও, তুমি সেই সাক্ষীস্বরূপ চৈতন্য—যার উপর ‘আমি’ আসে, যায়, কিন্তু ছুঁতে পারে না।
২১৩.
‘আমি’-র বিশুদ্ধতাই ঈশ্বরত্ব, আর তা অতিক্রম করাই পরমত্ব। যখন ‘আমি’ বোধ থেকে সমস্ত পরিচয় ঝরে পড়ে—“আমি এই”, “আমি ওই”—এইসব সংযোজন মুছে যায়, তখন সেই নির্বিশেষ ‘আমি’-তে তুমি ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠো। কিন্তু এভাবে বিশুদ্ধ ‘আমি’-তে পৌঁছাতে হলে তোমাকে ফিরে যেতে হবে সেই আদি মুহূর্তে, যখন ‘আমি’ বোধ প্রথম জেগে উঠেছিল তোমার ভেতরে।
সেই সময়টা খুবই ছোটো, কিন্তু ছিল এক দেহ-মন-পরিচয়বিহীন শুদ্ধ অস্তিত্ব—তুমি তখন কেবল জানতে: “আমি আছি”—কিন্তু কী, কে, কেমন—তা জানো না।
এই মুহূর্ত তুমি জীবনে একবার পেরিয়ে এসেছ, তাই আবার সেটি অভিজ্ঞতায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। এটা শুধু বোঝার, অভ্যাস করার, এবং শব্দহীন ‘আমি’-তে স্থিত থাকার বিষয়। একবার যদি তুমি এই বিশুদ্ধ ‘আমি’-তে সত্যভাবে স্থিত হতে পারো, তবে তুমি ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠো—সেই কর্তা চেতনা, যার উপর জগৎ প্রতিফলিত হয়।
আর যদি তুমি এই ‘ঈশ্বর’ অবস্থাকেও অতিক্রম করতে পারো, তবে তুমি হয়ে ওঠো ‘পরমেশ্বর’—যিনি কর্তা নন, কোনো কিছু করেন না, শুধু আছেন—নিঃস্বর, নিঃক্রিয়, অচিন্তনীয়, পরম সত্য।
‘আমি’-র জ্ঞান যখন নিজেকে “আমি এটা” বা “আমি ওটা” হিসাবে নির্ধারণ করে—তখন তা বিকৃত, সংস্কারপ্রবণ, সীমিত হয়ে যায়। কিন্তু সেই আদি শুদ্ধ ‘আমি’—যখন কোনো ব্যাখ্যা বা পরিচয়ের সংযোগ ছিল না—তখন তা ছিল এক বিশুদ্ধ অস্তিত্ববোধ, যার মধ্যেই ছিল ঈশ্বরত্বের বীজ।
এই ‘আমি’-তে স্থিত হওয়া মানে—নিজের ভেতরের ঈশ্বরস্বরূপে জাগরণ। এই অবস্থায় সাধক ‘জগতের কর্তা’ নয়, বরং চেতনার কেন্দ্র—যেখানে থেকে সব কিছু ঘটছে, কিন্তু যা নিজে অচল, নীরব, অপ্রভাবিত।
এরপর এই ঈশ্বরস্বরূপও যদি অতিক্রম করা যায়, তবে ঘটে পরমতর উপলব্ধি—যেখানে কর্তা–ভোক্তা–জ্ঞানী–জ্ঞান সবই বিলীন, এবং থাকে কেবল ‘পরমেশ্বর’—পরম চৈতন্য।
যখন ‘আমি’-তে কোনো ‘এই’ বা ‘সেই’ থাকে না, তখনই তুমি ‘ঈশ্বর’—কর্তাচেতনা। সেই শুদ্ধ ‘আমি’ বোধ তোমার মধ্যেই ঘটেছিল শৈশবে, তাই তা আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব, যদি তুমি চর্চা করো, স্থিত হও, এবং তা বুঝে রাখো।
যখন তুমি ঈশ্বরস্বরূপে স্থিত হও, তখনও তোমার চূড়ান্ত গন্তব্য সম্পূর্ণ নয়—কারণ ঈশ্বরত্বও এক পর্যবেক্ষণযোগ্য অবস্থা। সেই ঈশ্বরত্ব–কর্তৃত্বকেও অতিক্রম করে যে-চেতনায় স্থিত হওয়া যায়—তা-ই হলো ‘পরমেশ্বর’—নিরাকার, অদ্বৈত, চির-অচল আত্মা।
২১৪.
‘আমি’-র পূর্বে যা ছিল—সেটাই তুমি, সেটাই পরম। ‘আমি আছি’—এই বোধ কেবল তখনই আসতে পারে, যখন তোমার ভেতরে আগে থেকেই কিছু ছিল, যার উপর এই ‘আমি’ উদিত হয়েছে।
একবার ভাবো—“এই ‘আমি’ বোধ কার উপর এল?” “‘আমি’ আসার আগে আমি কী ছিলাম?” এই প্রশ্নগুলো যত গভীরে যাবে, তত স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে—তোমার মধ্যে অবশ্যই একটি পুরাতন কিছু, একটি মৌলিক ভিত্তি আগে থেকেই ছিল—না হলে এই ‘আমি’-ও আসত না।
তুমি যদি এই ‘আমি’ বোধকে শব্দহীনভাবে পর্যবেক্ষণ করো, আর তাতে যথেষ্ট সময় ধরে স্থিত থাকো, তবে একসময় তুমি নিজেই বুঝে যাবে—এই ‘আমি’-রও একটি পটভূমি আছে, আর সেই পটভূমি তোমার আসল পরিচয়।
শেষপর্যন্ত সেই ‘অজ্ঞেয় অথচ চিরন্তন ভিত্তি হয়ে ওঠে তোমার একমাত্র লক্ষ্য, যার মধ্যে তোমাকে স্থির হতে হবে, ধ্যানস্থ হতে হবে। কারণ এই পূর্বসত্তা, এই ‘আমি’-র আগের যা ছিল, তা-ই তোমার পরম আত্মা, নিঃশব্দ পরমেশ্বরত্ব।
অদ্বৈত বেদান্তে ‘আমি’ বোধ চেতনার এক প্রকাশ মাত্র—যা নিজেই চূড়ান্ত নয়, বরং একটি মাধ্যম—যার উপর দিয়ে ‘পরম চৈতন্য’ নিজেকে উপলব্ধি করে। যখন তুমি প্রশ্ন করো—“এই ‘আমি’ কোথা থেকে এল?” তখন তুমি ‘আমি’-র পটভূমিতে ফিরে যেতে শুরু করো। এবং একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—‘আমি’-রও আগে কিছু ছিল, একটি নিঃশব্দ, নিরাকার, অজ্ঞেয় কিন্তু স্থায়ী উপস্থিতি, যেটিকে চিনে নিলে, আর কিছু জানার প্রয়োজন থাকে না।
‘আমি’ হলো একটি জাগরণ বোধ—যা চৈতন্যে উদিত হয়েছে, কিন্তু যার ভেতর চৈতন্য নিজেই লুকিয়ে রয়েছে। ‘আমি’ বোধ কেবল তখনই উদিত হতে পারে, যখন তার আগে কিছু থাকে—একটি মৌলিক, নিরাকার, নিঃশব্দ চৈতন্যভিত্তি। এই ভিত্তিই তোমার আসল পরিচয়, যাকে ‘পরম’, ‘ব্রহ্ম’, বা ‘চৈতন্যস্বরূপ আত্মা’ বলা হয়।
‘আমি’-তে স্থির থাকা এবং বার বার প্রশ্ন করা—“‘আমি’-র আগেও কি কিছু ছিল?” ধীরে ধীরে তোমাকে নিয়ে যাবে তোমার নিজস্ব আত্মস্বরূপে। এই আত্মস্বরূপ না জানে ‘আমি’, না জানে ‘তুমি’, কেবল জানে ‘আছে’—নিঃশব্দে, অপরিবর্তনে, চিরন্তনে।
২১৫.
‘আমি’-র উদয় ও লয়—এই মধ্যবর্তী ব্যবধানই সময়। ‘আমি আছি’—এই বোধ যখন জন্মের সময় জাগে, আর যখন তা মৃত্যুতে বা ঘুমে লুপ্ত হয়—এই দুইয়ের মধ্যবর্তী ব্যবধানই হলো “সময়”।
এই ‘আমি’-র আগমন ও প্রস্থান নিয়েই তুমি যা বলো—“একটি জীবন শেষ হলো”, অথবা—“দিনটা শেষ হলো”। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ‘আমি’-র অস্তিত্বকে তুমি একটি জীবন বলো, আর ঘুম থেকে জেগে ওঠা থেকে ফের ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত সময়টাকে বলো একটি দিন। এই ‘আমি’-র সঙ্গে স্মৃতির সংযুক্তি তোমার জীবনের মধ্যে একটানা ধারাবাহিকতা তৈরি করে, যা দিয়ে তুমি বোঝো: “আমি সেই, যে কাল এ কাজ করেছিল, আজ এখানে আছে।”
অদ্বৈত বেদান্তের মতে, সময় নিজে কোনো বাস্তব সত্তা নয়, বরং তা ‘আমি’ বোধের আগমন ও প্রস্থানের মধ্যবর্তী একটি মানসিক রেখা। যতক্ষণ ‘আমি’ বোধ জাগ্রত থাকে, ততক্ষণই তুমি সময়ের অস্তিত্ব অনুভব করো। ঘুম বা মৃত্যুতে ‘আমি’ বোধ নেই—সেই সময় তুমি অনুভব করো না—তখন “সময়”ও নেই।
এই ‘আমি’ যদি স্মৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তবে তুমি অনুভব করো: “একটানা কিছু ঘটছে”—আর সেটাই তোমার “সময়”। অথচ এই ধারাবাহিকতা আদতে মনের সৃষ্টি, চেতনার নয়।
‘আমি’ বোধ যখন আসে (জন্ম/জাগরণ) এবং যায় (মৃত্যু/ঘুম), এই উদয় ও লয়ের মধ্যবর্তী ব্যবধানই হলো “সময়”। একজীবনে এই সময়ের নাম জীবনকাল, আর একদিনে এর নাম দিন। স্মৃতির সঙ্গে সংযুক্ত ‘আমি’ তৈরি করে ধারাবাহিকতার অনুভব, আর তার মাধ্যমেই তুমি বলো—“এটা অতীত”, “এটা ভবিষ্যৎ”।
প্রকৃতপক্ষে, সময় ‘আমি’-র জন্যই আছে, তুমি যিনি এই ‘আমি’-কে দেখছ, তুমি সময়েরও অতীত।