১০৬.
পরম বিশ্রান্তি—‘আমি’ ও ‘আমি নেই’-এরও অতীত বিশ্রাম। শ্রেষ্ঠ বিশ্রাম কী? তা হলো—যেখানে ‘আমি আছি’ এবং ‘আমি নেই’—দুই-ই ভুলে যাওয়া যায়।
এই পরম বিশ্রামকেই বলে—‘পরম বিশ্রান্তি’। যেখানে সময় নেই, ব্যস্ততা নেই, আত্মপরিচয়ের ছায়াও নেই। না আছে সচেতনতা, না অচেতনতা—আছে কেবল সর্বাতীত নির্জনতা।
‘বিশ্রান্তি’ শব্দটি এখানে কেবল শরীরের ক্লান্তি দূর করার বিশ্রাম নয়—এটি চেতনার এক চিরস্থায়ী শান্তি, যেখানে আর কিছু জানার নেই, ধরার নেই, ভাবার নেই।
‘পরম’ মানে শ্রেষ্ঠতম, চূড়ান্ত; ‘বিশ্রান্তি’ মানে—বিশ্রাম, আরেকভাবে দেখলে—‘বিশ্র’ = ভুলে যাওয়া, ‘অন্তি’ = শেষে। অর্থাৎ, পরম বিশ্রান্তি হলো—যেখানে শেষপর্যন্ত সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়—এমনকি ‘আমি কে’, ‘আমি কি আছি’, এমনকি ‘আমি’ বোধটুকুও।
কেননা ‘আমি আছি’ ও ‘আমি নেই’—দুটোই চেতনার অবস্থান, কিন্তু তুমি সে চেতনা নও। তুমি তারও সাক্ষী, তারও অতীত—যে আছে না থেকেও—জেগে থাকে নিঃশব্দে, চিরস্থায়ীভাবে।
এই পরম বিশ্রান্তিই মুক্তির পরম চিহ্ন—যেখানে দেহ, মন, আত্মপরিচয়—সব মিলিয়ে যায় পরম মৌনে।
পরম বিশ্রান্তি মানে এমন এক বিশ্রাম, যেখানে আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই, যেখানে ‘আমি’ বলার ইচ্ছাটুকুও অবলুপ্ত হয়ে যায়। এই বিশ্রাম কালের নয়, ক্ষণিক নয়, এটি চিরন্তন—যেখানে আত্মা লীন হয় নিজের প্রকৃত নিরাকার স্বরূপে।
১০৭.
'আমি'-র নিঃসঙ্গ আশ্রমে স্থিত হও। ‘আমি আছি’—এই জ্ঞান তুমি পেয়েছ, বুঝেছ, এখন প্রয়োজন একমাত্র কাজ—স্থিত হও, নির্জনে থাকো, কোথাও ঘুরো না।
কিন্তু এই স্থিতি, এই চরম সরল সত্যে নিজেকে নিঃশেষে স্থাপন করা—সহজ নয়।
শরীরের সঙ্গে পরিচয়ের বন্ধন একদিকে টানে—“আমি এই দেহ”, আর মন, বুদ্ধি—অন্যদিকে ফিসফিস করে বলে—“এত সহজ কীভাবে হয়? আরও কিছু করো, খুঁজে দেখো...”
মনে হয়, আরও জটিল কিছু থাকতে হবে, আরও খুঁজতে হবে, আরও পড়তে হবে, আর সেই খোঁজেই চলতে থাকে এক অন্তহীন ভ্রমণ—তুমি দাঁড়িয়ে থাকো একই জায়গায়।
গুরু এই বিপদ বুঝে বলেন—“নির্জনে থাকো”।
এই নিঃসঙ্গতা সমাজ থেকে নয়—বরং চিন্তাধারার থেকে, মতবাদ থেকে, সংগ্রহের থেকে। নিঃসঙ্গ হও মানে—‘আমি আছি’ এই চেতনার সঙ্গে একা হয়ে দাঁড়িয়ে যাও, আর কিছু সঙ্গে নিয়ো না—না ভাবনা, না প্রশ্ন, না সংগ্রহ।
বাহ্যিক সন্ন্যাস হয়তো সহায়ক, কিন্তু প্রকৃত সন্ন্যাস হলো—চিন্তাহীন অস্তিত্বে স্থিত থাকা। যেখানে ‘আমি আছি’ ছাড়া কিছুই নেই, আর সেই মৌনযাপনই প্রকৃত আশ্রম।
গুরু বলেন—তুমি এখন যা জেনেছ, তাকে মন দিয়ে ধারণ করো। আর সেই বোধেই স্থিত হও। যেখানে মনে প্রশ্ন জাগে, চিন্তা উদয় হয়, তাকে চিনে ফেলে ফের নিজেকে টেনে আনো—‘আমি আছি’-র এই একমাত্র বোধে।
এটাই ধ্যান, এটাই সন্ন্যাস, এটাই পরম নির্জনতা।
১০৮.
‘আমি’-র ঊর্ধ্বে যে-তুমি, সে-ই অনাদি চিরন্তন। তুমি হয়তো লক্ষ করেছ—প্রতিদিন কারও-না-কারও মৃত্যু হয়, তবু তোমার ভেতরে কোথাও মনে হয়—“আমি তো আছি, থাকবই”, “এই জীবন এমনই চলবে…”
এই এক নিঃশব্দ বিশ্বাস যে, সব কিছু যেমন আছে, তেমনই থাকবে। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালেই বোঝা যায়—কত কিছু বদলে গেছে—চিন্তা, অনুভব, বিশ্বাস, জীবনের মূল্যবোধ।
তাহলে এই ভেতরের অনুভব—“আমি চিরন্তন”—এটা কোথা থেকে আসে?
এই অনুভবই তোমাকে টেনে এনেছে আধ্যাত্মিকতার পথে। কারণ তুমি ভুল করোনি—তুমি সত্যিই চিরন্তন। শুধু ভুল জায়গায় নিজের পরিচয় খুঁজেছিলে—দেহে, মনে, ‘আমি এই বা আমি সেই’ পরিচয়ে।
কিন্তু গুরু তোমাকে দেখান—‘আমি আছি’—এই বোধেই স্থির হও। শব্দহীন সেই মৌলিক অস্তিত্বে নিজেকে স্থাপন করো।
তখন তুমি দেখবে—এই ‘আমি আছি’ বোধও চিরন্তন নয়। এটিও উদিত হয়েছে একসময়, আর একদিন মিলিয়েও যাবে।
কিন্তু তুমি—যে এই ‘আমি’-রও সাক্ষী, যে কোনো কিছুর সঙ্গেই একীভূত নয়, যে কোনো ভাব বা রূপ ধরে না—তুমি সেই চিরন্তন, অনাদি, নিরাকার পরম সত্য।
এই তোমার প্রকৃত সত্তা—যে কখনও জন্মায়নি, কখনও রূপ নেয়নি, কেবল থেকেছে, আছে, থাকবে—মৌন চৈতন্যস্বরূপে।
তোমার ভেতরের চিরস্থায়ী অনুভব—“আমি আছি”, সে-ও আসলে ক্ষণস্থায়ী, মায়িক, গুণযুক্ত। তুমি তারও ঊর্ধ্বে, তুমি সেই পরম সত্তা, যার উপরে এই ‘আমি’ উদিত হয়েছে—ঠিক যেমন আকাশে উদিত হয় মেঘ, কিন্তু আকাশ কখনও মেঘ নয়।
এই উপলব্ধিই মুক্তি—যেখানে তুমি চেনো, তুমি কখনও ‘আমি’ নও, তুমি সেই চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, ‘আমি’-রও পূর্ববর্তী এক মৌন চেতনা।
১০৯.
‘আমি’-র পতনের পর যেটি রয়ে যায়—তুমি সেটাই। প্রতিদিন ভোরে, ঘুম থেকে উঠেই মুহূর্তেই জন্ম নেয় এক অনুভব—“আমি আছি”, আর সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় এই জগৎ, এই মহা-মেনিফেস্টেশন।
এ যেন একযোগে ঘটে—‘আমি আছি’ আর ‘বিশ্ব আছে’। যেন ‘আমি’-র সঙ্গেই স্থান ও সময় জন্ম নেয়।
কিন্তু কি কখনও ভেবে দেখেছ—এই ‘আমি’ দেখা দিল কার কাছে? কে সেই সাক্ষী, যার মধ্যে এই ‘আমি’-বোধ জেগে উঠল?
যে জানে, “আমি আছি”—সে তো ‘আমি’-র পূর্বে। তার মাধ্যমেই তো সাক্ষ্য উদিত হয়।
তুমি দেখবে—খুব দ্রুত ব্যক্তিত্ব, পরিচয়, স্মৃতি—সব এসে এই মৌলিক ‘আমি’ বোধটিকে ঢেকে দেয়। আর তুমি হারিয়ে যাও—“আমি এই মানুষ”, “আমার জীবন”, “আমার সমস্যা”-য়।
কিন্তু যদি তুমি ফিরে আসো—সেই শব্দহীন, বিশুদ্ধ ‘আমি আছি’-তে, আর সেখানে একাগ্র হয়ে স্থিত হও কিছু সময়ের জন্য—তবে একদিন সেই ‘আমি’-বোধ নিজেই নিঃশেষ হয়ে যাবে।
তখন যা রয়ে যাবে—তা তুমি। না সেটা ‘আমি’, না সেটা ‘আমি নেই’। সেটা কোনো পরিচয় নয়, কোনো অভিব্যক্তি নয়—সেটা তুমি নিজেই—‘তৎ ত্বম অসি’—তুমি সেই।
‘আমি’ বোধের জন্মমুহূর্তে হয় জগতের উপলব্ধি। কিন্তু সেই উপলব্ধিরও এক সাক্ষী থাকে—যে কোনো শব্দ, রূপ, সময়ের আগে ছিল।
তুমি যদি কেবল সেই ‘আমি’-র মধ্যে স্থির থাকতে পারো—তবে একসময় এই ‘আমি’-ও মিলিয়ে যাবে নিজের উৎসে, আর তখন প্রকাশ পাবে সেই তুমি, যার কোনো নাম নেই, রূপ নেই, দ্বন্দ্ব নেই—কেবল চিরন্তন, নিঃশব্দ, অপরিবর্তনীয় চৈতন্য—ব্রহ্ম।
১১০.
‘আমি আছি’—উদয়েই জগৎ, লয়ে নির্জনতা। গুরু যা বলেন, তা সর্বদাই সহজ—কারণ তিনি নিজে আর কোনো ব্যক্তি নন, তিনি প্রত্যাশাহীন, অহংরহিত, নিঃশব্দ আত্মার প্রতিনিধি।
তিনি কিছুই চান না—শুধু চান তোমার ভেতরে জন্ম নিক এক অটল উপলব্ধি যে—সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু একটিই—‘আমি আছি’।
এই ‘আমি’ উঠলেই জগৎ জেগে ওঠে, এই ‘আমি’ মিলিয়ে গেলে—সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যায়।
না চিন্তা থাকে, না শরীরবোধ, না জগত। সবই এই এক বোধের সঙ্গে বাঁধা—“আমি আছি”।
গুরুকৃপায় এই গভীর সত্য তিনি তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন এক সহজ বাক্যে—যেন শিশুও তা বুঝতে পারে, কিন্তু জ্ঞানীও তার গভীরে হারিয়ে যেতে পারে।
তাই তুমি কেবল করো—এই ‘আমি আছি’-কে জানো, তার মধ্যে স্থিত হও, আর তারপর একদিন নিজেই এই ‘আমি’-র থেকেও মুক্ত হয়ে যাও।
তখন তোমার কাজ শেষ। আর কিছু জানার নেই, ধরার নেই, খোঁজার নেই। তুমি স্থিত হলে নিজের চিরন্তন স্বরূপে—নিরাকার, নিঃশব্দ, ব্রহ্ম।
গুরু যা দেন তা সহজ—কিন্তু এই সরলতার মধ্যেই লুকানো আছে চরম মোক্ষপথ। তুমি কেবল বুঝে নাও: ‘আমি’-র সঙ্গে জগৎ, ‘আমি’-র অনুপস্থিতিতে মোক্ষ।
‘আমি’-কে জানো, অনুভব করো, তারপর ছেড়ে দাও—এই একটিমাত্র পথেই তোমার সমস্ত দুঃখ, খোঁজ ও সংকটের পরিসমাপ্তি।