১৬.
আমি”—বন্ধুও, বন্ধনও। ‘আমি আছি’—এই অনুভবই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু, আবার সবচেয়ে আপন বন্ধু। যখন সে তোমাকে শরীরের সঙ্গে বেঁধে ফেলে, তখন সে বন্ধনরূপ শত্রু। আর যখন সে-ই তোমাকে শরীর-ভাব থেকে মুক্ত করতে চায়, তখন সে মিত্ররূপ গুরু।
যখন প্রথম এই ‘আমি’ অনুভব জেগে উঠেছিল তোমার চৈতন্যে, তখন সে তোমাকে বুঝিয়েছিল—"তুমি এই দেহ", এই নাম, এই রূপ, এই কাহিনি। এই বিশ্বাসই জন্ম দিয়েছিল মোহের, সৃষ্টি করেছিল পৃথক ‘আমি’ ও ‘তুমি’-র—আর এই ভ্রমই রচনা করেছিল জন্ম, মৃত্যু, দুঃখ, ও অহংকারের নাট্যগাথা।
উপনিষদ বলে, "অস্মিন্ শরীরে অনাত্মা আত্মাভিমানেন অপরাধম্ কুর্যাৎ"—শরীরকে আত্মা ভেবে বেঁধে ফেলাই মহাপাপ, আর এই ভুলেই শুরু হয় বেদনা। কিন্তু আজ, গুরুর বাণী ভেসে আসে—“ফিরে এসো, ফিরে এসো সেই ‘আমি আছি’ অনুভবে—তাকে চেনো, তাকে উপলব্ধি করো।” সেই 'আমি'-কে এবার বন্ধুর মতো গ্রহণ করো, গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা করো—তার নীরব উপস্থিতিতেই লুকিয়ে আছে মুক্তির দিশা।
আর যখন তুমি "আমি আছি"-র মধ্যে নিবিষ্ট হবে, কিন্তু তার নাম-রূপ-পরিচয়’কে পাশ কাটাবে, তখন সে-ই তোমাকে নিয়ে যাবে তার উৎসের দিকে—যেখানে ‘আমি’ও নেই, নেই ‘তুমি’, নেই দেহ, নেই দ্বন্দ্ব—আছে কেবল সত্য, চিত্, আনন্দ—অখণ্ড ব্রহ্ম।
‘আমি’ অনুভবই সেই দ্বৈততার দ্বারপাল, অথচ সদগুরুর বাণীতে সে-ই হয়ে যায় অদ্বৈততার প্রবেশপথ।
বন্ধন আর মুক্তি—দুটোই শুরু হয় ‘আমি’ থেকে, কিন্তু মুক্তির জন্য জানতে হবে—তুমি "আমি" নও, বরং তারও আগে—তুমি সে-ই, যার চেতনায় ‘আমি’-ও ভেসে ওঠে, আবার নিঃশব্দে লীনও হয়।
১৭.
“আমি”—জ্ঞানচক্রের আদ্যন্ত কেন্দ্র। জ্ঞানের শুরু ‘আমি’, জ্ঞানের শেষও ‘আমি’। এই একবিন্দু থেকেই প্রসারিত হয় অগণিত ধারণা, এবং সমস্ত বুদ্ধির কুহেলিকা পেরিয়ে ফের সেই এক বিন্দুতেই ফিরে আসতে হয়।
উপনিষদ বলেন, “জ্ঞানং চ জ্ঞেয়ং চ”—জানা ও জানাবার যাত্রা শুরু হয় যেখান থেকে—সে-ই হল ‘আমি’। প্রথম বোধ—“আমি আছি”—এরপরই জন্ম নেয় “আমি জানি”, “আমি বুঝি”, “আমি এই”।
‘আমি’—এই মূল বোধটিকে ভিত্তি করে নির্মিত হয় জ্ঞানের গোলকধাঁধা। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন—নানা ভেদ, নাম, রূপ, সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু সব পথ একবিন্দু থেকেই জন্ম নিয়েছে—আর মুক্তি চাও যদি, তবে সেই বিন্দুতেই ফিরতে হবে।
ফিরে চাও ‘আমি’-তে—ধ্যান দাও এর দিকে, অবিচল মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করো এই অনুভবটিকে; দেখবে, এ ‘আমি’ তো এক অনুভবমাত্র—একটি প্রাথমিক ছায়া, যার উদয় হয়েছে চৈতন্যে।
এবং, যখন তুমি বুঝে ফেলো ‘আমি’-কে, তখন তুমি আর ‘আমি’-র মধ্যেই নও—তুমি হয়ে যাও তার দর্শক, তার অতীত—যতই স্বচ্ছ হয় এই ‘আমি’-র বোধ, ততই গভীর হয় তার থেকে তোমার আলাদা হয়ে পড়া।
উপনিষদ বলেন, "যঃ পশ্যতি স পশ্যতি"—যে দেখে, তাকেই বলা যায় সত্যদ্রষ্টা। আর যে ‘আমি’-কে দেখতে পায়, সে তো আর ‘আমি’ নয়, সে তারও আগে—সে চৈতন্য, সাক্ষী, নিঃরূপ পরম।
সমস্ত জ্ঞান যদি একটি কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে মিলে যায়, তবে সেই কেন্দ্রই তো জ্ঞানাতীত—'আমি’ হলো সেই দ্বার—যেখান থেকে বাইরে গেলে মায়া, আর যার গভীরে ঢুকলে—ব্রহ্ম।
১৮.
“আমি”—প্রথম অজ্ঞান, প্রথম দ্বার। ধ্যান করো ‘আমি আছি’-র উপর, কিন্তু শরীর-মনের হাত ধরে নয়। এই ‘আমি’ বোধটাই প্রথম অজ্ঞান—প্রথম বিভ্রান্তি, যে তোমাকে মায়ার চক্রে টেনে এনেছে বলে তুমি ভাবলে—“আমি দেহ, আমি মন, আমি ব্যক্তি”।
উপনিষদ বলেন, অবিদ্যয়া মৃত্যুম্ তীর্ত্ত্বা”—অবিদ্যা দ্বারা, অর্থাৎ কর্ম, উপাসনা, ইন্দ্রিয়জগতের সাধনা দ্বারা জন্ম ও মৃত্যু-চক্র (সংসার) পার হওয়া যায়—কিন্তু তাতে মুক্তি বা অমৃতলাভ হয় না। “বিদ্যয়া অমৃতম্ অশ্নুতে”—আত্মজ্ঞান বা বিদ্যার দ্বারা পরমাত্মার সঙ্গে ঐক্যলাভ হয়, যা অমৃতত্ব— চিরন্তন অস্তিত্ব—আর সেই অবিদ্যা প্রথম পা ফেলেছিল এই অনুভবে—“আমি আছি”।
এখন তুমি যদি সত্য জানতে চাও, তবে ফিরে চাও এই মূল অনুভবের দিকে—সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করো এই ‘আমি আছি’-র উপর, একে ধ্যান করো, একে পর্যবেক্ষণ করো, কিন্তু তা করতে হবে দেহ-মনকে পাশে সরিয়ে রেখে।
প্রথমে শরীর বাধা দেবে, মন ছুটে যাবে বাইরের দিকে, তারা বলবে—“তুমি তো আমিই!”, “তুমি তো ভাবনাই!”, “তুমি তো দেহ!” কিন্তু তুমি অবিচল থেকো, পুনঃপুনঃ ফিরিয়ে আনো মন সেই মৌন অনুভবের কেন্দ্রে।
‘আমি’ বোধটিই সেই প্রথম দরজা—যা একদিকে মায়ার দিকে যায়, আর ধ্যান ও অন্বেষণের দ্বারা সেটিকেই ব্যবহার করে তুমি যেতে পারো মায়াতীত চৈতন্যে।
মনে রেখো, এই ‘আমি’ বোধটাই তোমাকে ফাঁকি দিয়েছে, এই অনুভবটাই তোমাকে করিয়েছে অবাস্তব বিশ্বাস—“আমি এই”।
অতএব, তাকে ছেড়ো না, তাকে অবলম্বন করো, তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখো, তাকে নিঃস্ব করে দাও। একমাত্র তবেই সে নিজেই পথ খুলে দেবে তার উৎসের দিকে—যেখানে ‘আমি’ নেই, কেবলই ব্রহ্ম।
‘আমি’ বোধই প্রথম ঘুম, আবার সেই ‘আমি’-তেই নিহিত আছে জাগরণের বীজ। আর তাই উপনিষদ স্মরণ করায়—“উত্তিষ্ঠত। জাগ্রত। প্রাপ্য বরান্নিবোধত।”—উঠে দাঁড়াও, জাগো, ‘আমি’-র দ্বার পেরিয়ে চলো নিজের দিকে।
১৯.
তোমার গুরু, তোমার ঈশ্বর—এই ‘আমি আছি’ বোধই। তার আগমনেই শুরু হলো দ্বিত্ব, সৃষ্টি, ক্রিয়া—আগে ছিল নিঃসীম মৌনতা, ছিল কেবল—তুমি, যে ‘আমি’-ও বলে না, ‘তুমি’-ও বলে না—শুধুই ‘আছে’।
“আমি আছি” অনুভবের সঙ্গেই জাগে বিভক্তি—দ্রষ্টা ও দৃশ্য, কর্তা ও কর্ম, জানতে চাওয়া ও জানবার বিষয়। উপনিষদ বলেন, “দ্বিতীয়াৎ বৈ ভয়ং ভবতি”—যেখানে দ্বিতীয় আছে, সেখানেই শুরু হয় ভয়, দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছেদ।
এই ‘আমি’ অনুভবই সেই প্রথম কণা, যা চৈতন্যের স্বচ্ছ জলে তরঙ্গ তোলে, আর সেই তরঙ্গেই শুরু হয় জগত, সময়, সম্পর্ক। অতএব, যদি মুক্তি চাও, তবে অনুসরণ করো এই ‘আমি’-কে, ধ্যান করো তার উপর, চুপ করে তার ওঠা-নামা অনুভব করো।
এবং, যখন তুমি এর গভীরে প্রবেশ করবে, তখনই তুমি বুঝবে—এই ‘আমি’ তো উদিত হয়েছিল তোমার উপরেই, আর তুমি ছিলে তার আগেও, থাকবে তার পরেও—তুমি সেই মৌন সাক্ষী—যে কেবল আছে, থাকে—জানে না, কিন্তু চেতন।
উপনিষদ ঘোষণা করেন—“যেনান জানেন ভূয়সাং জ্ঞানং তেন বিনশ্যতি”—‘আমি’ জ্ঞানও একপ্রকার ভ্রান্তি—তা যত দীর্ঘস্থায়ী হোক, তা একদিন নিঃশেষ হবে।
‘আমি’-র সঙ্গে এসেছিল জগতের নাট্য, কিন্তু তুমি সেই মঞ্চের আলো—‘আমি’ উদিত হবার আগেই যার দীপ্তি ছিল নির্বিকার। তাই 'আমি' নয়, ‘আমি’-র উৎসকে জানো—সেই তুমিকেই জানো।
২০.
“আমি”—মায়ার এক সীমান্তচৌকি। ‘আমি আছি’—এই ধারণাটি মায়ার শেষ প্রহরী—এ-ই হলো শেষ সীমান্ত, সর্বশেষ ছায়া—এটা পার হলেই ব্যক্তিত্বের অবসান, নাম-রূপের অপলাপ। যেমন এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে যাবার সময় পড়ে ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’, তেমনি মায়ার দেশ ছাড়তে গেলে—“আমি”-ই সেই শেষ সীমান্তচৌকি—তার পরেই নেই দেশ, নেই পরিচয়, নেই পথ, নেই পদচিহ্ন।
উপনিষদ বলেন, “নায়ম্ আত্মা প্রবচনেন লভ্যঃ”—এই আত্মা কথায় ধরা যায় না, গমনে পৌঁছানো যায় না—একে কেবল সে-ই পায়, যে নিজেকে মুছে দিতে জানে।
অতএব, নিজেকে স্থিত করো ‘আমি আছি’-র গভীর কেন্দ্রে, থাকো সেই অনুভবে, কিন্তু ছুঁয়ে দেখো না ‘আমি এই’ বা ‘আমি সেই’। কেবল সেই নিঃশব্দ অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে থাকো; দেখবে, তুমি একসময় নিজেই আর ‘ব্যক্তি’ থাকছ না—নাম-রূপ-ইতিহাস ফেলে তুমি লীন হয়ে যাও মৌন অনন্তে।
‘আমি’ বোধই সেই সর্বশেষ দরজা—তাকে ছুঁয়ে থাকো, কিন্তু পেরিয়ে যাও; তাকে আশ্রয় করো, কিন্তু আঁকড়ে ধরো না; কারণ সে-ই শেষ ভ্রম—যার বিলয়ে হয় মুক্তির দিকে পথচলা।
‘আমি’ হলো শেষ পর্দা—তার ওপারে নেই ‘আমি’, নেই ‘তুমি’, নেই পৃথকতা—কেবল থাকে সত্তা—অচিন্ত্য, নিরাকৃতি, বর্ণনাতীত ব্রহ্ম। তাই, ‘আমি’-তে স্থিত হও, আর নিজেই বিলীন হয়ে যাও তোমার পূর্বতন তুমি-তে।