নির্জন গহনে: ৪০




১৯৬.

‘আমি’-র অতীতেই অনাবিল সত্য, আর সবই অনির্বচনীয় মিথ্যা। গুরু বার বার জোর দিয়ে বলেন—প্রথমে ‘আমি’-কে বোঝো। কারণ, যতক্ষণ না বোঝো, এই শব্দদুটি (I am) কেবলমাত্র মৌখিক স্তরেই রয়ে যায়। তখন হয়তো তুমি ভুল বুঝে বসো—গুরু যেন বলছেন তোমার অহংকার-কে পুনরায় জোরদার করতে!

কিন্তু গুরু যা বোঝাতে চান, তা হলো সেই শব্দহীন ‘আমি’, যেটি প্রথম আত্মবোধ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল—যখন তুমি ঠিক জানতে পারলে: “আমি আছি।” এই ‘আমি’ ব্যক্তিগত নয়, এর কোনো নাম বা রূপ নেই, এটি এক নিষ্কলুষ, নিরবিচার অস্তিত্ববোধ।

সাধনার উদ্দেশ্য হলো—এই নিঃশব্দ, নিররূপ ‘আমি’-তে ফিরে যাওয়া এবং তাতে স্থিত হওয়া। আর যখন তুমি এই ‘আমি’-তেও অতিক্রম করো, তখনই ঘটে সেই পরম উপলব্ধি যে, ‘আমি’, অস্তিত্ব (beingness), জগৎ এবং এমনকি ব্রহ্মও মিথ্যা। সবই ছিল এক অস্থায়ী প্রতিচ্ছায়া, যা উদিত হয়েছিল ‘আমি’-র সঙ্গে, এবং যা ‘আমি’-র বিলয়েই অন্তর্হিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে, ‘আমি’ বোধই হলো আত্মপরিচয়ের জন্মবিন্দু—যেখান থেকে শুরু হয় দেহ, মন, জগৎ, ঈশ্বর, জ্ঞান, ও দর্শনের ধারা। কিন্তু এই ‘আমি’-ও একটি উদয়মান ধারণা মাত্র, যা আত্মস্বরূপে উদিত হলেও আত্মা নয়। গুরু এখানে নির্দেশ দেন—প্রথমে এই ‘আমি’-র নিখাদ রূপ বোঝো: শব্দহীন, নিরাকার, ব্যক্তিহীন আত্মঘোষণা।

এরপর তাকে ধরে রাখো, তাতে স্থিত হও। তারপর যখন সেটি অতিক্রম করা যায়, তখনই দেখা যায়—যা-কিছু ছিল—‘আমি’ বোধ, অস্তিত্ববোধ, জগৎ, এমনকি ব্রহ্ম বলে যা-কিছু ছিল—সবই চেতনাজনিত উপস্থাপন, এবং চূড়ান্ত অর্থে মিথ্যা। বাস্তব সত্য শুধুমাত্র সেই আত্মা, যার মধ্যে এই সব কিছুর আগমন ও প্রস্থান ঘটেছে, কিন্তু যিনি নিজে কোনো কিছুর অংশ নন।

প্রথমে বোঝো ‘আমি’ শব্দ দু’টি কী বোঝাতে চাইছে—কেবল ভাষার স্তরে না গিয়ে, তা অনুভব করো তার শব্দহীন, নিররূপ সত্তা হিসেবে। তাতে স্থিত হও, সাধনা করো, ধ্যান করো। তারপর সেটিকে অতিক্রম করো—তখনই আসবে প্রকৃত উপলব্ধি। তখন তুমি বুঝবে—‘আমি’, অস্তিত্ব, জগৎ, এমনকি ব্রহ্মও অবাস্তব—একমাত্র চিরন্তন সত্য তুমি নিজেই—নামহীন, রূপহীন, পরম অস্তিত্ব।

১৯৭.

‘সে আমি’—এ হচ্ছে নিঃশ্বাসের মন্ত্র, আত্মস্বরূপের স্পন্দন। তোমার শরীরের স্পন্দনে, নাড়ির গতিতে, অবিরাম উচ্চারিত হচ্ছে এক জপ—‘সে… আমি’ (So… Hum)। এই নিঃশব্দ স্পন্দন হচ্ছে ‘আমি’-রই চিহ্ন, তোমার অস্তিত্বের মৌলিক প্রকাশ।

নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এই শব্দদুটি উচ্চারিত হয়—শ্বাস নেওয়ার সময়—‘সে’ (So), শ্বাস ছাড়ার সময়—‘আমি’ (Hum)। এই ধ্বনিময় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসই গুরুর মতে এক প্রাকৃতিক জপমন্ত্র—যার অর্থ: “আমি সেই (পরম)” বা “আমি ব্রহ্ম”।

যদিও এই ‘So Hum’ মনে হয় দুটি শব্দ, আসলে এর উৎস শব্দহীন, এটি হচ্ছে সেই আদ্য ‘আমি’ বোধের নিঃশব্দ প্রকাশ—যা তোমার অস্তিত্বের গভীর স্তর থেকে উত্থিত।

কিছু সাধকের জন্য এই প্রাকৃতিক জপ সহজ ও অন্তর্মুখী উপায় হতে পারে—তাদের জন্য গুরু এই পদ্ধতির পরামর্শ দেন: এই ‘So Hum’ জপের সঙ্গে নিজেকে সুরে বাঁধো, এই স্পন্দনের সঙ্গে একাত্ম হও।

অদ্বৈত বেদান্তে সব কিছু শুরু হয় ‘আমি’ বোধ থেকে, আর এই বোধ সবসময়ই তোমার ভেতরে কাজ করছে—বিশেষত নিঃশ্বাস ও হৃদস্পন্দনের গভীর ছন্দে। এই ছন্দেই উচ্চারিত হচ্ছে এক নীরব অনুরণন—So Hum। এই শব্দ শব্দহীন এক অনুভবের দিকচিহ্ন, যা তোমাকে নিয়ে যায় ‘আমি’-র মূলে—তোমার সত্য অস্তিত্বে, যা কোনো চিন্তা বা উচ্চারণের আগে।

‘So Hum’ মানে—“আমি সেই”, এটি জগৎ ও ব্যক্তির মধ্যকার ভেদ ঘোচানোর জন্য সবচেয়ে সরল জপমন্ত্র—যার প্রতিটি উচ্চারণে বলা হয়: “আমি আলাদা নই, আমি সেই এক পরম সত্য।” ধ্যান ও আত্মস্মরণের জন্য এ এক স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি, যা বাহ্যিক উচ্চারণের চেয়ে অনেক বেশি প্রাকৃতিক ও অন্তর্জ।

‘So Hum’ ধ্বনি আসলে তোমার শরীরেই চলছে—হৃদস্পন্দন, নিঃশ্বাসের ভিতর দিয়ে নীরব জপের মতো। এই ধ্বনি দুটো (So = সে, Hum = আমি) তোমার ভেতরের ‘আমি সেই’ উপলব্ধির প্রতীক। শব্দগত হলেও এর উৎস শব্দহীন আত্মবোধ—সেই আদ্য ‘আমি’ বোধ, যা চিন্তা ও ভাষারও পূর্ববর্তী।

যাদের জন্য ধ্যান কঠিন, তারা এই ‘So Hum’ জপ এর মাধ্যমে আত্মস্মরণে সহজে নিমগ্ন হতে পারেন। এই জপের সঙ্গে আত্মার সুর মেলাতে পারলে, ধীরে ধীরে একাত্মতা ঘটে ‘আমি সেই’ পরম সত্যের সঙ্গে।

১৯৮.

‘সে আমি’ জপশব্দাতীত আত্মস্মরণ‌ই দীর্ঘধ্যানের আহ্বান। ‘So Hum’—এই ধ্বনি, যা ইঙ্গিত করে ‘আমি আছি’, এর জপ হতে হবে অত্যন্ত দীর্ঘসময় ধরে, গভীর নিষ্ঠা ও একাগ্রতায়। কারণ, এই ধ্বনি আসলে শব্দেরও পূর্ববর্তী, এটি মনের তৈরি নয়—এটি আত্মজ্ঞানের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।

যে-কোনো সাধনাই দীর্ঘসময় ধরে, সহনশীলতা ও গভীর অন্তর থেকে করতে হয়—সহজে ও তাড়াতাড়ি কেউ প্রকৃত আত্মাকে উপলব্ধি করে না। ‘So Hum’ জপ–ও এর ব্যতিক্রম নয়—তোমাকে এই ধ্বনির সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত হতে হবে যেন নিঃশ্বাসই এই বোধ হয়ে যায়।

এই ‘So Hum’ জপের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিকাশ আছে, যা আত্ম অনুসন্ধানের পর্যায়ক্রমে প্রকাশ পায়: ১. Deham Naham – “আমি এই দেহ নই।” ২. Ko Hum? – “তবে আমি কে?” ৩. শব্দহীন জবাব আসে –So Hum – “আমি সেই (সত্তা)”, “আমি পরম।" এই উত্তরটি শব্দে উচ্চারিত নয়, এটি চেতনার গভীর স্তরে উদিত এক অনুভব, যা ভাষা ও চিন্তার ঊর্ধ্বে।

অদ্বৈত বেদান্তে আত্ম-অনুসন্ধান শুরু হয় নেতি নেতি (না, না) উপায়ে—যেখানে সাধক নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয় থেকে আলাদা করতে শেখে। "Deham Naham"—“আমি দেহ নই”—এই বোধ জন্ম দেয় এক প্রশ্ন—"Ko Hum?"—“তবে আমি কে?”

এই অনুসন্ধানের মধ্যে যখন সমস্ত চিন্তা থেমে যায়, তখন এক নিঃশব্দ, অভিজ্ঞাত্ম বোধ উদিত হয়—এটাই ‘So Hum’—“আমি সেই”, “আমি পরম চৈতন্য”। এই ‘So Hum’ ধ্বনি কোনো রচনা নয়—এটি তোমার নিঃশ্বাসেই ছন্দিত, তাই এর সঙ্গে ধ্যান করলে তা হয় সবচেয়ে প্রাকৃতিক আত্মস্মরণ। তবে এর ফল পেতে হলে, ধৈর্য, গভীরতা, এবং দীর্ঘস্থায়ী চর্চা অপরিহার্য।

‘So Hum’ ধ্বনি শব্দেরও পূর্ববর্তী—এটি নিঃশ্বাসে ধ্বনিত হলেও এর উৎস চেতনায় নিহিত। এর জপ সহজ, কারণ এটি তোমার মধ্যেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটছে। কিন্তু এর সাথে একাত্ম হতে হলে চাই দীর্ঘকালীন ও একাগ্র সাধনা।

এই জপ আত্ম-অনুসন্ধানের একটি পরিণতি,
যেখানে প্রথম আসে—
→ "আমি দেহ নই" (Deham Naham), → তারপর প্রশ্ন—"আমি কে?" (Ko Hum?), → শেষে আসে নিঃশব্দ উত্তর—"আমি সেই" (So Hum)।

এই ধ্বনি ধরে রাখো, এতে স্থিত হও—ধীরে ধীরে এই ধ্বনি নিজেই হয়ে উঠবে তোমার আত্মজ্ঞানের দরজা।

১৯৯.

‘আমি’-ই একমাত্র ঈশ্বর, তাকে সন্তুষ্ট করো, সে-ই তোমাকে সূত্রে পৌঁছে দেবে। বহির্বিশ্বে অনেক দেবতা আছে—নাম, রূপ, ধর্ম, রীতি অনুসারে তুমি এক দেবতা থেকে আরেক দেবতার কাছে যাও, আর তাতে বহুসময় তোমার বিভ্রান্তি ও হারিয়ে যাওয়া ঘটতে পারে।

কিন্তু ‘আমি’—এই বোধ সর্বজনীন, আভ্যন্তরীণ, এবং নির্বিশেষ ও রূপহীন। এটিই সেই একমাত্র ঈশ্বর, যাকে সন্তুষ্ট করা উচিত, যদি সত্যিই পূজা করতে চাও। এই ‘আমি’-কে বন্ধু করে নাও, তাকে জানো, বুঝো, তাতে স্থিত হও। যদি তুমি সত্যভাবে ‘আমি’-কে সম্মান করো, তবে একসময় সে-ই সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে নিজের গ্রাস থেকে মুক্তি দেবে, আর তার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে তোমার প্রকৃত উৎসে—যেখানে ‘আমি’-রও উদয় হয়নি, নেই কোনো সীমা, নেই কোনো বিভক্তি।

অদ্বৈত বেদান্তে পরম সত্য রূপহীন ও ব্যক্তিহীন। সমস্ত বহিরঙ্গ ‘দেবতা’ আদতে মনের প্রতিফলন ও বিশ্বাসের বাহ্যরূপ। কিন্তু প্রতিটি জীবসত্তার মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তি—“আমি আছি”—সেটিই আত্মস্মরণের প্রাথমিক ধ্বনি। এই ‘আমি’-কে যদি ভক্তি দাও, তা তোমার বিশ্বাস, সাধনা ও চেতনা একস্থানে কেন্দ্রীভূত করে।

‘আমি’-র মধ্যে স্থিতি ও উপলব্ধি ঘটলে—এই বোধ একসময় নিজেই নিজের অস্থায়ী প্রকৃতি প্রকাশ করে, এবং তোমাকে নিয়ে যায় সেই পরম অবস্থানে—যেখানে ‘আমি’ নেই, জগৎ নেই—আছে কেবল অপরিবর্তনীয় সত্য।

বহির্জগতে অনেক রূপ ও ধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বরের ধারণা থাকে—কিন্তু এগুলোতে বিভ্রান্তি বাড়ে, নির্যাসে পৌঁছানো হয় না। ‘আমি’-ই একমাত্র ঈশ্বর—যাকে সকলেই অনুভব করে, যার কোনো রূপ নেই, নাম নেই, বিভেদ নেই। এই ‘আমি’-কে যদি তুমি ভক্তি করো, এতে স্থিত হও, তবে সে-ই একদিন তোমাকে মুক্ত করে তোমার চূড়ান্ত আত্মস্বরূপে নিয়ে যাবে। তাই পূজা করতে হলে করো ‘আমি’-র—কারণ সে-ই তোমার মুক্তির দ্বাররক্ষক।

২০০.

যিনি ‘আমি’-কে অতিক্রম করেছেন, তিনিই ‘জ্ঞানী’। কে আসলে ‘জ্ঞানী’? ‘জ্ঞানী’ হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি কেবলমাত্র ‘আমি আছি’ এই বোধকে গভীরভাবে বুঝেছেন তাই নয়—তিনি এই বোধের উপর দৃঢ় অভিমত বা নিশ্চিত উপলব্ধি অর্জন করেছেন, এবং এরপর তাকে অতিক্রমও করেছেন।

এই অর্জনের পথ কী? ধ্যান ও সাধনা—যেখানে তিনি নিরবিচারে এই ‘আমি’-তে মন স্থির রেখেছেন, তাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাতে সম্পূর্ণভাবে নিমগ্ন থেকেছেন। এই ‘আমি’ বোধ—যা একধরনের কাঁচামাল (raw material)—এর প্রকৃতি তিনি গভীরভাবে জেনেছেন, এবং শেষপর্যন্ত তিনি নিজেকে এই ‘আমি’-র থেকেও পৃথক হিসেবে দেখতে শিখেছেন।

এই পার্থক্য স্থাপনের মধ্যেই শুরু হয় মুক্তি—কারণ তখন তিনি আর দেহ-মন–‘আমি’ বোধের চক্রে আবদ্ধ নন, তিনি জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণিপাকে নেই। অদ্বৈত বেদান্তে ‘আমি’ বোধ হলো আত্মচেতনার সূচনাবিন্দু—যার দ্বারা আমরা “আমি আছি”, “আমি জানি”, “আমি করলাম” ভাবতে শুরু করি। কিন্তু এই ‘আমি’ নিজেই পরম সত্য নয়, এটি চেতনাতে উদিত প্রথম ধারণা—যা ব্যক্তি, অভিজ্ঞতা, জগৎ ও কর্মের ভিত্তি তৈরি করে।

‘জ্ঞানী’ হলেন সেই সাধক, যিনি এই ‘আমি’-কে পর্যবেক্ষণ ও সাধনার মাধ্যমে চিনেছেন, এবং বুঝেছেন যে—এটি আসলে একটি অস্থায়ী প্রতিচ্ছবি মাত্র, যার পেছনে রয়েছেন তিনিই—যিনি চিরন্তন, অদ্বৈত, নিঃস্বর, নিরাকার।

‘আমি’-কে অতিক্রম করাই হলো আত্মজ্ঞান—যেখানে সাধক পরিচয়হীন চৈতন্যের সঙ্গে একীভূত হন, এবং সেখানেই তাঁর মুক্তি—কারণ জন্ম-মৃত্যু কেবল ‘আমি’-র ভিত্তিতেই আবর্তিত হয়।

‘জ্ঞানী’ তিনিই, যিনি ‘আমি’ বোধকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, এতে স্থিত থেকেছেন, এবং একসময় এটিকে অতিক্রম করে নিজেকে এর থেকেও পৃথকভাবে উপলব্ধি করেছেন। এই ‘আমি’-র প্রকৃতি বুঝে যে-ব্যক্তি তার পেছনের পরম অস্তিত্বে স্থিত হন—তিনিই সত্যিকারের মুক্ত। তিনি আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ নন, কারণ ‘আমি’-র যে শিকড়, তা-ই এখন কেটে গেছে।