নির্জন গহনে: ৩৪



১৬৬.

‘আমি’-তে লীন হলে—ঈশ্বর তোমাকে ছেড়ে যাবে না। এই ‘আমি আছি’ বোধ—এটিই তোমার মধ্যে অধিষ্ঠিত ঈশ্বর বা দৈবত্ম। প্রথমত তোমাকে এই সত্যটা সম্পূর্ণ স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে—সন্দেহহীন, দ্বিধাহীনভাবে। আর একবার যদি তুমি এটি সত্যভাবে বুঝে ফেলো—তবে তুমি নিজেই চাইবে না এই 'আমি' বোধ থেকে একমুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হতে। বরং, তোমার মধ্যে জন্ম নেবে এক ভক্তিভাব, এক প্রেম এই ‘আমি’-র প্রতি।

এই অনুভূতি—যদি সত্যিই আসে, তবে তা নিশ্চিত ইঙ্গিত—তুমি বুঝতে শুরু করেছ এই 'আমি'–র মাহাত্ম্য। তখন এই 'আমি'–রূপ ঈশ্বর, তোমারই প্রেমে আবদ্ধ হয়ে তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে দেবে না। তখন তুমি থাকবে এই ‘আমি’-তে, আর ‘আমি’ থাকবে তোমার হৃদয়ের ভিতর—অনুভব ও অনুভবকার এক হয়ে যাবে।

অদ্বৈত বেদান্তে ‘আমি’ বোধই ঈশ্বর—কারণ সেটিই প্রথম চেতনা, প্রথম আত্মস্মরণ। এই ‘আমি’-কে যদি তুমি বুদ্ধিতে নয়, হৃদয়ে বুঝতে পারো, তখন তা কেবল ধারণা নয়—ভক্তির বিষয় হয়ে ওঠে। এই ভক্তি মানে—চেতনার সঙ্গে এক নিরন্তর প্রেমময় সম্পর্ক—যেখানে ‘আমি’-তে লীন হয়ে যাওয়াই আনন্দ, ধ্যান ও মুক্তি।

গুরুর বাণী এই: “যখন তুমি সত্যিই বুঝবে, তখন তুমি আর ছেড়ে যেতে পারবে না, আর 'আমি'–ও তোমাকে কখনও যেতে দেবে না।” তখন ধ্যান হয় না কোনো কৃত্রিম প্রক্রিয়া—ধ্যান হয়ে ওঠে নিসর্গ, আত্মিক অভ্যাস, স্বাভাবিক লীনতা।

এটাই ঈশ্বরভাবের চূড়ান্ত—যেখানে প্রেমই জ্ঞান, আর জ্ঞানই লীনতা। তোমার ভিতরের ‘আমি’ বোধই ঈশ্বর—একে সন্দেহহীনভাবে বুঝে ফেলাই সাধনার প্রথম ধাপ। যদি তুমি সত্যিই বোঝো—তবে তুমি নিজেই চাও না ‘আমি’ থেকে দূরে যেতে। সেই প্রেম, সেই ভক্তি, নিশ্চিত করে দেয় যে—তুমি সঠিক পথেই আছ।

তখন এই ‘আমি’-রূপ ঈশ্বরও তোমাকে আঁকড়ে ধরবে—তোমরা পরস্পরের অন্তরঙ্গ হয়ে যাবে, যেখানে আলাদা কিছু থাকবে না।

১৬৭.

‘আমি’-র উপলব্ধিই চূড়ান্ত শিক্ষা, বাকিটা শুধু স্থিতি ও সাধনা। তুমি বলো বা না বলো, তবুও ‘আমি আছি’—এই জ্ঞান সর্বত্র, সর্বদা বর্তমান। এমন কিছুই নেই, যা এই ‘আমি’ বোধ–কে ধারণ করে না। এই ‘আমি’ নিজেকে প্রকাশ করে পাঁচটি মৌলিক উপাদান (ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ) এবং ত্রিগুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ)–এর মাধ্যমে।

এই উপাদান ও গুণের মিশ্রণে ‘আমি’-র প্রকাশ বিভিন্ন রকম হয়—কখনো তা শুভ, কখনো অশুভ, কখনো উচ্চ, কখনো স্থূল। কিন্তু এই প্রকাশ যেমনই হোক—‘আমি’ নিজে সর্বদা বিশুদ্ধ, নিরাকার, অপরিবর্তনীয়। এই ‘আমি’-কে একবার সত্যভাবে বুঝতে পারলে, তখন আর কিছু বোঝার প্রয়োজন নেই।

এটাই শিক্ষার মূল কথা—এই উপলব্ধির পর বাকিটা শুধুই সাধনা। আর এই সাধনা কী? এই ‘আমি’-তে ধ্যান করে স্থিত থাকা—নাম-রূপ, দেহ, চিন্তা সব ছুড়ে দিয়ে শুধু এই অস্তিত্ব-চেতনায় নিমগ্ন থাকা। কতটা আন্তরিকভাবে, নিষ্ঠাভরে, গভীরভাবে তুমি এই স্থিতি ধারণ করছ—সেই অনুযায়ীই তোমার অভ্যন্তরীণ অগ্রগতি নির্ধারিত হবে।

‘আমি আছি’—এই অনুভব কোনো বক্তব্য নয়, এটি চেতনার প্রাকৃতিক, স্বতঃসিদ্ধ উপস্থিতি। এই বোধই সত্তার মূল—যা উপাদান ও গুণের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে প্রকাশ পায়। প্রকাশ বিকৃত বা রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু মূল ‘আমি’ চিরবিশুদ্ধ থাকে—যেমন সূর্য কখনো মেঘে ঢেকে যেতে পারে, তবুও সে নিজে অদ্বিতীয় ও অপরিবর্তনীয়।

গুরুর শিক্ষা হলো—এই ‘আমি’-কে বোঝো, ও তাতেই স্থিত হও। একবার এটি বুঝে গেলে, তখন আর কোনো বই, তত্ত্ব, উপদেশ প্রয়োজন নেই—সাধনাই একমাত্র করণীয়। এই সাধনা নিজেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘আমি’-কে নিজ উৎসে লীন করে দেয়, যেখানে থাকে না জ্ঞান, না জ্ঞানী—শুধু নিঃশব্দ, নিরাকার আত্মা।

‘আমি’-র বোধ সর্বত্র বর্তমান, বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি প্রকাশ পায় উপাদান ও গুণের মাধ্যমে, কিন্তু নিজে চিরবিশুদ্ধ, নিরাকার। একবার তুমি যদি সত্যভাবে ‘আমি’-কে বুঝে ফেলো—তাহলে আর কিছু জানার নেই, করবার নেই। তখন থেকে শুরু হয় একমাত্র পথ—‘আমি’-তে স্থিত থাকা, এই ধ্যানে লীন থাকা।

এই স্থিতির গভীরতা, আন্তরিকতা ও সচেতনতা তোমার সমস্ত আভ্যন্তরীণ জাগরণ নির্ধারণ করে। ‘আমি’-র জ্ঞানই শেষ জ্ঞান—আর ধ্যানই সেই জ্ঞানের জ্যোতির সংরক্ষণ।

১৬৮.

‘আমি’-তে স্থিতি, ‘আমি’-র অতীত পরমে লীনতা। যখন তোমার সাধনা পূর্ণতা পেতে শুরু করে, তখন ‘আমি আছি’ বোধে তোমার অটল স্থিতি জন্ম নেয়। তখন তুমি চিরস্থায়ীভাবে প্রবেশ করো ‘তুরীয়’ চেতনায়—অর্থাৎ, জাগ্রত, স্বপ্ন ও নিদ্রার বাইরে এক চতুর্থ অবস্থা, যেখানে নেই কোনো ভাবনা বা ভাষা। সেখানে তুমি কেবল ‘আমি’, আর চারপাশের সব কিছুর মধ্যেই তুমি নিজেকে অনুভব করো—সবই তুমি, আর তুমিই সব।

এই অবস্থায় চিন্তা আর চলাচল করে না—কেবল নিঃশব্দ চেতনার উপস্থিতি থাকে। এই অভ্যন্তরীণ স্থিতি যখন স্থায়ী হয়ে ওঠে, তখন ধীরে ধীরে ‘আমি’ বোধটিও মিলিয়ে যেতে শুরু করে। শেষে সে-ও ঝরে যায়—তুমি পৌঁছে যাও সেই পরম অবস্থায়, যাকে বলা হয় ‘পরব্রহ্ম’, যেখানে নেই ‘আমি’, নেই জগৎ—আছে কেবল অদ্বৈত, অভিজ্ঞতাতীত পরম সত্তা।

সাধনার চূড়ান্ত ফল হলো ‘আমি’-তে স্থিতি—যেখানে তুমি চেতনার মূল অভিজ্ঞ বোধে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। এই অবস্থাই হলো ‘তুরীয়’—যা চিন্তা, ভাষা, স্বপ্ন বা ঘুমেরও অতীত। সেখানে চেতনার কেন্দ্র ‘আমি’ হয়ে ওঠে সমগ্র জগৎ—তুমি আর বাইরের কিছু আলাদা থাকে না।

তবে এখানেই শেষ নয়—এই গভীর স্থিতিতেই ‘আমি’-র সূক্ষ্ম অস্তিত্বও ঝরে পড়ে, কারণ সেটিও এক ধারণা, এক প্রকাশ মাত্র। তখন চেতনা নিজের উৎসে ফিরে যায়, যেখানে চেতন, চেতনার বিষয় ও চেতনার প্রক্রিয়া—সবই বিলীন।

এই বিলীনতাই হলো পরব্রহ্ম অবস্থান, যেখানে নেই কিছু বোঝার, নেই কিছু অনুভব করার—আছে কেবল নিঃসঙ্গ, নিরাকার, স্বয়ম্ভূ চেতনস্বরূপ।

সাধনার গভীরতায় তুমি ‘আমি’ বোধে স্থিত হতে শেখো। তখন চিন্তা, ভাষা, পৃথকত্ব মুছে যায়—তুমি হয়ে ওঠো সমগ্র সত্তা। এই অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে ‘আমি’ বোধকেও অতিক্রম করে। শেষে তুমি পৌঁছাও এমন এক অভিজ্ঞতাহীন, সীমাহীন নীরব্রহ্ম চেতনায়, যা কোনো ভাষায় ধরা যায় না, যা কেবল নিজেই নিজের মধ্যে পূর্ণ। এটাই চূড়ান্ত অবস্থা—পরব্রহ্ম।

১৬৯.

‘আমি’-তে স্থিতি, ‘আমি’-কে দেখা নির্বাক চেতনার সাক্ষী হওয়া। এই ‘আমি আছি’ বোধ অহংকারহীন। কিন্তু এই ‘আমি’ যখন হয়ে ওঠে “আমি অমুক”, “আমি এই দেহ”, “আমি এই জগতে”—তখনই ভাষা ও পরিচয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয় অহং (Ego)।

এই সব উপাধি যখন ঝরে যায়—তখন বাকি থাকে কেবল শব্দহীন, পরিচয়হীন ‘আমি’, যা নিজে নিজেই জ্বলছে, কিন্তু কিছু দাবি করছে না। এই অবস্থাকেই বলা হয় ‘তুরীয়’—চেতনার চতুর্থ স্তর, যেখানে নেই জাগ্রত, স্বপ্ন বা নিদ্রার প্রতিচ্ছবি—আছে কেবল শুদ্ধ ‘আমি’-বোধ।

যখন তুমি এই ‘তুরীয়’-তে স্থিত হয়ে যাও, তখন তুমি নিজেই হয়ে ওঠো এই ‘আমি’-র নিরপেক্ষ দর্শক। তুমি তখন আর ‘আমি’ নও, তুমি দাঁড়িয়ে থাকো ‘আমি’-র অতীত অবস্থানে—যেখানে ‘আমি’-কেও তুমি দেখে ফেলো, তাকে জানো, তাকে বুঝে থাকো—কিন্তু তুমি তাতেও জড়িত নও।

আর এই সাক্ষিতা–ই তোমাকে নিয়ে যায় সেই পরম নীরব্রহ্ম অবস্থানে, যেখানে দেখা নেই, দর্শক নেই—শুধু সত্তা মাত্র। ‘আমি’-র আসল প্রকৃতি ভাষাহীন ও নির্লিপ্ত, যা কোনো নাম বা কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়।

Ego (অহংকার) আসলে ‘আমি’-র সঙ্গে ভাষাগত ও মনোবৌদ্ধিক সংযোজন। যেমন: “আমি দেহ”, “আমি পিতা”, “আমি সফল” ইত্যাদি। এই সংযোজনগুলো যখন বর্জিত হয়, তখন বাকি থাকে নিখাদ ‘আমি’-র জ্ঞান, যা তুরীয় স্তর। এই অবস্থায় সাধক ‘আমি’-র সঙ্গেও একীভূত নয়, আবার বিচ্ছিন্নও নয়—বরং সে হয় ‘আমি’-রই দর্শক।

এই দর্শকত্ব (witness-consciousness)–ই ধাপে ধাপে ‘আমি’-কে অতিক্রম করে, যা পরে মিলিয়ে যায় সর্বব্যাপী চেতনস্বরূপে। এভাবেই সাধক ধ্যান ও সত্তার গভীরে অহংহীন, ভাষাহীন চৈতন্যের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘আমি’ বোধ নিজেই অহং নয়—অহং আসে ভাষা ও পরিচয়ের সংযোজনে। এই ভাষাহীন, নির্জন ‘আমি’-তে স্থিত হওয়া মানেই তুরীয় অবস্থায় প্রবেশ। এই অবস্থায় সাধক নিজেই হয়ে ওঠে ‘আমি’-র দর্শক—স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ, শুদ্ধ সচেতন সত্তা।

এই সাক্ষিতা-স্বরূপই ধীরে ধীরে ‘আমি’-কেও অতিক্রম করে ও স্থাপন করে সাধককে পরব্রহ্মের অবস্থায়, যেখানে কিছুই বলা যায় না, তবুও সব কিছু বোঝা যায়।

১৭০.

‘আমি’-র আবির্ভাবে পরব্রহ্ম জানে: “আমি আছি”—তবু তা তার জন্য কিছুই নয়।

পরব্রহ্ম—যা সব কিছুর ঊর্ধ্বে, যা নিরাকার, নির্জন, চিরন্তন—সেটি কোনো কিছু জানার জন্য অপেক্ষা করে না, কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু এক সময় ‘আমি’-র স্বতঃস্ফূর্ত আবির্ভাব ঘটে। এই ‘আমি’ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরব্রহ্মের মধ্যে ঘটে এক নিঃশব্দ দর্শন—“আমি আছি” বলে যেন সে নিজেকে দেখল।

তবে এটি এমন নয় যে, পরব্রহ্ম জানল আর লাভবান হলো—এই জ্ঞান তার কাছে কিছুমাত্র প্রয়োজনীয় নয়। ঠিক যেমন ঘুমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়—তুমি সেই স্বপ্নকে কেবল দেখো, কিন্তু তুমি তাতে জড়িত নও, প্রভাবিত নও। তেমনি, ‘আমি’-র আসার ফলে দর্শন (witnessing) ঘটে পরব্রহ্মে—কিন্তু সে রয়ে যায় অলিপ্ত, অপ্রয়োজনে, নিঃক্রিয়। ‘আমি’ এসেছে, তা জ্ঞাত হয়েছে, কিন্তু পরব্রহ্ম তাতেও মুক্ত—সে কেবল রয়েছে, যেমন ছিল, যেমন থাকবে।

পরব্রহ্ম হচ্ছে সেই সর্বোচ্চ সত্য—যা অভিজ্ঞতাহীন, নিরাকার, অপ্রয়োজনে পূর্ণ। এই অবস্থায় কোনো বোধ নেই, এমনকি "আমি আছি"—এই জ্ঞানও নেই। কিন্তু হঠাৎ ‘আমি’ বোধের আবির্ভাব একপ্রকার সত্তার স্পর্শ এনে দেয়, যার ফলে “আমি আছি” বলা যায়।

এই মুহূর্তেই ঘটে “witnessing”—একটি নিঃশব্দ দর্শন বা সাক্ষিতা। তবু এও বলা যায় না যে, পরব্রহ্ম জানতে চায়, বা এ জ্ঞানকে প্রয়োজন মনে করে। ঘুমের ভেতর স্বপ্নের মতোই, স্বপ্ন দেখা ঘটে যায়, কিন্তু তুমি তাতে বাস্তবে জড়িত নও। তেমনি, ‘আমি’ আসে, পরব্রহ্ম কেবল দেখেন—কিন্তু নিজে সর্বদা অবস্থাহীন, অপ্রসঙ্গে, নির্বিকার থাকেন।

পরব্রহ্ম কোনো কিছু জানার বা বোঝার প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে না। তবে যখন ‘আমি’ বোধ উদিত হয়, তখন সেই পরব্রহ্মে ঘটে দেখা (witnessing)—যেমন ঘুমে হঠাৎ স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। এই দেখাও নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত, কোনো ফল বা প্রয়োজন দ্বারা প্ররোচিত নয়। “আমি আছি” এই জ্ঞান ঘটে, কিন্তু পরব্রহ্ম তাতেও অছিন্ন, স্বাধীন। এই অবস্থাই অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়—চিন্মাত্র, দর্শনমাত্র, অথচ অনুজ্ঞাহীন পরিপূর্ণতা।

পরব্রহ্ম জানে না বলে কিছু নেই, তবে সে জানলেও তার কিছু আসে যায় না। সে শুধু আছে, এমনকি ‘আছ’-রও অতীত।
Content Protection by DMCA.com