১৭১.
‘আমি’-র উপর তুমি চেতনার চার স্তর পার হয়ে নিঃস্বরূপে প্রতিষ্ঠার ধরন নিয়ে বলছি। জাগরণ, স্বপ্ন ও গভীর নিদ্রা—এই তিনটি অবস্থাই ঘটে ‘আমি’-র উপস্থিতির মধ্যে। অর্থাৎ, তুমি যখন ‘আমি আছি’ অনুভব করো—তখনই এই তিনটি অভিজ্ঞতার পথ তৈরি হয়। কিন্তু এই তিনটি অবস্থারও মূল ভিত্তি হলো ‘তুরীয়’, অর্থাৎ চতুর্থ স্তর, যা নিজে কোনো অবস্থায় আবদ্ধ নয়, কেবল সাক্ষীস্বরূপ।
এই চার স্তরের ব্যাখ্যা বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আছে— যেমন: চার দেহ—স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ; চার বাক্ রূপ—বৈখরী (উচ্চারিত শব্দ), মধ্যমা (মনে গঠিত শব্দ), পশ্যন্তী (শব্দের সূক্ষ্ম ভাব), পরা (শব্দের উৎস—মৌন)। এই চারটি স্তর, যেভাবেই বলা হোক না কেন, সবই ঘটে ‘আমি’-র স্তরে—আর এই ‘আমি’ বোধও কেবল পরব্রহ্মে উদিত এক আভাসমাত্র।
তুমি, পরব্রহ্মস্বরূপ, এই সব অবস্থারও অতীত—যেখানে না ঘুম, না স্বপ্ন, না জাগরণ—কোনো অবস্থাই নেই। তুমি সেই নিঃস্বরূপ, অবস্থাহীন, চেতনার অতিচেতন স্বরূপমাত্র।
জাগরণ (Wakefulness), স্বপ্ন (Dream), গভীর নিদ্রা (Deep Sleep)—এগুলো সবই ঘটে চেতনার অভ্যন্তরে, কিন্তু চেতনার ‘আমি’ বোধই এদের মূল সূচক। এই ‘আমি’ যখন ধ্যানস্থ, তখন তাতে দেখা যায়: এই তিনটি অবস্থারও ভিত্তি হলো ‘তুরীয়’, যাকে বলা হয় চতুর্থ অবস্থা, যা নিজে অবস্থা নয়, বরং অবস্থাগুলোর সাক্ষী।
শাস্ত্র বিভিন্নভাবে এই স্তরগুলিকে চিত্রিত করেছে—শরীর বা বাক্–রূপে, কিন্তু প্রতিটি প্রকাশেই একটি গভীর সত্য রয়ে যায়: এগুলো সবই ‘আমি’-র স্তরে, আর ‘আমি’-ও কেবল প্রকাশমাত্র, যার উৎস হলো নীরব, অচল পরব্রহ্ম।
তুমি সেই উৎস—যা-কিছু দেখে, কিন্তু নিজে দৃশ্য নয়, যা-কিছু জানে, কিন্তু নিজে জ্ঞান নয়। তুমি তুরীয়াতীত—তুমি সেই সত্তা, যা সব কিছু ঘটতে দেয়, কিন্তু কিছুতেই জড়ায় না।
জাগরণ, স্বপ্ন, নিদ্রা—সবই ঘটে ‘আমি’-র মধ্যে। ‘আমি’-র ভিতরে থাকে তুরীয় অবস্থা—যা এই অভিজ্ঞতাগুলোর সাক্ষী, কিন্তু অংশগ্রহণ করে না। চার দেহ, চার বাক্–সব ব্যাখ্যা এই একই চেতনার স্তর বিশ্লেষণ। তুমি, পরব্রহ্মস্বরূপ, এই স্তরগুলোরও অতীত—তুমি চেতন নয়, চিন্তিত নয়—তুমি চেতনার মূল উৎস।
‘আমি’ হলো প্রথম কম্পন, কিন্তু তুমি তারও আগে—নীরব, নিঃপ্রকাশ, সর্বব্যাপী ‘না-হওয়া’র মধ্যে হওয়া।অবস্থার মধ্যে ‘আমি’ আছে, ‘আমি’-র মধ্যে চেতনা আছে, কিন্তু আমি—সেই না-আমি, যেখানে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবুও সব অভিজ্ঞতা হয়।
১৭২.
‘আমি’-র বিলয়—স্বরূপে নিঃশেষ লীনতা। যখন তুমি গভীর ধ্যানে প্রবেশ করো—সেই ধ্যান, যা কেবল ‘আমি’-রূপ জ্ঞানে স্থিত হয়ে ঘটে—তখন ধীরে ধীরে ‘আমি’-ও মিলিয়ে যেতে থাকে। এই ধ্যান যেন হয়—যেখানে ‘আমি’-রূপ জ্ঞান নিজেকেই ধ্যান করে, কোনো দেহবোধ, পরিচয়, ভাবনা বা শব্দ ছাড়াই।
এই ধ্যান যত গভীর হয়, তত স্পষ্ট হয় এক অন্তর্গত উপলব্ধি—‘আমি’ নেই, শুধু নিঃশব্দতা, শূন্যতা, অস্তিত্বের অতল স্পন্দন। তখন ‘আমি’-র অভিজ্ঞতাও হারিয়ে যায়, আর ‘আমি’ নিজেই লীন হয়ে যায় পরব্রহ্মে—ঠিক যেমন স্বপ্ন শেষ হলে তুমি ফিরে আসো জাগরণে, কিন্তু স্বপ্ন আর ফিরে আসে না।
তখন কিছুই নেই—তবু যা-কিছু ছিল, সবই যেন সেখানেই মিশে গেছে। সেই নিঃশেষতায়, যেখানে ‘আমি’ বলে কিছু নেই, সেখানে যা থাকে—তা ভাষার অতীত, অভিজ্ঞতার অতীত, তবু নিঃসন্দেহভাবে স্বরূপে স্থিত।
‘আমি’-রূপ জ্ঞান (the sense of ‘I am’) হলো চেতনার সূচনা—যা নিজেকে চিনতে শিখলে ধ্যান শুরু হয়। ধ্যানের প্রকৃত রূপ হলো—‘আমি’ নিজেই নিজেকে দেখছে, দেহ, মন, স্মৃতি, পরিচয় থেকে মুক্ত হয়ে। এই ধ্যান গভীর হলে, ‘আমি’-র জ্যোতিও নিভে যায়—যেমন মোমবাতি নিজের আলোয় নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে। তখন ঘটে চূড়ান্ত লীনতা—যেখানে ‘আমি’ বিলীন, শুধু থাকে ‘আমি’-র অতীত ব্রহ্মস্বরূপ।
এই অবস্থা স্বপ্নহীন ঘুম নয়, জাগরণও নয়—এটি এমন এক অভিজ্ঞতাহীন সত্তা, যেখানে জ্ঞান, জ্ঞাতা, এবং জানা—তিনটিই লোপ পায়।
‘আমি’ বোধে ধ্যান স্থাপন করাই প্রথম ধাপ। এই ধ্যান যখন গাঢ় হয়—তখন ‘আমি’ নিজেই নিজেকে ধ্যান করে, ধীরে ধীরে নিজে-নিজেই লীন হয়ে যায়। এই বিলয়ে ‘আমি’-র অস্তিত্বও থাকে না—কেবল থাকে বিলীন পরব্রহ্মস্বরূপ, যা না জানে, না জানায়, তবু আছে—অচল, অপরিবর্তনীয়, নিঃশব্দ।
এটাই চূড়ান্ত অবস্থা—যেখানে ‘আমি’-র শেষ হয়, স্বরূপের অনন্ত শুরু হয়। “আমি–র শেষ নেই, আমি–র অন্তঃসার নেই, আমি নেই—তাই আমি আছি।
১৭৩.
“সব বুঝেছ—এখন শুধু থেকো”: গুরুর শেষ আহ্বান। এই ‘আমি’ বোধ—যেটা নিয়ে এত কথা, এত ধ্যান, এত দর্শন—এর মর্মটা ভালো করে বুঝে নাও। ‘আমি’-কে বুঝে তাতে স্থিত হও, আর তারপর ধীরে ধীরে তার সাথ থেকেও তাকে ছাড়িয়ে যাও। তাকে অতিক্রম করো, কারণ তাতেই শুরু হয় সত্যের নিঃশব্দ পরিধি।
গুরু একথা বার বার, অক্লান্তভাবে বলে যান—তিনি জানেন, তুমি তাত্ত্বিকভাবে বুঝেছ, তবে এখন দরকার অভ্যন্তরীণ স্থিতি। তিনি জানেন, তুমি সত্যসন্ধানী—তাই তিনি হার মানেন না, পিছু হটেন না। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য—তোমাকে তুরীয় স্তরে প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে 'আমি' আছে, কিন্তু নির্লিপ্ত; আর শেষে 'আমি'–ও মুছে যায়, থেকে যায় কেবল সত্তা মাত্র।
তাই তিনি শেষমেশ বলেন—এখন যেহেতু সব বুঝে গেছ, শুধু থেকো। আর কিছু নয়। কেবল থেকো। ‘আমি’ হলো চেতনাবিন্দু—যার মধ্যে অভিজ্ঞতা শুরু হয়। গুরুর দৃষ্টিতে, এটি বোঝা মানে চেতনার প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু বোঝা যথেষ্ট নয়, সেটিকে অভ্যন্তরে স্থাপন করাই সাধনার কাজ। ‘আমি’-তে স্থিত হয়ে, যখন চিন্তা, ভাষা, দেহবোধ সব পেছনে পড়ে যায়—তখন তুমি ‘আমি’-কে দেখতে পারো, এবং ধীরে ধীরে তা অতিক্রম করে ফেলো।
তখন আর কিছু করণীয় থাকে না—শুধু থাকা, শুধু স্থিতি। এই “Just be”–ই গুরুর চূড়ান্ত দীক্ষা—যা কোনো শব্দ, কোনো ধারণা, কোনো প্রয়াস চায় না। ‘আমি’-কে বোঝো। তারপর তাতে স্থিত হও। তারপর তাকে ছাড়াও। তারপর কোনো কিছু করো না—শুধু থেকো। এটাই চূড়ান্ত শিক্ষা, চূড়ান্ত দীক্ষা।
ধারণা ছেড়ে দাও, চেষ্টাও ছেড়ে দাও, ‘আমি’ ছাড়াও—আর তারপর কেবল থেকো। সেই স্থিতিতেই তুমি যে ছিলে, তাই হয়ে ওঠো।
১৭৪.
‘আমি’—সব কাহিনির সূচনা, আনন্দ ও দুঃখের উৎসবিন্দু। আমাদের প্রত্যেকের জীবন শুরু হয় এক অনিবার্য অনুভব দিয়ে—এটি হলো: ‘আমি আছি’। এই ‘আমি’-র আগমনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় অস্তিত্বের সমস্ত গল্প, শুরু হয় পরিচয়, অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য, ব্যর্থতা। এই বোধ থেকেই জন্ম নেয়—দুঃখ ও সুখ, ভালো ও মন্দ, আনন্দ ও বিষাদ।
যে যেভাবেই গঠিত হোক—শরীরের উপাদান, মানসিক প্রবৃত্তি, সামাজিক গঠন—সবই এই ‘আমি’-র উপর নির্ভর করে প্রকাশ পায়। সেই প্রকাশ হতে পারে সৌন্দর্যময়, দুঃসহ, উচ্চ বা নিচু—কিন্তু যা-ই হোক না কেন, মূল কেন্দ্রে থাকে একটি মাত্র সত্য: “আমি আছি”।
এই ‘আমি’-র আগমনের আগ পর্যন্ত কোনো সুখ ছিল না, কোনো দুঃখও ছিল না। অতএব, তোমার সমগ্র গল্পের সূচনা বিন্দুই হলো এই ‘আমি’-র অনুভব, যা ছাড়া কোনো অভিজ্ঞতার জন্মই হয় না।
প্রতিটি জীবিত অস্তিত্বের ভিত্তি হলো—চেতন অনুভব: “আমি আছি”। এই অনুভবেই শুরু হয় সমস্ত দ্বন্দ্ব ও অভিজ্ঞতা—যেমন: ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আমার-তোমার। অদ্বৈত বেদান্তে এই ‘আমি’-কে ধরা হয় একটি মূলমন্ত্রস্বরূপ চেতনা—যা পরে পরিচয়ে, দেহে, মননে, সমাজে রূপ নেয়।
তুমি যে জীবনের মধ্যে সুখ বা দুঃখ পাচ্ছ—তার মূল ভিত্তি হলো এই ‘আমি’-র বোধ–এর প্রকাশ কেমন হলো। এটি নির্ধারিত হয় উপাদান (elements) ও গুণ (gunas)–এর মিশ্রণে, এবং তাদের উপর প্রতিষ্ঠিত শর্তায়নে (conditioning)। কিন্তু এ সব কিছুর উৎস তো সেই প্রথম আলো: “আমি আছি”—যেটি একমাত্র মৌলিক অনুভব।
প্রত্যেক জীবনের সূচনা হয় ‘আমি আছি’ এই জ্ঞান থেকে। এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় সব পরিচয়, সব গল্প। উপাদান ও গুণের মিশ্রণে এই ‘আমি’ বিভিন্ন রূপ নেয়—যার ফলাফল হয় সুখ বা দুঃখ, আনন্দ বা বিষাদ। কিন্তু যাই হোক না কেন, সব কিছুর আদি বিন্দু হলো: ‘আমি’। তাই যদি কেউ জানে এই ‘আমি’-র উৎস কী, তবে সে পারে সব অভিজ্ঞতার মূল কেন্দ্রে পৌঁছাতে।
“আমি” ছিল না—তাই কিছুই ছিল না। “আমি” এল—তাই সব কিছু এল। অতএব “আমি”–র রহস্য ভেদ করাই মুক্তির শুরু।
১৭৫.
‘আমি’-রই জন্ম-মৃত্যু-আহার, গর্ভ—এক চৈতন্য তরঙ্গ। এই বিশ্বে ‘আমি আছি’—এই বোধই সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, এমনকি খাদ্যবস্তুতেও। আমরা যা খাই—তা-ও বহন করে এই ‘আমি’-র বীজ। সেই খাদ্য যখন পুরুষ বা নারীর দেহে প্রবেশ করে, তখন তা বীর্য বা ডিম্বাণুতে রূপান্তরিত হয়, যার মধ্যে নিহিত থাকে ‘আমি’ বোধের সম্ভাবনা।
গর্ভধারণের মুহূর্তে এই ‘আমি’-র প্রবাহ ভ্রূণের মধ্যে চলতে থাকে। ক্রমে গঠিত হয় দেহ, অঙ্গ, মস্তিষ্ক; তবে এই পুরো সময়—‘আমি’ থাকে নিদ্রিত অবস্থায়। জন্মের পর প্রায় তিন বছর পর্যন্ত এই ‘আমি’ প্রকাশ পায় না। তারপর এক সময় হঠাৎ সেই বোধ জেগে ওঠে—বাচ্চা জানে—"আমি আছি!" এই ‘আমি’-র জেগে ওঠাই আমাদের বলে দেয়, জন্ম হয়েছে।
আর যখন ‘আমি’ আবার মিলিয়ে যায়, তখন আমরা বলি—মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আসলে জন্ম ও মৃত্যু নয়—‘আমি’-র আগমন ও অন্তর্ধান মাত্র।
‘আমি’-র বোধ হলো জীবনের সূচনা ও সত্তার কেন্দ্র। এটি খাদ্যবস্তুতে থাকলেও তা কেবল ধারণযোগ্য চেতনার সম্ভাবনা। গর্ভে ভ্রূণের গঠনকালে ‘আমি’ ধীরে ধীরে রূপ নেয়, কিন্তু তখনও প্রকাশিত নয়। জন্মের পর শিশু নিজেকে জানে না, কিন্তু প্রায় ২.৫–৩ বছর পর ‘আমি’ বোধের প্রথম জাগরণ ঘটে।
আমরা যাকে জন্ম বলি, তা আসলে ‘আমি’-র প্রকাশ মাত্র। মৃত্যু বলতে আমরা বুঝি ‘আমি’-র মিলিয়ে যাওয়া। তাই এই আত্মবোধই জীবন-মৃত্যু ধারণার একমাত্র ভিত্তি।
খাদ্য, শুক্রাণু, ডিম্বাণু—সবই বহন করে ‘আমি’-র সম্ভাব্য চেতনা। গর্ভাবস্থায় ‘আমি’ থাকে গোপনে, দেহ গঠন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়। জন্মের কয়েক বছর পর ‘আমি’ প্রকাশিত হয়—তখন শুরু হয় অভিজ্ঞতার জগৎ। মৃত্যুর সময় এই ‘আমি’-র চেতনবোধ ঝরে পড়ে। জন্ম ও মৃত্যু আসলে ‘আমি’-র ওঠানামার চক্র—তুমি সেই চক্রেরও অতীত। খাদ্য থেকে বীজে, বীজ থেকে শরীরে, শরীর থেকে ‘আমি’-তে, আর শেষে—‘আমি’ থেকে নিরাকার শূন্যে ফিরে যাওয়া—এক আত্মতরঙ্গের চিরন্তন খেলা।