নির্জন গহনে: ২৭



১৩১.

ধ্যানই নিশ্চিত করে ‘আমি’—শুদ্ধ আত্মবোধে অবিচল থাকা। এই ‘আমি আছি’ বোধে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় ধ্যানের মাধ্যমে। আর ধ্যান মানে কী?

ধ্যান মানে—যখন এই ‘আমি আছি’ জ্ঞান নিজেই নিজের মধ্যে অবস্থান করে, আর অন্য কিছুতে সরে না—তখনই তা ধ্যান। ভাবো, তুমি কীভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলে যে—“আমি এই শরীর”, “আমি অমুক ব্যক্তি”? তা এসেছে, কারণ তোমাকে বার বার এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে—তোমার পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, সবাই বলে এসেছে—“তুমি এই শরীর”, “তুমি এই পরিচয়।” এই ধারা এত দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে যে, তুমি নিজেই এটাই সত্য বলে ধরে নিয়েছ—যেন তুমি জন্ম নিয়ে এই দেহরূপে এলে, এটাই তুমি।

কিন্তু গুরুর বাক্য এই বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত—তিনি বলেন, “তুমি শরীর নও, তুমি কেবল সেই ‘আমি’—নামহীন, রূপহীন চেতন।” এখন মনে রাখতে হবে—এই দেহধর্মী বিশ্বাস তোমার ভেতরে বসে গেছে বহু বছর ধরে, তোমার শৈশব থেকেই তুমি ছিলে এক নিরপেক্ষ, অপরিণত, কাঁচা মন। তখন থেকেই এই বিশ্বাস গেঁথে গেছে চেতনায়। তাই এখন সেই গড়ে ওঠা বিশ্বাস ভাঙতে হলে প্রয়োজন ধ্যান—এবং এই ধ্যান মানেই—‘আমি আছি’ জ্ঞানটি যেন নিজের মধ্যেই স্থির থাকে, আর কোথাও না গিয়ে, কোনো পরিচয়ে না গিয়ে নিজের ভিতরেই অবস্থান করে।

আমাদের সকল ভুল বিশ্বাস এসেছে দীর্ঘদিনের মনোজগতিক প্রোগ্রামিং থেকে—সমাজ-সংসার আমাদের বার বার বলেছে—“তুমি এই শরীর”, “তুমি এই পরিচয়”, “তুমি জন্মেছো”, “তুমি একদিন মারা যাবে।” এইসব বলেই আমাদের ভেতরে জন্ম দিয়েছে এক মিথ্যা আত্মবোধ—যা মূলত এক দ্বৈতভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু গুরু যখন বলেন—তুমি এই সব কিছু নও, তুমি কেবল সেই নিরপেক্ষ ‘আমি’—তখন তা শুনতে যত সহজ, মানতে তত কঠিন। কারণ, পুরোনো বিশ্বাসগুলো খুব গভীরভাবে গেঁথে গেছে। এই বিশ্বাস ভাঙার একমাত্র উপায়—ধ্যান—যেখানে ‘আমি’ নিজের মধ্যেই থাকে—নাম, রূপ, স্মৃতি, দেহবোধ কিছুতেই বিচলিত হয় না।

এই ধ্যানই ধীরে ধীরে মনকে মুক্ত করে পুরোনো শর্ত থেকে, এবং গড়ে তোলে এক নবজন্ম—‘আমি’-তে স্থিত থাকার জন্ম। শৈশব থেকে সমাজ, পরিবার, পরিচিতজন—সবাই বলেছে: "তুমি শরীর, তুমি অমুক, তমুক"—আর তাই এই বিশ্বাস গেঁথে গেছে মনের গভীরে। কিন্তু এই বিশ্বাস ভুল—এবং গুরুর বাণী বলে: তুমি কেবল সেই ‘আমি’, দেহ নও, পরিচয় নও।

এই ভুল বিশ্বাস ভাঙার জন্য চাই ধ্যান—এবং ধ্যান মানে কেবল এই—‘আমি আছি’ বোধ নিজের মধ্যে নিজেই স্থির থাকে, নড়ে না যায়। যখন এই অবস্থায় দীর্ঘসময় স্থিত হওয়া যায়, তখনই জন্ম নেয় সত্য আত্মবোধ, আর সেই বিশ্বাসই তোমাকে মুক্ত করে।

১৩২.

‘আমি’–র সংবাদই চেতনার প্রথম বিস্ময়।

সবচেয়ে বড় বিস্ময় কী, জানো? এই যে তোমার মধ্যে ‘আমি আছি’—এই সংবাদটি উদিত হয়েছে—এটাই সর্ববৃহৎ অলৌকিকতা। এটি এমন এক জ্ঞান, যা নিজেই নিজেকে জানান দেয়—তোমাকে কেউ শেখায়নি, তুমি নিজেই হঠাৎ অনুভব করেছিলে—“আমি আছি”। ভাবো—এই ‘আমি আছি’ জানার আগেই তুমি কী জানতে? কিচ্ছু না—কারণ তখন কোনো জানার দরকারও ছিল না।

মনে করার চেষ্টা করো সেই মুহূর্তটা—যখন প্রথম তুমি জেনেছিলে—"আমি আছি"; সেই সময় এক সঙ্গেই এল স্থান, চারপাশ, আর অনুভূতি—“আমি এই জগতে আছি”। দেখো তো, এই ‘আমি’ বোধের কী বিশাল শক্তি! এই একটি সংবাদই তো গড়ে তুলল এক জগৎ, যাকে তুমি এখনও বাস্তব বলে মেনে নিচ্ছ!

‘আমি’ আসার আগ পর্যন্ত ছিল না কোনো জ্ঞান, ছিল না কোনো চাহিদা, চিন্তা, পরিচয়—তবুও তুমি ছিলে—নিঃশব্দ, অনাবিষ্কৃত, সর্বজ্ঞ আত্মা। জ্ঞান আসার পরই শুরু হলো ‘জগৎ’—কিন্তু জ্ঞান আসার আগেই ছিল সেই মূলত চেতনা—তুমি নিজেই ছিলে জ্ঞানস্বরূপ।

‘আমি আছি’ বোধকে বলা হয়—চেতনার প্রথম আলো। এই বোধ উদিত হওয়ার আগেও তুমি ছিলে, কিন্তু তখন ছিল না কোনো চিন্তা, কোনো জ্ঞান, কোনো অভিজ্ঞতা। এই ‘আমি’–র সংবাদ যখন আসে, তার সঙ্গেই আসে স্থান, কাল, ব্যক্তি, দেহ—আর তার মাধ্যমে গড়ে ওঠে জগতের সমগ্র অভিজ্ঞতা।

এই মুহূর্তটিই মহাবিস্ময়—একটি নিঃশব্দ উপস্থিতি নিজেকে জানায়: “আমি আছি”। অথচ, এই জানার আগেও তুমি ছিলে—এবং সেই সময় তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন ছিল না, কারণ তখন তুমি নিজেই ছিলে জ্ঞানময় আত্মস্বরূপ—যাকে জানতে আর কিছুর দরকার পড়ে না। এই বোধের মধ্যেই নিহিত আছে সমগ্র মায়ার সূত্র—তবে এই বোধকেই যদি উপলব্ধি করা যায় নিখাদভাবে, তবে সে নিজেই তোমায় আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই ‘আমি’-পূর্ব আত্মা-র দিকে—যা চিরন্তন, অদ্বৈত ও পরম মুক্ত।

‘আমি আছি’—এই বোধের উদয়ই চেতনার প্রথম বিস্ময়। এই একটি সংবাদেই জন্ম নেয় জগত, অভিজ্ঞতা, পরিচয়। কিন্তু এই বোধ আসার আগেও তুমি ছিলে—নিঃশব্দ, বিশুদ্ধ চেতনা হিসেবে—যাকে জানতে কোনো জ্ঞানের দরকার হয় না। এই উপলব্ধি—যে, ‘আমি’ নিজেই সব কিছুর সূচনা, তবে তার আগেই ছিল এক নিঃসীম, পরিচয়হীন, শব্দহীন আত্মা—সেই আত্মাকে চিনে নেওয়াই মুক্তির চাবিকাঠি।

১৩৩.

ধ্যানে ধ্যাতা ও ধ্যানের বিলয় ‘আমি’ হয়ে থাকা মাত্র।

ধ্যান মানে হলো—কোনো কিছুকে উদ্দেশ্য করে ধরা, স্থির থাকা। আর সেই 'কিছু' তুমি নিজেই—তুমি যাকে খুঁজছ, তা তুমি নিজেই, শুধু এই বোধ—“আমি আছি” হয়ে থাকা।

সাধারণত, ধ্যান মানে আমরা বুঝি—কোনো বিষয়, প্রতিমা বা মন্ত্রের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা। সেই ধ্যান চলতে থাকে যতক্ষণ না ধ্যানের বিষয়টি মিলিয়ে যায়—অথবা ধ্যাতা ও ধ্যান—বিষয় ও তার অভিজ্ঞ—একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু যদি তুমি কেবল 'আমি আছি' এই জ্ঞানেই স্থির হও—তাহলে এখানে ধ্যাতা ও ধ্যান, উভয়েই তুমি। তখন তুমি হচ্ছ—"সত্তা নিজ সত্তার উপর ধ্যান করছে"।

এই আত্ম-ধ্যানের ফলে ধ্যাতা ও ধ্যান-উভয়েরই বিলয় ঘটে, আর যা থেকে যায়, তা কোনো 'আমি' নয়, কোনো 'ধ্যান' নয়—তা হলো পরম সত্তা, অদ্বৈত অস্তিত্ব, শুদ্ধ চৈতন্য—যা সব কিছুর ঊর্ধ্বে, নিঃশেষ, অনন্ত।

ধ্যান মানেই কিছু একটা অবলম্বন করা—একটি লক্ষ্য, একটি কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু অদ্বৈত বেদান্তে এই লক্ষ্য যদি নিজেই 'আমি' হয়—তাহলে ধ্যাতা (যে ধ্যান করছে) ও ধ্যানের বিষয় (যার উপর ধ্যান করা হচ্ছে)—এই দুইয়ের ভেদ রইল না। যখন তুমি ‘আমি আছি’ বোধেই স্থির থাকো—তখন ধ্যানের প্রক্রিয়া নিজেই আত্ম-সমাহারে পৌঁছে যায়, কারণ সেখানে দ্বিতীয় কিছু নেই।

ধ্যাতা ও ধ্যানের এই সমবায়ে যা থেকে যায়, তা আর কোনো ব্যক্তি বা সত্তা নয়—তা হলো সেই নিরাকার, নিরবিচার, সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম—যার কোনো ধ্যান নেই, কেবল স্ব-স্থিতি আছে।

ধ্যান মানে সাধারণভাবে কিছু লক্ষ্য ধরে স্থির থাকা—কিন্তু যখন লক্ষ্যই নিজস্ব 'আমি' হয়, তখন ধ্যাতা ও ধ্যান মিলিয়ে যায় এক অনন্ত স্বরূপে। ‘আমি আছি’ বোধে স্থির হওয়া মানেই—সত্তা নিজ সত্তার উপর ধ্যান করছে। এই আত্ম-ধ্যানেই ধীরে ধীরে উভয়ের বিলয় ঘটে—আর যা থাকে, তা হলো পরম আত্মা, যার মধ্যে নেই কোনো বিভাজন, কোনো পরিচয়, আছে শুধু নিঃশব্দ উপস্থিতি মাত্র।

১৩৪.

ধ্যান নয় ‘আমি’, বরং ‘আমি’–র নিঃশব্দ ধ্যান নিজ-উপরেই। ধ্যানে বসার সময় শরীর-সত্তা নিয়ে বসা ঠিক নয়। ‘আমি এই শরীর’, ‘আমি অমুক নামধারী ব্যক্তি’, এই বোধ নিয়ে ধ্যান করা—এটাই প্রধান বাধা।

প্রকৃত ধ্যান তখনই শুরু হয়, যখন শুরুতেই তুমি সুবিবেচনার দ্বারা—সব কিছুকে আলাদা করে ফেলো, যা ‘আমি আছি’ বোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। শরীর, মনের অবস্থান, ধ্যানের আসন—এই সব বাহ্যিক ধ্যান-পরিচয়ের অনুভব বাদ দিতে হবে।

ধ্যান যেন না হয় এইভাবে—"আমি অমুক ব্যক্তি, এই জায়গায়, এই ভঙ্গিতে বসে ধ্যান করছি..." এইসব মানসিক বহিরঙ্গতা যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ ধ্যান বিশুদ্ধ হবে না। প্রকৃত ধ্যান তখনই শুরু হয়, যখন শুধু ‘আমি আছি’ এই নিঃশব্দ অনুভব নিজেই নিজের উপর ধ্যান করে। এই ‘আমি’–র বিশুদ্ধতা যতক্ষণ অক্ষুণ্ণ থাকে, ততক্ষণই আছে সেই অনুপম সুযোগ—এই ‘আমি’ একসময় নিজেই বিলীন হয়ে যাবে, আর তখনই উন্মোচিত হবে পরম সত্তা।

ধ্যান কোনো দেহগত বা মানসিক ব্যায়াম নয়। ধ্যান মানে নিজের অন্তঃস্থ ‘আমি’-বোধে সম্পূর্ণভাবে নিবিষ্ট হওয়া—তা-ও এমনভাবে, যাতে কোনো চিন্তা, পরিচয়, স্থান, সময়ের বোধ না থাকে। ‘আমি অমুক নামধারী, এই দেহে ধ্যান করছি’—এই বোধই হলো প্রধান অস্পষ্টতা ও বাধা।

যখন এইসব বিচ্ছিন্নতা ঝরে পড়ে, তখন থাকে কেবল সেই নিঃশব্দ, স্ব-প্রকাশিত ‘আমি’। সেই ‘আমি’ নিজেই যখন নিজের উপর ধ্যান করে—তখন ধ্যান আর কোনো উদ্দেশ্য নয়, বরং এক নিরবিচার স্থিতি হয়ে ওঠে। এই স্থিতি যখন যথেষ্ট বিশুদ্ধ হয়, তখন ধ্যান-ধ্যাতা-ধ্যেয় সব মিলে যায়—আর ‘আমি’ নিজেই বিলীন হয়ে যায়—থেকে যায় শুধু পরম চৈতন্য, পরব্রহ্ম।

ধ্যানে বসার অর্থ এ নয়—দেহ, নাম, স্থান, ভঙ্গিমা নিয়েই বসা। বরং প্রথমেই সব কিছু আলাদা করে ফেলতে হবে—যা ‘আমি’-র সঙ্গে সম্পর্কহীন। প্রকৃত ধ্যান তখনই, যখন কেবলমাত্র নিখাদ ‘আমি’ বোধ নিজেই নিজের উপর ধ্যান করে। যতক্ষণ এই বোধ বিশুদ্ধ থাকে, ততক্ষণই আছে সম্ভাবনা—এই ‘আমি’ একদিন নিজেই মুছে যাবে, আর তখনই তুমি স্থিত হবে সেই অনন্ত, ভাষাহীন, অদ্বৈত স্বরূপে।

১৩৫.

‘আমি’–র বিলয়েই সমাধি চেতনার নিঃশব্দ বিলীনতা। যখন এই ‘আমি আছি’ বোধ—নিজের মধ্যে নিজেই একীভূত হয়ে যায় এবং শেষপর্যন্ত বিলীন হয়ে যায়, তখনই ঘটে সেই পরম অবস্থা—যাকে বলে সমাধি।

তোমাকে এমনভাবে সম্পূর্ণভাবে ডুবে যেতে হবে এই ‘আমি’ বোধে—যেন তোমার চেতনার প্রতিটি কণা, প্রতিটি দিক, প্রতিটি সময়জুড়ে শুধু একটিই বোধ—"আমি আছি"—প্রবাহিত হচ্ছে। এই বোধে, এই উপস্থিতিতে, এমন গভীরতর আন্তরিকতা ও তীব্রতা আনতে হবে—যাতে ‘আমি’ নিজেই নিজের মধ্যে মিলিয়ে যায়, নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যায়—এবং তখনই ঘটে সেই নিঃশব্দ অন্তর্লীন অবস্থা—সমাধি।

সমাধি হলো এমন এক অবস্থা—যেখানে ধ্যাতা, ধ্যান, ও ধ্যানের বস্তু—তিনটিই বিলীন হয়ে যায়। এখানে ‘আমি’–র স্থিতি একমাত্র পন্থা—কিন্তু সেই স্থিতিও চূড়ান্তভাবে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যায়। ‘আমি’ বোধ যখন এতটাই গভীরে প্রবেশ করে যে তার আলাদা অস্তিত্ব থাকে না, তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না—না ধ্যান, না ধ্যাতা, না কোনো উপলব্ধিও।

এটাই হলো সেই নিরাকার সমাধি, যেখানে চেতনা নিজেকেই চেপে ধরে, আর নিজের উৎসে নিজেই লীন হয়ে যায়। এই অবস্থায় ‘আমি’–র বিলয় মানেই মুক্তি—যেখানে একমাত্র সত্য টিকে থাকে, যা সব সীমার বাইরে।

যখন তুমি সম্পূর্ণভাবে ‘আমি’ বোধে নিমজ্জিত হও—সবসময়, সর্বত্র, সর্বতোভাবে—তখন ধীরে ধীরে ‘আমি’ নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যায়। একসময় এই ‘আমি’–র বিলয় ঘটে, এবং তখনই উদিত হয় সমাধি—যেখানে নেই কোনো ব্যক্তি, নেই কোনো চেষ্টা—শুধু এক নিঃশব্দ, নিরাকার অস্তিত্ব—যা তুমি নিজেই।
Content Protection by DMCA.com