১৪৬.
নির্বাক ‘আমি’–তে স্থিতি, শব্দের পূর্বের সেই নিঃশব্দ ধ্যান।
ধ্যানে বসো—কিন্তু কেবলমাত্র এই অনুভবে নিজেকে একাত্ম করে বসো: “আমি আছি”। তবে শুধু শব্দে ‘আমি’ বললেই হবে না—শব্দকে ছাড়িয়ে গিয়ে এই ‘আমি’ বোধে শব্দহীনভাবে স্থিত হতে হবে। এই জ্ঞান যখন তুমি বোঝো—তখন তোমার একমাত্র কর্তব্য হলো—শুধু এই ‘আমি’–তে থাকা, এবং তার মধ্যে লীন হওয়া।
এর জন্য ফিরে যেতে হবে সেই মুহূর্তে—যখন প্রথমবার তুমি অনুভব করেছিলে: "আমি আছি"। তখন ছিল না কোনো ভাষা, না কোনো শব্দ, না কোনো সংজ্ঞা—তুমি ছিলে, কিন্তু ভাষাহীন, চিন্তাহীন, ধারণাবিহীন। এই নির্বাক, ধারণাশূন্য উপস্থিতির সেই সময়টিকেই পুনরুদ্ধার করতে হবে—সেই নির্জন অস্তিত্বে ফিরে গিয়ে, তাতে স্থির থাকতে হবে। কারণ ভাষা, নাম, পরিচয়, এবং সব ধারণা এসেছে পরে—সমাজ ও স্মৃতির প্রভাবে, অভ্যাসে, শর্তায়নে। কিন্তু সেই প্রাক-ধারণাগত, শব্দহীন মুহূর্তেই নিহিত রয়েছে সত্য ‘আমি’।
ধ্যান মানে—সেই মুহূর্তে ফিরে যাওয়া, যেখানে “আমি আছি” ছিল—কিন্তু “আমি অমুক” ছিল না। ধ্যান কোনো চিন্তা বা শব্দ নয়—ধ্যান মানে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অস্তিত্বের বোধে স্থিত থাকা। আমাদের ‘আমি’ বোধ বর্তমানে ভাষা, স্মৃতি, ও পরিচয়ের সঙ্গে মিশে গেছে—তাই ধ্যানের উদ্দেশ্য হলো সেই মূল, নির্মল ‘আমি’–তে ফিরে যাওয়া। শিশুকাল বা জন্মোত্তর সেই মুহূর্তটি মনে করো—যখন তুমি জানলে: "আমি আছি", কিন্তু কিছু জানো না—কোনো নাম, কোনো ভাষা, কোনো সম্পর্ক নেই।
সেই অবস্থাই হলো প্রকৃত তুরীয় স্তর—যেখানে ‘আমি’ আছে, কিন্তু ব্যক্তিত্ব নেই। ধ্যান মানে সেই স্তরে ফিরে যাওয়া—শুধু ‘আমি’–তে থাকা, শব্দ ছাড়াই, ব্যাখ্যা ছাড়াই। এই অবস্থাতেই ধীরে ধীরে সমস্ত মায়া-বোধ, পরিচয়, চিন্তা মুছে যেতে থাকে—এবং চেতনা নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যায়।
ধ্যানে বসো এই উপলব্ধি নিয়ে—“আমি আছি”, কিন্তু কোনো নাম বা শব্দ ছাড়া। শব্দ উচ্চারণ করো না, শুধু সেই বোধটিতে থাকো—যেটা প্রথম জন্মেছিল তোমার মধ্যে, ভাষার পূর্বে। সেই বোধে ছিল না চিন্তা, না সংজ্ঞা—শুধু অস্তিত্বমাত্র। ধ্যানের উদ্দেশ্য সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়া—এবং তাতে স্থিত হয়ে থাকা। এটিই প্রকৃত ধ্যান—যেখানে ‘আমি’ শব্দ মুছে গিয়ে ‘আমি’ বোধ–ই সর্বস্ব হয়ে ওঠে।
১৪৭.
শারীরিক অনুশাসন নয়, ‘আমি’ বোধেই নিঃশব্দ সাধনা। এই সাধনার প্রেক্ষিতে—সব রকম শারীরিক অনুশাসনকে একবারের জন্য ভুলে যাও। বহু পথপ্রদর্শক বহু রকম শারীরিক সাধনার কথা বলেছেন—প্রাণায়াম, যোগ, ভঙ্গিমা, উপবাস, নিয়ম ইত্যাদি। শেষপর্যন্ত তুমিই ঠিক করো, কী তোমার জন্য উপযোগী। কিন্তু এই গুরু একেবারেই আলাদা কিছু বলছেন—তিনি বলছেন: এইসব শরীরকেন্দ্রিক চর্চা বাদ দাও। বরং বোঝার চেষ্টা করো সেই অনুভূতিটিকে—যেটি বলে “আমি আছি”। কোনো অনুশীলন নয়, কোনো নিয়ন্ত্রণ নয়—শুধু এই বোধের মধ্যে নিঃশব্দে স্থিত থেকো।
এই বোধের মধ্যে নাম নেই, রূপ নেই, দেহ নেই—আছে কেবলমাত্র অস্তিত্বের অনুভব। এই ‘আমি’–কে বোঝা জরুরি, এবং এরপর এই বোঝা–র উপর স্থিত থাকা জরুরি। এই দুইটি মিলে যে-পথ তৈরি হয়, সেটাই হলো প্রকৃত সাধনা—বোঝা ও স্থিতি, এই দুইয়ের মিশ্র প্রক্রিয়া।
সাধনাজীবনে বহু ধরনের শারীরিক অনুশাসনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়—কিন্তু অদ্বৈত বেদান্ত বলে, শারীরিক চর্চা দিয়ে সত্যকে পাওয়া যায় না, কারণ দেহ নিজেই একটি অনিত্য উপকরণ। সত্য উপলব্ধি করার জন্য গুরুর শিক্ষা একেবারে সরল, একেবারে গভীর—নিজের ‘অস্তিত্ববোধ’–কে উপলব্ধি করো এবং তাতে স্থিত থাকো।
এই অস্তিত্ববোধ—"আমি আছি"—এই বোধের ভাষাহীন, ধারণাহীন, দেহবিমুখ রূপটিকে অনুভব করো। এই বোঝার পরে এটিতে স্থিত থাকা, এই দুই পর্যায়ই হচ্ছে প্রকৃত সাধনা। আর এই সাধনা কোনো অঙ্গসাধনার চর্চা নয়, এটি কেবল চেতনার কেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার পথ—যেখানে আমি নিঃশব্দে নিজ অস্তিত্বে অবগাহন করে।
এই পথে শারীরিক অনুশাসন নয়, শুধু ‘আমি’ বোধে বোঝা ও স্থিতি—এটাই সাধনা। গুরু বলেন, শরীরকেন্দ্রিক কোনো চর্চা নয়—বরং নিজ অস্তিত্বের নিখাদ অনুভবেই প্রবেশ করো। “আমি আছি”—এই বোধের বিশুদ্ধতা বুঝে এতেই নিজেকে বিলীন করো। এই বোঝা এবং এই অবস্থানে নিঃশব্দে স্থির হয়ে থাকাই তোমার একমাত্র পথ, একমাত্র মুক্তির দিকনির্দেশ।
১৪৮.
‘আমি’–ই ঈশ্বর অস্তিত্বের নিঃশব্দ অলৌকিকতা। এই প্রশ্ন করো—"তুমি যে আছো, এইটা জানার জন্য কি কোনো বিশেষ প্রয়াস লাগে?" এই যে ‘আমি আছি’ বোধ—শব্দ ছাড়াই, চিন্তা ছাড়াই—এটাই তোমার ভেতরের ঈশ্বরস্বরূপ। যদি তুমি সত্যিই এই জ্ঞানটিকে বুঝে ফেলো—"আমি আছি"—তাহলে কিছু করবার আর প্রয়োজন কোথায়?
এই কারণেই তো গুরু সব শারীরিক অনুশীলন, কৃত্রিম উপাচার বাতিল করে দেন। ভাবো, এই ‘আমি’ বোধটা এতটাই সহজ, এতটাই প্রাকৃতিক যে, তুমি সেটা প্রতিদিন অনুভব করো, তবুও কখনও আলাদা করে নজর দাও না। গুরু এখন বলছেন—এই সাধারণ বোধটিকেই একবার নজরে আনো, এটার উপরই তোমার মনোযোগ দাও। দেখো কী ঘটে!
এই নিঃশব্দ অস্তিত্বের বোধ, এই ‘আমি আছি’, যার মধ্যে কোনো নাম নেই, শব্দ নেই—সেই সত্তাটিই তোমার ভিতরের ঈশ্বর। ‘আমি’–বোধই হচ্ছে চেতনার প্রথম অভিব্যক্তি—কিন্তু এই বোধ এতটাই স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক যে, আমরা একে আলাদা করে লক্ষ্যই করি না। কিন্তু গুরু এটিকেই মুখ্য করে তুলছেন—এই অনুভবটিকেই চেতনভাবে গ্রহণ করো, এটি কেবল ধারণা নয়—এটিই অস্তিত্ব, এটিই ঈশ্বরস্বরূপ। কারণ, যেহেতু সব কিছুই এই ‘আমি’–র উপর নির্ভর করে, তাই এই বোধের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্ত জ্ঞান, সত্তা, ও চৈতন্যের মূল।
এটিকে বুঝতে গেলে কোনো সাধনক্রিয়া, নিয়ম, প্রথা, উপবাস, কায়িক অনুশাসন কিছুই প্রয়োজন নেই—শুধু প্রয়োজন এই অনুচ্চারিত, নিঃশব্দ ‘আমি’–বোধকে স্বীকৃতি ও মনোযোগ দেওয়া। এই বোধেই চেতনাত্মকতা আছে, এই বোধেই ‘আমি কে’ এই প্রশ্নের উৎস আছে—আর এই বোধই আত্ম-ঈশ্বরের প্রকাশ।
‘আমি’–র জ্ঞান পেতে কোনো সাধনার প্রয়োজন পড়ে না—এটি এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক যে প্রতিদিন অনুভব করেও আমরা তা ভুলে যাই। গুরু বলেন—এই সহজ অস্তিত্ববোধটিকেই মনোযোগ দাও। এটাই তোমার একমাত্র উপায়, এটাই ঈশ্বরের অভ্যন্তরীণ উপস্থিতি। এই ‘আমি’ শব্দহীন, নিরাকার—তবুও সব অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের ভিত্তি। এটিকে বোঝা, এবং এটিতেই স্থিত থাকা—এটাই সাধনা, এটাই জ্ঞান, এটাই ঈশ্বরস্বরূপ তোমার নিজের ভেতরেই।
১৪৯.
একমাত্র ব্রত: “আমি দেহ নই, আমি চৈতন্য”।
তোমাকে এই একটি ব্রত পূর্ণ করতেই হবে—“আমি দেহ নই, আমি কেবল অন্তঃস্থিত ‘আমি আছি’ জ্ঞানমাত্র।” এখন পর্যন্ত যা-কিছু বলা হয়েছে, তাকে সত্যভাবে উপলব্ধি করতে হলে এই বিশ্বাস তোমার মধ্যে অটুটভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। এই বিশ্বাসকে স্থায়ী করতে গেলে তোমাকে যথেষ্ট সময় ধরে এই ‘আমি আছি’ বোধে ধ্যান করতে হবে।
দেহবোধকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, এই অন্তঃস্থিত ‘আমি আছি’ বোধে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন হওয়া—এটাই একমাত্র করণীয়। এটি একাধারে সাধনার শুরু এবং শেষ—একমাত্র ব্রত, একমাত্র সৎসঙ্কল্প। তুমি এটিকে বলতে পারো—সর্বক্ষণ ‘তুরীয়’ স্তরে থাকার চর্চা, যেখানে চেতনার অন্য কোনো রূপ থাকে না—থাকে কেবল অস্তিত্বমাত্র, নামহীন, রূপহীন, নিরুপাধি ‘আমি’।
অদ্বৈত বেদান্তে প্রকৃত আত্মজ্ঞান তখনই সম্ভব, যখন ‘আমি’ বোধের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া দেহ, পরিচয়, ইতিহাস, স্মৃতি সব কিছুকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে ফেলা যায়। এই বোধ—“আমি এই শরীর” এই বিশ্বাসই হলো আত্মবিস্মৃতির মূল। এই ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে হলে, আত্মবোধ—“আমি আছি” এই জ্ঞানেই নিজেকে বার বার স্থাপন করতে হবে। এই ধ্যানে দেহবোধ বিলীন হবে, চেতনা ফিরবে তার নিজস্ব কেন্দ্রে—যেখানে ধ্যাতা নেই, ধ্যান নেই, কেবল চেতন-অস্তিত্ব।
এই অবস্থাকেই বলা হয় তুরীয়—চেতনার সেই স্তর, যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও নিদ্রারও পেছনে রয়েছে। সেখানে পৌঁছানোই সাধকের একমাত্র ব্রত। “আমি দেহ নই, আমি কেবল ‘আমি আছি’ বোধমাত্র”—এই ব্রতই তোমার একমাত্র সাধনা। এই সত্যে স্থিত হতে হলে প্রয়োজন ধ্যান, প্রয়োজন গভীর আত্মদৃষ্টি—যার মাধ্যমে দেহবোধ ঝরে পড়ে, আর কেবল নিখাদ অস্তিত্ব টিকে থাকে। এই একাগ্র ‘আমি’–বোধেই লীন হওয়া, তাতে স্থিত থাকা—তোমার প্রথম এবং শেষ করণীয়। এটিই তুরীয় চেতনা—এবং এটিই মুক্তির দ্বার।
১৫০.
‘আমি’ হয়ে ওঠাই শিক্ষা গুরুর কাজ শেষ, এখন তুমিই পথ। যখন তুমি সত্যভাবে ‘আমি আছি’ বোধে স্থিত হয়ে যাবে, তখন এই ‘আমি’ নিজেই তোমার সামনে সব জ্ঞান উন্মোচন করবে। তখন তোমার আর কারো কাছে যাওয়ার প্রয়োজন থাকবে না—কোনো বাহ্যিক গাইড, কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই।
গুরুর দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় এক ও অভিন্ন—যেই আসুক না কেন, তিনি প্রথমে তাকে বোঝান: “এই ‘আমি’ কী?” তারপর বলেন: “এই ‘আমি’–তেই স্থির থাকো যতক্ষণ না তুমি নিজেই হয়ে ওঠো সেই ‘আমি’।” এটুকুই গুরুর কাজ—তিনি তোমার সামনে পথ খুলে দেন, তুমি হাঁটবে কি না, কতদূর হাঁটবে, সেটাই আসল সাধনা।
তোমার সফলতা একমাত্র নির্ভর করে এই দুই বিষয়ের উপর: ১. তুমি ‘আমি’–কে ঠিকভাবে বুঝেছ কি না, ২. তুমি প্রতিদিন সাধনা করছো কি না। গুরু অবশ্যই সব কিছু উজাড় করে দেবেন—শর্ত একটাই: তিনি যেন তোমার মধ্যে একজন আন্তরিক ও সত্সাধককে দেখতে পান।
গুরুর ভূমিকা হলো জাগরণ ঘটানো—তোমাকে নিজের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে তুমি নিজের অস্তিত্ববোধ—‘আমি’–কে চিনতে পারো। এই ‘আমি’ যদি নিখাদভাবে বোঝা যায়, তাহলে এটি কোনো ধারণা নয়—এটি এক অন্তর্জাগতিক, সর্বব্যাপী চেতনা, যা নিজেই সমস্ত জ্ঞানের উৎস। গুরু সেই দরজা খুলে দেন, কিন্তু দরজা দিয়ে পা রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণ শিষ্যের। যদি তুমি শুধু কথা বোঝো কিন্তু সাধনা না করো, তবে জ্ঞান বহিরাগত রয়ে যাবে। আর যদি তুমি ‘আমি’–তে স্থিত থেকে ধ্যান করো—তবে এই ‘আমি’ নিজেই ধীরে ধীরে খুলে দেবে জন্ম, মৃত্যু, সত্তা ও পরম সত্যের সমস্ত দরজা।
‘আমি’–তে স্থিত হও—এটুকুই গুরুর মূলশিক্ষা। যদি তুমি সত্যিকারভাবে এই বোধে প্রতিষ্ঠিত হতে পারো, তবে এই ‘আমি’ নিজেই তোমার শিক্ষক হয়ে উঠবে। গুরুর কাজ হলো বোঝানো ও পথ দেখানো—তারপর পথ হাঁটার দায়িত্ব তোমার। যারা আন্তরিক, তাদের জন্য গুরু সমস্ত সাধনার মূল রহস্য উন্মোচন করেন—আর বাকি কাজ তখন তোমার নিজের অভ্যন্তরে। এই অভ্যন্তরের যাত্রাই হলো আত্মজ্ঞান, এবং ‘আমি’–কে নিখাদভাবে চিনে নিয়ে তাতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে লীন করে দেওয়াই হলো সিদ্ধি।