১১৬.
নিরাকার, নিররূপ, চিরনির্বিকল্প যে পরম আত্মা—সেই অস্তিত্বেই প্রথম উদিত হয় ‘আমি আছি’ এই জ্ঞান। এই ‘আমি’-বোধও কোনো নাম, রূপ বা গঠন ধারণ করে না, কারণ তা উৎসারিত হয়েছে সেই চিরশান্ত, চিরনিরাকার চৈতন্য থেকে। আত্মা যেমন অসীম, তেমনি এই ‘আমি’-বোধও কোনো সীমারেখায় বাঁধা নয়—এটা শুধু উপস্থিতির সূচনা।
জন্মের পূর্বে ‘আমি’ বা কোনো আত্মপরিচয়ের ধারণা ছিল না—ছিল না রূপ, আকৃতি, সীমা বা ভাবনার স্পন্দন। ছিল শুধু এক অনন্ত নীরবতা—নির্লিপ্ত, অথচ নিখুঁতভাবে পূর্ণ। হঠাৎ একসময় সেই অচিন আত্মায় উদয় হয় ‘আমি আছি’ এই অনুভব, যার দ্বারা সমস্ত জগত ও পরিচিতি শুরু হয়।
কিন্তু এই ‘আমি’ও আত্মার মতোই নিরাকার, কারণ এর মূলেই আছে সেই একই চৈতন্য, যা রূপহীন। তাই, সকল জ্ঞান আসলে রূপবর্জিত—কারণ তার উৎপত্তি হয় এই 'আমি আছি'-র অনুভব থেকে, যা নিজেই এক অনস্তিত্ব থেকে উৎসারিত অস্তিত্ব।
‘আমি’ বোধই প্রথম প্রকাশ, কিন্তু তা-ও চেতন আত্মার প্রতিচ্ছবি মাত্র। আত্মা এই ‘আমি’-র আগেও ছিল, পরে থাকবে—কারণ তা কখনও জন্মায় না, মরে না। ‘আমি’ হলো স্রেফ এক গূঢ় সঙ্কেত, যা ধ্বংস হবে একদিন; কিন্তু তুমি, সেই নিরূপ চৈতন্য—জন্মপূর্বেও ছিলে, জন্মোত্তরেও আছ—এবং সর্বদা সকল অভিজ্ঞতার পেছনে নিঃসঙ্গ দ্রষ্টা রূপে বিরাজমান।
১১৭.
‘আমি আছি’ এই জ্ঞানটি তোমার চিরনির্বিকল্প আত্মস্বরূপের উপর হঠাৎ করেই উদিত হয়েছে—তাই এটিই এক বিভ্রম। তোমাকে কেউ জাগ্রত করেনি, তুমি নিজেও ইচ্ছাপূর্বক জন্ম নাওনি; তবুও হঠাৎ করে অনুভব করলে—"আমি আছি"। এই অনুভবটি এমনই এক উদিত ছায়া, যেমন নিদ্রার গভীরে হঠাৎ দেখা যায় স্বপ্ন—যা নিজের ইচ্ছাতেও আসে না।
স্বপ্ন যতক্ষণ থাকে, সত্য বলে মনে হয়; ঠিক তেমনই ‘আমি’ বোধটিও যতক্ষণ থাকে, সত্য মনে হয়। কিন্তু স্বপ্ন যেমন মিলিয়ে যায়, তেমনি একদিন ‘আমি’-বোধও মিলিয়ে যাবে। তখন যা থাকবে, সেটাই তোমার প্রকৃত আত্মা—চিরসত্য, চিরনিরাকার, চিরমুক্ত অবস্থা।
আত্মা স্বয়ং কখনও বলে না: "আমি"। এই ‘আমি’-বোধ এক প্রাকৃতিক ঘোরের মতোই আত্মার ওপর উদিত হয়—নিজের থেকে নয়, কোনো চেষ্টায় নয়। যেমন ঘুমালে স্বপ্ন আসে—তেমনই এই ‘আমি’-জ্ঞানও আসে নিঃশব্দে। এবং যেমন স্বপ্ন মিথ্যা, তেমনই এই ‘আমি’ও মিথ্যা—কারণ এটা কেবল এক ক্ষণস্থায়ী ‘উদয়’। এই জ্ঞানের মিলনে যখন তুমি আবার নিজ চির-অস্মৃত, নিরভিপ্রায়, নির্ভার আত্মাস্বরূপে বিলীন হবে—তখনই মিলবে তোমার প্রকৃত মুক্তি। ‘আমি’-র অবসানে যা থেকে যায়, তাই একমাত্র সত্য—তুমি নিজে, নির্বিকার, অপরিবর্তনীয় ব্রহ্ম।
১১৮.
‘আমি আছি’ এই জ্ঞান—যা মূলত ‘সত্ত্বগুণ’-এর প্রকাশ, তা নিজেকে স্থিরভাবে বহন করতে পারে না। তাই সে খোঁজে ‘রজোগুণ’ (কর্মপ্রবণতা) ও ‘তমোগুণ’ (কর্তৃত্বের মোহ)—এই দুই গুণকে অবলম্বন করে টিকে থাকতে চায়।
‘আমি’ জ্ঞানের তাৎপর্য বোঝা একটি বিষয়, আর সেটিতে অবিচল থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং কঠিন এক সাধনা। এই পথে চলো মানে যেন উলটো স্রোতে হাঁটা, কারণ এই ‘আমি’ জ্ঞান নিজে থেকেই বার বার পড়ে যায় গুণের টানে। সত্ত্বগুণ বিশুদ্ধ হলেও, তা নির্জীব নয়—বরং চঞ্চল, নিজেই নিজেকে বহন করতে পারে না বলেই রজ ও তম-কে আকর্ষণ করে। তাই ‘আমি আছি’ এই অনুভবকে বিশুদ্ধরূপে ধরে রাখতে হলে চাই একাগ্রতা, কঠোর সৎসঙ্কল্প, ও নিরলস স্মরণ।
এই জগতে কেউ সহজে স্থির থাকতে পারে না, এমনকি ‘আমি’-বোধও নিজেই নিজেকে সহ্য করতে পারে না—কারণ, তা যতই সত্ত্বময় হোক, তার মধ্যে থেকে জন্মায় কিছু করার আকাঙ্ক্ষা (রজ) এবং কিছু হওয়ার মোহ (তম)। তাই স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে এই 'আমি আছি'—এই বিশুদ্ধ অনুভবে টিকে থাকাই হলো প্রকৃত সাধনা। তুমি যদি নিজেকে চিনতে চাও, তবে গুণত্রয়ের এই মায়াজাল ছিন্ন করে, একমাত্র সেই ‘আমি’-বোধেই স্থিত হতে হবে। মনে রেখো, ‘আমি’-র বিশুদ্ধ রূপেই আত্মজ্ঞান নিহিত; এবং এই জ্ঞান পেতে হলে প্রয়োজন হয় দেহ-মন-গুণজয়ী একান্ত প্রত্যয়ের।
‘আমি’ বোধ হচ্ছে সেই সত্ত্বিক আলোকের দীপ্তি—কিন্তু সেই আলো নিজেই ছায়া খোঁজে। এই ছায়াই রজ ও তম—যা ‘আমি’কে করে তোলে এক ব্যক্তিত্ব, এক কর্মী, এক কর্তা। আর এটাই মায়া—যেখানে জ্ঞান নিজেকে ভুলে যায়। তাই সাধককে হতে হয় এক নীরব প্রত্যক্ষকারী, যে কেবল ‘আমি’ বোধে স্থিত থেকে সমস্ত গুণের মোহ ছাড়ে।
১১৯.
প্রকৃত সাধনা একটিই—নিজেকে প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করানো যে, “আমি দেহ নই; আমি এক নিরাকার, নামহীন ‘আমি’-জ্ঞানের শুদ্ধ সত্তা, যা এই দেহের মধ্যে বাস করছে।” এই সাধনার মূল তিনটি স্তম্ভ—১. আমি দেহ নই; ২. আমার ‘আমি’-বোধের কোনো রূপ নেই; ৩. এই ‘আমি’-জ্ঞানের কোনো নাম বা শব্দ নেই। এই ভাবনায় স্থিত হতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই মুহূর্তে, যখন প্রথম এই ‘আমি আছি’ অনুভবটি জেগে উঠেছিল। তখন এই অনুভব ছিল একেবারে বিশুদ্ধ, নির্ভার ও নির্মল—সেই অবস্থাতেই উপরের তিনটি সত্য একসঙ্গে বর্তমান ছিল।
আত্মস্মরণের সাধনা বলে আলাদা কিছু নেই—আছে শুধু এক জাগ্রত সচেতনতা, যে “আমি কেবল এই দেহসত্তা নই।” এই অনুভব—"আমি আছি", সেটিই সাধনার কেন্দ্রবিন্দু; তবে তা বিশুদ্ধরূপে ধারণ করতে হলে মনে রাখতে হবে, এ 'আমি' নামহীন, রূপহীন এবং দেহে অবস্থান করলেও দেহ নয়। এই অনুভবের সূচনালগ্নে—যখন প্রথম নিজেকে সচেতনভাবে ‘আমি’ বলে জানলে—তখন সেটি ছিল নিষ্কলঙ্ক, অহম্মুক্ত, ক্রিয়াহীন।
সেই স্মৃতি বা উপলব্ধিতে ফিরে যেতে পারলেই, আর কোনো সাধনার প্রয়োজন থাকে না। কারণ তখন তুমি স্বয়ং সেই ‘আমি’—যা অনন্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা আত্মপ্রকাশমাত্র।
সব সাধনার পরিণতি হলো স্মরণ—এবং সেই স্মরণ যদি বিশুদ্ধ হয়, তবে তাতেই মুক্তির পথ সুগম। নিজেকে 'আমি দেহ নই' জেনে, নিরাকার 'আমি' জ্ঞানরূপে স্থিত হওয়াই একমাত্র বোধের সোপান। এই ‘আমি’–জ্ঞানে স্থিত হওয়া মানেই সমস্ত কার্যসাধনার পরিসমাপ্তি—কারণ তখন কর্তা নেই, কর্ম নেই, কেবল সত্তা আছে—যেটি নিজেই চিরশুদ্ধ ব্রহ্ম।
১২০.
‘আমি আছি’ এই বোধে যদি যথেষ্ট সময় ধরে স্থির থাকা যায়, তবে এই জ্ঞান নিজেই একদিন সমস্ত কিছু উদ্ঘাটন করে দেবে—বাহ্যিক কোনো জ্ঞানের আর প্রয়োজন থাকবে না। শুরুতে প্রয়োজন এই ‘আমি’-বোধকে সম্পূর্ণভাবে বোঝা, এবং এটিকে ফিরিয়ে নেওয়া তার সেই বিশুদ্ধ অবস্থায়—যখন দেহসচেতনতা ছিল না। তখন এই ‘আমি’ ছিল নির্বাক, নিরাকার—কেবল এক নিঃশব্দ অনুভব, এক সত্তার অস্তিত্ব মাত্র।
এখন, একবার এই ‘আমি’কে উপলব্ধি করলে, তাতে স্থির থাকতে হবে—বার বার, দীর্ঘ সময় ধরে। এই পুনঃস্থাপনা ও স্থিতির মধ্য দিয়েই ‘আমি’ জ্ঞান আপনার অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে উঠবে, এবং নিজেই প্রকাশ করে দেবে তার গভীর রহস্য।
‘আমি আছি’—এই উপলব্ধি প্রথমে এক অভিজ্ঞতা; তারপর তা হয় এক সঙ্গী, শেষে তা নিজেই হয়ে ওঠে গুরু। বাহ্যিক কোনো বই, বক্তা বা যুক্তি তখন আর প্রয়োজন হয় না—কারণ এই অনুভব নিজেই আত্ম-প্রকাশ করতে শুরু করে। তবে শর্ত একটাই—এটিকে বারংবার স্মরণ ও আশ্রয় নিতে হবে, যেন এক নীরব আগুনে নিজেই নিজেকে জাগ্রত করে।
এই অভ্যাসই একমাত্র সৎসঙ্গ, কারণ এখানে অভ্যন্তরীন চৈতন্যই চৈতন্যকে আলো দেখায়। এই অভ্যন্তরীণ স্থিতি একদিন খুলে দেবে সেই দ্বার—যেখানে তুমি বুঝে যাও, বি-জ্ঞান কখনও বাইরে থেকে আসে না, সবই তোমার নিজের ভেতরেই সুপ্ত ছিল।
‘আমি’–জ্ঞানে স্থিত হওয়াই আসল গুরুপ্রাপ্তি। কারণ তখন আত্মাই আত্মাকে শেখায়, স্মৃতি হয়ে ওঠে বোধ, বোধ হয়ে ওঠে মুক্তি। আর এই উপলব্ধিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়—জ্ঞান কখনও সংগ্রহ করতে হয় না, জ্ঞান শুধু উদ্ভাসিত হয়।