১০১.
এই ‘আমি আছি’—যে-চেতনা তোমার অন্তরে উদিত হয়েছে, সেটাই হলো সেই অন্তঃস্থিত মূলতত্ত্ব—যার মাধ্যমে তুমি অনুভব করো, ভাবো, কর্ম করো, বাঁচো।
একবার ভাবো—যদি ‘তুমি’ না থাকতে, তবে এই বিশ্ব, এই অনুভব, এই অভিজ্ঞতা—কিছুই কি তোমার কাছে ঘটতে পারত?
তুমি আছ বলেই সবকিছু ঘটছে। এই ‘আছে’ বলেই উদ্ভূত হয় জ্ঞানের, জন্ম নেয় অভিজ্ঞতা। আর এই ‘আমি আছি’—এই জ্ঞান কোনো ব্যক্তিগত সত্তার সম্পত্তি নয়—এটি সকল সত্তার মধ্যে অভিন্ন, সর্বজনীন।
গভীর ঘুমে—যখন এই ‘আমি’-বোধ স্থগিত থাকে, তখন তুমি কিছু জানো কি? না, কিছুই জানো না—কারণ ‘আমি’ নিজেই তখন নেই। তেমনি জন্মের পূর্বেও—তুমি কিছু জানো না, ছিল না এই ‘আমি’-র বোধ। অর্থাৎ, সমস্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তি এই এক বোধ—‘আমি আছি’।
এই ‘আমি আছি’ কোনো গুণ বা রূপ ধারণ করে না—না তা পুরুষ, না নারী, না কোনো জাতি, না ধর্ম। এটি নির্গুণ, নিরাকার—তবু এটাই সব কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। এটিই সকল জীবনের অভিন্ন সূত্র, সকল চেতনার মূল নীরব স্পন্দন।
তোমার অভ্যন্তরের ‘আমি আছি’—এই বোধই তোমার সমস্ত অভিজ্ঞতা ও কর্মের উৎস। এটি কোনো ব্যক্তিগত বোধ নয়—বরং সকল জীবসত্তার মধ্যে এক অভিন্ন চৈতন্য, যা গুণ-ধর্মহীন, নিরাকার, এবং সর্বজনীন।
এই চেতনা না থাকলে না জ্ঞান, না কর্ম, না বিশ্ব—কিছুই সম্ভব নয়। এই উপলব্ধিই হলো আত্মজ্ঞান, যা জানিয়ে দেয়—তুমি কোনো ব্যক্তি নও, তুমি সেই চেতনা, যা সকল জীবনে সমভাবে উদিত।
১০২.
নিজেকে চেনো—সেই শ্রেষ্ঠতম তত্ত্ব হিসেবে, যা তোমার অন্তরে অধিষ্ঠিত—যাকে বলে ‘আমি আছি’।
এই ‘আমি’-বোধই তোমার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রকাশ—একে উপলব্ধি করো, কেবল খুঁজে পাও না, বরং পূর্ণতা দিয়ে বোঝো—এই বোধ-ই চেতনার মূল আলো।
প্রথমে চোখে পড়বে—“আছে কিছু একটা”—যা অনুভব করে, জানে, দেখে। এরপর আসে সাধনা—যেখানে তুমি কেবল এই ‘আমি’-তে স্থিত হতে শেখো, প্রতিনিয়ত, একাগ্র, অক্লান্তভাবে।
যখন সাধনা তীব্র হয়—তখন একসময় তুমি নিজেই মিলিয়ে যাও সেই ‘আমি’-বোধে, আর কেবল থেকে যায়—‘আমি আছি’। আর কিছু নয়। কোনো নাম নেই, রূপ নেই, চেতনার ঢেউ নেই—শুধু নিঃশব্দ সত্তা।
তখনই গুরু বলেন—তুমি উঠলে শ্রেষ্ঠতর স্থানে—তুমি হলে ‘বৃহস্পতিঃ’—দেবতাদের গুরু, জ্ঞানতত্ত্বের সর্বোচ্চ রূপ, কারণ তুমি এখন সেই স্বরূপের সঙ্গে এক।
এই বৃহস্পতি হওয়া কোনো বাহ্য সম্মানের বিষয় নয়—এটি সেই অন্তর্জাত উপলব্ধি, যেখানে তুমি নিজের মধ্যেই খুঁজে পাও পরম গুরু, যার কাছে ঈশ্বররাও শিষ্য।
‘আমি আছি’—এই বোধই তোমার মধ্যে নিহিত বৃহত্তম তত্ত্ব। এই বোধকে পুরোপুরি জানো, অনুভব করো,
তারপর এতে স্থিত হও। সাধনায় একসময় তুমি নিজেই ঐ ‘আমি’-তে পরিণত হবে, যেখানে ব্যক্তি-সত্তা লীন হয়ে যায় চৈতন্যের নিঃস্বর ধারায়।
এই অবস্থায় পৌঁছেই তুমি হয়েছো বৃহস্পতি—তোমার মধ্যেই জাগ্রত হয়েছে পরম গুরু, যে আর কাউকে অনুসরণ করে না—বরং নিজেরই নিঃশব্দ চেতনায় স্থিত থাকে।
১০৩.
এই ‘আমি আছি’—যে-অনুভব একদিন হঠাৎ উদিত হয়েছিল তোমার মধ্যে, ধীরে ধীরে তুমি যাকে অনুভব করতে শিখেছিলে—সেটিই হলো ‘অজ্ঞ শিশু-সত্তা’, গুরু যাকে বলেন—‘বালকৃষ্ণ’-অবস্থা।
এক নির্মল, আদিম জাগরণ—যেখানে ছিল না কোনো জ্ঞান, না ছিল বিচার, না আত্ম-পরিচয়ের ভার, কেবল ছিল এক কোমল অনুভব—“আমি আছি”।
যখন এই জ্ঞান তোমার মধ্যে প্রথম ফুটে উঠল, তুমি ছিলে একেবারে নির্জ্ঞান—জানতে না, এই ‘আমি’ কী, কোথা থেকে এল, কীভাবে এল, কেন এল।
তুমি শুধু জানতে—“আমি আছি”, আর “আমি নেই”—এই দুই অবস্থার মাঝে টলছিলে—কখনও ঘুমে, কখনওবা জাগরণে—সেই দুইয়ের বিনিময়ে ধরা দিচ্ছিল এক শিশুমন, যার কোনো প্রশ্ন নেই, তবু সে বেঁচে আছে।
এই শিশু-সত্তা—নির্জ্ঞান হলেও, ঠিক সেখানেই নিহিত আছে সমস্ত চেতনার বীজ, যেমন বালক কৃষ্ণের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পরম ভগবানের সম্ভাবনা।
গুরু বলেন—এই ‘বালকৃষ্ণ’ অবস্থাই সত্যিকারের সূচনা, কারণ এখানে নেই অহং, নেই জানার দাবি, কেবলই এক স্নিগ্ধ উপস্থিতি—যাকে বলা চলে—'বিশুদ্ধ অস্তিত্ববোধ'।
‘আমি আছি’—এই জ্ঞান তোমার মধ্যে প্রথম যে-রূপে প্রকাশ পেয়েছিল, তা ছিল শিশুর মতো—নির্জ্ঞান, নির্ভাব, পবিত্র। এই অবস্থাকে গুরু ‘বালকৃষ্ণ’ বলেন, কারণ এখানে জ্ঞান নেই, কিন্তু সম্ভাবনা অসীম।
তুমি তখন জানো না, কে তুমি, তবু অনুভব করো—তুমি আছ। এই নির্জ্ঞান সত্তাই আসলে জ্ঞানের আদিস্ফুরণ—যেখানে কোনো চিন্তা নেই, শুধু স্বরূপের অস্তিত্ব আছে।
এটাই সেই মাটি, যেখানে আত্মজ্ঞান জন্ম নেয়।
১০৪.
বালকৃষ্ণ—অজ্ঞ শক্তির উৎস—এই ‘আমি আছি’—এই মৌলিক বোধই হলো ‘বালকৃষ্ণ’ অবস্থা। ‘বল’ অর্থাৎ শিশুর অন্ন-দেহ—যে-শরীর সদ্য জন্মেছে, কিন্তু তার মধ্যে নিহিত অজস্র শক্তির সম্ভাবনা।
‘কৃষ্ণ’ অর্থ—অজ্ঞতা, জানে না সে কে, জানে না তার শক্তি কতখানি।
এই বালকৃষ্ণ অবস্থাই সেই মূল গর্ভবীজ, যার উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে তোমার অস্তিত্ব, তোমার জীবন, পরিচয়, জগৎ।
শুধু তোমার নয়—এই ‘আমি আছি’ বোধই রচনা করেছে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। এই বোধ না থাকলে—নেই ব্যক্তি, নেই জগৎ, নেই অনুভব।
এই ‘বাল’-দেহ মনে হয় দুর্বল, কিন্তু এর মধ্যে সুপ্ত আছে মহাবৃক্ষের সম্ভাবনা—একটি মাত্র বীজের মতো, যা জানে না, সে কত বিস্তৃত ছায়া দিতে পারে ভবিষ্যতে।
বালকৃষ্ণ মানে—অসীম সৃষ্টি-ক্ষমতা, অথচ সম্পূর্ণ নির্জ্ঞান অবস্থা—শিশুর মতো পবিত্র, কিন্তু ঈশ্বরতুল্য সৃষ্টিশীল।
গুরু বলেন—এই বালকৃষ্ণ অবস্থাকে তুচ্ছ ভেবো না, এ হলো মায়ার মূল রূপ—যেখানে সবকিছু জন্ম নেয়, অথচ সে নিজেই জানে না তার উৎস কোথায়।
‘আমি আছি’—এই নির্জ্ঞান বোধই তোমার, আমার, এবং সৃষ্টির প্রথম ভিত্তি। এই অবস্থার নাম ‘বালকৃষ্ণ’—যেখানে অন্নদেহের বল আছে, কিন্তু জ্ঞানের আলো এখনও ফোটেনি। তবু এখানেই লুকিয়ে আছে সমস্ত সৃষ্টি, এই বীজই একদিন পরিণত হয় মহাবৃক্ষে—যদি তুমি একে চিনে নিয়ো, একে ধারণ কোরো।
১০৫.
‘আমি’ থেকে আত্মস্বরূপে বিলয়—‘আমি আছি’—এই জ্ঞান যখন তোমার মধ্যে প্রথম উদিত হয়েছিল, তখন তা ছিল একেবারে বিশুদ্ধ, নির্জ্ঞান, নির্ভাব—শরীরের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না—ছিল না সময়বোধ, স্মৃতি, মানসিক দ্বন্দ্ব।
সেই আদিম স্তরেই ছিল বিশুদ্ধ আত্মচেতনা—এক শিশুর মতো পবিত্র, নামহীন অস্তিত্ব।
ধীরে ধীরে, অজান্তেই, এই ‘আমি’ শরীরকে নিজের বলে চিনতে শুরু করে—“আমার হাত”, “আমার চোখ”, “আমার নাম”—এবং মনও জুড়ে বসে তার সঙ্গে—“আমার মত”, “আমার ভয়”, “আমার চিন্তা”।
সময় এসে জড়িয়ে দেয় তাকে অতীত-ভবিষ্যতের ফাঁদে। এবং এই বিকাশে—অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ, পরিবেশ—সবাই কৌশলে রচনা করে এক ছদ্মপরিচয়—যাকে তুমি বলো ‘আমি এই ব্যক্তি’।
কিন্তু যদি সৌভাগ্যে জীবনে কোনো এক সময় তোমার সামনে আবির্ভূত হন সেই সত্যগুরু, তবে তিনি এই বিভ্রান্তি ভেঙে তোমাকে দেখিয়ে দেবেন—এই ‘ব্যক্তি’ হওয়া এক মায়া—আর এই 'আমি'-বোধও এক উপাধিযুক্ত ছায়া মাত্র।
তখন তিনি বলবেন—ফিরে যাও সেই আদিম মুহূর্তে, যেখানে কেবল ‘আমি আছি’ এই অনুভব ছিল—কোনো শরীর নয়, কোনো মন নয়, কেবল চেতনা।
এই ‘আমি আছি’ বোধে স্থিত হও, ধীরে ধীরে—তোমার মনের, শরীরের, ব্যক্তিত্বের ধারণা আপনিই ক্ষীণ হয়ে আসবে।
একসময় এমন এক ক্ষণ আসবে—যখন এই ‘আমি’-বোধও লীন হয়ে যাবে তোমার চিরন্তন, গুণাতীত, পরম স্বরূপে। তখন আর কিছুই বলার থাকবে না—না ‘আমি আছি’, না ‘আমি নেই’। কেবল এক মৌন অস্তিত্ব—যাকে বলে স্বরূপ, পরব্রহ্ম, সর্বাতীত নির্জ্ঞান প্রকাশ।
প্রথমে ‘আমি আছি’—এই মৌলিক জ্ঞানকে চিনে নাও, যা কোনো শরীর বা মানসিক পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত নয়। এই বোধে স্থিত হও—ধ্যান করো, অভ্যাস করো, আস্তে আস্তে তা তোমার সব ভ্রান্ত ধারণাকে সরিয়ে দেবে। শেষে এই ‘আমি’-বোধও নিজের উৎসে বিলীন হয়ে যাবে—সেই স্বরূপে, যা চিরকাল ছিল, আছে, এবং থাকবে—নিঃশব্দ, গুণাতীত, ব্রহ্মতত্ত্ব।