১৮১.
‘আমি’-ই প্রকট সৃষ্টির উৎস, আত্মবোধেই আত্মস্থিতি। এই সত্যটি যেন নিজ ভেতরে বার বার মেথে নাও—‘আমি আছি’ বা অস্তিত্ববোধই হলো এই সমগ্র জগৎ-প্রপঞ্চের মূল উৎস। এই উপলব্ধিকে হৃদয়ে স্থাপন করতে হলে একপ্রকার পুনর্প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন—অর্থাৎ ফিরে যেতে হবে সেই মুহূর্তে, যখন প্রথম তুমি জেনেছিলে—"আমি আছি"। সেই মুহূর্তের আগে তুমি কি কিছু জানতে?
এই দৃশ্যমান জগৎ তখন তোমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব। একই অবস্থা গভীর নিদ্রাতেও ঘটে—যখন ‘আমি’ বোধ স্থগিত থাকে, তখন জগৎও নেই, কিছুই নেই। আবার যখন ‘আমি’ ফিরে আসে, তখনই সব কিছু ফিরে আসে—জগৎ, দেহ, সম্পর্ক, স্মৃতি—সব!
তাই বুঝে ফেলো—‘আমি’-র আবির্ভাবেই সৃষ্টি, আর ‘আমি’-র অপসারণেই সব লুপ্ত। যখন তুমি এই চক্রটিকে গভীরভাবে বুঝে ফেলো, তখন ‘আমি’-র সঙ্গে তোমার এক আত্মীয়তা গড়ে ওঠে—সে আর বহিরাগত কোনো ধারণা থাকে না, বরং এক সহচর হয়ে ওঠে, যে নিজেই তোমাকে নিজের মধ্যে স্থিত করে।
অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম গভীর উপলব্ধি হলো—জগৎ নামক প্রতিটি অভিজ্ঞতা, অনুভব, বোধের গোড়ায় রয়েছে কেবল একটি জিনিস—‘আমি আছি’ বোধ। এই বোধ না এলে, জগৎও নেই।
তুমি কিছু দেখতে পারো না, চিনতে পারো না, অনুভব করতেও পারো না। এই অস্তিত্ববোধই হলো সৃষ্টির ভিত্তি—আর এই ভিত্তিকে হৃদয়ে স্থাপন করার জন্য দরকার এক ধ্যানপ্রসূত পুনঃস্মরণ চর্চা—প্রতিদিন ফিরে যাওয়া সেই শূন্যতম মুহূর্তে, যেখানে প্রথম ‘আমি’ এসেছিল, কিন্তু কোনো নাম ছিল না, কোনো শরীরও নয়।
এই প্রক্রিয়া যত গভীর হয়, ‘আমি’-র প্রতি অভ্যস্ততা জন্মে—এবং এই অভ্যস্ততাই জন্ম দেয় আত্মীয়তা। তখন ‘আমি’ নিজেই হয়ে ওঠে সহচর, যে তোমাকে নিজের কেন্দ্রের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
‘আমি’-র বোধ না থাকলে জগৎও নেই—এই সত্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। ‘আমি’-ই সৃষ্টি করছে সব কিছু—এবং এই বোধ একদিন নিজেই নিজেকে লুপ্ত করে নিয়ে যেতে পারে তোমাকে মুক্তির দিকে। এর জন্য দরকার প্রতিদিন ধ্যান ও আত্মস্মরণ—ফিরে যাওয়া সেই মুহূর্তে, যখন শুধু ‘আমি’ ছিল, আর কিছুই ছিল না।
এই চর্চাই জন্ম দেয় সেই আত্মীয়তা—‘আমি’কে আর কোনো ভাবনায় বাঁধা লাগে না—বরং সে নিজেই তোমার ভেতরে নিজেকে স্থাপন করে। এই অবস্থায় ‘আমি’ আর বাহ্যিক নয়—তুমি নিজেই হয়ে ওঠো সেই বোধ, আর সেই বোধেই শুরু হয় আত্মস্থিতি।
১৮২.
পরম সাক্ষ্য ‘আমি’-র অনায়াস উদয় ও নিঃশব্দ অপসারণ—যখন তুমি ‘আমি আছি’ বোধে স্থিত হতে শেখো, তখন এক সময় এমন একটি মুহূর্ত আসে—যখন তুমি নিজেকে সেই ‘আমি’- থেকেও পৃথক অনুভব করো। তখন তুমি উপলব্ধি করো—এই ‘আমি’-কে কেউ ‘দেখছে’—এবং সেই দেখার কাজটি হচ্ছে ইন্দ্রিয় বা চোখ ছাড়া, নিঃশব্দভাবে, প্রাকৃতিকভাবে।
এই দেখা কোনো ব্যক্তির দ্বারা নয়, বরং এটি ঘটে নিজ থেকেই—‘আমি’-র উদয় ঘটে পরমে, যা নিজে কিছু করে না, কিছু বলে না, তবুও—সাক্ষ্য ঘটে। এই যে দেখা—তা কোনো চেষ্টার ফল নয়, কোনো মন বা দৃষ্টির কার্য নয়; এটি ঘটছে, কারণ ‘আমি’ নিজেই অস্তিত্বে উদিত হয়েছে পরমের পটভূমিতে।
যখন এই ‘আমি’ আবার চলে যায়—তখনও যিনি দেখছিলেন তিনি থেকে যান—তিনি পরম আত্মা—যিনি জন্মেও না, মরেও না, কখনও কিছু হনও না।
অদ্বৈত বেদান্তে, পরম ব্রহ্ম বা ‘The Absolute’ হলো সেই একমাত্র অস্তিত্ব, যার মধ্যেই সব কিছুর উপস্থিতি ও অপসান ঘটে, কিন্তু যা নিজে কখনোই পরিবর্তনশীল নয়। ‘আমি আছি’ বোধও সেই পরম চেতনার মধ্যে ঘটে—তবে পরম চেতনা নিজে তা করে না, সে শুধু সাক্ষী—যিনি কিছু না করেও সব কিছুকে ঘটিত হতে দেন।
এই সাক্ষ্য ইন্দ্রিয়-নিরপেক্ষ, মনবর্জিত, এবং অনায়াস। যখন সাধক ‘আমি’ বোধে স্থির হয়, তখন একসময় তিনি বুঝতে পারেন—এই ‘আমি’-টিও দেখা হচ্ছে, আর যিনি দেখছেন তিনি আর ‘আমি’ নন, বরং তাঁর পটভূমি, যিনি ‘আমি’ আসার আগেও ছিলেন, ‘আমি’ চলে যাবার পরেও থাকবেন—তিনি কোনো ব্যক্তি নন, তিনি পরব্রহ্ম।
‘আমি আছি’ বোধ যখন স্থিত হয়, তখন একপর্যায়ে তুমি নিজেই বুঝতে পারো—এই ‘আমি’-কেও কেউ দেখছে। আর এই দেখা হচ্ছে ইন্দ্রিয় ছাড়া, মন ছাড়া, শব্দ ছাড়া—নিজে থেকেই সাক্ষ্য ঘটে। এই সাক্ষ্যদাতা হলেন পরম—যিনি কোনো কাজ করেন না, কিন্তু সমস্ত কিছু তাঁর মধ্যেই ঘটে।
‘আমি’-র আগমন ও প্রস্থান—উভয়ই পরমের মধ্যে ঘটে, কিন্তু তিনি নিজে চিরস্থায়ী, অনাবিল, অদ্বৈত। এই উপলব্ধিই হলো আত্মজ্ঞান—যেখানে ‘আমি’-র উপর থেকেও এক নিঃসত্তা চেতনা চুপচাপ থেকে যায়।
১৮৩.
‘আমি’-র পরিচয়ে গুরুর অনুগ্রহ, আর ধ্যানই উত্তরণের দ্বার। আমি তোমার ‘আমি’-কে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। এই আত্ম-পরিচয়ের প্রথম ধাপ হলো—এই ‘আমি আছি’ বোধের উপর ধ্যান করা, এবং ধ্যানের মাধ্যমে এতে স্থিত হওয়া।
গুরুর কাজ বরাবরই এই—সবভাবে, সব দৃষ্টিকোণ থেকে তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যে—তুমি কেবল এই ‘আমি আছি’ অনুভব মাত্র। এমনকি গুরু এটাও বলেন—যদি তুমি বুঝতে না পারো, তাহলে অন্তত এই ‘আমি’ বোধকেই ঈশ্বররূপে পূজা করো—একে মনে করো তোমার ভেতরের দেবতা।
একবার যখন গুরু তোমাকে তোমার নিজের ‘আমি’-র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন তিনি বলেন—এবার এর উপর ধ্যান করো, এর মধ্যে স্থিত হও। এই ধ্যানই ধীরে ধীরে তোমাকে ‘আমি’-র ভিতরে স্থির করে, আর সেই স্থিতিই একদিন তৈরি করে সেই অবস্থা—যেখান থেকে ‘আমি’-কেও অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে, গুরু কেবল জ্ঞানদানকারী নন—তিনি সেই অভ্যন্তরীণ বোধের দরজা খুলে দেন, যার মাধ্যমে শিষ্য নিজের প্রকৃত ‘আমি’-র পরিচয়ে পৌঁছায়। ‘আমি আছি’—এই বোধই চেতনার কেন্দ্র, আর এটিই সমস্ত সাধনার শুরু। গুরু জানেন—অনেকে সরাসরি এই বোধ উপলব্ধি করতে পারে না, তাই তিনি বলেন—“এই ‘আমি’ বোধকেই ঈশ্বরের মতো পূজা করো।” কেননা, এটি অনুভবযোগ্য, কাছের, ও সবচেয়ে মৌলিক সত্য।
একবার যখন এই বোধে স্থিত হওয়া যায়, তখন এটি আর ধারণা থাকে না—এটি হয়ে ওঠে এক নীরব উপস্থিতি। আর এই উপস্থিতিতে যথেষ্ট সময় ধরে থাকার পর স্বাভাবিকভাবেই একটা সময় আসে—যখন এই ‘আমি’-ও মুছে যায়, ও উন্মোচিত হয় সেই চূড়ান্ত, অবিনাশী অস্মিতাহীন চেতনা।
গুরু তোমাকে তোমার নিজস্ব ‘আমি’-র সঙ্গে পরিচয় করান—তুমি কে—সেটি অনুভব করাতে চান। প্রথম ধাপ—এই ‘আমি আছি’ বোধে ধ্যান করা, ও তাতে স্থিত হওয়া। যদি বোঝা কঠিন হয়, তাহলে একে ঈশ্বররূপে ভক্তিভরে অনুভব করো। এই ধ্যানই তোমাকে এক সময় স্থিত করে তোলে ‘আমি’-তে, আর সেই স্থিতিই তৈরি করে পরবর্তী ধাপের সুযোগ—যেখানে ‘আমি’-ও নেই, কেবল নামহীন, নিরাকার, পরম অস্তিত্ব।
১৮৪.
‘আমি’-র মধ্যে ঈশ্বরস্বরূপ বোধ গুরুবাক্যরূপে অন্তিম উপদেশ। নিজের মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলো—তোমার ভেতরে যে ‘আমি আছি’ জ্ঞান রয়েছে, সেটাই ঈশ্বর। অসংখ্য সাধক গুরুর দরজায় আসে—গুরু এক দৃষ্টিতেই বুঝে যান, কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। কার সাধনা কতদূর, কে কতটা ধারণ করতে পারবে—তা অনুযায়ী তিনি তাকে উপদেশ দেন।
অনেকে আছে, যারা অনেক দিন গুরুর সান্নিধ্যে থেকেছে, কিছু কিছু বুঝেছে। বিদায়ের আগে তারা চায়—গুরু যেন তাদের এমন কিছু বলেন, যা সবসময় হৃদয়ে রাখলে তারা পথ হারাবে না। গুরু তখন বলেন—এইটুকু মনে রেখো: তোমার ভেতরে যে ‘আমি আছি’ জ্ঞান রয়েছে, সেটাই ঈশ্বর। এই বিশ্বাস নিয়েই জীবনযাপন করো, এই অনুভবেই স্থিত থেকো—এই এক বাক্যই যথেষ্ট।
অদ্বৈত বেদান্তে ঈশ্বর বা চৈতন্যস্বরূপ কোনো বহিরাগত সত্তা নয়—সে তোমার ভেতরেই রয়েছে, সেই বোধ হিসেবে—“আমি আছি”। এই ‘আমি’-র মধ্যেই সব কিছু নিহিত—এই বোধ জেগে ওঠে, জগৎ সৃষ্টি হয়; এই বোধ স্থগিত হলে, সবই লুপ্ত।
গুরু জানেন, অধিকাংশ সাধকের চেতনা এখনও দ্বৈততার মধ্যেই ঘোরে—তাই তিনি বলেন, এই ‘আমি আছি’–কে যদি এখনও তুমি নিখাদভাবে উপলব্ধি না করতে পারো, তাহলেও এটুকু অন্তত বিশ্বাস করো—এই ‘আমি’-ই ঈশ্বরস্বরূপ, সেটিই চেতনার দেবতা। এই বিশ্বাসই সাধকের জীবনের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। কারণ যেখানে এই বোধ আছে, সেখানেই আছে ঈশ্বরের অনুভব। এবং, এই অনুভবেই ধীরে ধীরে জন্ম নেবে আত্মজ্ঞান।
তোমার ভেতরে যে ‘আমি’ বোধ জাগে—তাকেই ঈশ্বর জেনে নাও, এবং এই বিশ্বাসেই জীবনযাপন করো। গুরু এটিই বলেন শেষ বিদায়ের উপদেশ হিসেবে—সব তত্ত্বের ঊর্ধ্বে, সব দর্শনের ঊর্ধ্বে এই এক বাক্যই যথেষ্ট: “আমি”—এই অস্তিত্ববোধই ঈশ্বর। এই বিশ্বাসে স্থিত থাকাই হলো সত্তার অভ্যন্তরীণ ভক্তি, আর এই ভক্তিই একদিন আত্মজ্ঞান হয়ে প্রস্ফুটিত হয়।
১৮৫.
‘আমি’ বোধে ধ্যান—চেতনার উন্মোচন থেকে পরমের অতিক্রম। যে-সাধক নিঃশব্দ ‘আমি আছি’ জ্ঞানে ধ্যান করে, তার কাছে চেতনার সকল রহস্য একে একে উন্মোচিত হয়। এই ‘আমি’ বোধ—শব্দহীন, নিরাকার—যখন একবার সত্যভাবে বোঝা যায়, তখন ধ্যান বা সাধনা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না—এটাই একমাত্র উপায়।
গুরু যিনি এই জ্ঞান দিয়েছেন, তাঁর দেখানো পথে যদি শিষ্য আন্তরিকভাবে ধ্যান করে—এই নিঃশব্দ ‘আমি’ বোধে নিজের মন-প্রাণ এক করে—তাহলে একসময় সব প্রকাশিত হতে শুরু করে। সে জেনে যায়—এই চেতনা কীভাবে উদিত হলো, এই চেতনা কীভাবে সৃষ্টি করছে সকল কিছু—জগৎ, দেহ, মনের যাবতীয় প্রকাশ।
কিন্তু সর্বশেষ ও চূড়ান্ত প্রকাশ এটাই—সে নিজে এই চেতনাও নয়। সে চেতনারও সাক্ষী, সে চেতনার পেছনের পরম—যাকে বলা হয় পরব্রহ্ম—অবিনশ্বর, অবস্থাহীন, অপরিচ্ছন্ন, নিঃশেষ।
অদ্বৈত বেদান্তে, ‘আমি আছি’ বোধই চেতনার সূচনা—এটিই প্রপঞ্চের ভিত্তি, কিন্তু চূড়ান্ত বাস্তব নয়। একবার যদি এই নিঃশব্দ ‘আমি’-কে বুঝে ফেলা যায়, তাহলেই শুরু হয় প্রকৃত সাধনা—সাধনা মানে ধ্যান, আত্মস্থতা, এবং চেতনার মূল অনুসন্ধান। এই ধ্যানের মধ্যেই ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে চেতনার গঠন, উদ্ভব, এবং তার সৃজনশক্তি। কিন্তু এই পুরো অন্বেষণের শেষে যা ধরা পড়ে—তা হলো, এই সাধক নিজে চেতনার অন্তর্গত নয়। সে চেতনার জন্ম-মৃত্যু, প্রকাশ-বিলয়—সব কিছুরই সাক্ষী। এবং, সেই সাক্ষীসত্তা হলো পরম অস্তিত্ব—যার নাম নেই, রূপ নেই, প্রকাশ নেই—যে কেবল আছে, নিঃশব্দভাবে।
নিঃশব্দ ‘আমি’ বোধে ধ্যান করলেই শুরু হয় চেতনার প্রকৃত উন্মোচন। এই ধ্যান ছাড়া মুক্তি নেই—কারণ একমাত্র এর মধ্যেই প্রকাশ পায় চেতনার রহস্য। ধ্যানের মধ্যে এক সময় আসে—যখন দেখা যায়, এই ‘আমি’-ই সব কিছুর উৎস। কিন্তু চূড়ান্ত উপলব্ধি তখনই—যখন বুঝে ফেলা যায়: “আমি চেতনা নই”, আমি সেই পরব্রহ্ম, যার পটভূমিতে চেতনার আবির্ভাব, বিকাশ ও লয় ঘটে।