নির্জন গহনে: ২৬




১২৬.

সাক্ষীর অন্তঃস্থিতি ‘আমি’ কার উপর উদিত হলো?

এই ‘আমি আছি’ জ্ঞানটি হঠাৎ করেই তোমার মধ্যে উদিত হয়েছে—তুমি তা চাওনি, ডাকোওনি—তবুও এটি এসেছিল নিজে থেকেই। এই ‘আমি’-র উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় দেখা, অনুভব, চেতন—এই দেহ, এই জগৎ, এই শূন্যতা—সব কিছুর সাক্ষাৎকার শুরু হয় সেই মুহূর্তে।

এই ‘আমি’ এবং তার সঙ্গে জোড়া দেওয়া ‘আকাশসদৃশ স্থান’—একসঙ্গে এসে তৈরি করে এক চেতনা-সৃষ্ট বিশ্ব। তুমি তখন শরীরকে অনুভব করতে শুরু করো, আর ‘আমি’ বোধকে শরীরের সঙ্গে জুড়ে ফেলো—এইরকম এক আত্ম-ভ্রান্তি জন্ম নেয়।

কিন্তু যখন তুমি অভ্যন্তরের দিকে ফিরে যেতে শুরু করো, তখন এক গভীর প্রশ্ন জাগে—"কে দেখছে?" অথবা "এই ‘আমি’ কার উপর উদিত হলো?" তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে—যে দেখছে, সে, অবশ্যই যা দেখা হচ্ছে, তা থেকে পৃথক। আর এই দেখা-প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত সেই ‘একজন’—সে কখনও আসেনি, কখনও যাবে না—সে চিরকাল থেকেই ছিল, আছে, এবং থাকবে।

এই ‘আমি’ বোধ নিজেই এক আত্মপ্রকাশ—কিন্তু সে আসার পরই জগত, দেহ, স্থান, সময়—সব কিছু অনুভবের সূচনা হয়। ‘আমি’ আসেনি মানে কিছুই নেই—কিন্তু একবার তা এলেই সব কিছু দেখা যেতে থাকে—এবং সেই দেখা থেকেই জন্ম নেয় ‘আমি এই দেহ’, ‘আমি এই ব্যক্তি’ এই মিথ্যা পরিচয়।

কিন্তু সাধনার পথে ফিরে যেতে গেলে এক গভীর অনুসন্ধান শুরু হয়—‘এই দেখা কে দেখছে?’ তখন বোঝা যায়—দেখা হচ্ছে, কিন্তু একজন দেখছে—আর যে দেখছে, সে কখনোই ‘আমি’ নয়, বরং সেই পরম সাক্ষী—যার উপর এই ‘আমি’ জ্ঞানটিও উদিত হয়েছে।

এই সাক্ষী কোনো নাম, রূপ, পরিচয়ের অধীন নয়; এটি সর্বদা অব্যক্ত, জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, এবং সেই একমাত্র বাস্তব, যা সব কিছুর ভিত্তি।

‘আমি আছি’ বোধ হঠাৎ করে আসে—আর তার সঙ্গেই শুরু হয় অভিজ্ঞতার জগৎ। তুমি শরীরকে অনুভব করো, ‘আমি’–কে শরীর ভাবতে শুরু করো। কিন্তু নিজেকে জানার পথে এই প্রশ্ন উঠে—“এই আমি কার মধ্যে উদিত হলো?”

তখন আবিষ্কার হয়—এই দেখা চলেছে একজন সত্যিকারের সাক্ষীর মাধ্যমে—যিনি কখনও জন্মেন না, মরেন না, এবং সব কিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। তিনিই চিরন্তন, অদ্বৈত, নিরাকার আত্মা—যার উপরেই ‘আমি’ এসেছে, আবার একদিন তা বিলীনও হবে।

১২৭.

ধ্যান মানেই ‘আমি’–র নিজস্ব বোধে নিজের প্রতিফলন।

ধ্যান বলতে যা বোঝানো হচ্ছে, সেটি আসলে এই—‘আমি আছি’ এই জ্ঞান বা চেতনা নিজেই নিজের উপর ধ্যান করছে। যখন বলা হয়—‘আমি’ জ্ঞানকে ধ্যান করো, তখন কে ধ্যান করছে? ধ্যান করছে ‘আমি’ নিজেই—নিজস্ব নির্জন উপস্থিতির উপর। কিন্তু ভুলটা তখনই হয়, যখন তুমি ধ্যান করতে যাও—এই ভাবনায় যে, “আমি অমুক ব্যক্তি”, “আমি এই শরীর”, “আমি এই পরিচয়”।

এইরকমভাবে ‘আমি’-র সঙ্গে কোনো নাম, রূপ, পরিচয় জুড়ে দিলে—সেই ধ্যান আর বিশুদ্ধ থাকে না। বরং করতে হবে—সব কিছু থেকে ‘আমি’–কে বিচ্ছিন্ন করে তার একেবারে মূল, নিঃশব্দ, নিরাকার রূপে অবস্থান। এই বিশুদ্ধ ‘আমি’—কোনো চিন্তা ছাড়া, কোনো ভাষা ছাড়া—যখন নিজের উপর স্থিরভাবে ধ্যান করে, এবং এই ধ্যান যথেষ্ট দীর্ঘকাল ধরে চলে—তখন ‘আমি’ নিজেই নিজের অর্থ উন্মোচন করতে শুরু করে।

ধ্যান মানে বাইরের কোনো বিষয়বস্তুর উপরে মনোযোগ নয়—বরং চেতনার নিজের উপরে নিজেরই প্রত্যাবর্তন। ‘আমি’-কে যদি দেহ, পরিচয় বা মনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়—তবে সেই ধ্যান দ্বৈততার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। প্রকৃত ধ্যান তখনই হয়, যখন ‘আমি’ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সকল সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে, নাম-রূপ-স্মৃতি-ইতিহাস থেকে সরে এসে শুধু নিঃশব্দ অনুভূতির স্তরে নিজেকে অনুভব করে।

এই অনুভবই ধ্যান—এবং এই ধ্যান নিজেই একদিন উন্মোচন করে সেই গূঢ় সত্য: ‘আমি’ কে, কোথা থেকে এসেছে, এবং শেষপর্যন্ত কোথায় মিলিয়ে যায়। তখন ‘আমি’ আর ‘ধ্যানকারী’ আলাদা থাকে না—দুই মিলে এক হয়ে যায় আত্মজ্ঞানরূপে।

ধ্যান মানে অন্য কিছু নয়—‘আমি’ নিজেই নিজের উপর ধ্যান করছে। এই ‘আমি’ যেন কোনো ব্যক্তিসত্তা নয়—বরং একেবারে নির্জন, নিঃশব্দ, চিন্তাহীন সেই অনুভবমাত্র। দীর্ঘসময় ধরে এইভাবে ধ্যান করলে—‘আমি’ নিজেই নিজের গভীরতম অর্থ প্রকাশ করে। সেই প্রকাশই আত্মজ্ঞান—যা দ্বন্দ্বহীন, নিরাকার, এবং পরম মুক্তির দ্বার।

১২৮.

প্রশ্নের অবসান যেখানে—সেখানেই ‘আমি’ বোধে স্থিতি।

যখন তুমি ধ্যান করো এই ‘আমি আছি’ বোধে—যেটি সকল জ্ঞানের সূচনাবিন্দু—তখন কীভাবে আর কোনো প্রশ্ন জন্মাতে পারে? তুমি কি লক্ষ করো না—যখনই তুমি কোনো কিছু করো, মন সর্বদা কোনো-না-কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ের ছায়া ধরে রাখে? ঠিক তেমনটাই ঘটে, যখন তুমি আধ্যাত্মিক চর্চার পথে প্রবেশ করো—মন বলে ওঠে—“এই পথে কিছু হবে তো? না কি শুধু সময় নষ্ট করছি?”

কিন্তু যখন তুমি গুরুর নির্দেশিত পথে এই ‘আমি আছি’ জ্ঞানেই স্থিত হতে শুরু করো—তখন ধীরে ধীরে বোঝা যায়, এই ‘আমি’–ই সব জ্ঞানের প্রথম প্রকাশ, এর কোনো রূপ নেই, ভাষা নেই—শুধু নিঃশব্দ অস্তিত্বমাত্র। এই বোধে নিজেকে স্থাপন করাই সাধনার পথ।

আর একবার যদি সত্যভাবে এই ‘আমি’–তে স্থিত হও—তাহলে কোনো প্রশ্ন আর আসতে পারে না। যদি প্রশ্ন আসে—জেনো, তুমি ‘আমি’ থেকে সরে গিয়েছ, মন তোমায় টেনে এনেছে তার পুরোনো চক্রে। এই কথাটি বুঝলে, তাহলে প্রশ্নহীনতা নিজেই হয়ে দাঁড়ায় সাধনার অগ্রগতির এক স্পষ্ট লক্ষণ।

মন নিজের স্বভাবগত দ্বৈতচিন্তা ও সংশয়ে অভ্যস্ত। প্রত্যেক কাজেই, এমনকি আধ্যাত্মিক ধ্যানে প্রবেশ করেও, মানুষ প্রশ্ন তোলে—“আমি কি সঠিক পথে চলেছি?”, “এই ধ্যান কি সফল হবে?” যখন তুমি ‘আমি আছি’, এই নিঃশব্দ, নিরাকার, ভাষাহীন বোধে স্থিত হও, তখন আর কোনো দ্বৈততা থাকে না—তুমি কেবল রয়।

এই ‘আমি’–র সঙ্গে যদি কোনো পরিচয় জুড়ে দেওয়া হয়, তখন প্রশ্ন আসে। কিন্তু যদি তুমি নির্জন ‘আমি’–তে স্থিত থাকো, তবে কোনো প্রশ্ন আসার সুযোগই থাকে না—কারণ প্রশ্ন তো বিভাজন থেকে আসে। এইভাবে, প্রশ্ন আসছে কি না, তা-ই হয়ে দাঁড়ায় এক সাধনপর্যায়ের সূচক—যতক্ষণ প্রশ্ন থাকবে, ততক্ষণ মন কাজ করছে। যখন প্রশ্ন থেমে যাবে, তখনই তুমি পৌঁছাবে নিঃশব্দ চেতনায়—যেখানে কেবল ‘অবস্থান’ আছে, বিশ্লেষণ নেই।

‘আমি আছি’ বোধেই সব জ্ঞানের সূচনা, এবং এই বোধে স্থির হওয়া মানেই প্রকৃত ধ্যান। যদি প্রশ্ন ওঠে—"এতে কিছু হবে তো?"—তাহলে বুঝে নিতে হবে তুমি ‘আমি’ থেকে বিচ্যুত হয়েছ। কারণ এই বোধ নিজের গভীর স্তরে পৌঁছালে—কোনো প্রশ্ন আর জন্মায় না। এই প্রশ্নহীন অবস্থাই সাধনার প্রকৃত চিহ্ন। তাই, নিজের অভ্যন্তরকে পর্যবেক্ষণ করো—প্রশ্ন আসছে? তাহলে ফিরে যাও ‘আমি’–তে।

স্থির থেকো, নির্বাক থেকো—কারণ সেই স্থিতিই প্রকৃত মুক্তির দ্বার।

১২৯.

নাম, রূপ ও পরিচয়ের যে সমস্ত উপকরণ আছে—সেগুলো শুধু জাগতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করো। তার বাইরে, নিজের ভেতরে কেবল একটিই বোধ ধারণ করে রাখো—‘আমি আছি’, কিন্তু কোনো দেহবোধ ছাড়াই; নাম-রূপ-আকৃতির ঊর্ধ্বে এক নিঃশব্দ উপস্থিতি হিসেবে। হ্যাঁ, দেহে অবস্থান করছ, দেহ তো থাকবে, সেটিকে অস্বীকার করাও সম্ভব নয়।

সমাজ তোমায় এক নাম দিয়েছে, একটি রূপ দিয়েছে, কিছু বৈশিষ্ট্য বা ডিজাইন দিয়েছে। ঠিক আছে, এসব দিয়ে জগতে কাজকর্ম চালিয়ে যাও—কিন্তু মনের গভীরে স্থিরভাবে স্মরণ রাখো—তুমি এই কিছুই নও। এগুলো শুধু ব্যবহারযোগ্য বাহ্যিক রূপ—তোমার প্রকৃত পরিচয় নয়।

কাজ হোক, দায়িত্ব হোক, জীবন চলুক—কিন্তু সব কিছুর মাঝেও নিজের মধ্যে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এই অবদিত জ্ঞান—“আমি আছি”—কিন্তু আমি শরীর নই, পরিচয় নই, কেবল চেতনা।

এই জগতে দেহ, নাম, রূপ, সমাজ-দত্ত পরিচয় সবই একটি কার্যকলাপের খেলা। এগুলো বাস্তব নয়, তবে যেহেতু সংসার চলছে, সেহেতু বাহ্যিকভাবে এদের ব্যবহার করতে হয়। তবে ভিতরে ভিতরে, সাধক সবসময় সচেতন থাকেন—এই রূপগুলো কেবল ভূমিকা, আমি এসব নই। প্রকৃত ‘আমি’ হলো সেই নিরাকার চেতনা—যার কোনো জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, পরিচয় নেই—যা কেবলমাত্র উপস্থিতি (Presence)।

তাই, কর্মে থাকো—কিন্তু আত্মবোধে স্থিত থেকো। দেহ দিয়ে কাজ করো, মনে কোনো দ্বন্দ্ব রেখো না—তবে জানো, এ কেবল এক উপকরণ; আমি কেবল সেই ‘আমি’, যা সব কর্মের পেছনে নীরব সত্তা হিসেবে আছে।

নাম, রূপ, পরিচয়—এগুলো ব্যবহার করো শুধু সংসারের প্রয়োজনে। কিন্তু নিজের ভিতরে দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি রাখো—তুমি এগুলো নও। কর্ম চলবে, জীবন এগোবে—কিন্তু তার পেছনে থাকো সেই নিঃশব্দ ‘আমি’ হয়ে—যার কোনো দেহবোধ নেই, কেবল চেতনার বোধ আছে। এভাবেই সংসারের মাঝে থেকেও, তুমি চিরন্তন মুক্ত অবস্থানে স্থিত থাকতে পারো।

১৩০.

‘আমি’–তেই একমাত্র সাধনা, ‘আমি’–তেই মুক্তির পথ—এই পথে চলার কোনো পদ্ধতি নেই—পৃথিবীর সব সাধনার মাঝে একমাত্র পদ্ধতি যদি কিছু থাকে, তা হলো এই বিশ্বাস: ‘আমি’ মানেই ‘আমি’—এর বাইরে কিছু নয়।

গুরু বার বার এই একটিই শিক্ষা দেন—এবং এটিকেই বলেন প্রকৃত দীক্ষা ও উপদেশ: ‘আমি আছি’ বোধে স্থিত হও এবং এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলো। কিন্তু এই বিশ্বাসের মানে কী?

এর অর্থ হলো—তুমি যখন ‘আমি আছি’ বোধে স্থির থাকবে, তখন তার সঙ্গে অন্য কিছু মেশাবে না—কোনো পরিচয়, ভাবনা, স্মৃতি, অনুভূতি নয়—শুধু নিখাদ ‘আমি’ বোধ। এইভাবে তোমার চেতনা এতটাই পরিপূর্ণভাবে ভরে যাবে এই ‘আমি’ জ্ঞানে, যেন তোমার প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি অস্তিত্ব এই ‘আমি’–তেই গৃহীত হয়ে আছে।

তখনই—তুমি একদিন এই ‘আমি’–কেও অতিক্রম করে যেতে পারবে, কারণ তুমি তার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছ, আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কোনো বাহ্যিক সাধনা, মন্ত্র বা উপাচার নয়—প্রকৃত সিদ্ধির পথ হলো আত্মস্মরণ। আর এই আত্মস্মরণের কেন্দ্রবিন্দু হলো—‘আমি আছি’—এই বোধ। কিন্তু এই ‘আমি’ যেন কখনও ‘আমি অমুক’, ‘আমি তমুক’, ‘আমি পুরুষ/নারী’, ‘আমি দেহ’—এসব হয়ে না দাঁড়ায়।

বরং এটি হতে হবে—একদম প্রাথমিক, নিরাকার, নিরবিচার অস্তিত্বের অনুভূতি—যেখানে ‘আমি’–র সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু উপস্থতি আছে। এই ‘আমি’–তে সম্পূর্ণভাবে নিমগ্ন হলে, তুমি একসময় এর সীমাও অতিক্রম করতে পারো; কারণ কোনো কিছুর সাথে পূর্ণ একাত্মতা অর্জনই হলো সেই কিছুর বিলয় ঘটানোর প্রকৃত উপায়।

একমাত্র সত্যিকারের পদ্ধতি হলো—‘আমি’ বোধে স্থির থাকা, এবং এর উপর স্থায়ী বিশ্বাস গড়ে তোলা। এই ‘আমি’ যেন হয় বিশুদ্ধ, নিরাকার, চিন্তাহীন অস্তিত্বের অনুভব—যাতে কোনো পরিচয় বা অতিরিক্ততা না থাকে। যখন এই ‘আমি’–তে তুমি পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ হয়ে যাও—তখনই তোমার সামনে খুলে যাবে এর ঊর্ধ্বের পথ। কারণ তখন তুমি নিজে হয়ে ওঠো সেই বোধ—এবং তারপর ধীরে ধীরে সেই বোধ–কেও অতিক্রম করে চিরমুক্ত সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হও।
Content Protection by DMCA.com