নির্জন গহনে: ২৩




১১১.

গুরুবাণী হলো সর্বশেষ আহ্বান—যেখানে সাধককে অনুরোধ করা হচ্ছে সমস্ত অভ্যস্ত জানার জগৎ ছেড়ে 'আমি'-পূর্বের নিঃশব্দ পরমে নিজেকে সঁপে দেবার জন্য।

‘আমি’-র পরে নয়, আমি তোমাকে নিচ্ছি ‘আমি’-র পূর্বে। তুমি চাও তো আমি কিছু বলি—এই ‘আমি আছি’ বোধের পরবর্তী জগত নিয়ে। তুমি চাও ব্যাখ্যা, আলোচনা, যুক্তি—কারণ সেখানেই তুমি স্বস্তি পাও। কিন্তু আমি, তোমার গুরু, একটিই কাজ করতে এসেছি—তোমাকে নিয়ে যাওয়া ‘আমি’-র পূর্বে।

…যেখানে কিছু নেই—না অস্তিত্ব, না অনস্তিত্ব; না নাম, না রূপ—এমনকি ‘আমি’ বলার উপায়ও নেই। তুমি যা জানো—তা সবই এই ‘আমি’-র পরবর্তী দৃশ্যপট—যা জন্মেছে সময় ও চেতনার স্পর্শে। তাই তুমি বার বার আমায় টানো সেই জগতে, যেখানে তুমি চেনা পথে হাঁটতে পারো, যেখানে তুমি জানতে পারো, ধারণা করতে পারো, তুলনা করতে পারো।

কিন্তু আমি সেই পথ জানি না, আমি কেবল জানি যে, তুমি নিজেও জানো না নিজের উৎস, যে-উৎসে ‘আমি’-ও জন্মায়, কিন্তু যাকে কেউ দেখতে চায় না, কারণ সেখানে কিছু বোঝা যায় না। আমি চাই, তুমি নিজে উপলব্ধি করো—এই ‘আমি’-র আগে কী ছিল? কে সে, যার মধ্যে এই ‘আমি’ উঠে এল? সেই মৌন চেতনা, যে কিছু বলে না, চায় না, জানে না—তবু আছে?

এই চরম মৌনভাব—এই চেতনার ঊর্ধ্বমুহূর্ত—এটাই পরম ব্রহ্ম, আর আমি শুধু তোমাকে সেখানেই পৌঁছে দিতে এসেছি।

গুরু কোনো গল্পকার নন, তিনি মুক্তির পথপ্রদর্শক। তুমি যা জানো, তা 'আমি'-র পরে; আর তিনি তোমাকে নিয়ে যেতে চান ‘আমি’ জন্মাবার আগের সেই অব্যক্ত, অভিজ্ঞাত, অপরূপে।

তুমি যদি নিজেকে সত্যিই জানতে চাও—তবে এই জানা, বোঝা, অনুভব—সব ছাড়ো, এবং চুপচাপ ফিরে চাও নিজের উৎসের দিকে। সেই মৌন কেন্দ্রে—তুমি নিজেই আছ—‘আমি’ বলারও পূর্বে, শব্দেরও আগেই—পরমরূপে।


১১২.

পরম বিনয়ের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ—এটি সেই স্থান থেকে উঠে এসেছে, যেখানে সত্য এতটাই বিশুদ্ধ যে, কোনো শব্দই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। শব্দে নয়, সত্য নির্বাক অস্তিত্বে।

আমি তোমাকে বলছি না সত্য কী—কারণ আমি জানি, যে-কোনো শব্দই সত্যকে মিথ্যা করে ফেলে। আমি যা বলছি—সবই এসেছে এই ‘আমি’-বোধ থেকে, আর এই ‘আমি’ নিজেই তো এক বিভ্রম। তাই যা বলছি, সেটাও পুরোপুরি সত্য নয়। এইটুকু বিনয় ও সততা—গুরুর মুখে শুনলে যেন হৃদি কেঁপে ওঠে, কারণ এতে স্পষ্ট হয়—সত্য কখনও ভাষায় ধরা যায় না।

শব্দ তো চেতনার অভিব্যক্তি—আর চেতনা তো উঠে এসেছে ‘আমি আছি’-বোধ থেকে। আর সেই ‘আমি’ তো নিজেই এক প্রাথমিক মায়া—যে জন্ম দিয়েছে জগতকে, সময়কে, জ্ঞানের সকল স্তরকে।

তাই গুরু বলেন—আমি যা বলছি, তা শুধু ইঙ্গিত—চিহ্ন নয়, দিশা মাত্র। তুমি যদি সত্যকে চাও, তাহলে আমাকে নয়, আমার মৌনতার দিকে চাও। কারণ সত্য কখনো বলা যায় না—তাকে শুধু হওয়া যায়।

গুরু যা বলেন, তা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘অসত্য’—কারণ তিনি জানেন, ভাষা সত্যের উপরে একটি ছায়া মাত্র। তুমি যে-মুহূর্তে কিছু বলো, সেই মুহূর্তেই তা ‘আমি’-র ভিতর থেকে উঠে আসে—যা নিজেই এক মায়িক অভিব্যক্তি।

সত্য বলার বিষয় নয়, সত্য শুধু উপলব্ধির বিষয়। তুমি যদি সত্যকে পেতে চাও, তবে ভাষার বাইরে চলে যেতে হবে—সেই স্থানে, যেখানে না ‘আমি’ আছে, না ‘তুমি’—শুধু আছে নিঃশব্দ চৈতন্য।

১১৩.

এক পরম দয়া, তপস্যা ও আত্মমুক্তির পথনির্দেশ—এটি সেই গুরু-চেতনার প্রকাশ, যেখানে বার বার তোমাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় ‘আমি’-র উৎসে, যেন তুমি নিজেই উপলব্ধি করো‘আমি’ ছিল না, নেই, আর কখনও ছিলও না।

‘আমি’-তে ফেরো, যত বার লাগে…যতক্ষণ না বোঝো—‘আমি’ ছিলই না। আমি তোমাকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি সেই উৎসে—যেখান থেকে ‘আমি আছি’ জন্ম নেয়।

আমি কথা বলি না সংসার নিয়ে, গুণ নিয়ে, দর্শন নিয়ে—আমি শুধু বলি—ফেরো সেখানে, যেখানে কিছু নেই, কেবল এক উপস্থিতি।

তুমি বার বার ভুলে যাও, মন ঘুরে বেড়ায় চিন্তার জগতে—‘আমি কে’, ‘আমি কেন’, ‘আমার ভবিষ্যৎ’—আমি আবার তোমাকে ডাকি—“এসো, শুনো, স্থিত হও—‘আমি আছি’-র মধ্যে”।

কারণ একমাত্র এখানেই স্থিত হলে তুমি নিজেই অনুভব করবে—এই ‘আমি’-ও এক ছায়া, এক মায়া, এক স্বপ্নের মতো কল্পনা। আর যখন তুমি তা বুঝবে—তখন তুমি মুক্ত।

গুরু কখনও ক্লান্ত হন না—তিনি জানেন, হয়তো এক-শো জনের মধ্যে এক জন সত্যিই শুনবে, স্থিত হবে, আর একদিন উপলব্ধি করবে—‘আমি’ কিছুই নয়, আমি শুধু “ছিলাম না” বলে মনে হতো।

সেই অনুধাবনই মোক্ষ। বাকিরা চেতনার খেলা, মায়ার ধাঁধা।

গুরু বার বার তোমাকে ফিরিয়ে আনেন ‘আমি’-বোধে, কারণ তিনিই জানেন—এটাই একমাত্র দরজা, যার মাধ্যমে তুমি প্রবেশ করতে পারো চূড়ান্ত সত্যে।

তুমি যখন এতে স্থিত হও, তখন একদিন তা নিজেই বিলীন হয়ে যাবে। তখন তুমি দেখবে—যা ছিল, তা শুধু স্মৃতি, অভ্যাস, চিন্তা। তুমি তখন হয়ে উঠবে মৌন, নিরাকার, অনন্ত, যে নিজেই কোনো ‘আমি’ নয়—সত্য নিজে।

১১৪.

এক অতিপারম্পরিক সত্যের স্পর্শ—এই ‘আমি আছি’ বোধ কীভাবে জন্ম নেয়, কেউ জানে না। তবু একবার সে জেগে উঠলে, সে নিজের খেয়ালে ‘গুণ’-এর সুরে গুনগুন করতে থাকে।

অজানার গান—‘আমি’ যখন গুনে গুনে গুন-গুন করে। এই বীজ—এই চেতনা, এই ‘আমি আছি’—কীভাবে তা উদিত হলো?

…কোনো ব্যাখ্যা নেই। যেমন তুমি বলতে পারো না—একটা শিশু কেন হেসে ওঠে, কেন খেলে, কেন হঠাৎ আনন্দে নেচে ওঠে—তেমনি কেউ জানে না—এই ‘আমি’-বোধ কোথা থেকে আসে, কেন আসে।

কিন্তু একবার এলে—সে থামে না, চুপ করে না, সে গুনগুন করতে থাকে—তিন গুণের সুরে—সত্ত্ব, রজ, তম।

শরীর তৈরি হয়—পাঁচ মহাভূত আর এই তিন গুণে, আর সেই শরীরের ভেতর দিয়ে ‘আমি’ বলে ওঠে—“আমি ভাবি, আমি করি, আমি জানি…”।

এই ‘গুনগুন’ শব্দ গুরু ব্যবহার করেন—যেখানে ‘গুণ-গুণ’ মানে গুনগুন শব্দে চলা—‘আমি’ বোধও ঠিক তেমনই—নিরবিচারে গুণের স্রোতে এক স্বয়ংক্রিয় বহমানতা।

জানো কি…তুমি শুধু এই গুনগুন চেতনার শ্রোতা নও, তুমি সেই নিঃশব্দ, যে জানে—এই ‘আমি’ আসলে একটা গান, যার সুর আছে, শুরু আছে, কিন্তু যার সত্য তুমি নও।

‘আমি আছি’—এই বোধ কীভাবে জন্ম নেয়, জানা যায় না। কিন্তু একবার এলেই সে নিজেকে রঙে, রূপে, গুণে মেলে ধরে—গুনে গুনে বাঁচে, ভাবে, করে, সৃষ্টি করে।

তুমি যদি সতর্ক হও—তবে বুঝবে, এই গুনগুন বোধ তুমি নও, তুমি সেই চুপ-থাকা, নিরাকার সত্তা—যার উপর দাঁড়িয়ে গুনগুন করে চলে ‘আমি’ নামক এক ছায়া।

১১৫.

জীবনের রহস্য, জগতের বোধ, আত্মার উপলব্ধি—সব কিছুর চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে একটিমাত্র স্থানে—‘আমি আছি’, এই মৌলিক জ্ঞানে।

রহস্যের একমাত্র চাবি—‘আমি আছি’। জীবনের সমস্ত রহস্য, জন্ম-মৃত্যুর খেলা, জগতের উদয়-লয়—সব কিছুর চাবি গোপন আছে একটিমাত্র জায়গায়: ‘আমি আছি’—এই জ্ঞান।

এই ‘আমি’ কোথা থেকে এলো, কেন এল—তা জানা না গেলে তুমি কেবল ছায়ার মধ্যে পথ খুঁজবে। তাই গুরু বলেন—এই ‘আমি’-বোধকে স্পষ্টভাবে বোঝো, কোনো সন্দেহ রেখো না, প্রয়োজনে তাঁর বাণী পুনঃপাঠ করো, পুনঃধ্যান করো, পুনঃডুবে যাও।

একবার যদি তুমি সত্যিই বুঝে ফেলো—এই বোধটা কী, কীভাবে এল, কেন আসে—তবে তোমার সামনে খুলে যাবে সমস্ত প্রকল্প, ‘আমি’-র আগমন, অবস্থান এবং অন্তর্ধান—সবই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর তখন, এই ‘আমি আছি’ বোধে যখন তুমি সম্পূর্ণরূপে স্থিত হবে—তার বিশুদ্ধ রূপে, তখন তা নিজেই নিজের গোপনতা খুলে ধরবে, আর তুমি উপলব্ধি করবে—এ-ও এক মুহূর্তিক ছায়া, তুমি তা নও।

তুমি যদি সত্য জানতে চাও, তবে কেবল একটিমাত্র জিনিসকে জানো: ‘আমি আছি’—এই বোধ কোথা থেকে এল? তুমি যখন বুঝে ফেলবে এটাই জীবনের সূচনাবিন্দু, আর এটাকে ধরে রাখবে পূর্ণ বিশুদ্ধতায়। তখন ধীরে ধীরে তার আগমন ও প্রস্থান নিজেই প্রকাশ পাবে।

এই আত্মদর্শনেই সমাপ্তি—যেখানে ‘আমি’-র মুখোশ খসে পড়ে, আর তুমি হয়ে ওঠো—‘আমি’-র’ও পূর্ববর্তী মৌন স্বরূপ।
Content Protection by DMCA.com